বাংলাদেশের নাটক নির্মাতা, নাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, ক্যামেরাম্যান, প্রোডাকশন হাউজ সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি গ্রুপ মিলে বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে নেমেছেন। একই ছাতার নিচে এসেছেন তারা ‘ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গানাইজেশন’ নামে। অসাধারণ এক ব্যাপার! নিজেদের জন্য যারা বাংলা কোন নাম তারা খুঁজে পায় না, তারা করে সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন। এরাই আবার ফেব্রুয়ারি মাস এলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার জন্য হাহাকার করে। এখন নভেম্বর মাসে আন্দোলনে বাংলা ভাষা নিয়ে মাথাব্যথার কোন দরকার নেই।
যাই হোক, সেই এফটিপিও ৩০ নভেম্বর শহীদ মিনারে পাঁচ দফা দাবি পেশ করেছেন। তাদের পাঁচ দফার তিনটা দফা নিয়ে আমার ব্যাপক সমস্যা আছে।
তাদের একটি দাবি – বাংলাদেশের কোন কোম্পানি ভারতীয় টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতে পারবে না।
প্রথমত, তারা এরকম দাবি করার কোন এখতিয়ার রাখেন না। কেন বাংলাদেশের কোন কোম্পানি ভারতীয় চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতে পারবে না? এতে বাংলাদেশী অনুষ্ঠানের ভাগে কম বিজ্ঞাপন পড়ে বলে? এখন বাংলাদেশের নির্মাতাদের অনুষ্ঠানের মান এত খারাপ যে, দর্শকরা বাংলাদেশী চ্যানেল দেখে না। কোম্পানিগুলোকে নিজেদের ব্যবসার জন্যই ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে বাংলাদেশের পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতে হয়। ব্যাপারটা আমাদের নির্মাতাদের জন্য লজ্জাজনক হলেও সেদিকে তাদের কোন ভ্রূক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। এফটিপিওর মানুষেরা কষ্ট করে নিজেদের প্রোগ্রামের মান উন্নত করার জন্য কোন পরিকল্পনা না করে বরং সরাসরি সুরক্ষা চাচ্ছেন। তাদের বিজ্ঞাপনের বাজার যাতে নষ্ট না হয়, বিজ্ঞাপন যাতে ভারতে না যায়। প্রশ্ন হল, বাইরের দেশে বিজ্ঞাপন না গেলে তারা যে গোবর উৎপাদন করেন, সেই গোবরের উৎপাদন কি বন্ধ হবে? যে অনুষ্ঠানগুলোর ভার সইতে না পেরে বিশাল সংখ্যক দর্শক ভারতের চ্যানেলগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, সেই অনুষ্ঠান বানানো কি বন্ধ হবে? তারা নিজেরা সংশোধনের কোন পদক্ষেপ না নিয়ে অন্যের কাছে নির্লজ্জের মত নিশ্চয়তা চাইছেন কেন?
দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞাপনদাতাদের কী দায় পড়েছে মানহীন, দর্শকহীন অনুষ্ঠানের স্পন্সর করার? এফটিপিওর দাবি শুনলে মনে হয়, বিজ্ঞাপনদাতারা নিজেদের পণ্যের কথা ভাবার আগে দেশের সংস্কৃতি বাঁচানোর কথা ভাবতে হবে, দেশের সংস্কৃতিকে বাঁচানোর জন্য বিজ্ঞাপনদাতাদের এগিয়ে আসতে হবে। বাহ! বিজ্ঞাপনদাতারাই যদি সংস্কৃতি বাঁচানোর দায়িত্ব নেয়, তাহলে নির্মাতাদের কাজটা কী? আঙ্গুল চোষা? নিজেরা ভাল নাটক সিনেমা বানাতে পারবেন না, প্রতিযোগিতা করতে পারবে না, কিন্তু দাবি করবে তাদেরই বিজ্ঞাপন দিতে হবে। রাস্তায় নেমে এই রকম দাবি করার আগে তাদের কোন লজ্জা হয়নি?
তাদের আরেক দাবি- বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলে বিদেশী সিরিয়াল প্রচার করা যাবে না।
আরেকটা নেতিবাচক দাবি। এত বছর পরে বেশ বড় একটা দর্শকশ্রেণী ভারতীয় চ্যানেল বাদ দিয়ে দেশি টিভি চ্যানেলে বিনোদনের জন্য ফিরেছে ‘সুলতান সুলেমানে’র মধ্য দিয়ে। ব্যাপারটিতে আশার আলো না দেখে গিল্ডের লোকজন বরং ভয় পাচ্ছেন তাদের নাটকগুলো আর চলবে না ভেবে। অথচ, তারা এটাকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারতেন। বাংলাদেশের দর্শকরা বহু বছর পর দীপ্ত টিভির সুলতান সুলেমানের মাধ্যমে দেশের চ্যানেলের প্রতি দৃষ্টি ফিরিয়েছে। বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো যদি এখন একটা বিদেশী সিরিয়ালকে কেন্দ্র করে আরও কয়েকটা দেশি অনুষ্ঠান নিয়ে নতুন করে নিজেদের ঢেলে সাজাতে পারত, তাতে ইন্ডাস্ট্রি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পেত। দিনে ১ ঘন্টা বিদেশী সিরিয়ালের প্রচার করলেও সেটার পর ২৩ ঘন্টা বাকি থাকে। ‘প্রাইম টাইমের’ কথা চিন্তা করলেও সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা- ৪ ঘন্টার মধ্যে তিন ঘন্টা বাংলাদেশী প্রোগ্রামের জন্য তো বরাদ্দ থাকে। অথচ, এফটিপিওর মানুষজন এই ধরণের কোন দাবিই করছে না। টিভি চ্যানেলগুলোকে প্রাইম টাইমে সময় বরাদ্দ দেয়ার দাবি তারা জানাতে পারছে না। তারা দাবি তোলে অন্যকে নিষিদ্ধ করার। নিজেদের অবস্থান কতটা নড়বড়ে হলে অন্যকে সরানোর দাবি জানাতে হয়? কতটা অক্ষম হলে এইরকম ফালতু দাবি করার কথা ভাবতে পারে তারা?
তাদের তৃতীয় দাবি- বাংলাদেশের কোন চ্যানেলে বিদেশী কোন শিল্পীকে আনা যাবে না।
এটিও নেতিবাচক একটা দাবি। তারা নিজেদের এতটাই অনিরাপদ ভাবেন, নিজেদের অযোগ্যতা সম্বন্ধে তাদের ধারণা এতটাই অটুট যে, তারা নিশ্চিত যে তারা বিদেশীদের সাথে প্রতিযোগিতায় পারবেন না। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার যে, বাংলাদেশের বাজার খুব লোভনীয় না বিদেশীদের জন্য এবং বিদেশী যে কজন শিল্পী বাংলাদেশের প্রোগ্রামগুলোতে উপস্থাপনা করেন, তাদের মানও আহামরি কিছু না। নিজের দেশে সুবিধার কিছু করতে না পেরেই আমাদের দেশে আসা। অন্তত আমার তাই মনে হয়। কিন্তু আমাদের শিল্পীরা নিজেদের এতটাই অক্ষম, এতটাই অধম মনে করেন যে, সেই বিদেশীদের পর্যন্ত তারা নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করেন।
তাদের তিনটা দাবি বিশ্লেষণ করলে একটা জিনিসই ধরা পড়েঃ নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিরাপত্তা। আজকে তারা নিজেদের অনেক বেশি অনিরাপদ ভাবছেন। সেজন্যই বিদেশী শিল্পী, বিদেশী অনুষ্ঠান, বিদেশী চ্যানেলে বিজ্ঞাপন- সব বন্ধ করার দাবি তুলছেন। নিজে অক্ষম না হলে এরকম দাবি কেউ করে না।
মজার ব্যাপার হল, সমস্যার মূল কারণ নিয়ে তাদের কোন মাথা ব্যথাই নেই। আজকের দুর্দশার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী যারা, সেই চ্যানেল মালিকদের নিয়ে আমাদের ডিরেক্টরস গিল্ডের মানুষজন কোন কথাই বলেন নি। নিজের আত্মীয়স্বজনের দিয়ে গান গাওয়ানো, রান্নার অনুষ্ঠান করানো মানুষগুলোর প্রতি এফটিপিও কোন আহবান জানায়নি। সংবাদ, বিজ্ঞাপনের সময় কমানোর ব্যাপারে কোন দাবি জানায় নি চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিদের প্রতি। অথচ সবাই জানে দর্শকদের দূরে যাওয়ার মূল কারণই হল সংবাদ আর বিজ্ঞাপন। দেশী চ্যানেলগুলো প্রতি ঘন্টার খবর, শেয়ার বাজারের খবর, গ্রামের খবর, শহরের খবর, এমন কোন প্রকার খবর নেই যা প্রচার করে না। তার ওপর আছে টক শো- সকালে টক শো, সন্ধ্যায় টক শো, রাতে টক শো। এই খবর-টক শো যুগলের সাথে আছে সর্বগ্রাসী বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন এতটাই সর্বগ্রাসী যে চ্যানেলগুলোর স্ক্রিনের নিচে, সংবাদ শিরোনামের স্ক্রলের সাথে, উপরের ডান/বাম কোণায় বিজ্ঞাপন চলতে থাকে অবিরাম। খবরের মাঝখানে বিজ্ঞাপন বিরতি তো থাকেই, একাত্তর টিভি তো বিশেষ বিজ্ঞাপন বিরতিও উদ্ভাবন করেছে যখন তারা ফেরত আসে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে! ক্রিকেট খেলা দেখানোর সময় দুই বলের মাঝখানের সময় চ্যানেল নাইনের স্ক্রিন ভেদ করে মাটি ফুঁড়ে বাটিভর্তি ম্যাগি নুডুলস বের হয়ে আসে, বের হয়ে আসে শাহ সিমেন্টে তৈরি বাড়ি- আমাদের চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটাকে একটা নতুন স্তরে নিয়ে গেছেন। বিজ্ঞাপনে অতিষ্ঠ হয়ে দর্শকদের বিরাট অংশ এবার বিপিএল দেখছে সনি সিক্সে।
যাই হোক, যা বলছিলাম, আমাদের অসীম প্রতিভাবান এফটিপিওর হর্তাকর্তারা এতটাই নির্বোধ যে তারা মূল সমস্যাটা নিয়ে কোন কথাই বলেন নি। এই এফটিপিওর হর্তাকর্তাদের অগ্রজ, সতীর্থদের অনেকেই কিন্তু চ্যানেলগুলোর সাথে জড়িত। তারা চাইলেই একত্র হয়ে দর্শকদের ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে তারা দর্শকদের ঘরে ফেরাতে চান, নাকি শুধু নিজেদের নিরাপত্তা চান, সেটা দেখার ব্যাপার।
কথাটা নির্মম শোনায় কিন্তু বাস্তবতা হল, আজ নিজেদের আয়ে টান পড়েছে বলেই আমাদের নির্মাতারা ‘জেগে’ উঠেছে। আমাদের চ্যানেলগুলো হঠাৎ করে একদিনে দর্শকশূন্য হয়নি। নির্মাতা-চ্যানেলমালিকদের গত এক যুগের যৌথ প্রচেষ্টা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবেই আজ বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো দর্শকশূন্য হতে পেরেছে। আজ যদি বিজ্ঞাপন দেশের বাইরে না যেত, যদি তারা নিজেদের অবস্থান নড়বড়ে মনে না করত, যদি তাদের আয়ে কেউ ভাগ না বসাত, তবে সংস্কৃতি রক্ষায় তাদের রাস্তায় দেখা যেত না। তারা তাদের ‘গোবর’ উৎপাদনই অব্যাহত রাখত, আমার কোন সন্দেহ নেই।
২০০০ সালে যখন কৌন বানেগা ক্রোড়পতিকে কেন্দ্র করে কিউকি সাস ভি কাভি বহু থি, কাহানি ঘর ঘর কিসহ কয়েকটা হিন্দি সিরিয়াল নিয়ে স্টার প্লাস বাঙালি দর্শকদের টানা শুরু করল, আমাদের নির্মাতারা মাথা ঘামায়নি। দ্বিতীয় ধাপে আরও অসংখ্য হিন্দি সিরিয়াল যখন চালু হয়ে গেল, প্রায় দর্শকহীন হয়ে গেল আমাদের নাটকগুলো, তখনও তাদের টনক নড়েনি। কারণ, দর্শক গেলেও বিজ্ঞাপন তো ছিল। দর্শক দিয়ে তাদের কী। তারপর এল তারপর জি বাংলা, স্টার জলসার বাংলা সিরিয়ালগুলো। বাংলাদেশে জি বাংলা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ার পর ‘প্রাণে’র বিজ্ঞাপন যখন যাওয়া শুরু করল জি বাংলায়, ততদিনে আমাদের নির্মাতারা একটু নড়েচড়ে বসেছে। কারণ এই প্রথম লক্ষ্মীতে টান পড়েছে তাদের। আর সবশেষ, দীপ্ত টিভির সুলতান সুলেমানের জনপ্রিয়তা আর তার দেখাদেখি চ্যানেলগুলোর বিদেশী সিরিয়াল ডাব করার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার কারণে আজকে নির্মাতারা সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনে নেমেছেন।
যে ব্যাপারটা লক্ষণীয়, সেটি হল, দেশের মানুষ তাদের প্রোগ্রাম দেখে কি দেখে না, এই তুচ্ছ ব্যাপারে নির্মাতাদের কখনোই কিছু আসত যেত না। এমনকি এখনও আসে যায় না। সারা বছর না হোক, দর্শকরা গত দশ বছরে অন্তত প্রতি ঈদের সময় বাংলাদেশের চ্যানেলগুলো দেখতে বসেছে। সেই সময় আমাদের নির্মাতারা দর্শকদের কী দেখিয়েছে? মনে দাগ কাটার মত কয়টা নাটক প্রচার করেছে? চ্যানেলগুলো যে এত বিজ্ঞাপন দেখিয়েছে, সেটা নিয়ে কেন কখনো ডিরেক্টরস গিল্ড বা অন্য কোন শিল্পীগোষ্ঠী শক্ত প্রতিবাদ করেনি? এই এফটিপিওর বিবেক কেন তখন জেগে উঠেনি? দশ বছর তো কম সময় না। তারা এত বছর পর এখন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, কারণ ইদানিং তাদের আয়ে টান পড়েছে।
নির্মাতারা দেশের সংস্কৃতি নিয়ে যদি এতই উদ্বিগ্ন হতেন, তবে গত এক যুগ বা তারও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলোতে যে অনিয়ম চলে আসছে সেগুলো ঘটার কোন সুযোগ ছিল না। এই নির্মাতাদের বিবেক এত বছর ঘুমিয়েই ছিল। কারণ তাদের সাথে বিজ্ঞাপন ছিল। আজকে বিজ্ঞাপন দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, তাদের তৈরি গোবরপচা নাটক না দেখিয়ে চ্যানেলগুলো বিদেশী সিরিয়াল ডাব করে দেখাচ্ছে- মোটকথা, নিজেদের আয় কমে গেছে বলেই আজকে দেশের সংস্কৃতি ধ্বংসের সম্মুখীন, এই রব উঠেছে। আমি বলছি না শিল্পীদের কষ্ট করে বাঁচতে হবে, টাকা পয়সা লাগবে না তাদের। কিন্তু নিতান্তই অর্থনৈতিক আন্দোলনের ওপর তারা সংস্কৃতির মোড়ক লাগাচ্ছেন, একে সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন বলে চালানোর চেষ্টা করছেন, এই ব্যাপারটা আমার ঠিক সহ্য হচ্ছে না। যতদিন বিজ্ঞাপন ছিল, তাদের কাছে ততদিন দেশের সংস্কৃতি অটুট ছিল। আজকে সুলতান সুলেমান প্রচার হচ্ছে বলে সংস্কৃতি রসাতলে যাচ্ছে। এতদিন স্বর্গে ছিল আমাদের সংস্কৃতি।
যে নির্মাতারা আজকে নিজেদের সংস্কৃতি বাঁচানোর দাবি করছেন, তারা নিজেদের গত দশ বছরের আমলনামা পেশ করুক। তারা গত দশ বছরে প্রচার হয়েছে এমন দশটা ভাল নাটকের নাম বলুক, পাঁচটা ভাল ধারাবাহিকের তালিকা দিক দর্শকদের।
তাদের এই প্রশ্ন করলে তাদের গৎবাঁধা উত্তর দিবে, টাকা পয়সার অভাবে তারা ভাল নাটক করতে পারেনি। চ্যানেল মালিকরা তাদের টাকা পয়সা দেয় না, যেন টাকা দিলে তারা ‘উড়িয়ে’ ফেলত- অস্কারজয়ী নাটক বানাত। নাটকের জন্য অস্কারে আলাদা বিভাগ খুলতে হত তখন।
যদি তাদের কথা অনুযায়ী এখন এই বিদেশী সিরিয়ালগুলো বন্ধ করাও হয়, বিদেশী চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয় এর পর কী হবে? চ্যানেল মালিকরা কি তাদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেয়া শুরু করবে আর তারা অসাধারণ সব নাটক সিনেমা বানানো শুরু করবেন?
আসল ব্যাপারটা হল, তাদের পায়ের নিচ থেকে আজকে মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সংস্কৃতির দোহাই, ভাষার দোহাই সব ফালতু কথা। সত্যি সত্যি তারা এই ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হলে সেটা আরও বহু বছর আগেই হওয়ার কথা ছিল- কিউকি সাস ভি কাভি বহু থি যখন দর্শকদের নিয়ে যাচ্ছিল তখন সংস্কৃতির ক্ষতি হয়নি, যখন জি বাংলার পাখি উড়িয়ে নিয়ে গেছে দর্শকদের, তখনও তারা কিছু মনে করেনি। আজ বিজ্ঞাপনের বাজার দখল হওয়ার পরেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হচ্ছে। গত দশ বারো বছর আঙ্গুল চোষার পর আজকে সুলতান সুলেমান প্রচার হওয়ার পর সংস্কৃতির জন্য তাদের এই মায়াকান্না এজন্য সন্দেহ তৈরি করে। সুলতান সুলেমান, বা অন্য যে কোন বিদেশী সিরিয়াল, যেগুলোকে তারা নিজেদের নাটক-সিনেমার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন, যেগুলো নিষিদ্ধ না হলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার ভাবছেন, সেগুলো তাদের নিজেদেরই কৃতকর্মের ফসল। নিজেদের বোনা বীজের ফল তারা ভোগ করবেন না, এমনটা হয় না, হওয়া উচিৎও না।
এফটিপিওর হর্তাকর্তাদের উচিৎ এত দাবি দাওয়া পেশের আগে দেশের জনগণের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া। গত দশ বারো বছর তারা মানুষের ওপর যে অত্যাচার করেছেন, সেজন্য তাদের আরও কঠিন শাস্তি হওয়া উচিৎ ছিল। তারা এখন শুধুমাত্র অর্থনৈতিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যা শাস্তি হিসেবে খুবই লঘু। তাদের কোন ধারণা নেই দর্শকরা কী পরিমাণ ক্ষুব্ধ এই তথাকথিত সংস্কৃতির রক্ষাকারীদের ওপর। মানুষজন তাদের এখনও সহ্য করে, শহীদ মিনারের মত জায়গায় তারা প্রোগ্রাম করতে পেরেছেন, এটাকে তাদের প্রাপ্তি হিসেবে বিবেচনা করে ঘরে ফেরত যাওয়া উচিৎ।
বছরের পর বছর ধরে বাংলা সংস্কৃতির বারোটা বাজিয়ে আজকে তারা ত্রাণকর্তা সাজতে এসেছে। সংস্কৃতি রক্ষার এই ভন্ড আন্দোলনের দরকার নেই আমাদের।
আহাদুল ইসলাম
www.facebook.com/ahadultopu
মন্তব্য
"সুলতান সুলেমান"-এর কয়েকটা পর্ব দেখেছি; প্রায় পুরোটাই অটোমান হারেমের মেলোড্রামা। মূলগতভাবে এটা "কাহানি ঘর ঘর কি" অথবা "কিউ কি সাস ভি কভি বহু থি"-র অটোমান তুর্কী সংস্করণ। আনাড়ি, মেদবহুল স্ক্রিপ্ট এবং (আমাদের যাত্রাপালার মত) কেঠো অভিনয় (সংলাপ নিয়ে কিছু বলতে পারব না; কারণ এটা বাংলায় ডাব করা, আর আমি অটোমান তুর্কী ভাষা জানি না)-সমৃদ্ধ এই সিরিজ দেখার জন্য যদি বাংলাদেশের দর্শক হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তাহলেত বলতে হয় এই দর্শককে সন্তুষ্ট করার জন্য খুব বেশী কিছু দরকার হয় না! তবে হ্যাঁ, সিরিজটা সুনির্মিত, এবং ভিস্যুয়ালি সাম্পচুয়াস!
আমাদের নির্মাতাদের নিয়ে কিছু বলার নেই, কারণ সাফল্যের কোন নির্দিষ্ট ফর্মুলার বাইরে তারা (যেকোনো কারণেই হোক) যেতে চান না। নাহলে, বিজ্ঞাপন শিল্পের সঙ্গে জড়িত এত লোক টিভি সিরিয়াল বানাচ্ছেন; কিন্তু বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন ব্যবসা নিয়ে "ম্যাড মেন"-এর আদলে একটা সিরিজ তারা বানাতে পারেন না! কোথায় আমাদের সেসব নির্মাতা, যারা বাংলাদেশের অপরাধ জগত নিয়ে "দ্য সোপরানোস" অথবা "দ্য ওয়্যার"-এর আদলে একটা সিরিয়াল লিখবেন? এর কারণ কি কেবল অর্থনৈতিক? চিন্তা করতে বা লিখতে তো টাকা লাগে না!
হয়তো এ জন্যেই দেশী নাটকগুলোর খ্রাপাবস্থা। চিন্তা বা লেখার পেছনে টাকা খরচ করা শুরু করলে হয়তো পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে।
এই সিরিয়ালের অনুবাদ এবং ভয়েস-ওভার আমার দারুন লেগেছে। বিশেষ করে ভারতীয় আলিফ লায়লা ও অন্যান্য ডাবিং করা সিরিয়াল ইত্যাদির (এমনকি ডিস্কাভারি / ন্যাট জিও পর্যন্ত) ভিনগ্যালাক্সীয় চরম উদ্ভট, কিম্ভূতুড়ে ও হাস্যকর ক্রিমিনাল ক্যারিকেচার-মার্কা বাংলা শুনতে শুনতে পচে যাওয়া কানে 'সুলতান সুলেমান'-এর বাংলা অনুবাদ ও ভয়েস-ওভারকে মনে হয়েছে অগ্নিতপ্ত গ্রীস্মের প্রখর দাবদাহে চৌচির হয়ে মাটিতে হঠাৎ হিমশীতল তুমুল বারিবর্ষণের মতো!
আমি অবশ্য এই সিরিয়ালের নিয়মিত দর্শক ছিলাম না, স্রেফ ২-৪ টা এপিসোডের কিছু খণ্ডাংশ দেখেছি। কিন্তু ঐটুকুই যথেষ্ট মনে হয় - হাঁড়ির একটা ভাত টিপলেই বাকিগুলির অবস্থা বোঝা যায়। আর না, এটাকে "কাহানি ঘর ঘর কি" অথবা "কিউ কি সাস ভি কভি বহু থি"-র অটোমান তুর্কী সংস্করণ বলে মোটেও মনে হয়নি! মোটামুটি একই ধরণের দর্শকশ্রেণীর জন্য বা তাঁদের রুচিকে কেটার করার নির্মিত হলেও, এই সিরিয়াল "কাহানি ঘর ঘর কি" অথবা "কিউ কি সাস ভি কভি বহু থি"-র থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত মনে হয়েছে।
****************************************
অনেক কিছু জানলাম
পুরোপুরি একমত।
সহমত
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
সহমত। পণ্যের বা সেবার গুণগত উৎকর্ষতা না ঘটিয়ে কেবল উগ্র জাতীয়তাবাদের খোলসে নিজেদের মানহীন পণ্য বা সেবা বিক্রি করাই এই চক্রের উদ্দেশ্য ।
--- বোকা তেলাপোকা
নতুন মন্তব্য করুন