আমার তখন দশ বছর বয়স। গ্রীষ্মকাল- স্কুল বন্ধ, বন্ধুরা সব যে যার দেশের বাড়ি। দুপুর বেলায় খা খা করে আমাদের পাড়া। আমি তিন নম্বর সাইজের একটা ফুটবল নিয়ে গলির ভেতর একা একা ঘুরে বেড়াই, লাথি মেরে পাঠিয়ে দেই গলির মাথায়, তারপর দৌড়ে গিয়ে আবার উল্টো লাথি। একা একা আর কত খেলা যায়! আর তাছাড়া দুপুর বেলা মাথার ঠিক উপরে গনগনে সূর্যটাও জ্বালায় ভারি। মাঝে মাঝে ভাবি দেয়াল টপকে হিমেলদের বাড়িতে চলে গেলে কেমন হয়!
হিমেলদের বাড়িটা খুব ছায়া ঢাকা, চারিদিকে বড় বড় গাছপালা, তারই মদ্যিখানে টিনের চালে ছাওয়া সাদা রঙের ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির বাইরে পাকা উঠোন, হিমেলরা ঢাকায় থাকলে ওই উঠোনে আমরা লাট্টু খেলি। ওরা এখন দিনাজপুরে, মামার বাড়িতে আম কাঁঠালের ছুটি কাটাচ্ছে। হিমেলের মামা পাড়ার বাচ্চাদের খুব প্রিয়। দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এলেই আমাদের সাথে খেলতে নেমে যান। আমরা তাঁর আসল নাম জানিনা, গদাই মামা বলেই ডাকি। গদাই মামার পাঁচটা পোষা ভূত আছে। গদাই, মাখন, খলিলুল্লাহ, খইমন, আর রতন - এই পাঁচটি ভূতকে তিনি আটকে রাখেন কাঁচের বোতলে। এদের মধ্যে গদাই নাকি তাঁর সবচে প্রিয়।
হিমেলের বাবা খুব সাবধানী মানুষ। ছুঁচালো লোহার কাটা বিছিয়ে রেখেছেন যাতে দেয়াল টপকে কেউ গাছের ফল ফলাদি নিয়ে যেতে না পারে। সোহাগ একবার চেষ্টা করতে গিয়ে পায়ে কাঁটা বিঁধিয়ে ফেলেছিলো। দুই পরিবার কথা বলেনি তিনমাস।
আণ্ডা আইসক্রিম ফেরিআলা সরিফুদ্দিন আমার শেষ আধুলিটা নিয়ে চলে গিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। আণ্ডা আইসক্রিম দারুণ মজার। মাটির কলসির ভেতর বরফে ডুবানো ছোট ছোট প্লাস্টিকের বলের মাঝ বরাবর ছুরি দিয়ে চাপ দিতেই ম্যাজিকের মত বেরিয়ে আসে নারকেলের কুঁচি ঠাসা জমানো মালাই। কাঠিতে গেঁথে চেটে পুটে খেতে খেতেই চোখে পড়লো হিমেলদের গেটের তালাটা খোলা,একটু আগেও বন্ধ দেখেছি। ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে। দেয়ালের ওপাশে টসটসে হয়ে থাকা গাছপাকা আমগুলোর দিকে তাকিয়ে গোলমালের কথা ভুলে গেলাম। একবার মনে হলো বাসায় গিয়ে আমার স্কুলের ব্যাগটা নিয়ে আসি। কিন্তু ফিরে আসতে আসতে তালাটা যদি বন্ধ হয়ে যায় আবার!
হাত দিয়ে হালকা একটা চাপ দিতেই দুপুরের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ভীষণ বিচ্ছিরি একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে গেটটা খুলে গেলো। ভেতরে একরাশ পাতা পড়ে আছে। ওরা এখনো ফেরেনি তাহলে! খালাম্মার খুব শুচিবাই, বাড়ির ভেতর-বাইরে পরিষ্কার করতে করতেই তাঁর দিন চলে যায়। গেটটা ভেজিয়ে দিয়ে ভয়ে ভয়ে পা চালালাম উঠোনের দিকে। উঠোন পেরুলেই সেই আমগাছ। আমগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে কুচকুচে কালো একটা বেড়াল, আমাকে দেখেই ঘাড়ের রোম টোম ফুলিয়ে হিসিয়ে উঠলো। আমি পড়িমরি করে উল্টো দৌড় লাগাতেই গাছের মগডাল থেকে গদাই মামা ডেকে উঠলেন,
“কিরে টোকন কোথায় যাস?”
গদাই মামা মারা গিয়েছেন গত বর্ষায়। আম পাড়তে গাছে উঠার পর কেমন করে যেন পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন। সেই ঘটনার মাসখানেক পর একদিন; সন্ধ্যে বেলায় জামান খালু উঠোনে বসে চা খাচ্ছেন, দুটো চুমুক দিয়ে চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে পায়ের উপর পা তুলতে গিয়েই দেখেন গদাই মামা সামনে দাঁড়িয়ে। পরবর্তী অংশটা খালাম্মার কাছে শুনতে শুনতে আমাদের মুখস্ত হয়ে গিয়েছে।
“কিরে, কখন এলি?’
জামান খালুর মনেই নেই গেলো মাসের দুর্ঘটনার কথা।
“এই এলাম দুলাভাই।”
“নাকিয়ে নাকিয়ে কথা বলছিস যে, ঠাণ্ডা লেগেছে নাকি?”
“হি হি হি, কী যে বলেন দুলাভাই! নতুন করে আবার ঠাণ্ডা, হা হা হা। যেখানে থাকি সেখানে তো ঠাণ্ডাই।”
“তা বটে, তা বটে! ঢাকায় আজকাল সারা বছর একটাই সিজন। তেমন ঠাণ্ডা আর পড়ে কই?”
“সে জন্যেই তো চলে এলাম। হাওয়া বদল আর কি। আপনার চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে দুলাভাই। আমি বরং বাসায় যাই, আপনি আপনার চা শেষ করেন।”
“আচ্ছা যা, পরে তোর সাথে কথা বলবো।”
মামার দিকে না তাকিয়েই চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে আয়েশ করে একটা চুমুক দিলেন জামান খালু। তারপর আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার!
“কোথায় গেলো উল্লুকটা? নাজমা, এই নাজমা? হারামজাদাকে কান ধরে আমার সামনে নিয়ে আসো।”
নাজমা খালা কোমরে আচল গুঁজে দেয়ালের গায়ে লেগে থাকা কাকের ইয়ে পরিষ্কার করছিলেন। খালুর চিৎকার শুনে গজ গজ করতে করতে এসে জিগ্যেস করলেন,
“বলি, এই সন্ধ্যে বেলায় অমন চেঁচাচ্ছ কেন?”
“চেঁচাবো না তো কি আহ্লাদ করবো? আমার চায়ের কাপে এক গাদা চিরতা ঢেলে দিয়ে গিয়েছে।”
জামান খালু আর গদাই মামার ঠাট্টার সম্পর্ক। খালু যদিও খুব রাশভারী, গদাই মামা সেই সম্পর্কের ব্যাপারে বেশ সচেতন।
“কার কথা বলছ?”
“কার আবার, তোমার সেই গুণধর ভাই।”
বলতে বলতেই জামান খালুর মনে পড়ে গেলো গদাই মামা বেঁচে নেই।
সেই রাতে পাড়ার সবাই এসে জড়ো হয়েছিলো হিমেলদের বাসায়। সে এক দৃশ্য! জামান খালুকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে স্যালাইন পুশ করে গিয়েছেন সুরেশ কাকা। নাজমা খালা বারান্দার পিলারে হেলান দিয়ে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। মুন্নার বাবা, মানে আমাদের স্কুলের হুজুর স্যার, হারিকেন হাতে বাড়ির চারিদিকে ঘুরে ঘুরে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন আর তাঁর পেছন পেছন একটা তালেবে এলেম হাতুড়ি ঠুকে মাটিতে মোটা মোটা গজাল পুঁতে দিচ্ছে। আমরা বাচ্চারা আলো অন্ধকারে টিলো এক্সপ্রেস খেলছি, গদাই মামা ফিরে আসায় আমরা বাচ্চারা খুব খুশি। হিমেল একটু পর পর অভিনয় করে দেখাচ্ছে চিরতা মেশানো চা মুখে দিয়ে জামান খালু কেমন হাউমাউ করে চেঁচিয়েছিলেন। আমরা পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি উঠোনে। নাহ মামাটা একদম আগের মতোই আছেন।
হুজুর স্যারের গজাল কোনো কাজে লাগেনি। গদাই মামা এখানেই থেকে গিয়েছেন পাকাপাকি ভাবে। আমগাছটার মগডালে তাঁর বাসা, সে বাসা অবশ্য আমরা দেখতে পাইনা।
প্রথম প্রথম ভয় পেলেও পাড়ার লোকেদের আজকাল সয়ে গিয়েছে। খালাম্মাও মেনে নিয়েছেন ভূতপূর্ব ভাইয়ের ভুতাবস্থা। বাজার থেকে মাছ এলে, আঁশটা-মুড়োটা মামার জন্যই তোলা থাকে। কেবল জামান খালু চিড়বিড় করেন রাগে। গদাই মামার সাথে তাঁর ঠাট্টার সম্পর্ক। খালু যদিও খুব রাশভারি, সম্পর্কের দাবীটা মামা ভোলেন না।
যাই হোক, বেড়ালের খ্যাঁকানিতে ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে যেতে গদাই মামার গলা শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম,
“বাসায় চলে যাচ্ছিলাম মামা, হিমেলরা এখনো ফেরেনি কিনা…”
“আম খেতে এসেছিলি তাইনা?”
মামার কাছে লুকিয়ে আর কী হবে!
“দাও না মামা কয়েকটা পেড়ে। খালু তো আর এখানে নেই।”
“ওরে না থাকলেই কি শান্তি আছে? যাবার আগে গুনে রেখে গিয়েছেন, আর আমাকে বলেছেন পাহারা দিতে।”
গদাই মামার কাছ থেকে আম বাগানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
একটা টোবা টোবা আমের নিচের দিকটা ফুটো করে চুষতে চুষতে জিগ্যেস করলাম,
“আচ্ছা মামা, তুমি গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলে কেমন করে?”
“পড়ে যাইনি তো! খইমন আমাকে ফেলে দিয়েছিলো।”
“বলো কী! খইমন না তোমার পোষা ভূত?”
“গর্জনও তো দুলাভাইয়ের পোষা, তাই বলে কি কামড়ে দেয়নি?”
“গর্জনের কথা বাদ দাও মামা। কোথায় কুকুর আর কোথায় ভূত!”
“কুকুরে আর ভূতে কোনো পার্থক্য নেই, বুঝলি? দুটাই কামড়ায় যখন পাগল হয়ে যায়। খইমনটা এমনিতে ভালোই ছিলো, মাঝে মাঝে এক আধটু যন্ত্রণা করলেও আমার কথা অমান্য করতো না।’
“কোথায় পেয়েছিলে ওকে?”
“খালিশপুরের বিলে মাছ ধরতে গিয়ে। দিনাজপুরে আমাদের যে বাড়ি, তার একটু দুরেই খালিশপুরের বিল। আশেপাশে পাঁচ ছয় মাইলের মধ্যে বাড়িঘর কিছু নেই, বর্ষাকালে এক পাড়ে দাঁড়ালে আরেক পাড় দেখা যায়না, চারিদিকে কেবল পানি আর পানি। ভরা পূর্ণিমায় খাবার দাবার আর ছিপ নিয়ে বন্ধুরা বেরিয়ে পড়তাম, মাছ ধরাটা ছিল বাহানা, নৌকায় করে খালিশপুরে ঘুরে বেড়ানোটাই ছিলো আসল মজা।”
“নৌকায় করে ঘুরে বেড়াতে আমারও ভালো লাগে। ঢাকায় তো নৌকা নেই, নানা বাড়ি গেলে তখন খুব করে নৌকায় ঘুরি।”
“এ তো ভারি যন্ত্রণা হল, বলি গল্পটা তুই বলবি না আমি? কথার মধ্যে ভ্যাজর ভ্যাজর করবি না।”
“আর করবো না মামা।”
“সেবার গ্রামে বসন্ত হয়েছিলো খুব, আমার বন্ধুদের সবাই ঘরে বসে কোঁকাচ্ছে, খালিশপুরে যাবার মতো কেউ নেই, শেষমেষ একাই রওনা হলাম। পৌঁছুতে পৌঁছুতে সূর্য প্রায় ডোবে ডোবে। ঘাটে তখন নৌকা বলতে একটাই, মাঝি কোথায় গিয়েছে কে জানে! কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খাবারের পোটলা আর ছিপ গুলো নৌকায় তুলতে তুলতে একটা শব্দ শুনে পেছন ফিরে দেখি খইমন দাঁড়িয়ে।”
“খইমন দাঁড়িয়ে মানে?”
“আমাদের পাশের গ্রামের ছেলে। বয়স ধর এই তেরো কি চোদ্দ। বাপ-মা নেই, কাকাদের সাথে থাকে। সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, আজকে এর গাছের ফল, কালকে ওর খেতের শসা, পরশু তার পুকুরের মাছ - খইমনের দুরন্তপনার কোনো শেষ নেই। ওকে দেখে তাই অবাক হলাম না। জিগ্যেস করতে জানালো খবর পেয়েছে আমি নাকি মাছ ধরতে একাই খালিশপুরে যাচ্ছি, তারও খুব মাছের শখ তাই আমার পেছন পেছন চলে এসেছে। খালিশপুরের মাছেরা খুব চালাক, সহজে ধরা দিতে চায় না। অথচ সে রাতে, বললে বিশ্বাস করবিনা, মাছ ধরে যেন আর কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। শেষমেশ ছিপ গুটিয়ে ঘাটের সাথে নৌকা বেঁধে ঘুমিয়ে পড়লাম, সকাল হলে বাড়ি ফেরা যাবে। ঘুম থেকে উঠে দেখি খইমন আশেপাশে নেই। মাছ রাখার খালুই দু’টাও হাওয়া। ব্যাটা চোরের বাচ্চা চোর! আমার সারা রাতের পরিশ্রম সাফ করে পালিয়েছে।”
“একটা কথা বলবো মামা?”
“আহ, গল্পের মধ্যে বাগড়া দিবি নাতো!”
“আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি বলো।”
“খইমনদের বাড়িটা আমার ফেরার পথেই, ভাবলাম ওর কাকাকে বলে দু’চার ঘা’র বন্দোবস্ত করে যাই। সেই সাথে খালুই দুটোও ফিরিয়ে নেওয়া যাবে। দূর থেকেই চোখে পড়লো ওদের বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভিড়। ভিড় ঠেলে উঠোনে ঢুকে দেখি শম্ভু ওঝা মুখ ভার করে বসে আছে। তার পায়ের কাছেই একটা মাদুরে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে খইমন। আমি মুখ খোলার আগেই খইমনের কাকা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। খইমনকে সাপে কেটেছে। শম্ভু ওঝার আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো, সারারাত চেষ্টা করেও বিষ নামানো যায়নি। আমার অবস্থা তখন তোর জামান খালুর মতো। কেবল একবার বিড়বিড় করে বললাম, সে কি করে হয়? খইমন তো সারা রাত আমার সাথে খালিশপুরে মাছ ধরে বেড়িয়েছে! তারপর মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।”
“তারপর! তারপর কী হলো মামা?”
“কী আর? খইমনকে গোর দিয়ে ফিরে এসে শম্ভু পড়লো আমাকে নিয়ে। তিনদিন তিন রাত পরে আমার হুঁশ ফিরেছিলো। হুশ ফিরে দেখি ঘুটঘুটে রাত, আমার বিছানার পাশে গালে হাত দিয়ে বসে খইমন। আমি একটা চিৎকার দিয়ে আবার জ্ঞান হারালাম। খইমন আমাকে ছেড়ে যায়নি। তার নাকি খুব মাছ খাবার শখ, যে সে মাছ নয়, খালিশপুরের বিলের মাছ। একটা সময় আমারও ভয় কেটে গেলো। খইমন সাথে থাকলে তো ভালোই হয়, নৌকার আশেপাশে শ্রাবণ মাসে ধানক্ষেতে খলবল করতে থাকা কইয়ের ঝাঁকের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ আসে। বেচারার খোলা বাতাসে ঘুরে বেড়াতে ঠাণ্ডা লাগে খুব, তাই একটা বোতলের মধ্যে রেখে দিলাম। গদাই, মাখন, খলিলুল্লাহ, আর রতনকে ওই খইমনই জুটিয়ে এনেছে। ওরাও থাকতো সেই বোতলে।”
“কিন্তু মামা খইমন তোমাকে ফেলে দিলো কেন?”
“গদাইটা ছিলো এদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোটো। যখন পাই তখন ঠাণ্ডা লেগে ওর একেবারে যা তা অবস্থা, সারাক্ষণই নাকের নিচে সিকনি ঝুলে থাকে। ছোটো বলেই কিনা নাকি খুব রোগা বলে, ওর উপর মায়াটা আমার একটু বেশিই ছিলো। খালিশপুরের বিলে যেদিন মহাশোল ধরা পড়তো, মুড়োটা গদাইকেই দিতাম। অন্যেরা আঁশ পেলেই খুশি, তবে খইমন খুব গাইগুই করতো। গত বর্ষায় দুলাভাই এর জন্য খালিশপুরের একটা মহাশোল নিয়ে এসেছিলাম। দুলাভাইয়ের আবার মুড়ো খুব পছন্দ। আমি আপাকে লুকিয়ে আঁশগুলো নিয়ে আমগাছের একটা ডালে এসে বসলাম ভুতেদের খাওয়াবো বলে। গদাইকে একটু দিতেই খইমন রেগে গিয়ে বললো, মুড়োটাতো সবসময় ও খায় এখন আঁশ দিতে হবে কেন? তারপর এক কথা দুই কথা, হঠাৎ আমি বুঝে ওঠার আগেই দিলো ধাক্কা। দিয়েই ঝুপ করে ঢুকে পড়েছে আমার হাতে ধরা বোতলের ভেতর, সংগে অনন্যারাও। আমি ছিপি লাগাতে গিয়ে হাত ফসকে পড়ে গেলাম।”
“বল কী মামা? সেই বোতল এখন কোথায়?”
“সেটাতো জানিনা! আচ্ছা, তোর কাছে কি ভালো কোন বোতল আছে? আমগাছে অনেক ঠাণ্ডা, বুঝলি। কাশিটা যেতে যেতেও আর যাচ্ছে না।”
“কোকের বোতল হলে চলবে?”
“নাহ, কোকের গন্ধ আমার ভালো লাগে না। কড লিভার অয়েলের বোতল নেই? কী সুন্দর মাছ মাছ গন্ধ! একেবারে যেন খালিশপুরের মহাশোল।”
“আচ্ছা মামা, বোতল পেলে তোমাকে জানাবো। এখন যাই, বাবা অফিস থেকে এলো বলে! সময় মতো ফিরতে না পারলে আমার আজকে রেহাই নেই।”
বাড়ি ফিরে দেখি আমার নানা এসেছেন। এসেই মা’কে আচ্ছা করে বকাবকি। গরমের ছুটিতে কেন আমাকে নিয়ে গ্রামে যায়নি সেই নিয়ে রাগ। পরদিন সবাই মিলে হই হই করতে করতে নানাবাড়ি চলে গেলাম।
একমাস খুব করে আম কাঁঠাল খেয়ে ঢাকায় ফিরে দেখি হিমেলদের বাড়িটা নেই। নেই মানে, ঘর-দোর-উঠোন-গাছপালা কিছুই নেই। ওরা সব বিক্রি করে দিয়ে চলে গিয়েছে অন্য কোথাও। এখানে নাকি পাঁচ তলা একটা বাড়ি উঠবে।
…………………
…………………
আমার ছেলেটার বয়স এখন নয়। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে খুব মন খারাপ করে বললো,
“আচ্ছা বাবা, আমরা কোথাও যাইনা কেন?”
“কোথাও যাইনা মানে?”
“আজকে ক্লাসে মিস জিগ্যেস করলো, উইন্টার ব্রেকে তোমরা কোথায় কোথায় গিয়েছ? এরিক গিয়েছিলো ওর কাজিনদের বাড়ি, ফ্লোরিডায়। অ্যানা গিয়েছিলো ভ্যানকুভারে, সেখানে ওর গ্র্যান্ডপা থাকে। আমার ক্লাসের সবাই কোথাও না কোথাও গিয়েছিলো। আমি যেই বললাম আমরা টরন্টোতেই ছিলাম, শুনে সবার সে কী হাসা হাসি! আমার খুব মন খারাপ হয়েছে। আচ্ছা বাবা আমরা কোথাও যাই না কেন? নানাবাড়ি কি অনেক দুরে? দাদাবাড়ি?”
আমারও খুব মন খারাপ হয়ে গেল। অনেক দুরেই তো! নিদেন পক্ষে দশ হাজার ডলার দুরে।
ছেলেকে কাছে টেনে ওর একরাশ চুল ভর্তি মাথায় আমার নাকটা ডুবিয়ে বললাম,
“আয়, তোকে একটা গল্প বলি। অনেক দুরের গল্প। দাদাবাড়ির গল্প।”
...আমার তখন দশ বছর বয়স। গ্রীষ্মকাল- স্কুল বন্ধ, বন্ধুরা সব যে যার দেশের বাড়ি। দুপুর বেলায় খা খা করে আমাদের পাড়া......
মন্তব্য
দারুন মোখলেস ভাই, দারুন!
ও হ্যাঁ, টিলো-এক্সপ্রেসের কথা 'সাতচাঁরা' আর 'বোম্বাস্টিক'-এর কথাও মনে পড়লো!
****************************************
সময় নিয়ে পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ মন মাঝি। আমার ছেলেও সব বাদ দিয়ে জানতে চাইলো টিলো এক্সপ্রেস কেমন করে খেলতে হয়। যেন ভূতের ব্যাপারটা কোন বিষয়ই নয়!
-মোখলেস হোসেন
চমৎকার! পাঁচ তারায় পাঁচ তারা।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আজকাল তো আর লিখছেন না আপনি, এক লহমা! মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
--মোখলেস হোসেন
পড়ে ভাল লাগল।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
--মোখলেস হোসেন
দারুণ লাগলো মোখলেস ভাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ সোহেল ইমাম। হাতের জড়তা কাটিয়ে নিচ্ছি। অসমাপ্ত কিছু লেখা শেষ করার ইচ্ছে রয়েছে।
--মোখলেস হোসেন
চমৎকার বরাবরের মতোই।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
ধন্যবাদ দেবদ্যুতি।
--মোখলেস হোসেন
ভালোই লেগেছে । হান্টার
ধন্যবাদ হান্টার।
--মোখলেস হোসেন
খুবই ভালো লেগেছে। বর্ননা অত্যন্ত সহজ, সাবলীল এবং ঝরঝরে। গল্পের সমাপ্তিটা টেনেছেন দারুন টুইস্টের সাথে। চালিয়ে যান।
শুভ কামনা রইলো।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী।
ধন্যবাদ ইকরাম ফরিদ চৌধুরী।
--মোখলেস হোসেন
নতুন মন্তব্য করুন