লাদাখের ডায়েরী (তৃতীয় পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২১/১০/২০১৬ - ৫:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২রা মে, নুব্রা ভ্যালী, রাত ১০ টা
তেপায়ার সাথে আটকানো ক্যামেরাখানা বগলদাবা করে বারান্দা থেকে ঘরে আসলাম। ক্যামেরার মেমোরী কার্ডে চালান হয়ে গেছে এক আকাশ তারা। কিন্তু মন খুতখুত। মনের মত ছবি আর পেলাম কোথায়? তবুও আনাড়ী হাতে জীবনে প্রথমবার স্লো শাটারে রাতের আকাশের তারার ছবি তুলে একটু উত্তেজনা হচ্ছে বইকী। আসলে এক আকাশ জ্বলজ্বলে তারা দেখা এক জিনিষ আর সেগুলোকে ফ্রেমবন্দী করতে গিয়ে কতটা কালঘাম ছোটে, সেটা ভূক্তভোগী ক্যামেরাবাজ মাত্রই জানে। ও, বলতে ভুলে গেছি। এখন আমরা আছি নূব্রা ভ্যালীর হান্ডার গ্রামে।
গতকাল ভোরে রওনা হয়েছি নুব্রার উদ্দেশ্যে। নূব্রা - একটা পাহাড়ী শীতল মরুভূমি। লে শহর থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে এই নূব্রাভ্যালির যাত্রাপথে পরে খারদুংলা পাস। ১৮৩৮০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই রাস্তাটি বিশ্বের সবোর্চ মটরগাড়ি চলার রাস্তা।
DSC_0077
উচ্চতাজনিত কারনেই প্রচন্ড শীতল। হিমাংকের নীচে তাপমাত্রা। চারদিকে শুধুই শুভ্র বরফ। কোনটা জমাট বাধা। আবার কোথাও সদ্য পরা বরফকুচিতে আদুরে স্নিগ্ধতা। আবার কোথাও পাহাড়ের গা বেয়ে ঝোরা নামতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে বরফ হয়ে।
IMAG3451
কিন্তু বেশীক্ষন থাকার উপায় নেই। আমাদের সমতল জলহাওয়ায় পুষ্ট শরীর খুব বেশীক্ষন এই সুউচ্চ খারদুংলা পাসের শৈত্য সহ্য করবে না। তাই উঠতেই হল গাড়ীতে।
সময় যত এগোচ্ছে চারিদিকের ভূ-প্রকৃতি হয়ে উঠছে আরো রুক্ষ উষঢ়। বদলে যাচ্ছে পাহাড়ের রং। এই রূক্ষতার এক অন্য মাদকতা আছে। নূব্রা যাওয়ার আগে আমরা ঘুরে নিলাম সামস্টেলিং মনেষ্ট্রি। দু একজন প্রার্থনারত বৌদ্ধ সন্যাসীর দেখা মিলল সেখানে। চারদিক প্রচন্ড রকমের চুপচাপ। নৈশব্দের বোধ হয় নিজেস্ব কোন শব্দ আছে।
DSC_0667

সামস্টেলিং মনেষ্ট্রি থেকে পানামিক উষ্ণ পস্রবন। পাহাড়ের গায়ে প্রকৃতির কোন জাদুবলে তৈরী হয়েছে এই হট স্প্রিং। একসময় খোলা অবস্থাতে ছিল এটি। বছর কয়েক আগে স্থানীয় মহিলারা এটিকে ঘিরে পুরুষ- মহিলাদের জন্য আলাদা দুটি কক্ষ নির্মান করেছে। সামান্য প্রবেশ মূল্যের বিনিময়ে আপনি প্রস্রবনের জলে স্নান করে ক্লান্তি কাটাতে পারেন।
ফেরার পথে পরল সায়ক নদী। এটাকে নাকি বলা হয় মৃত্যুর নদী(River of Death)। বিশালাকার নদীখাতে শুধুই বালি আর তার মাঝে ক্ষীণতোয়া সায়ক।
DSC_0671

এভাবেই নদীর ধার দিয়ে এগোতে এগোতে এগোতে একসময় নুব্রা উপত্যকা। পাহাড়ের উপত্যকায় শীতল মরুভূমি। প্রকৃতির কোন জাদুকাঠিতে কারাকোরাম হিমালয়ের পাদদেশে তৈরী হল এরকম বালিয়াড়ি, আবার ক্ষীণ ধারার জলরেখায় পুষ্ট হয়ে উষঢ় প্রান্তর ভরে ওঠল আপেল, উইলোর স্নিগ্ধ ছায়ায়, সেটা একটা বিস্ময়।
DSC_0711
এটাই মোহিত করে পর্যটকদের। আর যেটা মোহিত করে নুব্রা অঞ্চলের পাহাড়ী মানুষের সারল্য আর আতিথ্যেয়তা।, ভাষা যেখানে ভাবপ্রকাশে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। পাহাড়ী আমরা একটিমাত্র লাদাখী ভাষা শিখেছিলাম – ‘জুলে’। অভিবাদন জানানোর জন্য ব্যবহৃত এই শব্দটাই নুব্রার স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে একটা যোগসূত্র তৈরী করেছিল।
DSC_0822
DSC_0777
আসলে শীতল মরুভূমি নুব্রা ভ্যালীর হান্ডার গ্রাম একটি মরূদ্যানের মত, যেখানে গড়ে উঠেছে পর্যটকদের জন্য রিসর্ট, হোটেল। স্থানীয় লোকেদের সাথে আলাপ করে জানা গেল, গোটা শীতকালটাই বরফে মুড়ে যায় গোটা অঞ্চল। গরমকালে পাথুরে জমিতেই ঝোরার জলের সাহায্য নিয়ে চলে চাষাবাদ। হান্ডারের রাস্তায় হেটে বেরোনোর সময় আলাপ হল একদল কচিকাঁচার সাথে।
DSC_0824
DSC_0775

পরদিন সকালে এক অন্য বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করে ছিল। রিসর্ট থেকে একটু দূরেই বালিয়াড়ী। সেখানে আছে দু-কুজ ওয়ালা উট, যা এদেশের শুধুমাত্র এই অঞ্চলেই মেলে।
DSC_0713
সেই উটের দুটি কুঁজের মাঝে চড়ে বসলাম। উট চালক দড়ি ধরে টানতেই চলা শুরু করল সে হেলে দুলে। নুব্রা মরুর বালির ওপর দিয়ে।
DSC_0748
দূরে সুউচ্চ ন্যাড়া পর্বত। বালির ওপর তৈরী বার্খান। জানা গেল, এই দু-কুঁজোয়ালা উটেরা নাকি এসেছে তিব্বত থেকে। প্রাচীন যুগে। সে সময় মালপত্র আনা হত এ ধরনের উটেদের পিঠে চাপিয়ে। তারপর বুড়ো উটেদের আর নিয়ে যাওয়া হত না সে দেশে।

বিকেলে গেলাম ডিস্কিট মনেষ্ট্রি। চতুর্দশ শতকে নির্মিত এই বৌদ্ধ বিহারে তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের চর্চা করা হয়। সেখানে আছে ৩২ মিটার উঁচু বুদ্ধের মূর্তি, সায়ক নদীর দিকে মুখ করে। সে মূর্তিকে ঘড়ির কাটার দিকে প্রদক্ষিন করা হয়।
DSC_0852
আমরা যখন পৌছালাম, সূর্য ডুবুডুবু। দূরে সায়ক নদী। অস্তমিত সূর্য তার শেষ বেলার ছটায় রাঙিয়ে দিচ্ছে দূরের পর্বতশ্রেনীকে।
DSC_0005

ডিস্কিট থেকে ফিরলাম আস্তানায়। রাতে হঠাৎ লোডশেডিং এ বিরক্তির বদলে হামলে পরে একরাশ ভাল্লাগা, যখন আকাশভরা তারারা চলে আসল আরো কাছে।
DSC_0692


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

তারার ছবি দেখলাম। অন্য ছবি গুলোও দারুন সুন্দর। বুদ্ধ মূর্তিটার আরো কয়েকটা ছবি থাকলে ভালো হতো, বিশেষ করে সামনা সামনি বা আরো একটু জুম করে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- মূর্তি এতই বিশালাকার যে ১৮ মিমি তেও আঁটতে চায় না পুরোটা।
- দীপালোক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক দারুণ!! পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
- দীপালোক

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার সব ছবি, সেইসাথে চমৎকার লেখনি। চলুক। চলুক

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
- দীপালোক

Md. Shahidul Kaysar Limon এর ছবি

সাধারন বর্ননা আর অসাধারন সুন্দর ছবি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।