পরিণীতা
--- রাজিব মাহমুদ
সন্ধ্যেটা বিকেলের পায়ের কাছে এসে বসে আছে। খুব সন্তর্পণে ওপরে ওঠার চেষ্টা তার। এই নিয়ন-সাইন-বিলবোর্ডের শহরে গো-ধূলির ‘গো’ আর কই আর তাই অফিস-ফেরতা বাসগুলোকে ঐ শূন্যস্থানে বসিয়ে সময়টাকে বড়জোর বাস-ধূলি বলে চালানো যেতে পারে। ফর ফর শব্দে বাতাসের অলিম্পিক চলছে জানালার ওপাশে। ওখান থেকে এক ঠোঙ্গা বাতাস কে যেন তার মুখে ছুড়ে দিয়েই দে ছুট। ‘তার’ মানে লিয়াকত মান্নানের যিনি একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কের কমিউনিকেশনস সেকশনের প্রধান। ব্যক্তিজীবনে অকৃতদার ও ভেতর-গোঁজা। লোনের টাকায় কেনা ১৫০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে একাই থাকেন তিনি। এই মুহূর্তে তিনি বসে আছেন নিজের ঘরের লেখার টেবিলের জানালার পাশে।
তার আরও একটা পরিচয় আছে: তিনি এই সময়ের একজন পাঠকপ্রিয় গল্পকার। একুশে’র বইমেলার প্রথম সপ্তাহেই তার অন্তত: একটি গল্পের বইয়ের হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায়। এই সময়ের গল্প-বিমুখ পাঠকদের, যারা কিনা শুধু উপন্যাস পড়তে চায়, গল্প পড়িয়ে ছেড়েছেন তিনি। শহুরে উচ্চ-মধ্যবিত্তের একটা অংশের গল্পের মেজাজটা খুব ভালো বোঝেন তিনি। সেই বুঝ থেকে তৈরি করে নিয়েছেন গল্প বলার নিজস্ব সুস্বাদু একটা ঢং।
তার পাঠকদের উপন্যাস পড়ার সময় নেই। প্রচলিত ছোটগল্পও তারা খুব একটা পড়েন না। আবার তাই বলে তারা যে অণু-পরমাণু গল্পের পাঠক সেটাও নয়। কেননা ওগুলো আবার আকারে একটু বেশিই ছোট। গল্প শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। এরা পছন্দ করে ১৫-২০ মিনিট লাগে পড়তে এরকম হাল্কা রসবতী গল্প। এসব গল্পের নায়িকার নাম চুমু হলে নায়কের নাম আদর। গল্পের বিষয়বস্তু এই দু’ জনের আর্দ্র অভিমান। এর সাথে আছে বৃষ্টি আর জোছনা। আর আছে পাতার চার-পঞ্চমাংশ শূন্য থাকে এরকম দু’এক শব্দের স্পঞ্জ-গোল্লা টাইপ সংলাপ। পাঠক ধীরে-সুস্থে গল্পে কামড় বসায়, ঠোঁট চেপে ধরে খাঁজের রস খায় আর ‘ব্যস্ত-অথচ-আন্তরিক’ কর্পোরেট প্রেমিকের হাসি ঝুলিয়ে আই-ফোনে প্রেমিকার সাথে কথা বলার মত করে গল্প পড়ে যায়। গল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে লেগে থাকে আদর-চুমুর অভিমানের নোনতা-মিষ্টি শব্দ-বাক্যগুলো। এসব গল্প জ্যামে বসে থাকার সময় বা বউয়ের সাথে টিভি’র চ্যানেল নিয়ে কাড়াকাড়িতে হেরে গিয়ে পড়ার জন্য আদর্শ। আর এমন গল্পেরই ওস্তাদ কারিগর লিয়াকত মান্নান।
সন্ধ্যেটা বিকেলের গায়ে যে কখন উঠে গেছে টের পেলেন না লিয়াকত মান্নান। অফিস থেকে আজ একটু আগেই চলে এসেছেন তিনি। শরীরটা ঠিক হাতে-পায়ে নিজের নেই যেন আজ-কথা শুনছে না কিছুতেই। তিনি যতই চেষ্টা করলেন কিছু জরুরী অফিশিয়াল ই-মেইলের উত্তর দিতে, শরীরটা যেন ঠিক ততই চাইছে বিশ্রাম। ভেবেছিলেন বাসায় এসে লিখতে বসলে হয়তো খারাপ লাগবে না। কিন্তু হাঁ করে করে পড়ে থেকে তার ল্যাপটপের স্ক্রিন একসময় “ঘুম”- মোড এ চলে গেলো। লেখা হলনা একটি লাইন-ও। একটা গল্প শেষ কয়েকটা প্যারার জন্য অসমাপ্ত পড়ে ছিল, পড়েই রইল।
চায়ের পাতলা লিকার গাঢ় হওয়ার মত আস্তে আস্তে গাঢ় হচ্ছে বাইরের অন্ধকার। কিছুক্ষণ আগের ফিচেল মেজাজটার ওপর পাতলা গাম্ভীর্যের নরম খোসা পড়তে শুরু করেছে । এর সাথে বাড়তে থাকে লেখকের অবসন্নতা । মনে হল ঠিক এখুনি ঘুমাতে না পারলে শরীরটা নুড়ি পাথরের মূর্তির মত চুরচুর করে ভেঙে পড়বে।
ঘটনাটা ঘটল ঠিক এই সময়েই- একটা কাশির শব্দ শোনা গেলো খুব কাছেই। গলাটা মেয়েলি।
ঘর এখন বেশ অন্ধকার। লিয়াকত মান্নান নিজের হাতটাও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন না। জানালার কোণার দিকটায় একটা আবছা আলোর রেখার ভেতরে একটা মেয়ের অবয়ব ফুটে উঠলো; জানালা-লাগোয়া চেয়ারটায় সে বসে আছে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে-খোলা চুল, ঈষৎ গোলাকার মুখ, মাঝারি স্বাস্থ্য, ঠোঁটের কোণায় পাতলা নরম হাসি। পরনে একটা সাদা সিল্কের শাড়ি, লাল পাড়। কোথা থেকে যেন বেলি ফুলের একটা গন্ধ ভেসে আসছে।
মেয়েটা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তাকানোর ভঙ্গিতে একটা কোমলতা মেশানো কৌতুক আছে। লেখকের ভয় তার কন্ঠে চাপা থাকল না-
“কে?”
খুকবুক খুকবুক কাশির শব্দ শোনা গেলো প্রথমে। সেই সাথে চাপা হাসির শব্দ। এরপর পরিষ্কার গলায় উত্তর এলো
“আমি পরিণীতা”
এরকম স্পষ্ট জবাবে লেখক থতমত খেয়ে গেলেন কিছুটা। এটা তাহলে কোন স্বপ্ন বা ঘোর নয়। পাঁচটার মধ্যে তিনটা ইন্দ্রিয়-ই তাকে বলছে যে ব্যাপারটা ঘটছে। তিনি চোখ সরু করে দেখতে থাকেন মেয়েটাকে। গলার কাছে হাতটা তুলে কাঁপুনি থামাতে থামাতে জিজ্ঞেস করলেন-
“কোন পরিণীতা?”
“যে গল্পটা আপনি এখন লিখছেন”
“মানে?”
“আপনি আমাকেই লিখছেন এখন।”
“আপনাকে লিখছি?”
চকিতে লিয়াকত মান্নানের মনে পড়ে যায় যে তিনি এখন যে গল্পটা লিখছেন সেই গল্পের শিরোনাম “পরিণীতা”। তার গল্প এসেছে তার-ই সাথে দেখা করতে? এও কি সম্ভব? তিনি কিছু না বুঝে তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে।
পরিণীতা হঠাৎ-ই কেমন গম্ভীর হয়ে বলল,
“আমি কিছু কথা বলতে এসেছি আপনাকে”
লেখক চুপ।
“শুনছেন?” পরিণীতা কিছুটা অধৈর্য হয়ে জানতে চায়।
“হ্যাঁ...না মানে কী ব্যাপারে?” লেখক ঢোক গিলে কোনরকমে বলতে পারলেন।
“আমার (মানে গল্পের) প্রধান চরিত্র যে মেয়েটা অর্থাৎ পরিণীতা তাকে আপনি ঠিক ফোটাতে পারছেন না”
লেখক পত্রিকায় নিজের গল্পের সমালোচনা প্রায়ই পড়েন। কখনো খুশি হন, আবার কখনো বা বিরক্ত। কিন্তু নিজের লেখা গল্পের কাছ থেকে সমালোচনা শুনে ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দেবেন বুঝতে পারলেন না। তবু অভিনেতার মত গানের সাথে শুধু ঠোঁট নাড়ানোর মত করে অথবা যেন বা নিজের সাথে কথা বলছেন এমন ভাবে বিড় বিড় করে বললেন-
“কী ফোটাতে পারছি না?”
“পরিণীতা’র চরিত্রটাকে। আপনি জনপ্রিয় লেখক তাই পাঠকের কথা মাথায় রেখেই লেখেন। কিন্তু একটা গল্পেরও তো লেখকের কাছে কিছু দাবি থাকতে পারে, তাই না?”
“ঠিক কী বলতে চান?” হঠাৎ-ই যেন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছেন লেখক।
“আপনি আপনার গল্পকে পাঠক-প্রিয় করার জন্য পাঠক যেভাবে পড়ে মজা পায় বা পেতে পারে বলে মনে করেন সেভাবে লিখছেন। কিন্তু একটা গল্পের শরীর সুন্দরভাবে গঠনের জন্য বর্ণনা আর বিশ্লেষণের ভেতরের যে সৌন্দর্য-চেতনা সেটা নিয়ে আপনি ভাবছেন না বা ভাবতে চাইছেন না।”
“কীরকম?”
“ধরুন পরিণীতা চরিত্রটির কথা। এই চরিত্রের টানাপড়েনগুলোকে আপনি-ই দাঁড় করিয়েছেন। অথচ সেগুলোর একটা মানবিক বিশ্লেষণের দিকে না গিয়ে আপনি অযথাই তার শরীরের বর্ণনা দিয়ে গেছেন লম্বা লম্বা প্যারাগ্রাফে। অর্থাৎ আপনি চরিত্রটার ক্রাইসিসকে স্পেস না দিয়ে স্পেস দিচ্ছেন তার কামজ সৌন্দর্যকে কেননা পাঠক এসবই বেশি পড়ে। উঠতি বয়সের পাঠক থেকে শুরু করে পূর্ণবয়স্ক পাঠকও ঐ কামোত্তেজক জায়গাগুলো পড়ে মজা পায়। কেউ কেউ আবার পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে রাখে পরে আবার পড়ার জন্য। পাঠকের চাহিদা-মাফিক যোগান দিতে গিয়ে আপনি গল্পটাকে বিকৃত করছেন।”
“এটা আমার স্টাইল…”
“শুধু স্টাইলের দোহাই পেড়ে লেখকেরা নিজেদের সাহিত্যিক অপরাধগুলোকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে আসছে সেই শুরু থেকেই। বড় বড় মাস্টাররাও এর বাইরে নয়। চলুন আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই। আপনার কিছু নতুন উপলব্ধি হওয়া দরকার।”
“কোথায়?”
“গেলেই বুঝবেন।”
লিয়াকত মান্নান হঠাৎ-ই নিজেকে আবিষ্কার করলেন একটা কার্পেট বিছানো নীল করিডোরের ভেতর। পরিণীতা হাঁটছে সামনে সামনে। পুরো ব্যাপারটা এতোটাই জীবন্ত যে পরিণীতা হাঁটার সময় তার সিল্কের শাড়ি’র যে খসখস শব্দ হচ্ছে সেটাও শুনতে পাচ্ছেন লেখক। ডানে একটা ভারী কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে সে ভেতরে ঢুকে হাত ইশারায় লেখককে ভেতরে যেতে বলল।
দরজার ওপাশটা বেশ আরামদায়ক ঠাণ্ডা আর শান্ত। মাথায় ধবধবে সাদা চুল আর নাকের ওপরের রিম্লেস চশমা নিয়ে একজন প্রায় বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন একটা বড় কাঁচের টেবিলের ওপাশে। একটা ভারী রেজিস্টার খাতায় চোখ বোলাচ্ছেন তিনি। পরিণীতা তার খুব কাছে গিয়ে কিশোরীর মত গলায় বলল, “পলাদি দ্যাখো কে এসেছে!”
লেখক এখন গল্প-ঘরে যেখানে পৃথিবীর সব গল্পেরা থাকে। পলাদি এই গল্প-ঘরের তত্ত্বাবধায়ক। ঐ ভারী রেজিস্টার খাতাটা যেটায় তিনি চোখ বোলাচ্ছিলেন তাতে পৃথিবীর সব গল্পের জন্য একেকটা এন্ট্রি দেয়া আছে। এখানে প্রত্যেক গল্পের জন্য রয়েছে আলাদা কক্ষ। তবে এসব কক্ষের বরাদ্দ তিন শ্রেণির গল্পরা পেয়ে থাকে (ক) প্রকাশিত গল্প (খ) লিখিত কিন্তু অপ্রকাশিত এমন গল্প ও (গ) এখনো লেখক পায়নি এমন গল্প।
প্রকাশিত গল্পরা শান্ত স্বভাবের। এরা এদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষ থেকে তেমন বের হয় না। এরা প্রকাশিত হলেও নিজেদের লেখকদের নিয়ে নানা অসন্তোষে ভোগে। ভাবে আরও ভালো লেখক পেলে তাদের জীবনটা অন্যরকম হতো। তারা থাকতে পারতো বিশ্বের পাঠককুলের মধ্যমণি হয়ে।
লিখিত কিন্তু অপ্রকাশিত গল্পরা নিজেদের আরও সুগঠিত ও বাড়ন্ত দেখতে চায়। এরা প্রায় প্রত্যেকেই ভাবে যে প্রকাশের আগে তাদের আরও সংশোধিত হওয়া প্রয়োজন-নিজেদের শরীরের একেকটা শব্দ-বাক্যকে এরা চকচকে অলংকারের মত জ্বলজ্বলে দেখতে চায়। এরা এদের লেখকদের ক্রমাগত উসকাতে থাকে এদের শরীরের বিভিন্ন জায়গাগুলোকে আবার লেখার জন্য।
আর লেখক না পাওয়া গল্পগুলো একটু বাউণ্ডুলে টাইপ। এরা রাত-বিরেতে লেখকের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। কোন লেখকের খোঁজ পেলে এরা উড়ে উড়ে লেখকের মগজে গিয়ে বসে ক্রমাগত সেখানে আঁচড় কাটতে থাকে। কেউ কেউ পেয়ে যায় মনের মত লেখক, কেউ বা পায় না আবার কেউ লেখক পেয়েও পছন্দ না হওয়ায় ফিরে আসে নিজেদের কক্ষে। ফেরত আসা গল্পগুলোর কারো কারো মুখে বসন্তের কালো দাগ বা ব্রণ, কারো বা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পোড়া চামড়া। এই খুঁত গুলো তাদের লেখকদের অক্ষমতার ধারক যারা তাদের ঠিকমত লিখে উঠতে পারেনি। নিজেদের শরীরের খুঁত নিয়ে এরা ভীষণ বিব্রত থাকে। তাই প্রথমে বাউণ্ডুলে থাকলেও ফিরে আসার পরে এরা খুব একটা বাইরে বেরোতে চায় না।
শ্রেণিবিভাগ এখানেই শেষ নয়। গল্পগুলো লিঙ্গের ভিত্তিতেও বিভক্ত: ছেলে গল্প আর মেয়ে গল্প। পরিণীতা যেমন একটা মেয়ে গল্প, যার বরাদ্দকৃত কক্ষটি ২২৫ তলায়, দক্ষিণমুখী। লেখককে সে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। খোলামেলা ঘর; প্রচুর আলো বাতাস। নানা বিষয়ে এটা-সেটা কথা’র পর পরিণীতার বারান্দায় দাঁড়িয়ে লেখক তাকে এক অদ্ভুত প্রস্তাব দিয়ে বসেন। সেটা এরকম: গল্প-ঘরের বিশ্ববিখ্যাত কয়েকটা বা কয়েকজন গল্পের সাথে কথা বলতে চান লেখক।
লেখক পরিণীতাকে লেখকদের একটা লিস্ট ধরিয়ে দিলেন। তবে পলাদি জানালেন যে লেখক যে গল্পগুলো’র সাথে দেখা করতে চান তাদের মধ্যে মাত্র তিনজন এই মুহূর্তে নিজেদের কক্ষে অবস্থান করছেন। এরা হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’, ফ্রান্য কাফ্কার ‘মেটামরফোসিস’ আর আর্নেস্ট হেমিংওয়ে’র ‘হিল্স লাইক হোয়াইট এলিফ্যান্ট’। এদের মধ্যে প্রথম আর শেষ গল্পটা মেয়ে মাঝেরটা ছেলে। লিঙ্গের যুক্তিটা এখানে ঠিক পরিষ্কার নয়। এটা নাকি গল্পের বৈশিষ্ট্য থেকে নির্ধারিত হয়। তবে মেয়ে গল্পগুলো সাধারণত পুরুষ লেখক বেশি পছন্দ করে আর পুরুষ গল্পগুলো স্বাভাবিকভাবেই পছন্দ করে নারী লেখক।
সমস্যা হল এই তিনটে গল্প’র কারো কাছ থেকেই তাদের কক্ষে গিয়ে দেখা করার অনুমতি পাওয়া গেলনা। তারা শুধুই ইন্টার-কমে কথা বলতে রাজি হল। কারণটা পরিণীতাকে জিজ্ঞেস করায় যে বলল যে এই গল্পগুলো যেহেতু একেকজন মাস্টারের লেখা তাই তারা তাদের দুর্বলতাগুলো বাইরের কারো কাছে প্রকাশ করতে চায় না। আর সেই মানুষটা যদি হয় কোন লেখক হয় তাহলে তো গল্পগুলো আরও বেশি বেঁকে বসে।
আলাদা আলাদা করে তিন গল্পের সাথেই কথা বললেন লিয়াকত মান্নান। পোস্টমাস্টার খুব স্বল্পভাষী; মৃদুস্বরে থেমে থেমে কথা বলল সে। তবে তার কণ্ঠস্বরের প্রচ্ছন্ন রাগ চাপা থাকছে না। রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে তার প্রথম অভিযোগ হল তিনি “পোস্টমাস্টার” গল্পটা একপেশে ভাবে শুধু পোস্টমাস্টারকে কেন্দ্র করেই বলে গেছেন। রতনকে রাখা হয়েছে সম্পূর্ণ নীরব; তার দুঃখগুলোকে ভাষা দেয়া হয়নি। সে যেন শুধুই কেঠো চরিত্র, পুরো গল্পে তার কোন সবল অংশগ্রহণ নেই। দ্বিতীয় অভিযোগ হল গল্পের বিয়োগান্তকতা। পোস্টমাস্টার কি পারতেন না রতনকে কোলকাতা নিয়ে যেতে? এটা করলে প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে দেখিয়ে দেয়া হতো একহাত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সেটা করেননি। এই না- করাটা ‘পোস্টমাস্টার’ এর মুখে একটা বিশ্রী গর্ত হয়ে ভেংচি কাটছে পুরো গল্পের দুনিয়াকে।
পরের গল্প ‘মেটামরফোসিস’ এর অভিমান বেশ উচ্চকিত। তার একটাই কথা যে গ্রেগর সাম্সাকে পোকা বানিয়ে একটা সোশ্যাল মেসেজ দিতে গিয়ে তার বোন, মা আর বাবা’র চরিত্রের স্বাভাবিক মানবতাগুলোকে মুছে ফেলা হয়েছে। গল্পটার নিজের ভাষায় ব্যাপারটা এরকম: ফ্রান্য কাফকা গল্পের শরীরের একটা অংশকে মনোরম বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে গিয়ে অন্যগুলোর হাত-পা কেটে গল্পের শরীরে একটা আরোপিত শিল্প-শোভা ফোটাতে চেয়েছেন। এতে নষ্ট হয়েছে স্বাভাবিকতা, গল্প হারিয়েছে তার প্রাকৃতিক প্রাণের দ্যুতি।
শেষ কথোপকথনটা হয় হেমিংওয়ের ‘হিল্স লাইক হোয়াইট এলিফ্যান্ট’ এর সাথে। এই গল্পের মূল অভিযোগ হল লেখকের ভাষা নিয়ে। হেমিংওয়ে’র “লেস ইজ মোর” বা “কম-ই বেশি” এর দর্শনের তেলেসমাতি গল্পে দেখাতে গিয়ে তিনি গল্পের বিভিন্ন জায়গায় বর্ণনা আর সংলাপকে অমানবিক ভাবে ছেঁটে ফেলেছেন। এতে করে ভেতরের গল্পটা যে ভাষার আঁটোসাঁটো জামায় হাঁসফাঁস করছে সেটা যেন লেখক বুঝেও বোঝেন নি। তিনি শুধু তার নিজের বিশ্বাস করা দর্শনকে একটা সাহিত্যিক জায়গা দিতেই ব্যস্ত ছিলেন।
সেরাতে গল্প-ঘর থেকে কখন ও কীভাবে ফিরে এসেছেন সেটা মনে করতে পারলেননা লিয়াকত মান্নান। তবে সেখানে যা যা ঘটেছে তার ছোট একটা ছোট টুকরোও ভুললেন না তিনি। এর পরের দুই দিন পরিণীতা এলো না আর তাই “পরিণীতা”ও আর এগলোনা। খুব চিন্তামগ্ন দু’টি দিন কাটালেন লেখক। তৃতীয় দিনে তার লেখার টেবিলের পাশে আবারো পরিণীতার নাটকীয় আবির্ভাব, হাসতে হাসতে বলল, “আপনাকে দু’টা দিন ভাবার সময় দিলাম।”
সেদিন থেকেই আবার লেখকের ল্যাপটপ জেগে উঠল। টানা বেশ কয়েকদিন চলল লেখার কাজ। লেখার সময় পরিণীতা পাশে বসে থাকে আর লেখার বিভিন্ন জায়গায় পরামর্শ দেয়। কাজটা দারুণ উপভোগ করছেন লিয়াকত মান্নান। স্বয়ং গল্প এসে তাকে দিয়ে নিজেকে লিখিয়ে নিচ্ছে। এটা এর আগে কোন লেখকের জীবনে হয়েছে কি-না সেটা তার জানা নেই।
পরিণীতা আসতে শুরু করার পর থেকে লেখক ঘরের দরজা বন্ধ করে লেখেন। যদিও এই গার্হস্থ্য-গোপনীয়তার কোন প্রয়োজন নেই কেননা পুরো ফ্ল্যাটে তিনি একাই থাকেন। এছাড়াও ইদানীং অফিস থেকে ফেরার একটা দারুণ তাড়া অনুভব করেন তিনি। কখন লেখার টেবিলে বসবেন আর কখন পরিণীতা এসে গল্পটা এখানে-ওখানে ঠিক করে দেবে অফিসে সারাদিন এটাই ভাবেন। পরিণীতা’র সাথে সম্পর্কটা এখন অনেক সহজ হয়ে এসেছে আর সম্বোধনটাও নেমে এসেছে ‘তুমি’তে । থেকে থেকে শব্দ-বাক্য নিয়ে খুনসুটি করে পরিণীতা, মৃদু ধমক দিতেও ছাড়ে না; মাঝে মাঝে ফিনফিনিয়ে হেসে ওঠে আর বাতাসে কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ পান লেখক। কিশোর প্রেমিকের মত পরিণীতা’র সবকিছুতেই মুগ্ধ হতে থাকেন লেখক । বোকা বোকা হেসে সব মেনে নেন; যথাসাধ্য চেষ্টা করেন পরিণীতা যেভাবে চাইছে সেভাবেই গল্পটা লিখে উঠতে।
গল্পটা শুরুতে যা ছিল এখন তা আর প্রায় কিছুই নেই। ভাষা ও সংলাপে নানা পরিবর্তন এসেছে; বর্ণনায় ক্রমাগত ঘষা-মাজার ফলে গল্পের চেকনাই- ই শুধু বাড়েনি, মেজাজে ও ব্যক্তিত্বেও হয়ে উঠেছে টানটান আর পেশল। শুধু তাই নয় লেখায় বেশ একটা গতিও এসেছে। লিয়াকত মান্নানের লেখক জীবনে এত আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে তিনি শেষ কবে লিখেছেন তার মনে নেই। বেশির ভাগ লেখাই লিখতে হয়েছে প্রকাশকের ক্রমাগত চাপে অথবা পাঠকের চাহিদাকে আয়নার মত সামনে রেখে।
লেখাটা যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে তখন হঠাৎ-ই একদিন পরিণীতা আবারও এলো না। লেখক লেখার টেবিলে বসে অনেক সংগ্রামের পর দুই প্যারা লিখলেন। একেকটা বাক্য লিখে ওঠার পর প্রথমেই ভাবেন যে এটা পরিণীতা পছন্দ করবে কি-না বা তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে। পরিণীতার সাথে কাল্পনিক কথোপকথনের চেষ্টা করে লেখাটা চালিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলেন লেখক। সেরাতে তার ঘুম হল না। সকালে লাল চোখ আর ম্যাজম্যাজ করা শরীর নিয়েই অফিসে গেলেন।
পরিণীতা এর পরের দিনও এলো না। লেখক বেশ মুষড়ে পড়লেন। তার কেবল-ই মনে হতে লাগলো গল্পটা আর শেষ করতে পারবেন না তিনি। পরিণীতাকে পাশে রেখে লিখতে লিখতে এমন একটা অভ্যাসের মধ্যে তিনি গত কয়েক দিন গিয়েছেন যে এখন ওর উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। পরিণীতা যেন শুধু গল্প না, গল্পের মিউজও বটে। এখন তিনি জানেন না যে এই মিউজকে তিনি কীভাবে আবার আনবেন। এটা পরিণীতাকে জিজ্ঞেস করার কথা কখনো মনেই পড়েনি। নিজের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন লেখক।
লেখার টেবিলে অনেকক্ষণ বসে থেকেও যখন কিছু লিখতে পারলেন না, ফ্ল্যাটের দরজায় তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলেন লেখক। বাসার সামনের পার্কে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে পার্কের পাশেই একটা কফি শপে ঢুকলেন। কাল ছুটির দিন তাই সকালে ওঠার তাড়া নেই। তিনি জানালার পাশের একটা টেবিলে বসে এক কাপ কড়া কালো কফি অর্ডার দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকেন। হঠাৎ-ই তার চোখ গেলো রাস্তার ওপাশে-পরিণীতা হেঁটে আসছে। সেই শাদা সিল্কের শাড়িটাই পরা। তবে সে একা নয়; সাথে একটা আবছা ছায়ামূর্তিকে দেখা গেলো। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ছায়ামূর্তির চেহারা দেখা না গেলেও সে যে একটা পুরুষ এটা বেশ বোঝা গেলো। ওরা হেসে হেসে কথা বলতে বলতে এই কফি শপের দিকেই আসছে। আরও কাছাকাছি আসতেই লেখক চিনতে পারলেন লোকটাকে।
ভেতরে ঢুকে ওরা বসলো লেখকের উল্টোদিকের টেবিলে। পরিণীতা লেখকের দিকে পিঠ দিয়ে বসেছে কিন্তু তার পুরুষ সঙ্গীটি বসেছে লেখকের দিকে মুখ দিয়েই; লেখককে চিনতে পেরে পুরুষ সঙ্গীটি উঠে এলো। ওদিকে হাতের ওপর আঁচল ফেলা অর্ধেক পিঠ খোলা কালো স্যাটিনের ব্লাউজে মোহময়ী লাগছিলো পরিণীতাকে।
“আরে লিয়াকত ভাই, কেমন আছেন?” বলল পরিণীতার পুরুষ-বন্ধুটি যার আরেকটা পরিচয় হল সে এই সময়ের সিরিয়াস ধারার একজন গল্পকার। নাম সায়েম মাহমুদ। ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত ও এক সন্তানের জনক। তিনি লিয়াকত মান্নানের মত জনপ্রিয় লেখকদের কোন লেখক-ই মনে করেন না। তবে সামনাসামনি পড়ে গেলে বেশ একগাল হেসে কথা বলেন। লিয়াকত মান্নানও এসব সিরিয়াস লেখকদের একদমই পাত্তা দেন না। এদের সাথে কথা বললেই নানা ছুতোয় জ্ঞান দিতে আসে। তিনি বললেন
“ভালো আছি। তুমি কেমন?”
আরও কিছু ভাংতি আলাপের পর সায়েম আহমেদ উঠে গেলো। তার সাথে যে একটা মেয়ে আছে সেটা তার ভাবসাবে বোঝা গেলো না একেবারেই। পরিণীতা আগের মতই একইভাবে বসে আছে।
মনের ভেতর একটা চোখা কাঁটা লেখকের গলার কাছাকাছি উঠে এলো। পরিণীতা কি এজন্যই এই দু’দিন আসেনি? তাহলে সে তার পছন্দের লেখক পেয়ে গেছে! বাহ্! চমৎকার! তার কফি এসে গেছে। তেতো কফিটা আজকে আরও বেশি তেতো মনে হল। তিনি কোনরকমে দু’টো চুমুক দিয়ে বিল দিয়ে উঠে পড়লেন। দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় পরিণীতার সেই পরিচিত কাঁচ-ভাঙ্গা হাসির গুঁড়ো বাতাসে ভেসে টাল খেয়ে পড়লো কফি শপের দরজায়। মেয়েটা সত্যিই সম্মোহন জানে-ছলাকলায় অনেক বাস্তব চরিত্রকেও, যেমন হয়তো রাণী এলিজাবেথকেও, ছাড়িয়ে যাবে।
লেখক সিদ্ধান্ত নিলেন “পরিণীতা” আর লিখবেন না। গল্পটার প্রতি একটা তীব্র ঘৃণা নিয়ে কাটিয়ে দিলেন একটা গোটা সপ্তাহ। দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম দিনেই পরিণীতা এলো আবার। এসে এমন ভাবে লেখককে লেখার তাড়া দিলো যেন কিছুই হয়নি। লেখক বসে রইলেন পাথরের মত। তার শরীর ঠাস-বুনোট অভিমানে জমে গেছে আগা-গোড়া।
“রাগ করেছো না-কি, লেখক মশাই?” মুখ টিপে হাসল পরিণীতা।
“রাগ করার কী আছে? তুমি তোমার পছন্দমত লেখক বেছে নিতেই পারো। তবে একটু বলে গেলে ভালো হতো।”
“কী করে বলবো? আমি কি জানি সায়েম মাহমুদ আমাকে কতটুকু লিখতে পারবে?”
“এখন ফিরে এসেছ তার মানে সায়েম তোমাকে লিখতে পারেনি”
“না, পারেনি। লেখার চেয়ে ওর লেখার ভাব বেশি।”
“মানে?”
“মানে সে ভালোই লিখতে জানে। বলতে পারো ডিম ছেলার মত করে একটা গল্পের নবজাতক শরীরটাকে খোসা থেকে পিছলে বের করে আনতে জানে সে। কিন্তু সে অসম্ভব অলস ও লেখার চেয়ে লেখার ভান ধরে বেশি।”
“তো?”
“আমি ওর কাছে আর যাব না”
“ভালো।”
মান-অভিমান পর্ব শেষ হতে হতে মধ্যরাত। যা হওয়ার তাই-ই হলো। কি-বোর্ডে ঠকাঠক ঠকাঠক ঝড় উঠল আবার।
লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন লেখক। ঘুম থেকে জেগে দেখলেন জানালা খোলা। পরিণীতা নেই। ল্যাপটপ-ও অনেকক্ষণ স্পর্শহীন থেকে ঘুমিয়ে গেছে। ল্যাপটপকে জেগে ওঠার নির্দেশ দিয়ে উনি টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন। ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল বের করে দুই গ্লাস পানি খেলেন। মাথাটা বেশ হাল্কা আর ঝরঝরে লাগছে। পরিণীতা’র ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করবেন কি-না ভাবলেন। গল্পটা তো শেষ। সিদ্ধান্ত নিলেন সম্পাদনা’র কাজটা শুরু করে দিবেন। পরে পরিণীতা এলে ওকে দেখিয়ে নেবেন একবার।
টেবিলে ফিরে এসে বসলেন আবার ল্যাপটপের সামনে। কিন্তু একী! গল্পের ফাইলটা শাদা। একটি অক্ষরও লেখা নেই ওতে। তবে কি তিনি লেখাটা শেভ করতে ভুলে গিয়েছিলেন? কিন্তু তা হলেও তো আজকের অংশটা ছাড়া গত কয়েক দিন ধরে লেখা অংশগুলো থাকার কথা। এ সময় চোখে পড়লো ল্যাপটপের স্ক্রিনের কোণায় আঠা দিয়ে লাগানো একটা হলুদ কাগজ। ওটা খুলে নিয়ে চোখ রাখলেন ভেতরের লেখায়। গোটা গোটা মেয়েলি হাতের লেখা-
“শেষ পর্যন্ত এভাবেই যেতে হল আমাকে। তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাতে তোমার যন্ত্রণাকাতর মুখটা দেখতে হত আমার। আমার চেয়ে বেশি কে জানে যে বিগত কয়েক দিন তুমি কী ভয়ঙ্কর পরিশ্রমটাই না করেছ আমাকে লিখে উঠতে। তোমার চেষ্টা আর অধ্যবসায় দেখে শ্রদ্ধায় আমার মাথা অবনত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কী জান তো...তুমি এত চেষ্টা করেও আমার পাল্সটা’র মিস করে যাচ্ছিলে বার বার। তুমি শুধু চেষ্টা করছিলে আমাকে খুশি করে লিখতে। অন্যসময় যেমন চেষ্টা কর তোমার পাঠকদের খুশি করে লিখতে। এই করে করে তোমার নিজের লেখক সত্ত্বাটা আস্তে আস্তে হারিয়ে গিয়েছে। তুমি এখন আর নিজের মত করে দৃঢ়ভাবে কিছু লিখতেই পার না। তোমার মাথায় শুধুই তৃতীয় পক্ষের চিন্তা । তোমার আর তোমার গল্পের মধ্যে সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে গেছে বহু আগেই। এই কথাটা তোমাকে বলতে চেয়েছি অনেকবার। বিরক্ত হয়ে চলেও গিয়েছি। কিন্তু আবার ফিরে এসেছি এটা ভেবে যে হয়ত তুমি শেষ নিজেকে আবার খুঁজে পাবে। কিন্তু সেটা হল না। আমরা গল্পরা লেখকের অনেক দুর্বলতা মেনে নিয়েও বেঁচে থাকি। কিন্তু যে লেখক তার ভেতরের কন্ঠস্বরটা হারিয়ে ফেলেছে তার সাথে আমরা আমাদের যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করি। গল্পঘরে যে লেখকদের সাথে তোমার পরিচয় হয়েছে এরা নিজেদের নানা ত্রুটি নিয়ে বিব্রত ঠিক-ই কিন্তু তা সত্ত্বেও এরা এদের লেখকদের ছায়াকে গর্ব ভরে ধারণ করে নিজেদের মধ্যে। কারণ এরা আজ গল্প হয়ে উঠেছে এদের লেখকদের কারণেই।
আমি ফিরে গেলাম গল্প-ঘরে। পারলে ক্ষমা করে দিও।
ইতি
পরিণীতা
মন্তব্য
আপনার গল্পটা বেশ ভালো লেগেছে। গল্পের বুনোট সুন্দর ও সাবলীল।
-ইকরাম ফরিদ চৌধুরী
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা।
রাজিব মাহমুদ
বেশ সুন্দর গল্প! গল্পেরা যদি এভাবে পথ দেখাতো!
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
এরকম পথ দেখানো গল্প সত্যিই-ই চান? শেষটায় ফাঁকি দিলেও?
রাজিব মাহমুদ
পরিণীতার পরিণতিতে রসভঙ্গের অংশটা না ধরলে বাকিটা পড়তে ভাল লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আপনার 'রসভঙ্গের' জন্য দুঃখিত :)। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনার কাছে প্রত্যাশাটা বাড়ছেই। এই গল্পটা ভালো লগেছে, তবে আমার ধারণা আপনার মধ্যে আরো ভালো আরো দুর্দান্ত কিছুর অস্থিরতা ঝড়ের মত পাক খাচ্ছে। অপেক্ষায় আছি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ, সোহেল ভাই। দুর্দান্ত কিনা জানি না, তবে অস্থিরতার ঝড়ের কথাটা একদম জায়গা মত ধরেছেন। সেই ঝড়ের কণামাত্র হয়তো প্রকাশ করতে পারি। বাকিটা মগজেই পাক খেতে থাকে। পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। শুভকামনা।
রাজিব মাহমুদ
লেখা ভালো লেগেছে।
"আপনি আমাকেই লিখছেন এখন" এটুকু পড়ার পর মনে হল এরকম একটা লেখা কোথায় যেন পড়েছি। পরে মনে পড়ল আমি এমন একটা লেখা লিখেছিলাম, পোস্ট হয় নি কোথাও। আপনার গল্পটা পড়ার পর মনে হল আমারটা কোথাও দিলে সবাই মনে করবে আপনারটার সস্তা নকল (cheap rip-off)। তাই এখানেই কপি পেস্ট করে দিচ্ছি; আমার লেখার হাত ভালো না, শুধু সাদৃশ্যটুকু শেয়ার করতে চাইছিলাম। শুভেচ্ছা
নাম বিহীন একটা গল্প
আমি হলাম গল্পের একটা চরিত্র, অনেকে ক্যারেক্টারও বলেন। মাঝে মাঝে অনেকে আবার আমাকে ডেকে আনেন গল্পের জন্য, পরে দেখা যায় যে পরে সেটা বড় হয়ে উপন্যাসে গিয়ে ঠেকে। উপন্যাসে কাজ করার সমস্যা হল একটা কাজ নিয়ে অনেকদিন থাকতে হয়। আবার অন্য চরিত্রদের সাথে কাজ করতে করতে একটা মায়াও পড়ে যায়, তখন শেষে পাতায় গিয়ে বেশ বিষণ্ন লাগে। আজকে আমাকে নিয়ে যেই লোকটা লিখতে বসেছে তাকে খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। এই লোকের কল্পনা শক্তির উপর কোন ভরসা নাই। আমার নাম রেখেছে হুমায়ূন আহমেদের নায়কদের নামে। দেখি কথা বলে কিছু করা যায় কিনা।
-"এই যে লেখক সাহেব, শুনতেছেন?"
-"কে ? কে কথা বলে?"
-"আমি মুবিন"
-"মুবিন কে?"
-"এই যে একটু আগে লেখা শুরু করলেন, আমার নাম রাখলেন মুবিন, ভুলে গেছেন নাকি?"
-"ও"
-"টেবিলে মাথা রেখে ঘুমায়ে পড়ছিলেন মনে হয়"
-"মনে হয়। আমি কার সাথে কথা বলছি?"
-"আবারও তো একই কথা জিজ্ঞেস করতেছেন। আমার নাম মুবিন, আগেই বলছি। আপনার গল্পের চরিত্র"
-"ঠিক বুঝলাম না"
-"আচ্ছা, ভাইঙা বলি। চিত্রশিল্পীরা ছবি আকার সময় কখনও কখনও একজনকে সমানে বসায়ে রাখে মডেল হিসাবে, দেখছেন?"
-"দেখেছি"
-"চিত্রশিল্পীরা ছবি মডেলকে বসায়ে রেখে ছবিটা আঁকে, তারপর মডেল চলে যায়, হয়ত আরেক শিল্পীর জন্য বসে থাকে। মডেলের ছায়াটা, ছবিটা আঁকা হয়, কিন্তু ঐ মডেল মানুষটা কিন্তু আটকা পড়ে না। সে ঘুরে বেড়ায় "
-"ও"
-"আমিও হইলাম সেইরকম, আমি একজন চরিত্র। লেখকরা কাহিনী বানানোর সময় আমাদের দরকার হয়, লেখা শেষে আমরা স্বাধীন।"
-" তা বুঝলাম, তোমরা কি সব লেখকের সাথেই কথা বল?"
-"না, সেইটার দরকার সবসময় হয় না। অনেক লেখক ধুমধাম লিখে ফেলেন, তখন কথা হয় না। তারা চরিত্র নিয়া খেলতে এক্সপার্ট। আপনি আমাকে অনেক্ষণ কোন কাজ না দিয়া বসায়ে রাখছিলেন, তাই আপনার সাথে কথা শুরু করলাম"
-"কিছু মনে কোরো না, তোমার ভাষাটা একটু কেমন যেন, ঠিক শুদ্ধ বাংলা না"
-"এর জন্য আপনেই দায়ী, আমার মুখে এরকম ভাষা দিয়ে আপনেই লেখা শুরু করছিলেন।"
-"তাহলে আমি চাইলেই তুমি সুন্দর বাংলায় কথা বলা শুরু করবে?"
-"করব"
-"আমি চাইছি। আচ্ছা, বল এখন কি করা যায়"
-"কিছু মনে করবেন না, আমার মনে হচ্ছে গল্প লেখার জন্য আপনি যথেষ্ট প্রস্তুত না। আপনি খুব বেশি সাহিত্য পড়েছেন বলেও মনে হচ্ছে না। আপনার কল্পনা শক্তিও খুব ভালো না, আপনি কাহিনীটাকে ভালোমত বানাবেন বলেও ভরসা পাচ্ছি না। মন খারাপ করলেন ?"
-"একটু"
-"শুনুন, লেখক সাহেব, লেখকদের সমালোচনা সহ্য করার ক্ষমতা থাকা জরুরি। যাই হোক, কোন নায়িকা আছে এই গল্পে? নায়িকার নাম কি নীরা?"
-"কিভাবে বুঝলে?"
-"আমার নামটা দেখেই বুঝেছি, আপনি হুমায়ূন ঘরানার লোক, কাজেই নায়িকার নাম নীরা, নীলা, নীতু বা এরকম কিছু একটা হবে। রবীন্দ্রনাথের কিছু পড়েছেন? নৌকাডুবি? গোরা? বা অন্য বড় লেখকদের লেখা?"
-"না, এগুলো পড়িনি, শেষের কবিতা পড়ছিলাম। এখন আসলে কোন প্লটই মাথায় আসছে না "
-"ঠিক আছে, একটু বাইরে হেঁটে আসুন, একটা সিগারেট ধরান, ভালো লাগবে"
-"আমি সিগারেট খাইনা "
-"সে কি? লেখক মানুষ হয়ে, সিগারেট খান না?"
-"লেখক হবার জন্য কি সিগারেট খাওয়া জরুরি নাকি?"
-"জরুরি না, অনেকেই খানতো তাই সাজেস্ট করেছিলাম। আপনি একটু রেগেও যাচ্ছেন আস্তে আস্তে।"
-"না"
-"আচ্ছা, যাই হোক। আজকের মত আমাকে ছেড়ে দিন, অন্য আরেকটা উপন্যাসে কাজ আছে আমার"
-"তোমরা কি একই সাথে একাধিক গল্পে কাজ করো নাকি?"
-"আপনাদের অভিনেতারাও অনেকগুলো প্যাকেজ নাটকে একই সময়ে কাজ করে -অনেকটা সেরকম"
-"বুঝেছি, যাও তাহলে আজকে। পরে আবার তোমাকে ডাকব। আর, অন্য লেখকের যে গল্পে কাজ করছো, সেখানে তোমার নাম কি?"
-"ওখানে আমার নাম অভি। এটা একটা প্যাকেজ নাটকের স্ক্রিপ্ট।"
-"তাই নাকি?"
-"তবে মজার ব্যাপারটা হল , বাস্তবের অভিনেতারা যখন আমার চরিত্রে অভিনয় করে, তখন তারা জানে না যে আমরা আগেই তাদের অভিনয়গুলো করে রেখেছি "
-"ভালো জিনিস জানলাম। ঠিক আছে, তোমাকে আর আটকাবো না"
-"ভাল থাকবেন লেখক, যদি সমস্যায় না থাকেন, বাকিটা ভেবে লেখা শুরু করবেন। তখন আবার আসব"
সত্যিই কি আসব? অনেক সময় লেখকরা উৎসাহের অভাবে বাকিটা লেখেন না। আসলে, অর্ধেক কাজ করার পর আমাদের, মানে চরিত্রদের, খুবই আগ্রহ থাকে, লেখক এরপর আমাদের দিয়ে কি করাতে চায় সেটা জানার। অনেকসময়ই সেই জানাটা আর কখনও হয়ে ওঠে না।
ধন্যবাদ। আপনার গল্পটা সুন্দর। এরকম আরও কিছু গল্প/নাটক আছে বিশ্বসাহিত্যে। যেমনঃ সিক্স ক্যারেক্টারস ইন সার্চ অফ এ্যান অথর। আমারটার সাথে আপনারটার অনেক পার্থক্য আছে। আমারটায় গল্প নিজেই আসে, আপনারটায় আসে চরিত্র। আর ডিটেইলিং এর পার্থক্য তো আছেই। আপনি নিশ্চিন্তে কোথাও দিতে পারেন।
নামটার জন্য ধন্যবাদ। উইকিতে গল্পের প্লটটা পড়ে আসলাম।
একটা খেলা শুরু করা যায় এই খান থেকে। বিভিন্ন লেখকরা একেকজন একেকটি চরিত্রকে নিয়ে আসুন। চরিত্ররা লেখক/দের সাথে কথা বলার পাশাপাশি নিজেদের মধ্যেও কথা বলবে। গল্পনদী কোথায় যাবে কিভাবে এগোবে, আগে থাকতে তার কিছুই জানা থাকবে না। কেমন হয়? কপিরাইটের প্রশ্ন এসে গেলে অবশ্য আমার কাছে কোন জবাব নেই।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আইডিয়া ভালো কিন্তু উৎসাহী লেখক ক'জন পাওয়া যাবে তাতে সন্দেহ আছে। তাছাড়া কপিরাইট ইস্যু তো আছেই।
ভাল বুদ্ধি। কপিরাইট সবার। যার চরিত্র বেশি কথা বলবে, তার ভাগে কম রয়্যালটি
হা হা হা
লাইনে দাঁড়ালাম।
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
উপভোগ্য। মেঘলা মানুষ, কতদিন পর আপনার লেখা পড়ছি!
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
ধন্যবাদ
রাজিব মাহমুদ
অনেক সুন্দর লেখেছেন ভাই
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।শুভকামনা।
ধন্যবাদ,ভাই।
চমৎকার থিম
-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু
আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে
উৎসাহ পেলাম। অনেক ধন্যবাদ
রাজিব মাহমুদ
আপনার লেখাটা একদমে শেষ করলাম । অনেক ভাল লেগেছে ,বিশেষ করে আপনার মেটাফরগুলো । পরিণীতা যখন আসল ,আমি পড়া বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম । আমি বাই-ডিফল্ট ভৌতিক সবকিছু এড়িয়ে চলি । বিরক্ত লাগে ।
ঠিক তখনি মনে পড়ল ,হুমায়ূন আহমেদ স্যারের কথা ,কোথাও তিনি বলেছিলেন যে " লেখার কোন এক পর্যায়ে চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠে ''''''''''''"। তার মানে এটা ভৌতক কিছু না , আপনি বোধহয় কোন একটা মেসেজ দিতে চাচ্ছেন । পরিণীতার শেষ চিঠিটা থেকে আমি আমার শৈশবকে আবার ফিরে পেয়েছি । অনেক কিছু মনে করিয়েছে পরিণীতা ,মনে থাকবে পরিণীতার কথা ।
নতুন মন্তব্য করুন