মাঝে মাঝে তব

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৫/০৩/২০১৭ - ৪:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার হাতে যদি কখনো একটা টাইম মেশিন এসে পড়ে আর তাতে করে যদি অতীতে ফেরার সুযোগ দেয়া হয়,আমি দ্বিধায় পড়ে যাব।আমি কেন, বেশির ভাগ মানুষের তাই হবার কথা,কারন কোনটা ছেড়ে কোনটা বাছব সেই জাতীয় সমস্যা এটা।তবে ইদানিং মনে হয় একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরে ফিরতে পারাটাই সবচেয়ে দারুণ ব্যাপার হবে।স্বাধীনতার এগার বছর পর আমার জন্ম,একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর আমি দেখিনি,কিন্তু কল্পনা করতে পারি সেদিন বিকেল সাড়ে চারটায় রেস্কোর্সে উপস্থিত থাকা বাংগালীদের জীবনে এর চেয়ে রোমাঞ্চকর মুহুর্ত বেশি আসেনি!অন্তত গত কয়েকশ বছরে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের এই ভুখন্ডের মানুষের জীবনে এর চেয়ে বড় কোন অর্জন কি আছে?সন্দেহ নেই,অসংখ্য লাশ আর রক্তগঙ্গা পেরিয়ে সে অর্জন,অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো সব কিছু ছাপিয়ে শোকই বড় হয়ে উঠেছিল...তবুও!

আমি আয়নায় নিজেকে কিংবা আমার চারপাশের বাংলাদেশিদের যত দেখি,একাত্তর আমার কাছে তত অলীক মনে হয়!এই অলস,স্বার্থপর, নৈতিকতাহীন,সারা বছর দলাদলি করে বেড়ানো আমাদেরকে আর যাই হোক যোদ্ধা মনে হয়না।তাহলে মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর আগে আমাদের পুর্বপুরুষের মাঝে সেই দুর্ধর্ষ যোদ্ধারা কোথা থেকে ভর করেছিল?আমাদের চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য যে আমরা একদম ঠিক সময়ে বঙ্গবন্ধু আর তাজউদ্দিনের মত দুজন অসাধারন মানুষকে পেয়েছিলাম,কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে তো লড়েছিল আমাদের মতই সাধারন মানুষেরা-তারা এমন অসাধারণ হয়ে উঠল কি করে?হুমায়ুন আহমেদ যে বলেছিলেন আগুনের পরশমনির কথা,সেটা ছোঁয়াল কে?

আমি ভাবতেই পারিনা,এই আমাদেরই মত মানুষেরা মরবে জেনেও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ করে গেছে একাত্তরে,অমানুষিক নির্যাতন করেও তাদের মুখ থেকে সহযোদ্ধার নাম বের করা যায়নি,কোন এক পিতা তার সব পুত্রকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন যারা কেউ আর ফেরেননি।বিধাতার কাছে পিতার তাই নিয়ে কোন অনুযোগ নেই,তার আক্ষেপ স্রষ্টা তাকে আরো কেন ছেলে দিলেননা যাদের তিনি যুদ্ধে পাঠাতে পারতেন!জাহানারা ইমামের মত মায়েরা নিরাপদ জীবন বাদ দিয়ে পুত্রকে যুদ্ধ বেছে নিতে বলেছিলেন!আজ এই ২০১৭ তে এসে মনে হয় সব মিথ্যে,সব কল্পকাহিনী,তা নাহলে সেই সব সুপারহিরোরা আজ সব কোথায়?

একাত্তরের পরের গল্পগুলো বরং অনেক সত্যি মনে হয়।সে গল্প যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে স্বাধীনতার নায়কদের ছবিতে ধুলো জমার গল্প।তাজউদ্দিনকে দূরে ঠেলে বংগবন্ধুর মোশতাককে কাছে টানার গল্প,স্বাধীনতার মহানায়ককে তার নিজের বাড়িতেই সপরিবারে হত্যার গল্প,অদ্ভুত উটের পিঠে চড়ে এক অদ্ভুত আধারে উলটো পথে চলার গল্প।সম্ভবত স্বাধীনতার তীব্র নেশায় মাতাল সাত কোটি মানুষের নেশা কাটার গল্প,খানিকটা কিংবা অনেকটা স্বপ্নভঙ্গের গল্প।

বাংলাদেশ নিয়ে আমি প্রায়ই আশা নিরাশার দোলাচলে থাকি।কখনো মনে হয়, এই যে এত আত্নত্যাগ সবটাই কি মাঠে মারা যাবে?আমি বিশ্বাসী মানুষ,ভাবি শেষ নি:শ্বাসে যে দেশকে ভালবেসে এত মানুষ প্রান দিল,সেই দেশকে স্রষ্টা নিশ্চয়ই আগলে রাখবেন।কিন্তু পরক্ষনেই মনে হয় সেই আত্নত্যাগের প্রতি যে অসম্মান আমরা করেছি তার কথা।এই স্বাধীন দেশেই মন্ত্রীর চেয়ারে বসেছে রাজাকাররা,আমাদেরই ভোটে,আমাদেরই করা ভোটের রাজনীতিতে।স্বাধীনতার পর গুনে গুনে কয়েকজনকে পদক দিয়ে ভুলে গেছি বাকি সবাইকে,মুক্তিযোদ্ধা তাই ভিক্ষে করে,বীরশ্রেষ্ঠের সন্তান তাই ভ্যান চালায়।যুদ্ধের পরপর ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা নারীদের আমরা গ্রহন করিনি,তাদের ঠাই হয়েছে ফুটপাতে,অথাবা গোয়ালন্দের পতিতালয়ে।তাদের পিঠে "নষ্টা"র ছাপ্পা মারতে মারতে নিজেরাই কখন নষ্ট হলাম,টেরই পাইনি!কোথায় যেন এক আদিবাসী নারীর সাক্ষাতকার পড়েছিলাম,একাত্তরে চা বাগানে পাকিস্তানিদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।মাটিতে থুতু ফেলে  তিনি বলেছিলেন -"এই দেশটাকে আমি অভিশাপ দেই!"দেশ নিয়ে যখন হতাশ হয়ে যাই,তখন মনে হয় এই শাপমোচন কক্ষনো হবেনা।একাত্তরে যারা কিছু না কিছু হারিয়েছে,তাদের পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলেও না।

আশা আর হতাশার মধ্যে কাটাকাটি হয়ে সারা বছর মোটামুটি নিউট্রাল থাকি।কিন্তু ছাব্বিশে মার্চ কিংবা ষোলই ডিসেম্বরে আশার পাল্লাটা খানিক ভারি হয়ে ওঠে।সেদিন রাস্তা ঘাটে,বাড়ীর ছাদে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে।সংখ্যা অবশ্য বিশ্বকাপের সময়ে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার পতাকার চেয়ে কম থাকে,তাতে কি?সেদিন রিকশাওয়ালা কিংবা সিএনজিওয়ালা তার "গাড়ি"তে ছোট্ট পতাকা লাগায়,মুদি দোকানিও তার দোকানে ঢাউস পতাকা ওড়ায়।এই দশ বা পঞ্চাশ টাকা সে নিজে থেকেই খরচ করে,এতে তার কাস্টমার বাড়ার কোন কারন নেই।ফেসবুকে পোস্ট দেবার উদ্দেশ্যও তার নেই।সেই দিনগুলিতে মনে হয় আশায় বুক বাধি,শাপমোচন বোধহয় হবে,এত মানুষের এত ভালবাসা কোন একটা মানে খুঁজে পাবে।সেই দিনগুলোতে একাত্তরের রূপকথাও সত্যি মনে হয়,আক্ষেপ হয় প্রতিদিন কেন ছাব্বিশে মার্চ বা ষোলই ডিসেম্বর হয় না!

শুভ ছেচল্লিশতম জন্মদিন,প্রিয় বাংলাদেশ!

-গগন শিরীষ


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

সব ধরনের যতিচিহ্নের পর স্পেস দিন, প্লিজ।

গগন শিরীষ  এর ছবি

ঠিক আছে, হিমু ভাই!

আয়নামতি এর ছবি

হতাশা রাগ কিংবা ক্ষোভে আর যাই ভাবুন না কেন, একাত্তরকে মীথ বা রূপকথা ভাববেন না প্লিজ!

*
পাকি জানোয়ার দ্বারা চা বাগানে নির্যাতিত মায়ের কথা/সাক্ষাতকারটি আপনি কোথায় পড়েছেন মনে পড়লে প্লিজ, প্লিজ, এবং প্লিজ বলবেন। আমি ওটা পড়তে চাই। ধন্যবাদ।

গগন শিরীষ  এর ছবি

ক্ষোভ আর হতাশা থেকেই বলা,রূপকথা ভাবার আর কোন কারন নেই। আর ওই সাক্ষাতকার প্রথম আলো কিংবা ভোরের কাগজে পড়েছিলাম।কোন বিশেষ ক্রোড়পত্রে না,এমনিই সাধারন একটা ছোট সাক্ষাতকার, 'এই জনপদ' বা এরকম কোন একটা পাতায়।এর বেশি কিছু মনে পড়ছেনা বলে দু:খিত।পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

সোহেল ইমাম এর ছবি

অন্য কিছু একটাও হচ্ছে। এই সেদিনে একজন বলছিলো বাঁশেরকেল্লার মত ভালো একটা ওয়েবসাইট সরকার বন্ধ করে দিলো। অন্য সময় এই কিছুদিন আগেও তীব্র প্রতিবাদ করতাম এই কথায় কিন্তু এখন সত্যিই কিছু বলবার ইচ্ছেও হলোনা। কোথাও একটা কিছু হচ্ছে। ৫৭ ধারার শাসনের আড়ালে যারা ভাবছি চুপ করে থাকাই বুদ্ধির কাজ তাদের বুদ্ধি নিশ্চয়ই রক্ষা পেয়ে যাবে কিন্তু হয়তো বাক শক্তিটা আর থাকবেনা। লাল সবুজ একটা পতাকা সব সময়ই উড়বে, এই চেতনা সংরক্ষণে আইনও পাশ হবে আরো কিন্তু এই চেতনার কথা হৃদয় থেকে বলবার মত সবাক মানুষ কয়জন থাকে সেটাই দেখার বিষয়।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

গগন শিরীষ  এর ছবি

সেটা অবশ্য একটা চিন্তার ব্যাপার,কিন্তু আমার মন বলছে যে এই দু:সময় আমরা উতরে যাব ইনশাআল্লাহ।

এক লহমা এর ছবি

মিথ্যে নয়, কল্পকাহিনীও নয়। সুপারহিরোদের লড়াই থামেনি, চলছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

গগন শিরীষ  এর ছবি

সেই ভরসাতেই তো আছি! পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

শুভ জন্মদিন, বাংলাদেশ। হাততালি

হুমায়ুন আহমেদ যে বলেছিলেন আগুনের পরশমনির কথা,সেটা ছোঁয়াল কে?

হু.আ. কবে এটি বলেছেন? চরণটি আদতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। প্রয়াত হু.আ. এর প্রচুর বইয়ের শিরোনাম অবশ্য রবীন্দ্রনাথ (কখনও জীবনানন্দ এবং অন্যান্য) থেকে ধার করা। সেগুলোকে এখন উনার কথন বলে বসলে হৃদয়ে ধাক্কা লাগে ভাই। ভাল থাকুন। হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

গগন শিরীষ  এর ছবি

গানটা রবীন্দ্রনাথের, সেটা জানি ভাই। আমি ঠিক সেই সময়টায় মানুষের বদলে যাবার পেছনের কারনটা খুঁজতে চেয়েছি।সেই কারন হিসেবে হুমায়ুন আহমদের দেয়া আগুনের পরশমনির উপমাটা পছন্দ হয়েছিল,ওরকম কিছু একটা কিছুর ছোঁয়াতেই যেন মানুষগুলো পালটে গিয়েছিল।পড়ার জন্য ধন্যবাদ সাক্ষী ভাই।

মেঘলা মানুষ এর ছবি

চমৎকার এবং ভণিতাবিহীন লেখা, তবে আরেকবার পড়ে পোস্ট করলে বানানের সমস্যাগুলো হয়ত চোখে পড়ত আপনার।
দেশের বড় শত্রু হল দেশের ভেতরেই বসে থাকা কিছু বদমাশ।

শুভেচ্ছা হাসি

গগন শিরীষ  এর ছবি

বানানের ব্যাপারটা সত্যি, এমনিতেই আমি কিঞ্চিৎ কাচা, তার উপর মোবাইলে লিখে মোবাইল থেকেই পাবলিশ করায় অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে মন খারাপ
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।