বর্ধমান বাঁকুড়া মেদিনীপুর মানভূম
দুমকা পাটনা আর মুর্শিদাবাদ বীরভূম
ষোল ক্রোশজুড়ে
লোহার খুঁটি মেরে
জলকে রেখেছে ঘেরে
তেরোশ’ পঁচাশি সালের বন্যা নিয়ে বাঁধা এই গানে মানভূম নামটা পাওয়া গেলেও ভারতের মানচিত্রে এখন মানভূম বলে কোন জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ১৮৩৩ সালে মানবাজারকে হেডকোয়ার্টার করে যে মানভূম জেলা গঠিত হয় সেটা আজকের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান, ধানবাদ, ধলভূম, সরাইকেলা আর খরসুআঁ (খরসন) মিলিয়ে। এরপর ১৮৪৫, ১৮৪৬, ১৮৭১ ও ১৮৭৯ সালে চার দফায় প্রশাসনিক পরিবর্তনে এর আকারে পরিবর্তন এসেছে — মূলত ছোট হয়েছে। ১৯১২ সালের ২২শে মার্চ বাংলা ভেঙে যখন বিহার-ওড়িষ্যা রাজ্য গঠন করা হয় তখন মানভূমকে বিহার-ওড়িষ্যার ভাগে ফেলা হয়। বাংলাভাষাভাষীদের জেলা মানভূমকে ভেঙ্গে বিহার-ওড়িষ্যায় ফেলার বিষয়টি স্থানীয় জনগণ মেনে নিতে পারেননি। ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে সি. বিজয়রাঘবাচার্যের সভাপতিত্বে নাগপুরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়,কিন্তু খুব সহসা মানভূমের ভাগ্য পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনা দেখা দেয় না।
১৯৩৫ সালে বিহার-ওড়িষ্যা রাজ্য ভেঙে বিহারকে স্বতন্ত্র প্রদেশ করা হয়। সদ্য গঠিত রাজ্যে কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ (পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি) হিন্দীভাষীদের স্বার্থ রক্ষায় ‘মানভূম বিহারী সমিতি’গঠন করেন। এতে ব্যারিস্টার পি. আর. দাসের নেতৃত্বে বাংলাভাষীরা ‘মানভূম সমিতি’ গঠন করেন। দুই সংগঠনের পাল্টাপাল্টি কার্যক্রমে মানভূমের ভাগ্য নিয়ে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে ওঠে। বিহার রাজ্য সরকার হিন্দী ভাষার স্কুল খুললেও বাংলা ভাষার স্কুল খোলা হয় না। ফলে স্থানীয় বাঙালীরা নিজ উদ্যোগে বাংলা স্কুল খোলা শুরু করেন।
স্বাধীনতালাভের পর নাগপুর অধিবেশনে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশগুলোকে পুনর্গঠন করা হবে কি হবে না সেটা ঠিক করার জন্য ১৯৪৮ সালের ১৭ই জুন সংসদের সভাপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এলাহাবাদ হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি এস কে ধর’কে প্রধান এবং আইনজীবি জে এন লাল ও অবসরপ্রাপ্ত আমলা পান্নালালকে সদস্য করে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন (ধর কমিশন) গঠন করেন। একই বছরের ১০ই ডিসেম্বর কমিশন সুপারিশ করে যে, ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন ভারতের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য কল্যানকর হবে না। ধর কমিশনের সুপারিশ ভাষাভিত্তিক বিভাজনের পরিবর্তে ভৌগলিক নৈকট্য, প্রশাসন পরিচালনার সুবিধা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ভিত্তিক বিভাজনের পক্ষে হওয়ায় কংগ্রেসের জয়পুর অধিবেশনে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য জওয়াহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও পট্টভী সীতারামাইয়াকে সদস্য করে আরেকটি কমিটি (জেভিপি কমিটি) গঠন করা হয়। ১৯৪৯ সালের ১লা এপ্রিল কমিটির প্রদত্ত রিপোর্টে বলা হয়, যেহেতু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তাই যদি জনগণের আকাঙ্খা প্রবল ও দাবি জোরালো হয় তাহলে আমরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবো; কিন্তু ভারতের সামগ্রিক স্বার্থ বিবেচনায় প্রয়োজনে সেখানে কিছু ছাড় দেয়া হবে।
১৯৪৮ সালে কেন্দ্রে যখন ভাষার প্রশ্নে প্রাদেশিক বিভাজন নিয়ে পর্যালোচনা চলছে তার মধ্যে বিহার রাজ্য সরকার হিন্দীকে রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। প্রাথমিক স্তর থেকে স্কুলে হিন্দী মাধ্যমে পড়ানো, স্কুলের সাইনবোর্ড বাংলার পরিবর্তে হিন্দীতে লেখা, অ্যাসেম্ব্লিতে বাংলা প্রার্থনাগীতের পরিবর্তে হিন্দীতে ‘রামধুন্’ গাওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়। আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে শুধুমাত্র হিন্দীতে শিক্ষা দেয়ার, দাপ্তরিক কাজে বা সরকার বরাবর কোন আবেদন শুধুমাত্র হিন্দীতে করার নির্দেশ দেয়া হয়। ৩০শে এপ্রিল বান্দোয়ান থানার জিতান গ্রামে অতুলচন্দ্র ঘোষের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের মানভূম জেলা কমিটির অধিবেশনে মানভূমের পশ্চিমবঙ্গভুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও মতভেদের কারণে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। পুরুলিয়ায় ৩০শে মে’র সভায় বিষয়টি আবারও উত্থাপিত হলে তা ভোটে দেয়া হয়, কিন্তু প্রস্তাবটি ৪৩-৫৫ ভোটে হেরে যায়। বিহার রাজ্য সরকার মানভূমে বাংলার ব্যবহার সীমিত করার জন্য কঠোর হতে শুরু করলে ১৪ই জুন বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনের জন্য অতুলচন্দ্র ঘোষ,লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ,বিভূতিভূষণ দাশগুপ্তসহ ৩৭ জন নেতা কংগ্রেসের জেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করে লোক সেবক সংঘ গঠন করেন। এই সংঘ বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের মধ্যে সভা-সমাবেশ, মিছিল ছাড়াও ছিল ঘরে ঘরে অরন্ধন,বিহার রাজ্য সরকার মানভূমে চাল আমদানী বন্ধ করলে বাঁকুড়া থেকে ট্রাকে করে চাল আনা তথা খাদ্য সত্যাগ্রহ আন্দোলন, এবং সরকার কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রিতে বাধা দিলে প্রকাশ্যে হাল-জোয়াল বিক্রি তথা হাল-জোয়াল আন্দোলন। বিহার রাজ্য সরকার বাংলাভাষীদের সভা-সমাবেশ ও মিছিল করা নিষিদ্ধ করলে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। আন্দোলন চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে।
১৯৫৪ সালের ৯ই জানুয়ারি থেকে ৮ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লোক সেবক সংঘ একমাসব্যাপী টুসু সত্যাগ্রহ আন্দোলন সগঠিত করে। টুসু হচ্ছে ঝুমুর বা ভাদু’র মতো মানভূম অঞ্চলের লোকগীতি। প্রধানত নারী কণ্ঠে গাওয়া টুসু গানের মূল বিষয় প্রেম; তাছাড়া নারীর আনন্দ, বেদনা, স্বপ্ন, বঞ্চনা, ঈর্ষা, ভালোবাসা, দেহগত প্রেম, সাংসারিক ক্রিয়াদি, সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় খুব স্পষ্ট ভাষায় গানের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। তবে টুসুতে সমকালীন বিষয়াদী বা গণসচেতনতামূলক বিষয়াদীও থাকতে পারে। মকরসংক্রান্তিতে (২৯শে পৌষ) রাতভর টুসু গান গাওয়ার রীতি আছে। মানভূমকাণ্ডের শুরু থেকে বাংলা নিয়ে অনেক টুসু গান বাঁধা হচ্ছিল। ১৯৫৪’র মকরসংক্রান্তিতে সেই্সব গান সত্যাগ্রহের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ঐসব গানের কিছু উদাহরণঃ
১।
“শুন বিহারী ভাই, তোরা রাখতে লারবি ডাঙ্ দেখাই
তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি, বাংলা ভাষায় দিলি ছাই
ভাইকে ভুলে করলি বড় বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই
বাঙালী-বিহারী সবই এক ভারতের আপন ভাই
বাঙালীকে মারলি তবু বিষ ছড়ালি — হিন্দী চাই
বাংলা ভাষার পদবীতে ভাই কোন ভেদের কথা নাই
এক ভারতের ভাইয়ে ভাইয়ে মাতৃভাষার রাজ্য চাই”
(কবিঃ ভজহরি মাহাতো)
২।
“বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে
ও ভাই মারবি তোরা কে তারে
এই ভাষাতেই কাজ চলেছে সাত পুরুষের আমলে
এই ভাষাতেই মায়ের কোলে মুখ ফুটেছে মা বলে
এই ভাষাতেই পরচা-রেকর্ড,এই ভাষাতেই চেক কাটা
এই ভাষাতেই দলিল-নথি,সাতপুরুষের হক পাটা
দেশের মানুষ ছাড়িস যদি ভাষার চির অধিকার
দেশের শাসন অচল হবে,ঘটবে দেশে অনাচার”
(কবিঃ অরুণচন্দ্র ঘোষ)
৩।
“আমার মনের মাধুরী সেই বাংলা ভাষা করবি কে চুরি
আকাশ জুড়ে বিষ্টি নামে মেঠো সুরের কোন্ ধুঁয়া
বাংলা গানের ছড়া কেটে আষাঢ় মাসে ধান রুয়া
মনের মাধুরী মনসা গীত বাংলা গানে
শ্রাবণে জাত-মঙ্গলে চাঁদ-বেহুলার কাহিনী গাই
চোখের জলে গান বলে বাংলা গানে দোলা সাজাই
বাংলা গানে করি লো সই ভাদুপরব ভাদরে
গরবিনীর দোলা সাজাই ফুল-পাতায় আদরে
বাংলা গানে টুসু আমার মকর দিনের সাক্রাতে
টুসু-ভাসান পরব টাঁড়ে টুসুর গানে মন মাতে”
(কবিঃ অরুণচন্দ্র ঘোষ)
৪।
“প্রাণে আর সহে না হিন্দী কংগ্রেসীদের ছলনা
ইংরাজি আমলে যারা গো করতো মোসাহেবিয়ানা
এখন তারা হিন্দী কংগ্রেস মানভূমে দেয় যাতনা“
(কবিঃ জগদ্বন্ধু ভট্টাচার্য)
৫।
“মানভূমবাসী থাকবে সতরে
ধলভূমবাসী থাকবে সতরে
হিন্দীর ফন্দী এল জীপ গাড়ি ভরে
যত টাকা কেবল ফাঁকা
বাঁধ কুয়ারই খবরে
মিথ্যা চালান কাটি,নিচ্ছে লুটি
হিন্দী ভাষার প্রচারে
ভাই,এদের তরে চাষের অন্ন
দাও এখন বাঁধা দরে
নইলে পরে কেমন করে
মরবি ৰুধায় ভাদরে
সেদিন এরা কেউ ছিল না
থাকবে নাকো এর পরে
এখন এত ব্যথা গোপন কথা
শুন কমিশনের ডরে”
(কবিঃ জগদ্বন্ধু ভট্টাচার্য)
৬।
“মন মানে না হিন্দীর সইতে
ভাষা মোদের হরে নিল হিন্দীতে
মাতৃভাষা হরে যদি আর কি মোদের থাকে রে
তাই মধু বলে মাতৃভাষায় ধ্বজা হবে বহিতে”
(কবিঃ মধুসূদন মাহাতো)
৭।
“স্বাধীন জীবনে এবার মিলব রে জনে
সত্য পথে চল্ রে সবাই
গান্ধী-বাণী রাখ্ মনে
কানন বলে পাবি আরাম
বাংলা ভাষার জীবনে”
(কবিঃ কাননবিহারী ঠাকুর)
এমন সব টুসু গান ছড়িয়ে পড়ে গোটা মানভূম জুড়ে। ‘টুসুর গানে মানভূম’ নামে ঐসব গানের একটা সংকলন বের করা হয়। সংকলনটির হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়। বিহারের তৎকালীন রাজস্বমন্ত্রী কৃষ্ণবল্লভ সহায় বলেন, টুসু আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মানভূমকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে যাওয়া। টুসু গানের সংকলনটি আপত্তিকর। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বিহার রাজ্য সরকার ও তার কর্মচারীদের নিন্দা করা, বিহারী ও হিন্দীভাষীদের গালি দেয়া। এখন যেখানে পুরুলিয়া জেলা জজের আদালত তার সামনে তখন একটি বড় মাঠ ছিল। সেই মাঠে সাধারণত মকরসংক্রান্তির টুসু গান গাওয়া হতো। ১৯৫৪’র মকরসংক্রান্তিতে ঐ মাঠে যখন এসব গান গাওয়া শুরু হয় তখন শুরু হয় পুলিশী আক্রমণ। রাজ্য পুলিশ আন্দোলনকারীদের পিটিয়ে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। পুরো মানভূমে এই পুলিশী নির্যাতন আর গ্রেফতার চলতে থাকে টুসু সত্যাগ্রহের মাস জুড়ে।
এই সময় বিহারের জননিরাপত্তা আইনের ৯-এর (৫) ধারায় ১৭ জন টুসু সত্যাগ্রহীকে এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৪৩ (বেআইনী জনসমাগম), ২২৫ (সরকারি হেফাজত থেকে আসামী ছিনিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা) এবং ১৮৬ (সরকারি কাজে বাধা দান) ধারায় লোকসেবক সংঘের কর্ণধার অতুলচন্দ্র ঘোষ, লোকসভা সদস্য ভজহরি মাহাতো, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, অশোক চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। তিয়াত্তর বছর বয়সী, নিম্ন রক্তচাপ ও ব্রঙ্কাইটিসের রোগী, স্বাধীনতা সংগ্রামী অতুলচন্দ্র ঘোষকে পুরুলিয়া জেলে তৃতীয় শ্রেণীর বন্দীদের সাথে রাখা হয়,এরপর খোলা ট্রাকে চাপিয়ে ১৩৫ কিলোমিটার দূরের হাজারীবাগ জেলে স্থানান্তর করা হয়। লোকসভা সদস্য ভজহরি মাহাতোকে সাধারণ অপরাধীদের সাথে হাতে হাতকড়া দিয়ে,কোমরে দড়ি বেঁধে আদালতে আনা হয়। বিচারে তাঁর ১১ মাসের কারাদণ্ড হয়। লাবণ্যপ্রভা ঘোষকে ১ মাসের কারাদণ্ড ও ১০০ টাকা জরিমানা, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সমরেন্দ্র ওঝাকে ১ বছরের কারাদণ্ড ও ১,০০০ টাকা জরিমানা, অরুণচন্দ্র ঘোষসহ পাঁচজনকে ১৪ মাসের কারাদণ্ড, অশোক চৌধুরী, রামচন্দ্র অধিকারী ও শ্রীশচন্দ্র ব্যানার্জীকে ১ বছর করে কারাদণ্ড এবং আরও ২৩ জন আন্দোলনকারীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। বাবুলাল মাহাতো নামের পনের বছরের এক জন্মান্ধ কিশোরকে ৩ মাসের কারাদণ্ড ও ২০০ টাকা জরিমানা, এবং নয় বছরের বালক সুধন্বা মাহাতোকে ৯ মাসের কারাদণ্ড ও ১,০০০ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানার টাকা আদায়ের জন্য ২১শে ফেব্রুয়ারী সুধন্বাদের বাড়িতে পুলিশ মালামাল ক্রোক করার চেষ্টা চালায়। জরিমানার টাকা আদায়ের নামে পুলিশ মানবাজার থানার পিটিদারী গ্রামের দণ্ডপ্রাপ্ত আন্দোলনকারীদের বাড়িতে তালা ভেঙে মালামাল ক্রোক করার চেষ্টা চালায় এবং বাড়ির নারীদের প্রতি আপত্তিকর আচরণ করে।
এই পর্যায়ে মানভূমে বাংলাভাষী ও হিন্দীভাষীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। বিহার রাজ্য সরকারের মদদপুষ্ট হিন্দীভাষী গ্রুপগুলো হিংসার আশ্রয় নিতে থাকে। বাংলা স্কুলে আগুন দেয়া, বাঙালীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে। বিহার রাজ্য সরকার স্কুলগুলোতে বাংলা পড়ানো বন্ধ করে দিয়ে হিন্দীকে শিক্ষা ও কাজের জন্য বাধ্যতামূলক ভাষা করার নির্দেশ দেয়। স্কুলগুলোতে গণহারে হিন্দীভাষী শিক্ষক নিয়োগ করা হয়, বাঙালী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হিন্দীভাষী জেলাগুলোতে বদলী করা হয়। মানভূমে হিন্দী ভাষার প্রসারের জন্য ৩০ লক্ষ টাকার থোক বরাদ্দ দেয়া হয়।
বিহারে বাংলা ভাষাসংক্রান্ত পরিস্থিতি ও বাংলা ভাষাভাষীদের অবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৫৪ সালের ৫ই জুলাই পাটনায় এক বিশেষ সভার আয়োজন করা হয়। সেখানে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কৃষ্ণ সিংহ, রাজস্বমন্ত্রী কৃষ্ণবল্লভ সহায়, শিক্ষাসচিব বদ্রীনাথ শর্মা, তথ্যসচিব মহেশপ্রসাদ সিংহ; পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় ও পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি অতুল্য ঘোষ অংশগ্রহন করেন। সভা শেষে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় সাংবাদিকদের যা জানিয়েছিলেন তা ছিল হতাশাজনক। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের ভাষ্য, বিহার রাজ্য সরকার বিহারে বাংলা ভাষার স্বার্থ সংরক্ষণে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে,এক্ষেত্রে আরও উন্নতি দেখা যাবে। বাঙ্গালী ছাত্রদেরকে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের জন্য বিহার রাজ্য সরকার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছে। বাংলা ভাষা নিয়ে বিহার সরকারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো সত্য নয়,এবং এগুলোর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। এর বাইরে আরও যেসব অভিযোগ করা হয়েছে বিহার রাজ্য সরকার শীঘ্রই সেগুলোর তদন্ত করে উত্তর জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রধান ব্যক্তিদের এহেন আচরণে আসলে অবাক হবার কিছু নেই। যেখানে ডঃ রাজেন্দ্রপ্রসাদের মাপের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ বিহার রাজ্য সরকার এবং বিহার প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি হিন্দীর প্রসার ও মানভূমের বিহারভুক্তির জন্য যথাসাধ্য সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন এবং বিহারের স্বার্থ সংরক্ষণকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন সেখানে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি শুরু থেকে কেন্দ্রতোষণ ও হিন্দীর ব্যাপারে নতজানু নীতি নিয়ে রেখেছিল। এই জন্য মানভূমের পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বা পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি কখনো কোন উদ্যোগ নেয়নি। ঐ সময়ে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে কংগ্রেস ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক দলের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে বামদের শক্তি অর্জন করতে তখনো অনেকটা পথ বাকী ছিল,তাই মানভূম আন্দোলনে বামদের বিচ্ছিন্ন অংশগ্রহন থাকলেও তা গোটা রাজ্য জুড়ে কোন সম্মিলিত বা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।
দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য বিভাজনের প্রশ্নটি নানা প্রদেশে উত্থাপিত হতে থাকে এবং ছোট বড় আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। বিশেষত, মহারাষ্ট্র, বোম্বে, মাদ্রাজে এই প্রশ্নে আন্দোলন শুরু হয়। কয়েক বছর ধরে চলা এইসব আন্দোলনের আগুনে ঘি পড়ে যখন ১৯৫২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তেলেগুভাষী রাজ্যের দাবিতে আমরণ অনশন করা পোত্তি শ্রীরামুলু মারা যান। এই প্রেক্ষিতে ১৯৫৩ সালে তেলেগুভাষীদের রাজ্য অন্ধ্র প্রদেশ গঠিত হয়। অন্ধ্রের সাফল্য দেশজুড়ে আরও নতুন রাজ্য গঠন বা পুনর্গঠনের দাবিকে আরও জোরালো করে। এইসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই তাছাড়া প্রশাসনিক সুবিধা,প্রতিরক্ষা ইত্যাদি কৌশলগত কারণে রাজ্য গঠন ও পুনর্গঠন প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি স্যার সৈয়দ ফযল আলী, কূটনীতিক কভালাম মাধব পানিক্কর এবং রাজনীতিক ডঃ হৃদয় নাথ কুঞ্জরু’র সমন্বয়ে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৫৫ সালে এই কমিশন ভারতকে ১৬টি রাজ্য ও ৩টি ইউনিয়ন টেরিটোরিতে পুনর্বিভাজন করে। ১৯৫৬ সালে কমিশনের সিদ্ধান্ত আইনে পরিণত হয়।
মানভূমের পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখার জন্য রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সদস্য কভালাম মাধব পানিক্কর ও ডঃ হৃদয় নাথ কুঞ্জরু ১৯৫৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি মানভূমে আসেন। জেলা কংগ্রেস কমিশনের কাছে মানভূমকে বিহারের অন্তর্ভূক্ত রাখার দাবি জানায়। পক্ষান্তরে লোক সেবক সংঘ মানভূমকে বাংলার অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানায়। এই পর্যায়ে বিহার রাজ্য সরকার একটু কৌশলের আশ্রয় নেয়। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দামোদর নদীর দক্ষিণের বোকারো থানায় ভবিষ্যত ইস্পাত নগরী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। বোকারো যেন বিহারের ভাগে পড়ে এজন্য বিহার রাজ্য সরকার মানচিত্রে দামোদরের শাখা নদী গার্গকে দামোদর হিসেবে দেখিয়ে বোকারোকে ধানবাদের অংশ হিসেবে দাবি করে। এমনকি গার্গ নদীর পশ্চিম তীরের চাষ ও চন্দনকিয়ারী থানাকেও ধানবাদের অংশ হিসেবে দেখানো হয়। অথচ ধানবাদ দামোদরের উত্তর তীরে এবং বোকারো, চাষ ও চন্দনকিয়ারী দামোদরের দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। রাজ্য সরকারের এই কৌশলের কথা প্রকাশিত হয় যখন দিল্লীতে কংগ্রসের বিশেষ অধিবেশনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ ধানবাদ ও ধলভূম মহকুমা বাংলায় অন্তর্ভূক্ত হতে যাচ্ছে কিনা এই প্রশ্ন উত্থাপন করেন। এই দুই মহকুমার বাংলায় অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আযাদ সমর্থন করলেও রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ এর বিরোধিতা করেন। ফলে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ পুনর্গঠন বিষয়ে ধানবাদ বিহারে রেখে দেয়ার ব্যাপারটি অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হতে থাকে। ১৯৫৫ সালের ১০ই অক্টোবর কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করে।
মানভূমের ভাগ্যের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় ১৯৫৬ সালের এপ্রিলে লোক সেবক সংঘের আন্দোলনকারীরা কলকাতা অভিমুখে পদযাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। ২০শে এপ্রিল অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে সাড়ে তিনশ’ নারীসহ হাজার দেড়েক আন্দোলনকারী দশটি বাহিনীতে ভাগ হয়ে পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে পদযাত্রা শুরু করেন। নারীদের বাহিনীটির নেতৃত্বে ছিলেন বাসন্তী রায়। পদযাত্রা বাঁকুড়া, বেলিয়াতোড়, সোনামুখী, পাত্রসায়র, খণ্ডঘোষ, বর্ধমান, রসুলপুর, মেমারী, পাণ্ডুয়া, মগরা, চুঁচুড়া, চন্দননগর, গোঁদলপাড়া, শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়া, হাওড়া পেরিয়ে ষোল দিন পর ৬ই মে কলকাতায় উপস্থিত হয়। ধলভূমকে বাংলার অন্তর্ভুক্ত করার দাবীতে গড়া মুক্তি পরিষদের ১৭৫ জন আন্দোলনকারী বঙ্কিমচন্দ্র চক্রবর্তী ও কিশোরীমোহন উপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ধলভূম থেকে পদযাত্রা শুরু করে ৫ই মে কলকাতা পৌঁছে হাজরা পার্কে সভা করেন। নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সভাপতিত্বে ঐ সভায় সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, সাতকড়ি রায় বক্তব্য রাখেন। ৬ই মে অতুলচন্দ্র ঘোষের সভাপতিত্বে মানভূমের আন্দোলনকারীরা কলকাতার ময়দানে জনসভা করেন। কলকাতাবাসীদের পক্ষ থেকে হেমন্তকুমার, জ্যোতি বসু, মোহিত মৈত্র, সুরেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট নাগরিকগণসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ উপস্থিত হয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। ৭ই মে আন্দোলনকারীরা অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে ডালহৌসীতে (বি-বা-দী বাগ) সমাবেশ করেন। সমাবেশ যেন না হতে পারে এজন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার আগে থেকের ১৪৪ ধারা জারী করে রেখেছিল। ফলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে পুলিশ ৯৬৫ জন আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করে কলকাতা প্রেসিডেন্সী জেল, আলীপুর সেন্ট্রাল জেল ও আলীপুর স্পেশাল জেলে পাঠায়। বারো দিন পর তাঁরা মুক্তি পান। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থানে প্রায় ৩,৩০০ আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করা হয় যারা প্রধানত লোক সেবক সংঘ অথবা বাম দলগুলোর কর্মী ছিলেন।
রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন তাদের রিপোর্টে মানভূমের বাংলাভাষী অধ্যুষিত ১৯টি থানা নিয়ে পুরুলিয়া জেলা গঠন করে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে। একইসাথে মানভূমের ধানবাদ মহকুমার ১০টি থানা ও পুরুলিয়া মহকুমার ২টি থানা বিহারের অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। এই পর্যায়ে টাটা আয়রন এন্ড স্টিল কোম্পানীর কর্ণধার জেহাঙ্গীর রতনজী দাদাভয় টাটা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়কে অনুরোধ করেন পুরুলিয়া মহকুমার পতমদা, চন্দ্রিল আর ইছাগড় থানা যেন বিহারে থাকে। এরকম অনুরোধের কারণ সম্ভবত জামশেদপুরে অবস্থিত টাটাদের স্টিল আর মোটর কারখানাসহ অন্যান্য স্থাপনা যেন হিন্দী বলয়ের ভেতরে থাকে এমনটা নিশ্চিত করার জন্য। বিহারের রাজধানী পাটনায় জন্মানো ও বড় হওয়া ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় আর পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কংগ্রেস টাটার এমন অনুরোধ মেনে নেয়। কী যুক্তিতে বা কী কারণে তারা অমন দাবি মেনে নিয়েছিল তা অজ্ঞাত। ফলে বাংলাভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও পতমদা, চন্দ্রিল আর ইছাগড় থানা বিহারের অংশ হয়ে যায়। এতে দালমা ও চন্দ্রিল-গামারিয়া বনভূমি, ডিমনা হ্রদ ও সুবর্ণরেখা নদীর মধ্যাংশ বিহারে চলে যায়।
মানভূমের মতো ধলভূমকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল মুক্তি পরিষদ। ধলভূমে হিন্দী, ওড়িয়া বা সাঁওতালী ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী থাকলেও সেখানে বাংলাভাষীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ একই প্রকার রাজনীতির চালে পড়ে ধলভূম ও সিংভূমকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে পশ্চিমবঙ্গ জামশেদপুরের মতো শিল্পোন্নত ও সমৃদ্ধ নগর হারায়।
অবশেষে ১৯৫৬ সালের ১লা নভেম্বর মানভূমের পূর্বাংশ ‘পুরুলিয়া জেলা’নামে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভূক্ত হয়।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত চলা আন্দোলন মানভূমকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে হলেও এর মূলটা ছিল নিহিত ভাষার বিভাজনে। আন্দোলনের সূত্রপাত এবং সংগঠনের মূলে ছিল ভাষার আন্দোলন। বাংলাদেশের ভাষার আন্দোলনে যে চেতনার বীজ উপ্ত হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তার সফল সমাপ্তি ঘটে; পক্ষান্তরে মানভূমে ভাষার আন্দোলন পরিণতিতে মানভূমের পূর্বাংশকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করে সমাপ্ত হয়। মানভূমের ভাষার লড়াইয়ে কাউকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়নি সত্য তবে প্রায় ৯ বছর ধরে চলা আন্দোলনে লাখ লাখ মানুষকে নানা প্রকার অন্যায়-অবিচার-বঞ্চনা-অত্যাচার সইতে হয়েছে। হাজার হাজার জনকে জেলজুলুম আর পুলিশী নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। মানভূমের ভাষার আন্দোলন মানভূমবাসীর জন্য গৌরবের বিষয় তো বটেই সারা পৃথিবীর বাংলাভাষাভাষী মানুষ এই গৌরবের অংশীদার। কিন্তু কালে কালে মানভূমের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস মোটামুটি সাধারণের জানার বাইরে চলে গেছে। ২০০৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পাকবিড়রাতে ভাষা আন্দোলনের স্মারক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই মোতাবেক স্মারক নির্মাণের কাজ এক সময় শুরু হলেও আজ অবধি সেটা সমাপ্ত হয়নি। বাংলাদেশ তো দূরে থাক পুরুলিয়ার বাইরে খোদ পশ্চিমবঙ্গেও সরকারী বা বেসরকারীভাবে মানভূমের ভাষা আন্দোলন নিয়ে বার্ষিক কোন অনুষ্ঠান বা আলোচনা হয় না। পুরুলিয়ার সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে মানভূমের ভাষা আন্দোলন অন্তর্ভুক্ত হলেও সেটা গোটা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষায়তনগুলোর পাঠ্যপুস্তকে ঠাঁই পায়নি। অতুলচন্দ্র ঘোষ,লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, ভজহরি মাহাতো, ভাবিনী মাহাতোদের মতো শত শত ভাষাসৈনিক তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা পাননি।
বাংলা এক আশ্চর্য ভাষা! এই ভাষাভাষীদের নিজের মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য লড়তে হয়েছে অখণ্ড বাংলার পশ্চিম সীমান্তের মানভূম থেকে পূর্ব সীমান্তের বরাক উপত্যকা পর্যন্ত। জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে দফায় দফায়। অত্যাচার-নির্যাতন সইতে হয়েছে বছরের পর বছর ধরে। লড়তে হয়েছে উর্দু, হিন্দী আর অহমীয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে। জানি না পৃথিবীতে আর কোন ভাষার জন্য এমন বার বার, নানা জায়গায়, নানা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে লড়তে হয়েছে কিনা। আসামে বাংলা ভাষার যথাযথ অধিকারের লড়াই সম্ভবত আরও অনেকদিন ধরে চালিয়ে যেতে হবে। অদূর ভবিষ্যতে একই প্রকার লড়াই হয়তো চালাতে হতে পারে ত্রিপুরা, মেঘালয় ও ঝাড়খণ্ডে। কে জানে যুক্তরাজ্য তার ‘চক্ষু-কর্ণ দুইটি ডানায়’ ঢাকলে হয়তো লড়াই চালাতে হতে পারে লন্ডনেও।
তথ্যসূত্রঃ
১. Bengal District Gazetteers – Manbhum, H. Coupland, Bengal Secretariate Book Depot, 1911
২. টুসুর গানে মানভূম, সম্পাদনা অরুণচন্দ্র ঘোষ, ১৯৫৪
৩. Rajendra Prasad, first President of India, Kewalram Lalchand Panjabi, Macmillan, 1960.
৪. Role of Women in the Freedom Movement in Bengal, 1919-1947: Midnapore, Bankura, and Purulia District, Niranjan Ghosh, Tamralipta Prakashani, 1988
৫. Local Politics and Indian Nationalism, Purulia, 1921-1947, Jayanta Kumar Dab, Progressive Publishers, 2007
৬. The Promise of Power: The Origins of Democracy in India and Autocracy in Pakistan, Maya Tudor, Cambridge University Press, 2013
৭. ভাষা স্মারক অর্ধসমাপ্তই, অবহেলায় ছড়াচ্ছে ক্ষোভ, সমীর দত্ত, আনন্দবাজার, ২০১৫
৮. নীরবে পার পুরুলিয়ার জন্মদিন — ক্ষোভ নানা মহলে, সমীর দত্ত ও প্রশান্ত পাল, ২০১৫
৯. ভাষা-আন্দোলন দেশে দেশে, উত্তম কুমার রায়,পরিবর্তন, ২০১৭
১০. পুরুলিয়া জেলার ওয়েবসাইট
মন্তব্য
অনেক খেটে চমৎকার একটা লেখা দাঁড় করিয়েছেন। এটা আরও মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া উচিত। অবশ্য, ইতিহাসকে "কার্পেটের তলে" লুকিয়ে রাখতে চাইবে অনেকেই।
দুর্ভাগ্য হল, শাসনদন্ড হাতে পেলে দুর্বলের উপর চড়াও হওয়াটা কেন যেন যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে।
শুভেচ্ছা
[একটা নিক যোগ করে দেবেন লেখায়]
পোস্ট পড়া আর মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ।
শাসকের আচরণ সম্পর্কে আপনার অভিমত ঠিক। মানভূমকাণ্ডে বিহার রাজ্য সরকার ও বিহার প্রাদেশিক কংগ্রেসের আচরণ অপ্রত্যাশিত নয়, বরং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কংগ্রেসের আচরণ হতাশাজনক। স্থানীয় সরকার তার জনগণের ন্যায্য আদায়ের ক্ষেত্রে যদি কেন্দ্রের অনভিপ্রেত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয় তাহলে আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়, জনগণ তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থায় আঞ্চলিক সরকারের এহেন আচরণ শুধু উন্নয়ন বৈষম্যই সৃষ্টি করে না সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ আধিপত্যেরও বিকাশ ঘটায়।
ভাষা আন্দোলনের এই অধ্যায়টা একরকম অজনাই ছিলো। ধন্যবাদ এই চমৎকার তথ্য সমৃদ্ধ লেখাটির জন্য।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
পোস্ট পড়া আর মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ সোহেল ইমাম।
বাংলা নিয়ে মানভূমের এই ইতিহাস জানা ছিল না। 'জনগণের আকাঙ্খা প্রবল ও দাবি জোরালো হয় তাহলে আমরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবো' ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে কমিটি এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেটা কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ না হবার পেছনে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়দের মত বাঙালিদের দায়ী করলে খুব অন্যায় হবে না। আপনি অনেক খেটেখুঁটে লেখাটি দাঁড় করিয়েছেন ভাই। সেজন্য উত্তম জাঝা গ্রহন করেন। আশ্চর্য হলাম এমন লেখায় পাঠক নাই দেখে।
নাম দেননি কেনু রে ভাই? আরো লেখুন ভায়া/ভগ্নি
পোস্ট পড়া আর মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ আয়নামতি। দায়টা শুধু ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বা অতুল্য ঘোষদের ছিল না, সেই সাথে বাকি পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরও ছিল; এবং আন্দোলনটা ১৯৪৯ সালে নয়, ১৯১২ সালে শুরু করা উচিত ছিল যখন বাংলা ভেঙে বিহার-ওড়িষ্যা রাজ্য গঠন করার সময় মানভূম-সিংভূম-ধলভূমকে বিহার-ওড়িষ্যার ভাগে ফেলা হয়েছিল। একটা আয়রনি দেখুন ১৯০৫ সালে বাংলা ভেঙে পূর্ববঙ্গকে আসামের সাথে জুড়ে স্বতন্ত্র রাজ্য গঠন করার সময় পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠায় তার ছয় বছরের মাথায় বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হয়; অথচ তার এক বছরের মাথায় বাংলা ভেঙে যখন বিহার-ওড়িষ্যা রাজ্য গঠন করে মানভূম-সিংভূম-ধলভূমকে বিহার-ওড়িষ্যার ভাগে ফেলা হলো তখন কোন আন্দোলন বাকি বাংলায় গড়ে ওঠেনি। যা কিছু লড়াই সেটা মানভূম-সিংভূম-ধলভূমের মানুষকে করতে হয়েছে। এখান থেকে চল্লিশের দশকে শরৎ বোস-আবুল হাশিমদের অখণ্ড বাংলা গড়ার প্রচেষ্টা কেন মার খেয়েছিল সেটার একটা কারণ আঁচ করা যায়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বর্ণান্ধ, সাম্প্রদায়িক, সুবিধাবাদী শ্রেণীর করায়ত্ত্ব থাকলে গণদাবীকে পাশ কাটিয়ে এভাবে তাদের সুবিধা অনুযায়ী মানচিত্রকে কাটাছেঁড়া করা যায়; অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থে বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
"রাজনৈতিক নেতৃত্ব বর্ণান্ধ, সাম্প্রদায়িক, সুবিধাবাদী শ্রেণীর করায়ত্ত্ব থাকলে গণদাবীকে পাশ কাটিয়ে এভাবে তাদের সুবিধা অনুযায়ী মানচিত্রকে কাটাছেঁড়া করা যায়; অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি স্বার্থে বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে অবিমৃষ্যকারী সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।" - সেইটাই।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
চমৎকার এবং প্রয়োজনীয় লেখা।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
পোস্ট পড়া আর মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ এক লহমা।
বেশ বিস্তারিত লেখা, পরে সময় নিয়ে পড়ব। লেখক কে?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
আশা করি লেখাটা পড়বেন এবং পাঠপ্রতিক্রিয়া জানাবেন।
অতি গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রায় অজ্ঞাত একটি বিষয় তুলে ধরার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। ঠিকই বলেছেন, বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য যে মহাপ্রাণ ব্যক্তিরা মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন, বাংলাকে খণ্ডিত করে তার বিশাল অংশ ভিন্ন রাজ্যে প্রদান করলেও কেন তাঁরা ভবলেশহীন হয়ে রইলেন, এর মধ্যেই আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অনেক প্রশ্নের উত্তর নিহিত রয়েছে। "আমার সোনার বাংলা" কেন মানভুম আর বরাক উপত্যকার ব্যাপারে এমন নির্লিপ্ত রইল, সেটাও বোধ হয় ভাল করে ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
নতুন মন্তব্য করুন