আরে, এই ইলেকট্রিকের খাম্বার পাশেইতো ছিলো মেয়েটা! লাল ফ্রক পরা! মিনিট তিনেক আগেইতো মিনুকে এখানে ট্রাঙ্কের উপর বসিয়ে রেখে ড্রেনের ধারে বহুক্ষন ধরে চেপে রাখা “ছোট-কাজ” সারতে গিয়েছিলেন নজীর আলী। কোথায় গেল বাচ্চাটা? এতবড় ঢাকা শহর। কিছুই চেনেন না। সদরঘাটে লঞ্চ থেকে নেমে সরাসরি বাসে চেপে পি.জি. হাসপাতাল না কি যেন বিজি হাসপাতালের সামনে এসে নেমেছেন আধ ঘন্টা মত হয় সাত বছরের মেয়ে মিনুকে নিয়ে। সমবয়সী চাচাতো ভাই বারেক আলী চিঠিতে বলেছিল সদরঘাট থেকে সরাসরি শাহাবাগের বাস ধরে এই হাসপাতালের সামনে নেমে এক নম্বর গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে। ঠিক একটার সময় সে আসবে নিতে। বিশাল শহর এই ঢাকা। ইয়া বড় বড় রাস্তা, বিশাল দালান, গাড়ীঘোড়া, মানুষজনের হাঁকডাক দেখেই গ্রাম-গঞ্জের বাতাসে অভ্যস্ত বুকে কাঁপন ধরে যায় নজির আলীর। ত্রিশ বছরের জীবনে এই প্রথম ঢাকা আসা। লঞ্চ থেকে নেমেই কেমন যেন বেদিশা বেদিশা লাগছিল, ধরফর ধরফর করছিল গেঁয়ো বুকটা। এক পলকের জন্যেও মা মরা মেয়েটাকে হাতছাড়া করেন নি। এক হাতে শক্ত করে ধরা মেয়ে, অন্য হাতে বাহারি টিনের ট্রাঙ্ক। আর বুক পকেটের কাছে ভেতরদিকে সেলাই করা গোপন পকেটে একশ টাকা। কোন বাসে উঠবেন তাও জানা নেই। দেখেশুনে ভালোমানুষ গোছের দু’একজনকে জিজ্ঞেস করে বাস চিনে নিয়েছিলেন। ঠেলেঠুলে উঠার সময়ও আগে মেয়েকে উঠিয়েছেন, তারপর নিজে। হেল্পারকে বলে রাখাতে সেই শাহাবাগ আসার পর নামিয়ে দিয়েছিল। তারপর ১ নম্বর গেট খুঁজে নিয়ে এই খাম্বার ধারে ছায়ায় বসে ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা। তৃষ্ণার্ত মেয়েকে একটা ডাবও কিনে খাইয়েছিলেন কিছুক্ষন আগে। একটা ডাবের দাম পাঁচ টাকা! ডাবও একটা কিনে খাওয়ার জিনিষ? তাও এত দাম দিয়ে! ঢাকা বুঝি ডাকাতের শহর? সারাক্ষন চোখেচোখে রাখলেও, বাচ্চাকে পাশে দাঁড় করিয়ে তো আর পেচ্ছাব সারা যায় না। অনেক্ষন ধরেই চেপে আছেন। হিসেব মত বারেক আসতে আরো আধঘন্টা মত বাকী। তাই নিতান্ত অপারগ হয়েই একটু আড়ালে এই সামান্য দূরে ড্রেনের পাশেই কাজ সারতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরমধ্যেই মেয়েটা গেল কোথায়? টিনের ট্রাঙ্কটাও নেই। বারেকের কথায় একটু ভালো থাকার লোভে ঢাকা শহর এসে এ কোন বিপদে পড়লো সে? বারেকই বা কোথায়? কোথায় গেল সাত বছরের বুকের ধন মিনু? ডাকাতের এই শহরে কেউ ধরে নিয়ে গেল কি মুহুর্তেই? কোথায় খুঁজে পাবে সে তার সোনা-মানিকটাকে? একটা দানব যেন আচমকা ধক করে হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে হৃৎপিন্ডটা। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে। সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। কাটা কলা গাছের মত পড়ে যেতে যেতে কেবল বুঝতে পারেন কে যেন তাকে ধরে ফেলেছে, “স্যার, ও স্যার,... এই পানি আন, পানি, পানি, জলদি...”
বারেক আর নজীরের একই সাথে গ্রামের খালেবিলে, গাছে-বাদারে লাফালাফি-ঝাপাঝাপি করে বড় হয়ে ওঠা। স্কুলেও একই ক্লাসে। আত্নীয়ের চেয়ে বেশী জিগরী-ইয়ার। লেখাপড়া নজীর ভালো ছিল বলে আর দশটা গরিব বাপের মত তার বর্গাচাষী বাপেরও বুকেও শত বছরের জীর্ণ স্বপ্ন ডালপালা মেলে ধরে, ছেলে বড় পাশ দিয়ে উকিল, ডাক্তার, দারোগা হবে। অন্তত একটা ভালো চাকরি করবে। দুটো পয়সা আসবে। দুখের দিন পালাবে ভাঙ্গা জানালা দিয়ে। কিন্তু ভাঙ্গা জানালা ক্ষয়ে আরো জীর্ণ হয় শুধু। ক্লাস নাইনে উঠার পরপরই বাপটা অকালে মরে যায়। বাপের স্বপ্নের হাল ধরে মা। ছেলে পড়বে। ক্ষেতে-খামারে, খালেবিলে কামলা খাটবে না। ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়ায় মার সে কি খুশি! ওদিকে বারেক ম্যাট্রিকে ফেল করে রগচটা বাপের রাম-ঠ্যাঙ্গানির ভয়ে ভয়ে পালিয়ে লঞ্চে চেপে সোজা ঢাকা। টানাটানির মধ্যেও ইন্টারটা শেষ করেছিল সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে। আর্টস থেকে। কিন্তু আর দশটা অপূর্ণ স্বপ্নের মতই অভাবের সাথে মারামারিতে হার মানে গ্রাম্য মেধা। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে বি.এ তে ভর্তি হয়েও আর এগুনো আর হয়ে ওঠে নি। মায়ের ধরাধরিতে দূর সম্পর্কের মামা ইউনুস চেয়ারম্যান নিজের মায়ের নামে সদ্য খোলা খোদেজা বেগম মেমোরিয়ার প্রাইমারী স্কুলে মাস্টারির চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিলেন। চাকরি হতে না হতেই দুই মরা বাচ্চার পর টিকে যাওয়া একমাত্র ছেলেকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিলেন মা। ওর বয়স তখন কত বিশ-একুশ? ঘরে এল বিশাল লাল ঘোমটা টানা এক নতুন মানুষ, তার বউ। সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনের দিকে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকা এক নতুন বিষ্ময়। বিয়ের পর বছর ঘুরতেই মায়ের মৃত্যু। বড় মায়াবতী মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুর শোক ভোলাতেই বুঝি পরের বছর তাদের প্রথম সন্তান এলো ঘর আলো করে। নাম রাখা হলো মরিয়ম আক্তার। ডাক নাম মিনু। সময় কেটে যেতে থাকে এক এক দিন করে, একরকম সুখ-অসুখ আর পাওয়া না-পাওয়ার মধ্যে।
ওদিকে ঢাকায় পালিয়ে আসা ম্যাট্রিক ফেল বারেক কিভাবে যেন জোগাড় করে নিয়েছিল কোন একটা সরকারী অফিসের পিওনের চাকরি। সেই চাকরির ভোজবাজিতে দিনে দিনে বাড়তে থাকে তার পকেটের ওজন। বেড়ার ঘর একদিন ঢেউটিনের, তারপর পাকা একতলা হয়। হয়তো দোতালাও হয়ে যাবে কিছুদিন পর। লাফিয়ে লাফিয়ে এগোয় তার ধানী জমির সীমানা। পিয়নের চাকরিতে এত টাকা আসে শুধু একভাবেই, ঘুষ। এখন নাকি অফিসের বড় সাহেবের খাস পিয়ন। অন্য কন্ট্রাক্টরের ফাইল টানাটানি আর কতদিন? সরকারী কাজের আঁটঘাটও ততদিনে শেখা হয়ে গেছে বেশ। তাই সেও ভাবে চাকরির পাশাপাশি শুরু করবে কন্ট্রাক্টরির কাজ। নিজের অফিসে তো আর নিজের নামে লাইসেন্স করা যায় না। দরকার বিশ্বস্ত কাউকে। নাতো সাহস হয় না। চিঠি পাঠায়, প্রতিবার গ্রামে গেলে নজীরকে জোরাজুরি করে, “চইলা আয়, আপনা লোক দরকার। কি করবি এই মাটি কামড়াইয়া পইরা থাইকা? আমার লগে থাক। মনে কর তুইই মালিক। তোর মাথা ভালো। সব দেইখাশুইনা সামলাইয়া রাখবি, হিসাব কিতাব সব তোর হাতে। ঢাকা শহরে ইয়ার-বন্ধু যা আছে, সব চুতমারানীর পোলাই চোর। আমারে চুইষা খাওয়ার ধান্দা। আমার কি চাকরি তাতো তুই বোঝোসই। আমি ফাইল ঠেকায়া টাকা নিতে জানি। কিন্তু হিসাবের মাথা নাই। তুই আয় ভাই। দু’দোস্ত মিল্যা ঠ একটু রুটি-রুজির ধান্দা করি”। বারেক ঘুরেফিরে গত দেড় বছর ধরে খালি একই ঘ্যানঘ্যান করে যায়। নজীর খালি মাথা নাড়ায় আর হাসে, কিন্তু জবাব দেয় না। এদিকে ক্ষমতার পালাবদলে সেই চেয়ারম্যান মামা পনের বছরের টানা চেয়ারম্যানগিরির চেয়ার উলটে খুনের কেসে পড়ে দু বছরের বেশী সময় পলাতক থাকায় বদলে যেতে থাকে সব। এখন সেই স্কুল চলে কি চলে না। অংকের মাস্টারের তবু কিছু দাম আছে। অবস্থাপন্ন গেরস্থের দু’একটা ছেলেকে পড়ানো যায়। সমাজ-বিজ্ঞান পড়ানো মাস্টারের কাছে কে পড়তে আসে প্রাইভেটে? জমি-জিরেত বলতে ভিটে খানা আর লাগোয়া কাঠাখানেক জমি। তা সেটা না থাকার মতই। স্কুলে এক মাসে অর্ধেক বেতন হয় তো, বাকী দুই মাস খবর নেই। বউটাও গত বর্ষায় বলা নেই, কওয়া নেই, সাপের কামড়ে মরে গেল হুট করে। এখন শুধু সে আর তার ছোট্ট মেয়ে মিনু। চাহিদা বেশী না, কিন্তু অনিশ্চয়তা অনেক বেশী। তাই এবার আর না করতে পারে না। এক ভোরে ভাইয়ের কথায় সাড়া দিয়ে ঘরে তালা দিয়ে রওনা দেয় লঞ্চঘাটের দিকে, গন্তব্য ঢাকা।
শেরাটনের মোড় পার হয়ে কালো কাঁচে ঢাকা উল্কা বেগে ছুটে আসা মার্সিডিজ বেঞ্জ G550 SUV শাহাবাগের মোড় ঘুরে ঘ্যাঁচ করে থামার আগেই ভেতর থেকে চেঁচিয়ে ওঠে বছর পঁচিশেক বয়সের রাহাত, “হেই, দেয়ার হি ইজ! ওই যে মজনুর সিগারেটের দোকানে”। “ম্যান, আ’ম টায়ার্ড অফ দিজ গেম।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে স্টিয়ারিং হুইল ধরা বড়ভাই রাফি। গলায় চাপা ক্ষোভ। পেছন সিটে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা কুদ্দুসের বুক থেকে নেমে যায় যেন একটা পাথর।
বিক্রিবাটা বন্ধ রেখে বুড়ো মানুষটাকে শক্ত করে ধরে বসে আছে মজনু মিয়া। তখনো টপ টপ করে কিছু পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে বৃদ্ধের সাদা চুলদাড়ি বেয়ে। বুড়োটাকে সময়মত সেই প্রথম দেখতে পায়। ধরাধরি করে পানিটানি ঢেলে জ্ঞান ফিরিয়েছে। বরাবরের মত ঝিম মেরে বসে আছে জ্ঞান ফেরার পর। মুখে কোন কথা নেই। চোখ দুটো বন্ধ। মাথাটা বুকের উপর ঝুঁকে আছে। হাতদুটো কোলের উপর জড়ো করা। পাঞ্জাবীর বুকের কাছটা ভেজা। কার মুখ দেখে যে আজ মজনু ঘুম থেকে উঠেছিল! তার দোকান ঘিরে ছোটখাট জটলা। মজনুর দশ বছরের ছেলে টুকুমিয়া খুব ব্যাস্ত। হাতে তার ইদানিংকার সর্বক্ষনের সঙ্গী ছোট্ট প্লাস্টিকের ব্যাডমিন্টনের র্যা্কেট আর ঠোঁটে ধরা প্লাস্টিকের টিয়া রঙের হুইসেল। সে এখন পুলিশ। খুব গুরত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছে। মাঝে মাঝে পুররর পুররর করে হুইসেল বাজিয়ে ভীড় সরাচ্ছে। মুখটা গম্ভীর। মুরুব্বিরে “ডিশটাব” দেয়া যাবে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বড় হলে “পুলিশের সার্জন” হবে। তখন তার একটা “হুন্ডা” থাকবে, আর কোমরে বন্দুক। তবে ডিউটি করবে শুধু শাহাবাগেই, বাবার পান-বিড়ির দোকানের কাছে। তার কাজকারবারেও পাবলিক মজা পাচ্ছে।
কালো গাড়ীটা থামতে দেখেই মজনুর এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত হাসি ছড়িয়ে পরে। বড় সাহেবকে সেই মোবাইল করেছিল। গাড়ীটা দেখে হিংসায় জ্বলতে থাকা ডাবওয়ালা শুক্কুর, ফলওয়ালা আসলাম আর ডিম-পরোটা ওয়ালা জব্বারের চোখ সরু হয়ে আসে। ইস্, ওরা যদি বুড়োটাকে আগে দেখতে পেত!
গাড়ী থামতে না থামতে লাফ দিয়ে নেমে এগিয়ে আসে রাহাত। “থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ মজনু মিয়া। আপনাদের বারবার কষ্ট দেই।” মজনু একেবারে বিগলিত হয়ে হয়ে বলে, “কি যে বলেন স্যার, হেঃ হেঃ। মুরুব্বির পর্তি আমাগো একটা দায়িত্ব আছে না! আমিতো দেইখ্যাই দুইন্যাদারি ফালায়া দৌড় পাড়ছি। সুময় মত গিয়া জাপ্টায়া না ধরলে তো মাডিত পইড়া সব্বোনাশটা হইতো।”
এরমধ্যে রাফিও এগিয়ে এসে দুজন দুদিকে বাবাকে ধরে তোলে গাড়ীতে উঠানোর জন্য। ওদের চেহারা, গাড়ী, পোশাক-আশাক, চলার ভঙ্গি, কথার ধরন সবকিছুতেই ঝলক দিচ্ছে প্রাচুর্য। পেছন পেছন কাঁচুমাচু মুখে বাবার সার্বক্ষনিক এসিস্ট্যান্ট কুদ্দুস। ওর এক মুহুর্তের গাফিলতিতেই আজ আবার এই অঘটন। কেন যে মোবাইলে কথা বলতে বলতে রুমের বাইরে গিয়েছিল? দুবাই থেকে ছেলের ফোন। দরকারী কথাও ছিল কিছু। আর ওদিকে বুড়োটা কি সুন্দর ভালো মানুষের মত খাটের উপর বসে বসে চা খেতে খেতে পত্রিকা পড়ছিল। সবকিছুই আর সবদিনের মত সুন্দর-স্বাভাবিকইতো ছিল! চোখের পলকে কোন মুহুর্তে যে হাওয়া হয়ে গেল! হারামজাদা দারোয়ান মোবারকটারও ঘুমের কোন টাইম টেবিল নেই। এবার দু’জনের একজনেরও চাকরি থাকে কিনা কে জানে?
দুই ভাই আর কুদ্দুসের সাথে মজনুও হাত লাগায় বৃদ্ধ মানুষটাকে ধরে গাড়িতে তুলে দেয়ার জন্য, সে আর কুদ্দুস পায়ের দিকটায়। “এই সামলায়া, আস্তে, আস্তে। মাথার দিক আগে...”। সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে শুক্কুর, জব্বার, আসলাম সহ আরো চেনা কয়েকজন। একটু নেক নজরে থাকার চেষ্টা। কিন্তু দুই ছেলে, কুদ্দুস আর মজনুর ধরাধরির মাঝে সুযোগ করতে পারে না। বিজয়ীর হাসি কেবল মজনু মিয়ার মুখে। গাড়ীতে তুলে মজনু বিগলিত ভঙ্গিতে সালাম দেয় দুই স্যারকে। “ওয়াইলাইকুমস্লাম মজনু মিয়া, থ্যাংক ইউ এগেন” বলে আলতো করে পিঠ চাপড়ে দিয়ে রাফি পকেটের মানিব্যাগ বের করে কড়কড়ে পাঁচটা এক হাজার টাকার নোট গুঁজে দেয় মজনু মিয়ার হাতে। “না স্যার, না স্যার, লাগবে না স্যার...” বলতে বলতে সেও মুঠোর মধ্যে টাকাটা নিয়েই নেয়। আনন্দে মনটা একেবারে বাকবাকুম! আরে, এই পুরষ্কারের জন্যইতো ব্যাবসাপাতি বন্ধ করে বুড়োটাকে নিয়ে বসে আছে এই দেড় ঘন্টা। কড়কড়ে নোট হাত বদল হতে দেখে সময় মত নজীর আলী ওদের নজরে না পড়ার দুঃখে ঈর্ষায় জ্বলতে থাকে শুক্কুর, জব্বার আর আসলামের বুক। যদিও ওদেরও এই সুযোগ হয়েছিল আগে একবার করে। তবে মজনু মিয়ার এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। তবু ওরাও বিদায়ী সালাম দেয়, “আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।” শুক্কুর আসলামের পেছন থেকে হাত তুলে একটু গলা চড়িয়ে বলে, “এই এলাকায় মুরুব্বির খেদমতে আমরা সবসময় আছি স্যার, চিন্তা নিয়েন না স্যার।” ওদের মনের কথাটা বুঝতে পারে রাফি। মৃদু হেসে সে একটা করে নতুন হাজার টাকার নোট ধরিয়ে ওদের কয়জনের হাতে। খুশিতে চকচক করে ওঠে ওদের চোখও। ফাও পাওয়ার আনন্দ আরো বেশী। এপর্যন্ত ওনাদেরকে কোনদিন পুরোন নোট দিতে দেখে নি ওরা। তারপর হুশ করে বেড়িয়ে যায় বিশাল কালো গাড়ীটা। সেটার ভেতর ক্লান্ত দুচোখ বুঁজে হেলান দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসে স্মৃতির উলটো পথ ধরে কি যেন খুঁজতে থাকেন বৃদ্ধ নজীর আলী, কিংবা মরিয়ম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জনাব এন. আলী, দেশের প্রথম সারীর শিল্পপতি, একজন সফল মানুষ, একজন বাবা।
চলে যাওয়া গাড়ীর দিকে একবুক আশা আর ভবিষ্যত গোপন প্রতিযোগিতা নিয়ে তাকিয়ে আছে মজনু, শুক্কুর, জব্বার আর আসলাম। আবার কবে জানি এই বুড়োটার হঠাৎ মাথা বিগড়াবে, আর সবাইকে ফাঁকি দিয়ে গুলশানের প্রাসাদোপম বাড়ী ছেড়ে চলে আসবে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের ১ নম্বর গেটের কাছে, বহুযুগ আগে কি জানি কিভাবে যেন হারিয়ে যাওয়া মিনু নামের একটা মেয়েকে খুঁজতে।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী
মন্তব্য
মন খারাপ করা গল্প। কিন্তু, গল্প পছন্দ হয়েছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
গল্প পছন্দ হয়েছে জেনে ভালো লাগছে। অনেক ধন্যবাদ।
এমন নয় যে গল্পটা নতুন, লেখক দারুণ কোন জীবনদর্শনের কথা বলছেন আমাদের। তবে তিনি ভালো লেখেন। আসলে ভালো নয়, দুর্দান্ত লেখেন তিনি। মাত্রুশকা পুতুলের মতো গল্পের ভেতরে গল্প, তাঁর ভেতরে ছোটো ছোটো প্লট, কিছু তার জুড়েছেন পাশাপাশি সেলাই করে, কিছু চলেছে সমান্তরাল।
সাইবেরিয়াতে বেশিদিন আটকে থাকার পাত্র যে আপনি নন সে আশংকা আমার ছিল ইকরাম ফরিদ চৌধুরী।
----মোখলেস হোসেন
আপনার মন্তব্যগুলো আপনার গল্পের মতই গোছানো, সুন্দর। অনেক ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য। গল্প আগেও লিখেছি দু' চারটা, অন্য ব্লগে। আইভান ডেনিসোভিচ বরং আমার প্রথম খেয়ালী অনুবাদের চেষ্টা। তবে সাইবেরিয়াতে মনে হচ্ছে ঠান্ডাটার প্রকোপটা একটু বেশীই, তাই পাঠকের আনাগোনা কম। সেকারনেই যে শহরে থাকি সেটাকেই পুঁজি করে একটা গল্প হঠাৎ করেই ফেঁদে বসলাম।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী
দারুন সুন্দর একটা গল্প পড়লাম।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
কষ্ট করে সময় নিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। হঠাৎ করেই লেখা। খুব বেশী চিন্তা ভাবনা করি নি। আপনার ভালো লেগেছে জেনে অনেক ভালো লাগছে।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী।
আগেই পড়েছিলাম। আজ শুধু ভালোলাগা জানাতে এসেছি। ছোট ছোট বর্ণনাগুলো খুব নিখুঁত করে দিয়েছেন।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
অনেক ধন্যবাদ গল্পটি পড়ার জন্য এবং মূল্যবান মন্তব্যের জন্য।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী
নতুন মন্তব্য করুন