গত ২১শে এপ্রিল, সারা বাংলাদেশকে অঝোরও ধারায় কাঁদিয়ে খসে পড়লো একটি নক্ষত্র, লাকী আখন্দ। লাকী আখন্দ, কে উনি? একজন সুরকার? গায়ক? যন্ত্রী? মুক্তিযোদ্ধা? নাকি একজন কিংবদন্তী…আসলেই কে উনি? দুঃখের বিষয় যে আমরা অনেকেই এই অত্যন্ত অমায়িক, মিষ্টভাষী, বিনয়ী, নম্র স্বভাবসুলভ, অভিমানী মানুষটিকে ভাল করে চিনতে পারিনি। লাকি আখন্দের কাছে বাংলা গান এবং বাংলা গানের স্রোতারা আজীবন ঋণী, যা কোনোদিনও শোধ হবে না।
Contemporary বাংলা গান লাকী আখন্দ ছাড়া অসম্পূর্ণ। কিছু কিছু গান আমাদের জীবনের মুহূর্তগুলোর সাথে জড়িয়ে থাকে। আবার এলো যে সন্ধ্যা, আগে যদি জানিতাম, এই নীল মণিহার, যেখানে সীমান্ত তোমার, কবিতা পড়ার প্রহর, আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না, আজ এই বৃষ্টির কান্না...ছাড়াও অসংখ্য গানের সুরকার ও গায়ক তিনি। আমাদের দেশের অনেক স্বনামধন্য গায়ক/গায়িকা লাকী আখন্দের সুরে গান করেছেন।
সত্তর দশকে যখন দেশীয় সঙ্গীতভুবনে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রভাব শুরু হয়, বিশেষ করে যন্ত্রানুসঙ্গে, তখন গিটার হাতে দুই ভাই, লাকী আখন্দ আর হ্যাপি আখন্দ বাংলা গানে নিয়ে এলেন নতুন সুর, নতুন ছন্দ, নতুন ধরণের যন্ত্রানুসঙ্গ, নতুন গান, আর নতুন স্বপ্ন, যা এই যুগেও নতুনই রয়ে গেল। বাংলা গানের ভুবনে শুরু হল নতুন অধ্যায়, ব্যান্ড সঙ্গীতের সূত্রপাত। অচিরেই সঙ্গীত জগতে এই দুই ভাই হয়ে গেলেন সবচেয়ে পরিচিত নাম। শুধু গিটার কেন, কিবোর্ড, হারমনিকা, অ্যাকরডিয়ান, পারকাশন সব কিছুতেই পারদর্শী।
আমার বাবা রেডিও টেলিভিশনের পেশাদার শিল্পী বিধায় ছোটবেলা থেকেই অনেক নামকরা গানের কারিগরের সান্নিধ্যে এসেছি। বাবা কাজও করতেন রেডিও বাংলাদেশে। তাই সেই সুবাদে প্রায়ই রেকর্ডিং দেখার সৌভাগ্য হতো। সেই সময় লাকী আখন্দ বাবার একটা গানের সুর নিয়ে কাজ করতে বাসায় আসতেন। রেকর্ডিং চলাকালীন সময়ে হঠাৎ করেই ঝাঁকড়া চুলের একটা ছেলে স্টুডিওতে ঢুকে “গানে গিটার নেই কেন…??” বলে বেশ হইচই করলেন। আমি তখন অনেক ছোট, বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা কি হচ্ছে। পরে সেই ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটি গিটার নিয়ে আমার পাশে বসে পুরো গানটি অবলীলায় বাজিয়ে দিলেন। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখলাম আর ভাবলাম এটা কিভাবে সম্ভব। পরে জানলাম উনি ছিলেন কিংবদন্তী হ্যাপি আখন্দ। এর কিছুদিন পরেই হ্যাপি আখন্দের অকাল মৃত্যু। দেশের বেশিরভাগ ব্যান্ডের মুখে তখন হ্যাপির গান। কিন্তু অনেক একা হয়ে গেলেন বড় ভাই লাকী আখন্দ।
তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেল। ১৯৯৩, আমি তখন এইচ, এস, সি, পাশ করে নিজের ব্যান্ড করবো তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তখন বাবা কথা বললেন লাকী আখন্দের সাথে আমাকে গিটার শেখানর ব্যাপারে, ডাক পড়লো বাবার অফিসে শাহবাগ রেডিও বাংলাদেশে, গিয়ে দেখি লাকী আখন্দ অপেক্ষা করছেন। এতো বড় একজন সুরকার অথচ কোনও দাম্ভিকতা নেই। আমার সৌভাগ্য হল এমন একজনের সান্নিধ্য পাবার, তার কাছ থেকে গিটার আর কিবোর্ডে হাতেখড়ি পাবার। তারপর অনেকদিন ধরে অনেক মনোযোগ দিয়ে শেখালেন বিভিন্ন কর্ড, আর কর্ড চেঞ্জিং। এর মাঝে প্রায়ই হারমোনিয়াম নিয়ে আসা হতো, আমি অনুরোধে গান করতাম, লাকী আখন্দ হারমোনিয়াম বাজিয়ে কর্ড চেঞ্জিংগুলো দেখিয়ে দিতেন। শুধু তাই না, গিটার কেনার আগে যেন ওনাকে সাথে নিয়ে যাই, যাতে ভাল দেখে পছন্দ করে দিতে পারেন। এর মাঝে অনেকবার চেয়েছেন আমাকে দিয়ে গান করাবেন, হয়ে উঠলো না। আমিও চলে আসলাম দেশের বাইরে। শুধু ওনার সাথে শেষ কথাটা ভেতরে গেঁথে থাকলো, বললেন, “তুমি দেশের বাইরে চলে যাচ্ছ? তোমার মতো শিল্পী আমাদের দেশে অনেক প্রয়োজন ছিল।”
লাকী আখন্দ শুধুমাত্র কিংবদন্তী একজন শিল্পীই নন, একজন চমৎকার মানুষও। কিছু কিছু গান আমাদের জীবনের মুহূর্তগুলোর সাথে জড়িয়ে থাকে। গান থেকে যেমন আমাদের পাবার অনেক কিছু থাকে, তেমনি যারা এই গানগুলোর জনক, তাঁদের জন্যে আমাদের কিছু দেবারও থাকে। কয়জন বলতে পারবেন যে আপনার কেনা অ্যালবামের টাকা লাকি আখন্দের মতো আরও অনেক শিল্পীর হাতে এসে পৌঁছেছে...পৌঁছে থাকলে আমাদের দেশে "দুস্থ শিল্পী" নামক বিশেষণটা থাকতো না। যাই হোক, সেই প্রসঙ্গে আর না যাই। শিল্পী তাঁর শিল্পের মাঝেই বেঁচে থাকুক, এই কামনাই রইলো।
- রিদম হাসান
মন্তব্য
এটাই আসল কথা
প্রথম দফা গানের অ্যালবাম বের হলো। কণ্ঠশিল্পী হয়তো কিছু টাকা পেলেন; গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক আর যন্ত্রশিল্পীরা
আরও সামান্য কিছু টাকা পেলেন।
গানের অ্যালবামটি আরও কয়েক দফা বের হলো। কণ্ঠশিল্পী-গীতিকার-সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক-যন্ত্রশিল্পীরা কোন টাকা পেলেন না।
অ্যালবামটির গান রেডিও চ্যানেলগুলো আর টিভি চ্যানেলগুলোতে বাজলো। কণ্ঠশিল্পী-গীতিকার-সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক-যন্ত্রশিল্পীরা কোন টাকা পেলেন না।
উৎস স্বীকার করে বা না করে অ্যালবামটির গান অন্যরা গাইলো। কণ্ঠশিল্পী-গীতিকার-সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক-যন্ত্রশিল্পীরা কোন টাকা পেলেন না।
মোটামুটি বিনা পয়সায় গান শুনতে আগ্রহী শ্রোতা, রয়্যালটির কথা শুনলে চোখ কপালে তুলতে অভ্যস্ত রেকর্ড কোম্পানী-রেডিও-টিভি-গান ব্যবসায়ী যত দিন সংখ্যায় ভারি থাকবে ততদিন 'দুঃস্থ শিল্পী' শব্দটা প্রায়ই মিডিয়ায় আসবে।
লাকী অনন্য - ছিলেন, আছেন, থাকবেন।
অপূরনীয় একটা ক্ষতি, আর তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কথা এই ধরণের সৃজনী শক্তি গুলোকে আমাদের সময়টা কি আদৌ সৃষ্টি করতে পারছে। কালজয়ী এই শিল্পীর জন্য শ্রদ্ধা।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
কোনো শূন্যস্থানই পূরণ হয় না, শুধু নতুনের চাপে বিস্মৃত হয়। হুমায়ূন ফরীদি মারা যাওয়ার পর মনে হয়েছিলো, এ শূন্যস্থানটা বহুদিন প্রকট হয়ে রয়ে যাবে মানুষের মাঝে। দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয়তা সত্ত্বেও লাকী আখন্দের মৃত্যু তেমনই আরেকটা শূন্যস্থান তৈরি করে গেলো।
যাঁরা ভালো গান লিখতে পারেন, যাঁরা সে গানে ভালো সুর দিতে পারেন, তারা এক একজন এক একটা ফুলের প্রজাতির মতো, বিনা শর্তে জগৎ রঙিন করে রাখেন। লাকী আখন্দের অনুপস্থিতির শোক ভুলিয়ে দেওয়ার মতো দ্বিতীয় কেউ সক্রিয় হয়ে উঠুন, তিনি অনুপ্রাণিত করুন তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চমজনকে।
মন্তব্যে জাঝা!
চমৎকার স্মৃতিচারণ
লাকী আখন্দ চলে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তার কালজয়ী সৃষ্টি। যে সৃষ্টি আজও শ্রোতাদের মুখে মুখে।
"আগে যদি জানিতাম", "আবার এলো যে সন্ধ্যা", " আমায় ডেকো না" এই গানগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে
থাকবে।।
নতুন মন্তব্য করুন