মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আর ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/১০/২০১৬ - ২:৪৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মার্কিন অন্য রাষ্ট্রপতিদের মত বারাক ওবামাকেও ইসরায়েল আর তার সাথে মার্কিন ইহুদি লবির আশীর্বাদ সাথে নিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে হয়েছে। তাই আগের রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশের চাইতে উদারপন্থী হিসেবে পরিচিতি থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েল আর ইহুদি লবির ধারণা ছিল ওবামা বুশের মত না হলেও ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করবেন। ঘোট পাকে যখন ওবামা ২০০৯ সালে মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়েকটি দেশ ওবামার সফরের তালিকায় থাকলেও বাদ পরে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র ঈসরায়েল। ব্যাপারটি ভালভাবে নিতে পারেনি ঈসরায়েলের সে সময়কার রক্ষণশীল প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। মূলত তখন থেকেই ওবামার সাথে নেতানিয়াহুর টানাপোড়েনেটা শুরু হয়। এই টানাপোড়েনটা আরো খারাপ দিকে যায় যখন ২০১৫ সালে নেতানিয়াহু মার্কিন সিনেটে বক্তৃতা করতে এসে ওবামার সাথে দেখা না করে ফেরত যান। তার উপর ওবামা তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের শুরু থেকেই বলে আসছেন যে তিনি ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন দ্বন্দের দুই-দেশ সমাধানে বিশ্বাসী যেটি ভালভাবে নেয়নি নেতানিয়াহুর মত রক্ষণশীল ইসরায়েলি নেতারা।

আয়তনের হিসেবে ইরান ঈসরায়েলের প্রায় ৮০ গুণ (ছবি)। মধ্যপ্রাচ্যে কাছাকাছি থাকা দেশ দুটির মাঝে রয়েছে ইরাক, সিরিয়া আর জর্দান। যদিও সত্তর দশকের দিকে মার্কিন আশীর্বাদপুষ্ট রেজা শাহ পাহলভী ঈসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়, বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শাষণে আসা খোমেনি নেতৃত্বাধীন রক্ষণশীল শাসকগুষ্টি সেই স্বীকৃতি তুলে নিয়ে ঈসরায়েলের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। শুধু তাই না দেশ হিসেবে ইসরায়েলের বৈধতা পুরোপুরি অস্বীকার করে।


ছবিঃ ছবিতে ইরান আর ইসরায়েল। সবুজ রঙের দেশটি ইরান আর বাদামী ইসরায়েল।

মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি আর স্থিতিশীলতা রক্ষায় ইরান-ঈসরায়েলের সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ঈসরায়েলের আশেপাশে থাকা দেশগুলোর মাঝে ইরান রাজনৈতিকভাবে সবচাইতে স্থিতিশীল, সামরিক সামর্থ্য অনেক দেশের চাইতে বেশী এবং ইরানের উপরে পশ্চিমা প্রভাব খুবই কম। ইরানের রক্ষণশীল শাসকেরা কিছুদিন পরে পরেই পৃথিবীর উপর থেকে ঈসরায়েলকে মুছে ফেলার তীব্র ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকে। তাই ইসরায়েলের কাছে ইরানকে শাসনে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কাজটি করতে তারা মূলত তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিনিদের ব্যবহার করে থাকে। ওবামার পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতিরা ঈসরায়েলের হয়ে এই কাজটি ভালভাবেই করেছেন। সমস্যা হয় যখন ওবামা এসে ঈসরায়েলের সাথে দূরত্ব বজায় রেখে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করেন। প্রথম থেকেই ইসরায়েল ব্যাপারটি ভালভাবে নেয় নি। ইসরায়লের বিশ্বাস ইরানের আপাত শান্তিপূর্ণ পরমাণু প্রজেক্টের আসল উদ্দেশ্য পরমাণু বোমা তৈরি করা যা ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য অনেক বড় হুমকি।

এর রেশ ধরে গত বেশ কয়েক দশক ধরেই মার্কিনিরা ইরানের উপর নানা ধরণের অর্থনৈতিক, সামরিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। জাতিসংঘের মাধ্যমেও চাপ তৈরী করেছে তারা। এতে ইরানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই, তবে ইরান বাঁকা রাস্তা দিয়ে নিজের দরকারী জিনিসগুলো সংগ্রহ করা শিখে গেছে। নিজেদের তেলকে ব্যবহার করে চীন আর জার্মানির মত দেশের সাথে বাণিজ্য চালিয়ে গিয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে অনেক দিক থেকে। প্রথমত মন্দা অর্থনৈতিক অবস্থার থেকে অন্য দিকে চোখ ফেরাতে ইরানের রক্ষণশীল শাসকগোষ্ঠী বেছে নিয়েছে ঘৃণার রাস্তা। সেটা ইহুদিদের প্রতি ঘৃণার আফিম। নতুন প্রজন্ম কতটুকু এ আফিমে প্রভাবিত হয়েছে বলা মুশকিল, তবে ইরানের প্রশাসন থেকে শুরু করে সামরিক শক্তি যে এতে অনেক প্রভাবিত তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর দ্বিতীয়ত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে নতি স্বীকার না করায় ইরানের উপরে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ কমে গেছে অনেক।

মূলত ওবামা আসার পর থেকেই হোয়াইট হাউসে নীতির পরিবর্তন আসে। আর সেটি হল অকার্যকর নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্য দিয়ে শান্তি বজায় রাখা। নীতির সারমর্ম হল, তোমার এটা দরকার আমি দেব, এর বিনিময়ে তুমি এই কাজটি করতে পারবে না। ওবামার এই নীতির সুবিধা হল এতে ঘৃণার চাষবাসের সুযোগ কমে, শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজটি সহজ হয় আর সম্ভাব্য শত্রুকে ভালভাবে চোখে রাখার সুযোগ তৈরী হয়।

ওবামার এই নীতির পরিবর্তনটা একটু আলাদা আলোচনার দাবী রাখে। পছন্দ না হলেই সামরিক আক্রমণের হাজারটা সমস্যা আছে। ড্রোন দিয়ে বোমা মেরে শ'খানেক মানুষ মেরে ফেলা সহজ। কিন্তু যারা মারা গেল তাদের পরিবারের যে কাওকে সন্ত্রাসী হিসেবে গড়ে তোলা অনেক সহজ। মধ্যপ্রাচ্যে রক্ষণশীল গোষ্ঠী ঘৃণার চর্চা এমন পর্যায় নিয়ে গেছে যে মার্কিন বোমার আঘাতে মারা যাওয়া প্রতিটা মানুষের ক্ষেত্রেই এ কথা খাটে। আভিবাসীদের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই অভিবাসন বন্ধ করতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ করে মার্কিনিরা সস্তায় তেল কিনতে পারছে বটে, এর প্রভাবে তারা নিজের ঘরে যে সন্ত্রাসের বিপদ টেনে আনছে সেটা বুঝতে দেরী হয়ে গিয়েছে অনেক। মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের মাঝে ওবামা প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি দীর্ঘ মেয়াদে এ ধরণের সামরিক আক্রমণের সমস্যা বুঝতে পেরেছেন। এই নীতি ঈসরায়েলের গুপ্তহত্যার নীতির পুরোপুরি উল্টো - যেটি ওবামার সাথে দূরত্ব তৈরী হবার একটা বড় কারণ বলে মনে হয়েছে।

ওবামার এই নীতির ফলশ্রুতি হল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সাম্প্রতিক চুক্তি। এ চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে কিছু সুবিধা দেবে। এর বিনিময়ে ইরান নিজেদের পরমাণু প্রজেক্টের আওতা কমিয়ে আনবে। রাষ্ট্রপতি মেয়াদের একেবারে শেষ সময়ে হলেও ওবামার এই উদ্যোগটি চলমান থাকলে তা মধ্যপ্রাচ্যের শান্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ওবামার পরবর্তী যে রাষ্ট্রপতি হবেন তিনি কি এই ধারা বজায় থাকবে? অক্টোবরের শেষদিকে এসে মনে হচ্ছে হিলারি ক্লিনটনই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি। এখন এখানে দুটি সম্ভাবনা আছে। এক হচ্ছে হিলারি চুক্তি নবায়ন না করে আবার আগের অবস্থায় ফিরে গিয়ে নতুন করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। এ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরী হবার সুযোগ আছে। অথবা ইরানের আস্থা অর্জন করে ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরীর পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা। নানা সূত্র দাবী করে ওবামার ইরানের সাথে চুক্তিটির পেছনে এক কালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কাজ করা হিলারির ভূমিকা আছে। হিলারির নানা সাক্ষাৎকারে সে কথা উঠেও এসেছে। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন হিলারি্র ওবামার মত আলোচনা চালিয়ে যাবার উপরে আস্থা কম। তাই সম্ভাবনা থাকলেও আলোচনা চলবে কি না বলা মুশকিল। সেক্ষেত্রে হিলারি রাষ্ট্রপতি হলে ইরানের মারফতে মধ্যপ্রাচ্যে আরো অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরী হবার সম্ভাবনা আছে।

পাদটীকাঃ ওবামার সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক ইরানের সাথে চুক্তির পরে নতুন মোড় নেয়। ২০১৮ সালে শেষ হতে যাওয়া একটি সহায়তার সম্প্রসারণে ওবামার সাথে ইসরায়েলের আলোচনা চলছে অনেক দিন ধরেই। নেতানিয়াহু বেশ কয়েকবার এ নিয়ে ওবামার সাথে আলোচনায় অস্বীকৃতি জানায়। শোনা যায় নেতানিয়াহু পরবর্তী রাষ্ট্রপতির জন্য অপেক্ষা করছে। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি রিপাবলিকান হলে ইসরায়েল কিছু বাড়তি ছাড় পাবে এ ভাবনা থেকেই দেরী। ইরানের সাথে চুক্তির পরে ইসরায়েল তাড়াহুড়ো করে আলোচনার টেবিলে আসে। আলোচনা শেষে ওবামা প্রশাসন ইসরায়েলের জন্য ৩৮ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা অনুমোদন করে। এটি আগামী ১০ বছরে সামরিক সহায়তা হিসেবে দেয়া হবে যেটি ইসরায়েল নিজের প্রতিরক্ষার কাজে খরচ করবে। চুক্তির বিস্তারিত না জানা গেলেও দেয়া টাকার একটা বড় অংশ ইসরায়েলকে মার্কিন পণ্য কিনেই খরচ করতে হবে। মার্কিন সরকারের দেয়া এই সহায়তা কোন দেশকে দেয়া সামরিক সহায়তার মাঝে সর্বোচ্চ। তবে আশার কথা হল ওবামা প্রশাসন এখনো দুই-দেশ সমাধানের ব্যাপারে উচ্চকন্ঠ যেটি বাস্তবায়িত হলে হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে এই অংশে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

-প্রতীক


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

নানা সূত্র দাবী করে ওবামার ইরানের সাথে চুক্তিটির পেছনে এক কালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কাজ করা হিলারির ভূমিকা আছে।

হিলারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, স্বরাষ্ট্র নয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার লেখা।

বর্তমান রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প পুরোপুরি ইসরায়েলপন্থি । তিনি ইসরায়েলের রাজধানী জেরুজালেমে নেওয়ার ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন। এই রাষ্ট্রপতির আমলে ফিলিস্তিন সমস্যার কোন সমাধান আশা করাও বোকামি।

--- বোকা তেলাপোকা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।