২১ ফেব্রুয়ারীঃ ফেইসবুক বনাম বাস্তবতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২১/০২/২০১৭ - ১০:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে এবার অতিরিক্ত কচকচানি ঘচঘচানি হয়েছে। বাস্তবে না, ফেইসবুকে। ঝুড়ি ভর্তি লেবু এতই বেশী কচলানো হয়েছে যে বিষ একদম চারপাশে। ফেইসবুক আর বাস্তব এক নাকি এটা নিয়ে আমার মনে সবসময় সন্দেহ থাকে। তাই অফিসে ছুটি না থাকা সত্ত্বেও পানি আসলে কতটুকু গড়িয়েছে, তা যাচাই করার জন্য বের হলাম।

শুরুতেই উবারের একটু গুনগান করে নেই। চাইতেই উবারের লক্ষ্মী নীল রঙের গাড়ি হাজির, সাথে ভালো ড্রাইভার ফ্রি। আমার দেখানো রাস্তা ধরে অল্প সময়েই বাংলা মোটর চলে এলাম। কিন্তু এরপর তো আর গাড়ি চলে না। চলে না মানে, একদম চলে না। হাঁটার মত শক্তি ছিলো না, তাই গাড়িতেই চোখ বন্ধ করে গিট্টু মেরে বসে থাকলাম, দেখা যাক কি হয়। আর উবারের একটা প্রমো কোড ছিলো, তাই ভাড়া নিয়ে চিন্তা কম ছিলো। একটু পরে চোখ খুলে দেখি অল্প একটু রাস্তা পার হয়েছি, রাস্তায় মানুষের মিছিল। এবার চোখ বন্ধ না রেখে, মানুষের মিছিল দেখা শুরু করলাম।

মানুষের মিছিলে মূলত চার ধরনের মানুষঃ পরিবার, ছেলে-মেয়ে জুটি, ৩/৪ অথবা তার বেশী সংখ্যক ছেলে/মেয়েদের দল, আর মজা দেখতে আসা দুষ্ট, নষ্ট ছেলেদের দল। ভাবছেন, শেষের দল্টাকে কীভাবে আলাদা করলাম? ঢাকার রাস্তায় বের হওয়া যে কোন মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেই উত্তর পেয়ে যাবেন। মুখের অভিব্যাক্তি, হাসির শব্দ, কথা – এসব থেকে এদের খুব দ্রুত চেনা যায়। যাই হোক, মানুষের ভিড় দেখতে ভালোই লাগছিলো। “সব দিবসরে ভালোবাসা দিবস বানাইলো, দেশ রসাতলে গ্যালো গা রে, গ্যালো গা” – ফেইসবুকে এই আর্তনাদ আজকাল খুব শুনি। আমার অবশ্য রঙ্গিন, বিভিন্ন বয়সী জুটিদের দেখে তেমন লাগছিলো না। স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা ছুটির দিনে ঘুরলে যদি কারো দেশ রসাতলে যায়, তবে যাক। আমার বাংলাদেশ কাঁচের মত ভঙ্গুর নয় যে এতো অল্পতে ভেঙ্গে যাবে, ভেসে যাবে।

গাড়ি আবার একটু চলতে শুরু করলো, তারপরো জাতীয় জাদুঘরের সামনে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে গেলো। এরপর হাঁটা ছাড়া গতি নেই। উবারের লক্ষ্মী নীল গাড়ি আর ভালো ড্রাইভারকে বিদায় দিয়ে শুরু করলাম হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো অনেক কিছু। কয়েকটা ব্যাপার বলার লোভ সামলাতে পারছি না। এক, ফেইসবুকের সব ট্রলের মুখে ছাই দিয়ে সব চেয়ে বেশী সেলফি তুলছে ছেলেরা। দুই, পরিবার নিয়ে প্রচুর মানুষ এসেছে। তিন, কম বয়সী কপোত-কপোতীরা অসম্ভব ভদ্রভাবে চলাফেরা করছে। কোন অসতর্ক মুহূর্তের ছবি তুলে ট্রল বানানোর সুযোগ মনে হয় আর কেউ দিতে চায় না। চার, মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ার মত ব্যাপার যারা করছে তারা সবাই একাকী পথিক, কুকীর্তি করছে একা একা। আবারো প্রশ্ন, আমি কীভাবে জানলাম? আমি নিজেকে টোপ হিসেবে রেখে এটা জেনে নিয়েছি, আর শিকার ধরে ধোলাই দেই নি। বরং তার পিছু নিয়ে, কি করে দেখার চেষ্টা করেছি।

বইমেলায় ঢোকার জন্য তেমন বিশাল লাইনে দাঁড়াতে হয় নি। সারাদিন কেমন ছিলো, তা জানি না। আমি বলছি বিকেলবেলার গল্প। তবে এতো মানুষ একসাথে এবার বইমেলাতে আর দেখি নি। সব চেয়ে ভালো লাগছিলো যেটা সেটা হলো, মানুষ বই কিনছে। হয়তো নিয়মিত পাঠক না, কেবলি সাদা-কালো পরে মেলায় এসেছে। তারপরও বই দেখছে, বই কিনছে। দুষ্ট, নষ্ট ছেলেদের দল অবশ্য বই কেনাকাটাতে ছিলো না। তারা মজা দেখতেই এসেছে। হয়তো বাড়ি ফিরে গিয়ে দেশ-জাতি উদ্ধার করে একটা জ্বালাময়ী ফেইসবুক স্ট্যাটাসও দিবে। আমার পরিচিত দুষ্ট, নষ্ট ছেলেদের সবাই কোন এক অজানা কারনে ফেইসবুকে দেশ-জাতি উদ্ধার করতে খুবই পছন্দ করে। একটা দলকে আমি হাতানাতে ধরেছি, দলের ২ জন ইতিমধ্যেই জ্বালাময়ী ফেইসবুক স্ট্যাটাসও দিয়েছে, যার সারমর্ম হলো – “দেশের কিছু হবে না। কেউ বই পরে না। খালি সেজেগুজে, সাদা-কালো কাপড় পরে ডেটিং করতে প্রেমিক-প্রেমিকারা বইমেলা যায়। হায়রে জাতি!”। ওহ, কাপরের কথা যেহেতু উঠলো তাই এইবেলা বলে ফেলি। পহেলা ফাল্গুন যেমন হলুদের মেলা বসে, আজ সেরকম সাদা-কালো কাপড়ের মিছিল হয় নি। অনেকে পরেছে, তা ঠিক। তবে অন্য অনেক রঙ, বিশেষ করে লাল-সবুজও অনেক চোখে পড়েছে।

আজ মেলাতে বেশ কয়েকজন পুরনো এবং নতুন লেখক এসেছেন। নতুনদের সবাইকে আমি চিনি না, এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তবে ফেইসবুকের কল্যাণে অনেকের কথা জেনেছি, বই কিনে পড়াও হয়েছে। যাদের এখনও চিনি না তাঁদের তাদের ভক্ত পাঠকরা ঠিকই চিনেন। তাদের সাথে সেলফি তোলার ধুম দেখে সেটা বুঝে নেওয়া যায়।

মেলা থেকে বের হওয়ার সময়ও স্রোতের মত মানুষ ঢুকছিল। এর অর্ধেক মানুষ যদি একটা করেও বই কেনে এবং বইটা পড়ে তাহলে সেটাই বা কম কী! ফেরার পথের যাত্রাতে অসহনীয় জ্যাম ছিলো না। নিয়ন বাতি আর অন্যান্য আলোতে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা পড়তে পেরেছি – “স্বাধীনতা, সে আমার - স্বজন, হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন-”।

- বান্ধবী


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

ভাল লাগল। পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, চেষ্টা করবো।

এই লেখায় কিছু ভুল আছে, এখন দেখলাম মন খারাপ

মন মাঝি এর ছবি

মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়ার মত ব্যাপার যারা করছে তারা সবাই একাকী পথিক, কুকীর্তি করছে একা একা - - - আমি নিজেকে টোপ হিসেবে রেখে এটা জেনে নিয়েছি - - -

আপনি তো দেখছি ডেঞ্জারাস লোক!!! গুল্লি

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

এরকম ঘটনাগুলো যে ঘটে এটা কিছু মানুষ কিছুতেই মানতে চায় না। বললেই "প্রমান কই", "বানোয়াট", "কিছু হয়, তবে এতো বেশী না", "গুজব" - এসব বলে হইচই করে। এজন্য আমি অন্য কারো রেফারেন্স ব্যবহার করি না, নিজের দেখাগুলো বলি দেঁতো হাসি

দেবদ্যুতি এর ছবি

লেখাটা ভালো। আপনার সাথে একটা ব্যাপারে আমি পুরোপুরি একমত, কেবল যাওয়ার জন্যই গিয়েও যদি অর্ধেক মানুষও একটা করেও বই কেনে তবে সেটাও বইয়ের জন্য, লেখক ও সাহিত্যের জন্য মঙ্গলজনক।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি এরপরও আরো দু'বার গিয়েছি। একই দৃশ্য, নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে প্রায় সবাই'ই একটা না একটা বই কিনে ফেলে। এমনকি নতুন বা কম পরিচিত লেখকদের বইও।
বুঝে কিনুক, না বুঝে কিনুক - কিনছে তো!

- বান্ধবী

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

দুষ্ট, নষ্ট ছেলেদের দল সম্পর্কে আপনার মুল্যায়নের সাথে দ্বিমত পোষণ করি না। তবে একটা বিষয় ভেবে খুব পেরেশান বোধ করি। এই যে বিপুল সংখ্যক দুষ্ট, নষ্ট ছেলেদের দল, সেই সংখ্যক মেয়েদের থেকে নৈতিক মানদণ্ডের বিচারে অনেকটাই পিছিয়ে! তাহলে আমরা কী পোকায় খাওয়া, জীবাণু আক্রান্ত, দুষিত একটি জনগোষ্ঠীকে লালন করে চলেছি সমসংখ্যক মেয়ের ভবিষ্যৎ জীবন দুর্বিষহ করে তোলার জন্য?

অতিথি লেখক এর ছবি

এটা একটা চক্রের মত।

সমাজ ছেলের মায়েদের আলাদা সম্মান দেয়, সেই থেকে মায়েরা ছেলে শিশুদের প্রতি আলাদা আচরন করে, সেই আচরন থেকে ছেলে শিশুরা ভুলকে ভুল না ভাবতে শেখে, একটু বড় হয়ে আশেপাশে এমন আরও ছেলে শিশুকে বন্ধু হিসেবে পায়, গড়ে ওঠে দুষ্ট ছেলের দল।

এরপর প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে পার্টনার বা স্বামী হিসেবে স্ত্রীর কাছ থেকে "পুরুষের সাত খুন মাফ" আচরন আশা করে, কিছু স্ত্রী মেনে নেয় কেউবা মেনে নেয় না।

এই চক্র ভেদ করা অনেক সময়ের ব্যপার।

- বান্ধবী

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখা সুন্দর হয়েছে। দেশ রসের অতলে এমনিও গেছে ওমনিও গেছে। যুগ যুগ ধরে রসাতলেই যাচ্ছে , তলা আর খুজে পাচ্ছে না! কোন পত্রিকায় দেখলাম একুশের দিন কিভাবে সাজবেন, কিভাবে রান্না করা খাবার দিয়ে অক্ষর লিখে পরিবেশন করবেন, সেই ব্যপারেও খুব সিরিয়াস পোষ্ট দিয়েছে। ১৯৫২ সালে সালাম বরকত রফিক জব্বার শহীদ হয়েছেন, মারা গেছেন , এই উপলব্ধিটুকুও যদি মানুষের ভিতরে কত টুকু দেখেছেন, সেটা যদি ব্যাখ্যা করতেন, তবেই বুঝতাম ২১ শে ফেব্রুয়ারী কি ? খায় না মাথায় দেয় হান্টার হান্টার

Md Arifur Rahman এর ছবি

সুন্দর লেখা হয়েছে। ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।