হাহাকার

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ২৬/০৪/২০১৭ - ৭:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নদীর নাম তরা, ব্রিজের পাশে ছোট একটা নামফলকে লেখা। ব্রিজটা বেশ উঁচু, অনেক নীচে মাটি দেখা যাচ্ছে। হ্যাঁ মাটিই, পানি না। যত দূর চোখ যায় শুধু ধু ধু বালি চোখে পড়ে। আমি সাঁতার পারিনা, কিন্তু নদী বা সাগর আমাকে কেমন যেন টানে। যে চাকরি করি, তাতে সারা দেশ টো টো করে ঘুরে বেড়াতে হয়।যখন যেখানে যাই, খোঁজ নেই আশেপাশে কোন নদী আছে কিনা। থাকলে একবার হলেও ঘুরে আসি।ব্যাপারটা কেমন যেন নেশার মত হয়ে গেছে।আজ অবশ্য সেরকম নয়, এ রাস্তায় যে এত বড় একটা নদী পড়বে জানা ছিলনা। ব্রিজের দৈর্ঘ্য আর উচ্চতা দেখে বোঝা যাচ্ছে এককালে বড়সড় নদী ছিল এটা। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা ট্রাক চলছে,'নদীর' ঠিক মাঝ দিয়ে। মোটা মোটা টায়ারগুলোর পেছন থেকে উড়ে আসছে একগাদা ধুলো, বৈশাখের তপ্ত হাওয়ায় সে ধুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারিদিক, তাতে যেন মিশে আছে তরার হাহাকার।

"মনসুর ভাই,গাড়ীটা থামানতো একটু। চা খাই"-জহির বলল। জহির আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু আবার সেই সাথে কলিগও।চা খাওয়াটা তার নেশার পর্যায়ে চলে গেছে, নাহলে এই গরমে কেউ চা খায়? গাড়ি থামানোয় অবশ্য আমি আপত্তি করলাম না। চা এর বদলে আমি কোক দিয়ে গলা ভেজাব, তাছাড়া নদীটা সম্পর্কে খোঁজখবরও নেয়া যাবে। ড্রাইভার মনসুর ভাই রাস্তার দুপাশে তাকালেন, দোকানপাট হাইওয়ে থেকে বেশ খানিকটা নীচে। একপাশে ঢালমত একটা রাস্তা নীচে নেমে গেছে, সেটা ধরে এগিয়ে একটা বাজারমত জায়গায় গিয়ে থামলাম।

আমাদের তিনজনের চা আর কোকের অর্ডার দিয়ে দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চে যেয়ে বসলাম। জহির আর মনসুর ভাই গল্পবাজ লোক, দোকানি আর অন্য কাস্টমারদের সাথে আলাপ জমিয়ে দিল। আমি কথা কম বলি,চুপচাপ সামনে তাকিয়ে আছি। জায়গাটা ব্রিজ থেকে অনেক নীচে,নদীটাকে(কিংবা সাবেক নদীটাকে) অনেক কাছ থেকে দেখা যায় এখানে। দেখার মত তেমন একটা কিছু অবশ্য নেই, বেশিরভাগটাই বালি, কোথাও কোথাও আবার দুচারটে কুঁড়েঘর আছে, তারো পরে এক জায়গায় কাশবনও আছে দেখছি! তন্ময় হয়ে সেদিকে চেয়ে আছি, মাঝে মাঝে বাকিদের কথাবার্তা টুকটাক কানে আসছে। সেসব টুকরো টুকরো কথা থেকে বুঝলাম বছর বিশেক আগেও ব্রিজটা ছিলনা, তখন এখানে ফেরিঘাট ছিল।স্বাভাবিকভাবেই সেকালে জায়গাটা খুব সরগরম ছিল। এখনো বেশকিছু দোকানপাট আছে, কিন্তু আগে নিশ্চয়ই আরো বেশি ছিল। যারা দোকান বেচে দিয়ে এখন অন্যকিছু করছে, তারা হয়ত সেসব দিনের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে!

কোকে আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছি, এমন সময় লোকটার ওপর চোখ পড়ল।বেশ বুড়ো, চুল দাড়ি সব পেকে ধবধবে সাদা হয়ে গেছে, বয়সের ভারে খানিকটা কুঁজোও। একটা লাঠিতে ভর দিয়ে নদীর সাদা চরের উপর দিয়ে হাঁটছে। কিছুক্ষণ পরপর লাঠি দিয়ে বালুতে খোঁচাচ্ছে, যেন কিছু খুঁজছে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো, এই ঠাঠা রোদের মধ্যে এই বুড়ো ঠিক কি করছে?

মৌনব্রত আর বেশিক্ষন পালন করা গেলনা,দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম-
-"ভাই,ওই বুড়ো লোকটা কে?"
আমার দেখান আংগুল বরাবর তাকাল দোকানি।
-"ওহ,এ তো নুরু মাস্টার,তারাগঞ্জের"
-"তারাগঞ্জ কই ভাই?"
-"এখান থেকে দুই গ্রাম পরে,ভ্যানে গেলে প্রায় বিশ মিনিট লাগবে"।
-"আচ্ছা, কিন্তু উনি এখানে করছেনটা কি?কিছু খুঁজছেন নাকি?"
-"আরে স্যার বইলেন না, পাগলের কারবার আর কি।"

গল্পের গন্ধ পেলাম এই কথায়,উতসুক হয়ে তাই আবার জিজ্ঞের করলাম-
"ভাই বিষয়টা কি,বলেন তো"
"স্যার সে মেলা দিন আগের কথা,বাপ চাচার মুখে শোনা।সত্যি মিথ্যাও জানিনা"।
এসব ডিসক্লেইমার শুনতে ইচ্ছে করছিলনা,তাই বললাম-
"যা শুনছেন তাই বলেন,সমস্যা নেই"।
দোকানি মতি ভাই(পরে তার নাম জেনেছিলাম) গল্প শুরু করলেন-

"পাকিস্তান আমলের কথা,তখন নদী ছিল পানিতে ভরা, স্টিমার চলত কলকাতা পর্যন্ত, বিশ্বাস হয় স্যার?নুরু মাস্টারের মেয়ে ছিল একটা, রোকেয়া নাম,বড় আদরের। সেই মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছিল নালতা গ্রামে। এখান থেকে দূর আছে,ব্রিজের ওই পাশ থেকে বাস পাবেন, আধা ঘন্টা লাগবে। তখন তো আর বাস ছিলনা, নৌকায় যাওয়া আসা হত। চৈত্র মাসের এক দুপুরে মেয়ের বিয়ে হল, কিন্তু মেয়েকে বিদায় দিতে দিতে বিকেল হয়ে গেল।পড়ন্ত বিকেলে যখন মেয়ে আর জামাইকে নৌকায় তুলে দিলেন, তখন জানতেন না যে এই ওদের শেষ দেখা। সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে আসা কালবোশেখি বরযাত্রী সহ সব নৌকা ডুবিয়ে দিল। নিমিষেই নুরু মাস্টারের জীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। অনেকেই সাতরে তীরে পৌঁছতে পারলেও রোকেয়া আর তার বর পারেনি। জামাইয়ের লাশ পরদিন পাওয়া গেলেও মেয়ের লাশ অনেক খুঁজেও আর পাননি নুরু মাস্টার।এরপর থেকেই খানিকটা এলোমেলো হয়ে যান তিনি। প্রায়ই নদীর তীরে এসে নদীকে অভিশাপ দিতেন।এখন সবাইকে বলে বেড়ান যে তার অভিশাপেই নাকি তরা শুকিয়ে গেছে।"

-"বুঝলাম, কিন্তু লাঠি দিয়ে ওরকম খোঁচাচ্ছেন কেন?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
-"মেয়ের লাশ তো পায় নাই, তাই গহনা খুঁজে। বালিতে খুঁচিয়ে দেখে, যদি মেয়ের হাতের বালা বা গলার হার খুজে পায়।"
-"এত দিন পর সেই গহনা খুঁজে পাবে কিভাবে? আর পেলেই বা কি, সেটা যে তার মেয়েরই তার কি প্রমান আছে?"
-"আরে স্যার বললাম না, পাগলের ব্যাপার? মনে সুখ পায় আর কি। খুঁজতে চায় তো খুঁজুক না, কি সমস্যা?"

এরপর অবশ্য আর কথা চলেনা। কোক শেষ করে চুপচাপ ভাবতে লাগলাম।মানুষের জীবন কত নাটকীয় আর ট্র্যাজিকই না হয়! জহিরের অবশ্য আমার মত ভাবালুতা নেই, পুরো ব্যাপারটাকে সে 'মেলোড্রামা' বলে উড়িয়ে দিল।
-"হুহ,অভিশাপে নদী শুকায়। পারলে বিরাট কোহলিরে অভিশাপ দিয়ে ওর সেঞ্চুরি ঠেকাক তো দেখি!" - জহিরের গজগজে স্বগতোক্তি।

ব্যাপারটা আমার মনে বেশ দাগ কেটেছিল, ভেবেছিলাম অনেকদিন মনে থাকবে।কিন্ত আসলে তেমনটা হলনা, আমিনবাজার ব্রিজে এসে ঢাকার স্কাইলাইন চোখে পড়তে না পড়তেই স্মৃতিটা ফিকে হতে শুরু করল। হতচ্ছাড়া মিরপুর রোডের জ্যাম ঠেলে শ্যামলী পৌছাতে পৌছাতে সব বেমালুম ভুলে গেলাম।

কয়েক মাস পরের কথা। পিরোজপুরের নেসারাবাদ বলে এক জায়গায় যাচ্ছি। সাথে এবারো মনসুর ভাই, যদিও জহির নেই।ম্যাপ ঘেঁটে দেখলাম যে পথে নদী পড়বে, যথারীতি মন খুশি খুশি হয়ে গেল। এদিককার নদীগুলোয় অনেক পানি থাকে, উত্তরবংগের নদীগুলোর মত মরা না। ঘাটে এসে বুঝলাম ধারনা ঠিকই ছিল। নদীর নাম সন্ধ্যা, বিশাল চওড়া নদী, চারদিকে থইথই পানি। ফেরিতে ওঠার পর গাড়ি থেকে নেমে ফেরির সামনের দিকে চলে এলাম। বেশ বাতাস ছিল সেদিন, আকাশ মেঘলা বলেই কিনা জানিনা নদীর পানিও কালচে দেখাচ্ছিল। উপরে খোলা আকাশ, চারদিকে দুকূল ছাপানো নদী, চুলে খেলা করছে পাগলা বাতাস, আর সব কিছু ছাপিয়ে পৃথিবীর হৃদস্পন্দনের মত ফেরির ঠা ঠা শব্দ। এরকম মুহুর্তগুলোতে মানুষ হয়ে জন্মানোর কারনে আমার নিজের প্রতিই হিংসে হয়।

পুরো নদীতে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। হঠাত হঠাত দুয়েকটা নৌকা চোখে পড়ে। কোনটা গাছের গুঁড়ি বোঝাই করে শহরের দিকে যাচ্ছে, কোনটায় আবার মানুষজন আছে। এরকমই একটি নৌকায় মেয়েটিকে চোখে পড়ল। অল্পবয়েসী, সাজপোশাকের ধরন দেখে বোঝা যায় যে সাধারন গ্রামের মেয়ে। ঠিক কেন জানিনা, তখন আমার হঠাত করে মতি ভাইয়ের মুখে শোনা তরার পাড়ের রোকেয়ার কথা মনে পড়ে যায়! এতক্ষন প্রেমিকার মত মনে হওয়া সন্ধ্যা নদীকে এবার একটু একটু করে রাক্ষুসে ডাইনি মনে হতে শুরু করে। আর উত্তর দিকে বয়ে আসা ভেজা বাতাস যেন কোন সুদূর থেকে নুরু মাস্টারের হাহাকার বয়ে আনে!

-গগন শিরীষ


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

এতো সুন্দর করে লেখেন কি করে!!! চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

গগন শিরীষ  এর ছবি

প্রশংসা এবং পড়ার জন্য ধন্যবাদ সোহেল ভাই।এরকম মন্তব্য পেলে সাহস বাড়ে, অনুপ্রেরণা পাই।

দেবদ্যুতি এর ছবি

তারাগঞ্জ! আমি নদীহীন গ্রামের মানুষ তবু নদী ভীষণ টানে। এখন তো এই হাহাকার পীড়া দিচ্ছে।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

গগন শিরীষ  এর ছবি

আমি আজন্ম শহুরে মানুষ,দাদা বাড়ি যে গ্রামে সেখানেও নদী নেই।তারপরও যে আমার নদীপ্রীতি কোথা থেকে এল নিজেই জানিনা।পড়ার জন্য ধন্যবাদ দেবদ্যুতি।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো কিছু মুহূর্ত ছিলো গল্পটায়। শুভেচ্ছা।

---মোখলেস হোসেন

গগন শিরীষ  এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ মোখলেস ভাই।আপনার মন্তব্যের জন্য অপেক্ষায় থাকি হাসি

এক লহমা এর ছবি

সেই ত, হয় নদী-র, না হয় নুরু-মাস্টারের হাহাকার।
লেখা চলুক, চলতে থাকুক। চলুক

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

গগন শিরীষ  এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ,এক লহমা!

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বেশ ভাল লেগেছে!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

গগন শিরীষ  এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ, রোমেল ভাই!

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো! আপনার লেখা বরাবর ভাল লাগে।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।