পর্ব = ৬
(পূর্ববর্তী পর্বের লিঙ্ক গল্পের শেষে)
এই বিস্তির্ন তুষার ঢাকা প্রান্তরে জানালার কপাটগুলো তুলে লাগানোর মত কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু কিল্গাস বললো, “ভান্যিয়া (আইভান নামের সংক্ষিপ্ত রুপ), আমি একটা জায়গার খবর জানি যেখানে দারুন ফেল্টের (Felt : পশম বা লোমকে চেপে তৈরী এক ধরনের মোটা কাপর) রোল আছে যেগুলো ফ্রেমের সাথে জুড়ে ছাদের কাঠামোর অংশগুলো তৈরী হচ্ছে। ওগুলো আমি নিজের হাতে সরিয়ে রেখেছিলাম। চল, ওগুলো চুরি করে নিয়ে আসি।”
কিল্গাস জাতে লাটভিয় কিন্তু রাশান ভাষায় কথাবার্তা বলতে পারে একেবারে স্থানীয়দের মত। ওদের গ্রামের কাছে একটা প্রাচীন মতাদর্শীদের (Old Believers, এরা ১৬৬৬ ইং সনে এই মতাদর্শীরা আদর্শগত বিরোধের কারনে রাশান অর্থোডক্স চার্চ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন করে ফেলেছিল) একটা উপনিবেশ ছিল এবং একারনে শৈশব থেকেই তার রাশান ভাষা শেখা হয়ে গিয়েছিল। তার ক্যাম্পের জীবন মাত্র দুই বছরের, কিন্তু এরমধ্যেই সে সব কায়দা-কানুন বুঝে নিয়েছে। এখানে দাঁত দিয়ে কামড়ে আদায় করে নিতে না জানলে কিছুই পাওয়া যায় না। ওর আসল নাম জোহান এবং সূখোভও ওকে ভান্যিয়া বলেই ডাকে।
এই বিস্তির্ন তুষার ঢাকা প্রান্তরে জানালার কপাটগুলো তুলে লাগানোর মত কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন। কিন্তু কিল্গাস বললো, “ভান্যিয়া (আইভান নামের সংক্ষিপ্ত রুপ), আমি একটা জায়গার খবর জানি যেখানে দারুন ফেল্টের (Felt : পশম বা লোমকে চেপে তৈরী এক ধরনের মোটা কাপর) রোল আছে যেগুলো ফ্রেমের সাথে জুড়ে ছাদের কাঠামোর অংশগুলো তৈরী হচ্ছে। ওগুলো আমি নিজের হাতে সরিয়ে রেখেছিলাম। চল, ওগুলো চুরি করে নিয়ে আসি।”
কিল্গাস জাতে লাটভিয় কিন্তু রাশান ভাষায় কথাবার্তা বলতে পারে একেবারে স্থানীয়দের মত। ওদের গ্রামের কাছে একটা প্রাচীন মতাদর্শীদের (Old Believers, এরা ১৬৬৬ ইং সনে এই মতাদর্শীরা আদর্শগত বিরোধের কারনে রাশান অর্থোডক্স চার্চ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন করে ফেলেছিল) একটা উপনিবেশ ছিল এবং একারনে শৈশব থেকেই তার রাশান ভাষা শেখা হয়ে গিয়েছিল। তার ক্যাম্পের জীবন মাত্র দুই বছরের, কিন্তু এরমধ্যেই সে সব কায়দা-কানুন বুঝে নিয়েছে। এখানে দাঁত দিয়ে কামড়ে আদায় করে নিতে না জানলে কিছুই পাওয়া যায় না। ওর আসল নাম জোহান এবং সূখোভও ওকে ভান্যিয়া বলেই ডাকে।
ওরা রোলটা নিয়ে আসার সিদ্ধান্তই নিল, কিন্তু প্রথমে সূখোভ ছুটে গেল রিপেয়ার-শপের নির্মিয়মান নতুন অংশের দিকে। তাকে তার কর্ণিকটা নিতেই হবে। রাজমিস্ত্রির কাজের জন্য কর্নিক খুবই দরকারী একটা জিনিষ, যদি যেটা হয় হালকা আর ব্যাবহারের জন্য সুবিধাজনক। কিন্তু নিয়ম হচ্ছে কাজ যাই হোক না কেন, কাজ করার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি সকালে দেয়া হয়েছে সেটা প্রত্যেক সন্ধ্যায় ফিরিয়ে দিতে হবে, এবং পরের দিন কি ধরনের যন্ত্রপাতি পাওয়া যাবে সেটা ভাগ্যের বিষয়। যদিও এক সন্ধ্যায় সে টুল-স্টোরের লোকটাকে বোকা বানিয়ে এই কর্ণিকটা মেরে দিয়েছিল, এবং এটা এখন সে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে রাখে এবং প্রতিদিন সকালে ইট গাঁথার কাজ পরলেই সে এটা বের করে আনে। ১০৪ নম্বর দলটাকে “সমানতান্ত্রিক জীবনধারায়” কাজ করতে পাঠালে এই কর্ণিকটা ছাড়াই তাকে কাজ করতে হতো। এখন শুধু একটা ইট সরিয়ে, একটা ফাটলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে সেটা বের করে আনা।। জায়গা মতই আছে, কেল্লা ফতেহ্!
সূখোভ আর কিল্গাস রিপেয়ার-শপ ছেড়ে ছাদের কাঠামোগুলোর দিকে হাঁটতে শুরু করলো। ওদের নিশ্বাসের সাথে মেঘের কুন্ডুলির মত বাষ্প বের হচ্ছে। সূর্যের অবস্থান এখন দিগন্তের সামান্য উপরে, কিন্তু ঘন কুয়াশার জন্য কোন আলোই ছড়াতে পারছে না। দুপাশে আলোর স্তম্ভের মত উঠে গেছে।
“ঠিক খাম্বার মত দেখাচ্ছে, তাই না?” সূখোভ মাথা ঝুঁকিয়ে বললো।
“খাম্বা নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই।” কিল্গাস বলে উঠলো, “শুধু ওগুলোতে তারকাঁটা টানা না থাকলেই হলো।”
হাসি-ঠাট্টা না করে কিল্গাস লোকটা কথাই বলতে পারে না, আর একারনেই দলের সবার কাছেই সে খুব প্রিয়। আর ক্যাম্পের লাটভিয়দের মাঝেও ওর দারুন কদর! এ কথা সত্যি যে ওর খাওয়াদাওয়ার কোন অভাব নেই, মাসে ওর নামে দুটো খাবারের পার্সেল আসে, আর চেহারাসুরতও বেশ লাল টসটসে। মনেই হয় না যে সে ক্যাম্পের কোন বন্দী। ওর মত অবস্থা হলে যে কেউই হাসি-মস্করার মধ্যে থাকতে পারে।
কন্সট্রাশন সাইটটার ব্যাপ্তি বিশাল এলাকা জুড়ে। এমাথা থেকে ওমাথা যেতে বেশ অনেকটা সময় লাগে। পথে ওরা ৮২ নম্বর দলটার মধ্যে দিয়ে পার হলো। এদেরকে আবার মাটিতে গর্ত খোঁড়ার কাজ দেয়া হয়েছে। গর্তগুলো বেশ ছোট ছোট, লম্বায় দেড় মিটার, বেড়ে আধা মিটার, গভীরতাও ততটুকুই। কিন্তু এখানকার মাটি গ্রীষ্মকালেই পাথরের মত শক্ত হয়ে থাকে, আর এখনতো একেবারে তুষারের কবলে। সামান্য আঁচড় কাটাও দুঃসাধ্য! ওরা গাঁইতি দিয়ে চেষ্টা করছে, প্রতিটা ঘাঁইয়ের সাথে আগুনের ফুলঝুড়ি তুলে গাঁইতিগুলো পিছলে পিছলে যাচ্ছে, কিন্তু এক খাবলা মাটিও জায়গা থেকে সরছে না। গর্ত প্রতি একজন করে লোক। দাঁড়িয়ে এদিকওদিক তাকাচ্ছে, কিন্তু গা গরম করার কোন ব্যবস্থাও কোনদিকে নেই। এক পা এদিকওদিক নড়াচড়া করারও অনুমতি নেই। সুতরাং আবার গাঁইতি চালাও, গা গরম রাখার এটাই একমাত্র উপায়।
সূখোভ ওদের একজনকে চিনতে পারলো, ভিতকা অঞ্চলের লোক।
“এই যে মজুর, শোন”, সে তাকে উপদেশ দিল, “প্রত্যেকটা গর্তের জায়গায় বরং আগুন জ্বালাও, মাটি নরম হয়ে আসবে।”
“এটা করা নিষেধ” বললো লোকটা, “ওরা আমাদের কোন জ্বালানীকাঠ দেয় না”।
“তাহলে কিছু চুরি করে আন”, বলেই কিল্গাস থুক করে ছোট একদলা থুতু ছুঁড়ে ফেললো।
“তুমি কিভাবে এরকম ভাবো, ভান্যিয়া? কতৃপক্ষের যদি বিন্ধুমাত্র কান্ডজ্ঞান থাকতো, তাহলে কি ওরা এই তুষারের মধ্যে এভাবে লোকগুলোকে শুধু গাঁইতি দিয়ে এভাবে মাটি ঠোকরানোর জন্য পাঠাতো?”
তারপর সে বিড়বিড় করে কি সব দুর্বোদ্ধ শপথ নিয়ে চুপ মেরে গেল। এই তীব্র শীতের মাঝে খুব বেশী কথা মুখে আসে না। ওরা হাঁটতেই থাকলো যতক্ষন না তারা তুষারের নিচে কবর-চাপা হওয়া ছাদ তৈরীর প্যানেলগুলোর কাছে পৌঁছুলো।
কিল্গাসের সাথে কাজ করতে সূখোভের বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু কিল্গাসের একমাত্র খারাপ দিক হচ্ছে সে ধূমপান করে না, আর তার পার্সেলগুলোতেও তামাকের চালান থাকে না।
কিল্গাসের কথাই ঠিক। ওরা কয়েকটা তক্তা নিয়ে ওগুলোর উপর রুফিং-ফেল্টের রোল চাপিয়ে দিলো। তারপর কানায় ধরে তুলে নিল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ওরা এগুলো বয়ে নিবে কিভাবে? ওয়াচ টাওয়ার থেকে ওদের দেখে ফেলবে। অবশ্য সেটা কোন ব্যাপার না। ওখানকার “তোতাপাখিগুলোর” মাথা ব্যাথা হচ্ছে কোন বন্দী যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা। এলাকার ভেতরে সব প্যানেল কুপিয়ে জ্বালানী কাঠ বানিয়ে ফেললেও ওদের কিছু যায় আসে না। কোন গার্ডের সামনে পড়ে গেলেও কোন অসুবিধা নেই। সেও অন্যদের মতই কোন কিছু চুরি করে হাতিয়ে নেয়া যায় না কি সে ধান্দাতেই ব্যাস্ত। আর কয়েদীদের কথা চিন্তা করলে, এই ছাদ তৈরীর অংশগুলো নিয়ে ওদের কোন মাথা ব্যাথাই নেই। এগুলোর দিকে নজর রাখার দায়িত্বে আছে শুধু ওই দ্ব্যার নামের বেসামরিক শুয়োর সুপারিন্ট্যান্ডেন্ট, আর লিকিলিকে লম্বু অপদার্থ ষ্কুরোপাতেংকো, এই টুকরোগুলো যাতে চুরিচামারি না হয়ে যায় সেজন্য নিজেদের বিশ্বস্ত লোক মনে করে যাকে এগুলো পাহারা দেয়ার সাময়িক দায়িত্ব দিয়েছে কতৃপক্ষ। ঠিক, এগুলো আড়াআড়ি ভাবে বয়ে নিয়ে গেলে এই ষ্কুরোপাতেংকোর চোখেই ধরা পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী।
“দেখ ভান্যিয়া,” সূখোভ বললো, “এগুলো আড়াআড়ি ভাবে বয়ে নিয়ে যাওয়াটা আমাদের উচিত হবে না। বরং দু’প্রান্তে ধরে লম্বালম্বি করে দুজনের বাহুর মাঝখানে করে নিয়ে যাই। বয়ে নিতেও সুবিধা হবে, আবার আমাদের শরীরের কারনে ঢাকা পড়েও থাকবে। দূর থেকে দেখে বোঝাও যাবে না।”
এই বুদ্ধিটা বেশ কাজ়ের। আড়াআড়ি ভাবে বয়ে নিয়ে যাওয়াটা কেমন যেন বেখাপ্পা দেখায়। তাই ওরা ওটাকে দুজনের মাঝে লম্বালম্বি করে ধরে রওনা দিল। দূর থেকে দেখে মনে হবে যেন তিনজন লোক গায়ে গা লাগিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।
“কিন্তু দ্ব্যার যখন জানালার মধ্যে ফেল্টগুলো লাগানো দেখবে তখন সে ঠিকই বুঝে যাবে এগুলো কোত্থেকে এসেছে”, সূখোভ বললো।
“এর সাথে আমাদের কি সম্পর্ক?”, কিল্গাস আশ্চর্য হয়ে বললো, “আমরা বলবো এগুলো আগে থেকেই এখানে ছিল। এখন আমরা কি এগুলো নিয়ে যাবো, নাকি না?” ওর কথাটাই ঠিকই আছে।
ছেঁড়া মিটেন্সের ভেতর সূখোভের আঙ্গুলগুলো অসাড় হয়ে আছে। কোন অনুভূতিই যেন নেই। কিন্তু ওর বাঁ-পায়ের বুটটা এখনও ঠিকঠাক আছে, সেটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কাজ করা শুরু করলে আঙ্গুলের অসাড়তা ঠিকই কেটে যাবে।
ওরা বিস্তির্ণ নবীন তুষারের ঠেলে হাটতে হাটতে টুল-স্টোর থেকে পাওয়ার স্টেশন পর্যন্ত চলে যাওয়া একটা স্লেজ টানা পথের চিহ্নের কাছে এসে পৌঁছুলো। তাদের দলের লোকেরা নিশ্চয়ই এই পথে সিমেন্ট নিয়ে গেছে। পাওয়ার স্টেশনটা সাইটের একেবারে প্রান্তে। বহু সপ্তাহ এর ধারেকাছে কেউ আসে নি, আর তাই এর যাওয়ার পথটাও মসৃন তুষারের চাদরে ঢাকা পড়ে আছে। সদ্য স্লেজ টেনে যাওয়ার চিহ্ন আর ১০৪ নম্বর দলের গভীর পায়ের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। দলের লোকেরা ইতিমধ্যে কাঠের বেলচা দিয়ে বিল্ডিঙের আশপাশ থেকে তুষার সরানো আর লরি চলাচলের জন্য পথ তৈরীর কাজ শুরু করে দিয়েছে।
মালপত্র উপরে টেনে তোলার যন্ত্রটা ঠিকঠাক থাকলে খুব ভালো হতো। কিন্তু ওটার মোটরটা আগেই জ্বলে গেছে, আর ওটা সারাইয়ের কোন ব্যাবস্থাও কেউ করে নি। তার মানে, মালমসলা, ব্লক থেকে শুরু করে সবই দোতালায় বয়ে নিয়ে তুলতে হবে।
গত দু’মাস ধরে তুষারের মধ্যে অসমাপ্ত দালানের কাঠামোটা একটা ধূসর কঙ্কালের মত দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেভাবে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল, সেভাবেই। আর এখন এটাতে এসেছে ১০৪ নম্বর দল। কিন্তু ওদেরকে কাজে উৎসাহী করতে পারে এরকম কিই বা এর মাঝে আছে? দড়ির বেল্ট দিয়ে আঁটোসাঁটো করে প্যাঁচিয়ে রাখা শূন্য উদর! ফাটতে থাকা বরফ! নেই কোন শরীর উষ্ণ রাখার ব্যাবস্থা, একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গও না! কিন্তু এখন এখানে ১০৪ নম্বর দলটা আসাতে দালানটা জীবন ফিরে পেয়েছে।
মেশিন-রুমে ঢোকার দরজার সামনে আনত না আনতেই মশলা মেশানোর পাত্রটা ভেঙ্গে টুকরো হয়ে গেল। ওটার অবস্থা এমনিতেই জরাজ়ীর্ণ ছিল, এবং সূখোভও আশা করে নি যে ওটাকে এতদুর আস্ত অবস্থায় আনা যাবে। তিউরিন অভ্যাসবশতই লোকজনের উপর খানিক চোটপাট করলো, কারন সে নিজের বুঝতে পারছে যে এখানে কাউকে দোষ দেয়ার কিছু নেই। ঠিক সেই মুহুর্তেই রুফিং-ফেল্টের রোলটা নিয়ে ওখানে হাজির হলো কিল্গাস আর সূখোভ। তিউরিনও ওদের দেখে বেশ খুশি হলো, এবং তক্ষুনি একটা নতুন ব্যবস্থার পরিকল্পনা করে ফেললো। সূখোভকে দায়িত্ব দেয়া হলো উনুনের পাইপটা ঠিক করার যাতে দ্রুত আগুনের ব্যাবস্থা করা যায়, কিল্গাসের কাজ দুই এস্তনিয়র সহায়তা নিয়ে মশলা মেশানোর বাক্সটা ঠিক করা, আর সেনেকাকে একটা কুঠার দেয়া হলো কাঠের লম্বা ফালি চিড়ে ফেলার জন্য যাতে ফেল্টগুলো পেরেক ঠুকে ওগুলোর সাথে জুড়ে দেয়া যায়, প্রতি জানালার জন্য দুই প্রস্থ করে। কিন্তু কাঠের ফালিগুলো আসবে কোথা হতে? তিউরিন চারদিকে তাকালো। সবাই তাকালো। সমাধান একটাই, দোতালায় উঠার জন্য যে ঢালটা তৈরি করা হয়েছে সেটার হালকা রেলিং হিসেবে যে কয়টা তক্তা লাগানো আছে সেগুলো খুলে ফেলা। সেক্ষেত্রে সাবধানে চোখ রেখে উঠানামা করতে হবে। নাতো কিনারা থেকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এছাড়া তক্তা পাওয়ার অন্য উপায়ই বা কি আছে?
মনে প্রশ্ন আসতে পারে, দীর্ঘ দশ বছর ধরে ক্যাম্পের বন্দীরা কেন নিজেদের নিংড়ে দিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে থাকে? মনে হতে পারে যে ওরা বলবে, “ধন্যবাদ, কারন আর কিছুই না। আমরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজের মধ্যে কাটিয়ে দেই, কারন রাতের সময়টা একেবারে আমাদের নিজস্ব।”
কিন্তু আসল কারন সেটা না। প্রকৃতপক্ষে বন্দীদের বোকা বানানোর জন্য ওরা বিভিন্ন দলে ভাগ করে দেয়ার কৌশল তৈরি করেছে। কিন্তু এই দল স্বাভাবিক স্বাধীন জীবনযাপনকারী মানুষের দলের মত না, যেখানে সবাই যার যার কাজের জন্য পাওনা পায়। এখানে ক্যাম্পের সবকিছু এমনভাবে সাজানো যে বন্দীরা প্রত্যেকে একে অপরকে কাজ করার জন্য প্ররোচিত করতে থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম, হয় দলের সবাই কাজের জন্য অতিরিক্ত কিছু পাবে, অথবা সবাইকে অসন্তুষ্ট থাকতে হবে। “এই ব্যাটা অলস ছুঁচো, তোর জন্য আমি না খেয়ে থাকবো না কি? উঠে গতর খাটিয়ে কাজ়ে নেমে পড়, ময়লা গাঁদ কোথাকার!”
অবস্থা যদি এরকমই হয় তবে তার সাথে আরো অনেক বিষয়ই যোগ হয় আলসেমি করার লোভকে দূরে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার মত। ইচ্ছে হোক, আর নাই হোক, কাজ করে যেতেই হবে। কারন, সে তুমিই হও বা অন্য যে কেউ, কাজ করা ছাড়া শরীর উষ্ণ করার আর কোন কায়দা খুঁজে বের করতে না পারলে, জায়গাতেই জমে পটল তুলতে হবে।
পালভো যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছে। এবার এগুলো নিয়ে কাজে নেমে পড়ার সময়। কয়েকটা লম্বা স্টোভ-পাইপের টুকরোও এনেছে। ওগুলোতে টিনের মিস্ত্রীর কাজ করার উপযুক্ত যন্ত্রপাতি নেই সত্যি, কিন্তু একটা ছোট হাতুড়ি আর একটা হালকা কুঠার আছে। ওগুলো দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়া যাবে।
সূখোভ মিটেন্স পরা দু’হাতে তালি দিয়ে তারপর পাইপের টুকরোগুলোর প্রান্তগুলো জোড়া দিয়ে ওগুলো হাতুড়ি পিটিয়ে জুড়ে দিল। সে আবার হাততালি দিয়ে হাতুড়ি পেটানোর কাজ চালিয়ে যেতে লাগলো। (সে তার কর্ণিকটা একটা কাছাকাছি ফাটলের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে। যদিও সবাই এখানে নিজেদের লোক, তারপরেও বলা যায় না, কেউ হয়তো নিজেরটার সাথে বদলে নিতে পারে। সেটা কিল্গাস হওয়ার সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।)
এরপর তার মাথা থেকে সব চিন্তা দূর হয়ে গেল। সকল স্মৃতি, সব চিন্তা অস্পষ্ট হয়ে আসলো। তার মাথায় শুধু একটাই ভাবনা, কিভাবে পাইপের বাঁকগুলোকে ঠিক করে এটাকে ঝুলিয়ে দেয়া যায় যাতে ধোঁয়া বেরুনো বন্ধ হয়। সে গপচিককে পাঠালো এক টুকরো তার নিয়ে আসতে, পাইপটা জানালার কাছে ঝুলিয়ে দেয়াটাই সবচেয়ে ভালো হবে।
এক কোনায় আরেকটা স্টোভ আছে, বেশ হোঁতকা গড়নের, ইটের চিমনি-ওয়ালা। ওটার উপরে একটা লোহার পাত আছে যেটা তাপে লাল গনগনে হয়ে উঠলে তার উপর জমাট বালি ছুড়ে ফেলে গলিয়ে নরম করে তারপরে শুকানো হয়। ওটা ইতিমধ্যে জ্বালানো হয়ে গেছে, এবং ক্যাপ্টেন আর ফেতিউকোভ মিলে ঠেলা-গাড়িতে করে বালি নিয়ে আসছে। ঠেলাগাড়ি ঠেলতে খুব বেশী প্রতিভার দরকার হয় না। তাই সর্দার এধরনের কাজ তাদেরকেই দেয় যারা পেশা জীবনে উঁচু অবস্থানে ছিল। ফেতিউকোভ ছিল কোন এক অফিসে বেশ বড়কর্তা, ওর একটা গাড়িও ছিল।
এদিকে প্রথমে ফেতিউকোভ ক্যাপ্টেনের গায়ে থুতু ছিটালো, তারপর ওর সাথে চ্যাঁচামেচি করলো। কিন্তু চোয়াল বরাবর একটা ঘুষিই যথেষ্ট। ওরা আবার ঠিকঠাক মত কাজ করা শুরু করলো।
বালি টানার লোকগুলো উনুনের কাছে ঘেঁষে একটু গা গরম করার সুযোগ নিতে চাইলে তিউরিন ওদের তাড়িয়ে দিল।
“সাবধান, যে কেউ একজন কিন্তু মুহুর্তেই ধরা খেয়ে যাবে। জায়গাটা ঠিকটাক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর।”
একটা মার খাওয়া কুকুরকে চাবুক দেখানোই যথেষ্ট। ঠান্ডাটা ভয়ঙ্কর, কিন্তু সর্দারের চেয়ে বেশী না। সবাই ছড়িয়ে পড়লো আর যার যার কাজে ফিরে গেল।
সূখোভ শুনতে পেল তিউরিন পালভোকে বলছে, “এখানে থাকো, আর সবাইকে ব্যাস্ত রাখো। আমি কাজের রিপোর্টটা দিয়ে আসি।”
কাজের চেয়ে বরং নির্ভরশীলতা কাজের রিপোর্টের উপরই বেশী। সেই হচ্ছে চালাক-চতুর দলনেতা যে কাজের রিপোর্টের উপর গুরুত্ব বেশী দেয়। এটাই লোকেদের খাবার জোগায়। তাকে যে কাজটা হয় নি, সেটা হয়েছে বলে প্রমান করতে হয়, সামান্য কাজকে বড় করে দেখাতে হয়। একারনে একজন দলনেতাকে সবসময় নিজের মাথাটা খাটাতে হয় যাতে পরীক্ষককে সব কিছু ঠিকঠাক ভাবে বুঝিয়ে দিতে পারে। বেশ তেলবাজিও তাকে করতে হয়। কিন্তু এই সব কাজের রিপোর্ট থেকে আখেরে লাভ হয় কার? ব্যাপারটা ভালোভাবে বোঝা দরকার। লাভবান হয় ক্যাম্প। ক্যাম্পের জন্য ভবন-সংস্থা থেকে বরাদ্দ হয় হাজার হাজার রুবোল যাতে ল্যাফটেন্যান্ট গার্ডেরা পায় মোটা বোনাস, যেমন ভল্কোভয় পায় চাবকানোর জন্য। আর তুমি? তুমি পাও রাতের খাবারের সাথে অতিরিক্ত দু’শো গ্রাম রুটি। তোমার জীবন নিয়ন্ত্রন করে ওই কয়েকশ গ্রাম রুটি।
দু’বালতি জল আনা হয়েছে, কিন্তু ওগুলো পথে আসতে আসতেই জমে গেছে। পালভো সিদ্ধান্ত নিল এভাবে কাজ করা অর্থহীন। এরচেয়ে তুষার গলানো সহজ। বালতিগুলো উনুনের উপর রেখে দেয়া হলো।
গপচিক ইলেক্ট্রিকের কাজে ব্যাবহারের কয়েকটা এলুমিনিয়ামের তার নিয়ে এসেছে।
সে ওগুলো সূখোভকে দিয়ে বললো, “এগুলো দিয়ে ভালো চামুচ বানানো যাবে। আমাকে শিখিয়ে দাও কিভাবে ছাঁচে ঢেলে বানাতে হবে।”
এই ছোকরাটাকে সূখভের খুব পছন্দ। তার নিজের ছেলে অল্প বয়সে মারা গেছে, এবং তার ঘরে ছোট অবস্থায় ছেড়ে আসে মেয়েদুটোও বড় হয়ে গেছে। ওকে ব্যান্ডেরার (স্টিফেন ব্যান্ডেরা, ইউক্রেনের জাতীয়তা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা)লোকদের জন্য জঙ্গলে দুধ সরবাহ করার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং দেয়া হয়েছিল একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সমান বন্দীত্বের সাজা। সে যেন একটা হুটোপুটি ক্রা আদরপাগল কুকুরছানা এবং সবার সাথেই সে হুটোপুটি করে বেড়ায়। কিন্তু এর মধ্যেই সে অনেক চতুরতা শিখে গেছে। তার কাছে খাবার পার্সেলে যা আসে সেটা সে একাই খেয়ে নেয়, মাঝে মাঝে রাতের আঁধারে।
আসলে এতটুকু খাবার সবার সাথে ভাগাভাগি করাও সম্ভব না।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী
পর্ব ৫ = http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56529
পর্ব ৪ = http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56453
পর্ব ৩ = http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56431
পর্ব ২ = http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56426
পর্ব ১ = http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56419
মন্তব্য
এই পর্বটি অনেক সময় নিয়ে পরিশ্রম করে লিখেছেন। লেখায় গতি এসেছে, বাক্যের গঠনে একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। একটা অণুরোধ, ভেবে দেখতে পারেন। তথ্য এবং ব্যাখ্যা আমার মতে মূল লেখার সাথে না দিয়ে ফুটনোটে দিলেই পড়তে আরাম হয়। আরেকটা কথা ভাই, রাশান ভাষা কেমন যেন খুব এই সময়ের শোনায়। রুশ ভাষা কথাটায় একটা পুরনো পুরনো গন্ধ রয়েছে যা গল্পের সময়ের সাথে খুব যায় বলেই আমি মনে করি।
---মোখলেস হোসেন।
ধৈর্য এবং অনেক মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ মোখলেস ভাই। মূল্যবাদ মতামতের জন্য আরো বেশী ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আমি মুলত ঠিক এধরনের উপদেশ এবং মতামতের আশাতেই থাকি।
আমি পাঠক হিসেবে একটানে পড়ে যেতে ভালবাসি। কোন কিছু না বুঝলে, আবার বইয়ের পৃষ্ঠার শেষে কিংবা একেবারে বইয়ের শেষে ক্রমিক ধরে লেখা টিকা-টিপ্পনি থেকে ব্যাপারটা বুঝে আবার থেকে যাওয়া অংশে ফিরে আসাটা আমার নিজের কাছে খুব বিরক্তিকর লাগে। মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। অন্তত আমার। পড়তে পড়তে মনে হয়, লেখক এখানেইতো অর্থটা দিয়ে দিতে পারতেন। সেই ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই এভাবে লেখা। তবে গতানুগতিক ধারায়ও তথ্য, ব্যাখ্যা ইত্যাদি * কিংবা ১, ২, ৩ দিয়ে শেষে লেখা যায়। ক্ষতি নেই।
আমার কানেও "রুশ" শব্দটা অনেক বেশী যুতসই মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতে বিষয়টা সব শব্দের ক্ষেত্রেই মাথায় রাখবো। আর লেখার মানের ক্ষেত্রে বলতে হয় আমি এই অনুবাদটাকে সহজ রাখার চেষ্টা করছি। বাংলা ও ইংরেজী এই দুই ভাষার শব্দ গঠন, প্রয়োগ আর প্রকাশ ভঙ্গি একেবারেই ভিন্ন। হুবুহু অনুবাদ করলে হাস্যকর একেকটা বাক্যের জন্ম হয়। তাই করে ছোটখাট পরিবর্তন আনতেই হয়।
আমি সবসময় একভাবেই লিখি। সচেতনভাবে কোন প্ররিবর্তন আনার চেষ্টা করি নি। আর মূলগল্পটাই একটু একঘেঁয়ে। বর্ণহীন কষ্টকর আর হীম শীতল গুলাগ শ্রম-শিবিরের ছকে বাঁধা জীবনের গল্পে কোন বৈচিত্র আশা করাটাও ভুল। তাই আমার নিজের কাছেও অনুবাদটা কেমন যেন একঘেঁয়ে মনে হচ্ছে। তবুও "গাইতে গাইতে গায়েন" এর মত লিখতে লিখতে যদি হালকা পাতলা উন্নতি ঘটে (ধরে নিচ্ছি পরিবর্তন বলতে আপনি উন্নতি বোঝাতে চাচ্ছেন ) সেটা উপরি পাওনা। ভালো থাকবেন। আরো ভালো ভালো উপদেশের অপেক্ষার রইলাম।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী।
বিঃদ্রঃ আপনার উপর কিন্তু আমি সার্বক্ষনিক নজর রাখছি। রুদাই-২ আলোর মুখ দেখতে পাওয়ায় ধন্যবাদ। বাকী ধারাবাহিকগুলোকে অকালে হত্যা করবেন না প্লিজ।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী
নতুন মন্তব্য করুন