২৮ শে মে,২০১৬, কার্গিল, রাত ন’টা
তারিখটা দেখার জন্য মোবাইলের পর্দার দিকে চোখ রাখতে হল। অবশ্য এমনটাই তো হওয়ার কথা। স্বপ্নের ভ্রমণে কে আর খামখা তারিখ নিয়ে মাথা ঘামাতে যায়। এমনিতে কাজের দিনগুলোতে প্রাত্যহিকটার সওয়ারী হয়ে আসে একের পর এক তারিখ। সপ্তাহ। মাস। বছর। সাধারণত একটি তারিখ আরেকটির নির্মম পুনরাবৃত্তি হয় বেশীরভাগ সময়। শুধু হেডলাইনগুলো পালটে যায় নিজের মত করে।
কিন্তু বিগত সপ্তাহ খানেক ধরে প্রতিদিন, প্রতিবেলায় বদলে যাওয়া দৃশ্যপট মনের মধ্যে হিল্লোল তুলে গেছে শুধু। হবে নাই বা কেন বলুন? যায়গাটার নাম যে লাদাখ ও ভূসর্গের কিছু অংশ।
সাধারণত লাদাখ, মানে জম্মু কাশ্মির রাজ্যের স্বপ্নের যায়গাটিতে যেতে হলে আপনার কাছে তিনটি বিকল্প। এক, যেটা সবচেয়ে সহজ – দিল্লী থেকে সোজা উড়ে লে – লাদাখের মূল শহর। দুই- দিল্লী বা চন্ডীগড় থেকে মানালী, সেখান থেকে সারচু হয়ে লে। এখানে আবার একটা অসুবিধে আছে। সড়কপথ বছরের বেশীরভাগ সময় বন্ধ থাকে। মে মাসের শেষদিকে খোলে, মানে সড়কের ওপর জমে থাকা বরফের স্তর সরিয়ে ফেলে সেনাবাহিনী। আমাদের রওনা দেবার সময় পর্যন্ত যতটুকু খবর পাওয়া গেছিল – এই রাস্তা খোলে নি। আমরা, মানে আমি, আমার স্ত্রী আর ক’জনের একটা দল তৃতীয় বিকল্পটাই বেছে নিয়েছিলাম। মানে জম্মু অবধি ট্রেনে গিয়ে সেখান থেকে শ্রীনগড়। সেখানে দিন দুই কাটিয়ে সড়কপথে কার্গিল। কার্গিলে রাত্রিবাস করে পর দিন রওনা দিয়ে বিকেল বিকেল লে।
কেন দেশবিদেশের ভ্রমণ পিপাসুদের প্রথম পছন্দ কাশ্মীর, সেটা সেখানে না এলে বোঝা কঠিন। হিমালয়, কারাকোরাম শ্রেণী, তার মাঝে একটা আস্ত উপত্যকা। উপত্যকার বিরাট অংশ জুড়ে ডাললেক। দূরে পর্বতশ্রেণী। বরফ ঢাকা শৃঙ্গ।
হ্যা, কাশ্মীর উপত্যকার কথাই বলছি। স্কুলছুটির মরশুমে চারদিকে থিকথিকে পর্যটকদের ভীড়। ডাল লেক ঘিরে পসরা সাজিয়ে বসেছে শিকারা চালকেরা। ছোটখাটো নৌকোকে সাজিয়েগুছিয়ে পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্য এলাহি আয়োজন। অতঃপর দর কষাকষি। দেড় দু ঘণ্টার জন্য শিকারা সওয়ারী হয়ে ডাল লেকের বুক চিড়ে এগিয়ে যাওয়া। যেতে যেতে পাশের নৌকা-দোকানীর হরেক আবদার। লেকে ভাসতে ভাসতেই কিনে ফেলা যায় মেয়েদের চিরাচরিত কাশ্মীরি গয়না থেকে অনেক কিছু। কিংবা আপনি চেখে দেখতে পারেন ঠান্ডা পানীয় থেকে কুলফি মালাই। শিকারা হাইসবোটের পাশ দিয়ে চলে যাবে। আসলে হাউসবোট গুলো এক একটা ভাসমান হোটেল। পকেট একটু গরম থাকলে সেখানেই কাটানো যায় রাত। রসনা তৃপ্তির হরেক আয়োজন নিয়ে হাজির তারা। এরপর শিকারার গন্তব্য মিনাবাজার। আমাদের দেশের একমাত্র ভাসমান বাজার। শীতপোষাকের হরেক পশরার হাতছানি।
একটা শহরের, রাজ্যের অর্থনীতি যে কতটা পর্যটন নির্ভর হতে পারে সেটা কাশ্মীরে না আসলে বোঝা কঠিন। শিকারা চালক থেকে শুরু করে অটোওয়ালা, হাউসবোটের রাধুনি থেকে শ্রীনগরের ফুটপাথে পশরা সাজিয়ে বসা দোকানী কিংবা শহর গ্রামের অখ্যাত পোষাক কারিগর সবারই রুটিরুজি, দিনযাপন নির্ভর করে মরশুমি পর্যটকদের ওপর। ওদের ‘ট্রেড ক্রাই’ বিরক্তির উদ্রেক ঘটালেও একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় সাধারণ কাশ্মীরিদের দিনযাপনের সংগ্রাম।
আজ অনেক ভোরে রওনা দিয়েছি কার্গিলের উদ্দেশ্যে। ভো্রের শিরশিরে বাতাস মেখে প্রথম গন্তব্য সোনমার্গ। উপত্যকা থেকে একটু একটু করে উপরে উঠতেই বদলে গেল ভূ-প্রকৃতি ও স্বাভাবিক উদ্ভিদ। দু-পাশে মাথা উঁচু করে থাকা পাইন আর পাহাড়ী নৈশব্দকে খানখান করে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী নদী সিন্ধু। আরও উপরে উঠতেই চোখে পড়বে পাহাড়ের গায়ে লেপটে থাকা সাদা হিমবাহ।
সোনমার্গ আর কিছুই নয় একটা আস্ত ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার – যে ক্যালেন্ডারে একখানা ল্যান্ডস্কেপ ছবি –ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে তোলা বরফে ঢাকা দূরে শৃঙ্গ, আবছা সবুজ পাইন।
সোনমার্গ থেকে কার্গিলের রাস্তা কিছুটা বিপদশঙ্কুল। মে-র প্রথম নাগাদ খোলে এই রাস্তা । তার আগে শুধুই জমাট বাধা বরফ। সেই বরফ পরিষ্কার করে চলার মত রাস্তা তৈরী করার কৃতিত্ব সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। এই রাস্তার আরেকটা মজা হল খুব দ্রুত ভূমিরূপের পট- পরিবর্তন। ধীরে ধীরে সবুজ মুছে যাবে পাহাড়ের গা থেকে। আরও উপরে উঠলে বদলে যাওয়া শিলার গায়ে জড়ানো লেপের মত সাদা বরফ আর বরফ। হঠাৎ শুরু হওয়া তুহিনপাত কিংবা মনকেমন করে দেওয়া ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সঙ্গী দ্রাস বলে একটা ছোট পাহাড়ী গঞ্জের দোকানে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ।
এমনি করেই কার্গিল। হেড লাইনে একসময়ে ঝলসে ওঠা কার্গিল। কিংবা দেশের স্বাধীকার অর্জনের লড়াইয়ে নিহত জওয়ানের রক্তস্নাত কার্গিল। আজকের কার্গিলে শুধুই নদীর কুলকুল শব্দ আর সাধারন পাহাড়ী মানুষের দিনযাপনের সন্ধ্যা সংগীত।
পাহাড়ী জনপদ (কার্গিল)
******************
# দীপালোক
#
******************
মন্তব্য
লেখা আর ছবি দুটোই চমৎকার।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অনেক ধন্যবাদ।
- দীপালোক
চমৎকার, চলতে থাকুক। বাংলাদেশীদের জন্য লাদাখ যেতে হলে কি আলাদা পারমিট লাগে? কাশ্মীর ঘুরে দেখার ইচ্ছে অনেকদিনের। কবে যে সুযোগ পাব?
ফাহমিদুল হান্নান রূপক
আমাদের দলে ঢাকার এক ভদ্রলোক ছিলেন। ওনার কাছেই শুনেছিলাম, টুরিষ্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশের যে কেউ লাদাখ বা কাশ্মীর ভ্রমণে আসতে পারেন। তবে তবে এই মুহূর্তে ওই রাজ্যে যাওয়াটা কতটা নিরাপদ সেটা আমার জানা নেই।
ভালো থাকবেন।
-দীপালোক
অনেক ভাল লাগলো আপনার পোস্ট। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। একজন টুরিস্ট হিসেবে কাশ্মীরকে কতটুকু নিরাপদ মনে হয়েছে?
------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ
ধন্যবাদ।
আমরা যখন গিয়েছিলাম, মানে এবছর মে জুন মাসে, তখন কোন অশান্তি চোখে পরে নি। শ্রীনগরে একদিন কার্ফু ছিল। কিন্তু ডাল লেক সংলগ্ন অঞ্চলে, যেখানে অধীকাংশ হোটেল লজ, সেখানে তার প্রভাব চোখে পড়েনি। সাধারন কাশ্মীরিরা পর্যটকদের সন্মান দেয় খুব। তবে এই মুহূর্তে ওখাঙ্কার পরিস্থিতি কতটা পর্যটক অনুকূল, সেটা বলা কঠিন।
- দীপালোক
অপূর্ব, ভাগ্যবান আপনি, পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
গুডরিডস
ধন্যবাদ। উৎসাহিত হলাম।
- দীপালোক
দিল্লী থেকে লেহ্ যাবার বিমান ভাড়া খুব বেশি নয়। সড়কপথে/রেলপথে গেলে এরচেয়ে বেশি খরচ হয়। তবে বিমানে করে গেলে যাবার পথের সৌন্দর্যটা আর চোখে পড়বে না।
অনেকদিন পরে লিখলেন। সিরিজ লিখতে গিয়ে আবার গোলাপীরঙা কাশ্মিরী 'নুন্ চায়ে' পান করতে বসে যাবেন না। বর্ণনা আর ছবি দুটোই ভালো লেগেছে।
ঠিকই ব্লেছেন আপনি। আসলে লাদাখের ক্ষেত্রে আলাদা করে কোন টুরিস্ট স্পট চিহ্নিত করা ঠিক না। গোটা রাস্তাটায় খুব ঘুম পেলেও আপনি চোখ বন্ধ করতে পারবেন না। আর বিমানে গেলে উচ্চতাজনিত অসুস্থতার কবলে পরতে পারেন।
ধন্যবাদ, উৎসাহ দেবার জন্য।
- দীপালোক
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
লেখা দারুন। কবে ঘোরার সৌভাগ্য হবে জানিনা। একটা অপরাধ কতেছ লেখায় বৌদিকে পেলাম না...
ছবি গুলি অসাধারণ
নতুন মন্তব্য করুন