(ভেবেছিলাম দুই পর্বে শেষ করব, কিন্তু ইচ্ছে করছে লিখতে থাকি- তিন, চার, হয়তো পাঁচ। সময় পাওয়াটাই মুশকিলের। তারচে মুশকিল মডারেটরদের রাজি করানো)
সবুজ তল্লাটে কাউকে প্রার্থনা করতে দেখিনি কখনো। ছাঁকনদারদের কাছে ঈশ্বরের কথা শুনেছিলাম একবারই- যখন প্রিংতা এসেছিলো। বাদামিদের কথা আলাদা, এদের ঈশ্বর ভক্তি দারুন প্রবল। রুদাই নিয়ে ফিরে আসার পর থেকেই দেখতে পাচ্ছি গুনগুণ করে একটা গান গাইছে সবাই। গানের কথাগুলো স্পষ্ট নয়, তবে যেটুকু ধরতে পারছি তাতে ঘুরেফিরে ঈশ্বরের বন্দনাই, সম্ভবত প্রার্থনা সংগীত। ভীষণ একঘেয়ে একটা সুরে, পালা করে জোড়ায় জোড়ায় গেয়ে চলেছে,
নিস্প্রানে থাকে প্রাণ
ঈশ্বর (দুর্বোধ্য) তাই
(দুর্বোধ্য) ঈশ্বর
(দুর্বোধ্য) দিলে তাই
তুমি প্রভু তোমাকেই
(দুর্বোধ্য) সেবাতেই
আরও (দুর্বোধ্য) তাই
…………………
…………………
…………………
ঈশ্বরে ভয় যার
(দুর্বোধ্য) জয় তার
ঈশ্বর তোমাকেই
(দুর্বোধ্য) (দুর্বোধ্য) চিন্তার
………………
………………
………………
কতক্ষণ চলল সে গান বলতে পারবো না। হঠাৎ ঘর্ঘর ঘর্ঘর একটা শব্দ শুনে পেছন ফিরে দেখি গোল মতন কী একটা জিনিস ঠেলতে ঠেলতে দলপতি, যে কিনা ফেরার পথে কোন এক ফাঁকে দলছাড়া হয়ে গিয়েছিলো, আসছে আমাদের দিকে। গান থামিয়ে সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো,
“ঈশ্বরের জয় হোক”
“ঈশ্বরের জয় হোক। জয় হোক দেবদ্যূত কন্ড্রিয়ার। আমি বাইশ নম্বরের কথা তাঁকে বলেছি। ঈশ্বরের সাথে পরামর্শ করে তিনি জানাবেন আমাদের কী করনীয়। ততক্ষণ পর্যন্ত এ আমাদের সাথেই থাকছে। বাইশ নম্বর, তুমি তোমার ঘরে যাও। কন্ড্রিয়ার স্পষ্ট নির্দেশ রুদাই আনার সময়টুকু ছাড়া ঘর থেকে বেরুবে না তুমি।”
আমি আশেপাশে তাকিয়ে ঘরটর কিছু দেখতে না পেয়ে জিগ্যেস করলাম,
“কোথায় ঘর?”
“কোথায় মানে? এটাই।”
এই গোল জিনিসটাই তাহলে ঘর! কিন্তু ঢুকবো কিভাবে? দরজা জানালা কিছুই চোখে পড়ছে না।
“কী হলো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?”
“ভেতরে কেমন করে যাবো বুঝতে পারছি না।”
“সবাই যেমন করে যায় তেমন করে।”
“সবাই কেমন করে যায়?”
“ঘরের উপর তোমার বাঁ হাতটা রাখো।”
হাত রাখতেই চমকে উঠলাম, গোল জিনিসটা জীবন্ত নাকি! টান দিয়ে হাত সরিয়ে নিতে গিয়েই টের পেলাম আমি এটার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান জগতটা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো, একটা বাদামি গোলকের ভেতরে একা দাঁড়িয়ে আমি, আশেপাশে কেউ নেই। বের হবার চেষ্টা অর্থহীন জেনেও আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম চারিদিক। দিক বললে অবশ্য ভুল হবে, আবদ্ধ একটা বৃত্তের ভেতরে দিক বলে কিছু নেই।
বাইরে থেকে যতটা ছোটো দেখায় তার চেয়ে বেশ বড় জায়গাটা। বদ্ধ হলেও একেবারে অন্ধকার নয়, সেইসাথে মৃদু একটা উষ্ণতা, ঠিক শুষ্ক নয়, কেমন যেন ভেজা ভেজা একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে রয়েছে ঘরময়।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। ঘুম ভেঙে উঠে দেখি ভিজে একেবারে চুপসে গিয়েছি। ঘর জুড়ে থকথকে একটা তরল, জায়গায় জায়গায় ছোটো ছোটো বুদবুদ আর থেকে থেকে ভারি মিষ্টি একটা গন্ধ, গন্ধটা আমার খুব চেনা। কিন্তু তরলটা এলো কোথা থেকে! মাথায় একটা ফোঁটা পড়তেই পরিষ্কার হয়ে গেলো সব। আমার ঘরটাই গলে গলে পড়ছে! কী করব ভাবতে না ভাবতেই চারিদিক থেকে হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়লো সব।
আমার সামনে সেই একুশজন, আমার মতোই ভিজে একসা, গলে গলে পড়া বৃত্তাকার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে একে একে। সবার হাতে একটি করে ভাণ্ড, উপচে রয়েছে ঘর ভাঙা তরলে।
“হা করে দেখছো কী? খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালাও। হ্যাঁ, কথাটা তোমাকেই বলেছি বাইশ নম্বর!”
দলপতির ধমক শুনে আর দেরি না করে লাইনের শেষ মাথায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার বাদামি জীবনের আজ দ্বিতীয় দিন।
……
ঘর ভাঙার ব্যাপারটা আজকাল সয়ে গিয়েছে। ঘর ভাঙবেই, এটাই ঈশ্বরের বিধান। ভাঙা ঘর থেকে ঝরে ঝরে পড়া অমৃতের খানিকটা পাই আমি, বাকিটুকু নিয়ে যাই তাদের জন্য যারা পথে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বড় রাস্তাটার মোড়ে। ওদের সাথে আমার কথা হয়না। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কথা হয়না কারও সাথেই, বাদামি তল্লাটে আমার কোন বন্ধু নেই। আমি এদের বন্দি। একটা বৃত্তের ভেতর আটকে থাকি, প্রতিদিন নতুন বৃত্ত, নতুন ঘর। ঘর না ভাঙলে ঘর থেকে বেরুবার সাধ্য আমার নেই। দেবদ্যূত কন্ড্রিয়া আমার ব্যাপারে এখনও কোন সিদ্ধান্ত জানান নি।
পথটাকে আজ অনেক দীর্ঘ লাগছে, কেন জানিনা, মনে হচ্ছে ভীষণ অর্থহীন আর অসহ্য এ যাত্রা! তার চেয়েও অসহ্য বাদামিদের গান। আজকের গানটাও ঈশ্বরকে নিয়েই, তবে কথা গুলো অন্যরকম, খুব রাগি রাগি। আমি যতটা সম্ভব কান বন্ধ করে ঈশ্বরের কথা ভাবতে থাকি। ঈশ্বর কি খুব রাগি, নাকি দয়ালু! ক্লোরো নিশ্চয়ই জবাবটা জানে। অবশ্য জানলেই বা কী, আমি তো আর সবুজ তল্লাটে নেই যে সোনালি স্রোতে ভেসে আসা রুদাই তোলার অবসরে জিগ্যেস করে জেনে নেবো। আজকাল সোনালি স্রোতটার জন্য বুকের ভেতর কেমন খাঁ খাঁ করে উঠে।
এতো রুদাই আমি আগে কখনো দেখিনি। ছাঁকনদারদের আনন্দ যেন উপচে পড়ছে উপচানো রুদাইয়ের মতো। এমনকি বুড়ো ফিলের মুখেও বেমানান একটা হাসি। সে হাসি থেমে যেতে সময় লাগলো না।
দলপতি ফিলের দিকে তাকিয়ে কাটা কাটা গলায় বলল,
“পাপী! ভেবেছো ঈশ্বরকে ফাঁকি দিয়ে বেঁচে যাবে, তাই না? ঈশ্বর সব কিছুর খবর রাখেন।”
ফিল আমতা আমতা করে ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিলো,
“আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা! নৈবেদ্যর তো কোন কমতি হয়নি। বরং অন্যান্য বারের চেয়ে ঢের বেশি এনেছি এবার।”
“ওই ছোকরাটা একে চেনে। একশ বাইশ বলে ডেকেছিলো। কোথায় সে?”
ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো ক্লোরো, চোখে মুখে দারুণ একটা ঔদ্ধত্য ছিটকে ছিটকে পড়ছে তার।
“এই যে আমি, আমার একটা নাম আছে। এরপর থেকে ক্লোরো বলেই ডাকবে।”
রেগে ফেটে পড়তে পড়তে সামলে নিলো দলপতি। কর্তৃত্বমাখা কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“তুমি এর ব্যাপারে কী জানো? কোথা থেকে এসেছে, কেমন করে?”
“আমাকে জিগ্যেস না করে ঈশ্বরকে জিগ্যেস করলেই পারো! তিনি তো সব কিছুর খবর রাখেন, তুমিই না বললে?”
“ঈশ্বর এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাবিত নন, দেবদ্যূত কন্ড্রিয়া জানতে চেয়েছেন বলেই তোমাকে জিগ্যেস করছি।”
“যাতে তিনি ঈশ্বরের কান ভারি করতে পারেন, তাইতো? আচ্ছা, ঈশ্বরের আবার দ্যূতের প্রয়োজন কী?”
“মুখ সামলে ছোকরা, যা জানতে চেয়েছি ঠিক ঠিক জবাব দাও।”
“আমার নাম ক্লোরো, আমি একশ এক। একশ বাইশ এসেছিলো একটা ভালব টেনে, আর সে ভালবটা ছিলো সুতোয় বাঁধা। ভালব আর সুতো কী জিনিস তা তুমি ঈশ্বরকে জিগ্যেস করে জেনে নিও।”
জবাবের অপেক্ষা না করে দলপতির দিকে পিঠ ঘুরিয়ে চলে গেলো ক্লোরো। দলপতি পারলে যে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ঈশ্বরের বিধান সবার জন্যই সমান ভাবে প্রযোজ্য। সবুজ তল্লাটে প্রবেশাধিকার বাদামিদের নেই। তারা আটকে রয়েছে বাদামি তল্লাটে, যেমন আটকে ছাঁকনদারেরা তাদের সবুজে। ব্যাতিক্রম শুধু আমি।
আমি যে ব্যাতিক্রম, আমি যে বাদামি তল্লাট ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারি তা আগে কেন মাথায় আসেনি এটা ভেবে নিজের উপর খুব রাগ লাগছে। কাজটা অবশ্য সহজ হবেনা। সবুজ তল্লাট ছেড়ে আসার আগে আমি ছিলাম স্বাধীন, এখানে বৃত্তবন্দি। পালাতে হলে আগে বৃত্তটাকে ভাঙতে হবে।
----চলবে
প্রথম পর্বের লিংকঃ
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56534
মন্তব্য
ওহ, আপনার এই রুদাই পড়বো বলে রোজ রোজ রোজ রোজ উঁকি দিয়ে যাই । চমৎকার লাগছে ।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ধন্যবাদ তুলিরেখা। অনুপ্রাণিত বোধ করছি।
---মোখলেস হোসেন
অনেক অনেক পর্ব আসুক।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ এক লহমা। লিখতে ভালো লাগে সকাল বেলায়। অথচ সকাল বেলাতেই সকল কাজ।
----মোখলেস হোসেন
দুই পর্বেই শেষ করবেন কথা দিয়েই আঁটকে ফেলেছেন, ধরা খেয়ে গেলাম। চলুক যতদিন চলান। এখনও আপনার অসমাপ্ত গল্প গুলোর চরিত্ররা মনে হানা দেয় বাকি পৃষ্ঠা গুলোর জন্য ভেতরটা ছটফট করে। কিন্তু “স্রষ্টার” কাছে আমরা সবাই অসহায়, কি আর করা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ সোহেল ইমাম। অসমাপ্ত লেখাগুলোর জন্য দায়ী আমার ব্যাস্ততা আর আলসেমি। খানিকটা পড়াশোনা না করলে ওগুলো নিয়ে এগুনো মুশকিল। বর্তমান লেখাটিতে নিয়ে সেই ভাবনা নেই। ইতিহাস কিম্বা প্রবন্ধ নয়, রুদাইয়ের জন্য প্রয়োজন কেবল সোনালি স্রোত। লিখতে পারবো আমার ইচ্ছে মতো, আমার নিজের রঙে। এটা শেষ হতে দেরি হবেনা।
----মোখলেস হোসেন
দুই পর্বে শেষ হচ্ছে না জেনে ভালো লাগছে। তবে অনুরোধ একটাই, অন্যান্য লেখার মত মাঝপথেই বাক্সবন্দী করে দেবেন না যেন।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী
ধন্যবাদ ইকরাম ফরিদ চৌধুরী। নীড়পাতা থেকে সরে গেলেই পরের কিস্তি দিয়ে দেবো। এই গল্পটা নিয়ে নয়ছয় নয়।
---মোখলেস হোসেন
সালোকসংশ্লেষণ চলতে থাকুক!
পড়ার জন্য ধন্যবাদ উদ্দেশ্যহীন।
---মোখলেস হোসেন
পড়া শুরু করতে না করতে পটাং করে শেষ হয়ে গেলো। এইটা কিছু হইল! পরের পর পর্বগুলো সুরসুর করে আসুক।
*
সম্পাদনা করার সুযোগ মিলে গেলে 'গুনগুন' করতে করতে সচল'দেবদূতে'র আয়ুকামনা করিয়া টাইপোগুলো ঠিক করে নেবেন ভায়া
সুরসুর করে না এলেও ভাববেন না। প্রয়োজনে হিড়হিড় করে টেনে আনবো। পড়ার জন্য ধন্যবাদ আয়নামতি। টাইপগুলো একদম চেয়ে থাকে!
---মোখলেস হোসেন
ভাল লেগেছে!
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।
ধন্যবাদ রোমেল চৌধুরী।
--মোখলেস হোসেন
নতুন মন্তব্য করুন