হরিপূর্ণ ত্রিপুরা
[শিল্পী সাপু ত্রিপুরার আঁকা ছবি, যে ছবিটি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিটি গণহত্যা আর ঘরবাড়ি অগ্নিসংযোগে কারা কারা সবসময় জড়িত তার একটি ক্লাসিক উদাহরন তুলে ধরে ৷ ]
পাকিস্তান ও পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে (অবশ্য রাজাকার-আলবদররা ভিন্নভাবে দেখতে পারে) তাদের নয় মাসের নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ-খুন-ধর্ষণ ইত্যাদির জন্য ভয়ংকর এক ঘৃণার নাম হিসেবে পরিচিত ৷ কিন্তু আপনি যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের সেই সত্তর দশকের শেষার্ধ হতে খেয়াল করেন তাহলে দেখবেন কিভাবে আপনি/আপনারা - সেই একই পাকিস্তানের ঘৃণাকারীদের অংশ - নিজেদেরকে পাকিস্তানীদের চেয়ে বহুগুণ ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন ৷ কিভাবে ? তা বলছি ৷
আপনি যদি চিন্তা করেন, দেখবেন পাকিস্তানীরা হচ্ছে হাজার মাইল দূরের থেকে আসা লোক ৷ ম্যাপে দেখলে বুঝবেন, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মাঝে বিশাল বড় ইন্ডিয়া ৷ পাকিস্তানী সে সময়ে বলতে গেলে ধরে নিতে পারি খুবই সংখ্যালঘু শ্রেণি যারা শুধু সামরিক আর সরকারীযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতো কিন্তু রাজনীতি-জনসংখ্যাগত প্রাধান্যসহ অন্যান্য বিষয় বলতে গেলে পূর্বপাকিস্তানে বাঙালিদের প্রাধান্য ছিলো ৷ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের সময়ে কতোজন বা তাদের রাজাকারে-আলবদর ঘাতক বাহিনী ছিলো ? কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে আপনি দেখেন ; এটি নাকি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সেনা উপস্থিতি-সেনাশাসনের জায়গা ৷ কিছুদূর পর পর জলপাই পোষ্ট ৷ রাজনীতি-অর্থনীতি-জনসংখ্যা-সংবাদমাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ বলুক কোনটাতেই পাহাড়িরা নেই ৷ তাতেই কি আপনার মনে হয় না দৃশ্য-অদৃশ্য নির্যাতনের তীব্রতা কতো কঠোর হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের উপর ৷ বাংলাদেশেতো নয় মাসই হত্যাযজ্ঞ হয়েছিল কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বলতে গেলে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন হতে ৷ সময়ের হিসেবে ধরলে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের চেয়ে চল্লিশগুণের বেশি ৷ এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু এই সময়কালে অনেক পাহাড়ি পরিবারের একেকটি পরিবারকে নয়ের অধিকবারও
ঘরবাড়ি -জিনিসপত্র ধ্বংসের মুখোমুখি হতে হয়েছে ৷ কয়েক বৎসর পর পর আবার নতুন করে শুরু করতে হয়েছে ৷ কেউ বুঝবে না -ধ্বংসের মধ্যে নতুনভাবে শুরু করতে যাওয়া মানে কি; একমাত্র ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়া ৷ দেড় ডজনের মতো সুপরিকল্লিতভাবে বড় বড় গনহত্যা এখানে ঘটানো হয়েছে ৷ কতো নারী যে ধর্ষিত হয়েছে তার হিসাব নেই এবং এখনো হচ্ছে ৷ জোর জবরদস্তিসহ নানান কৌশলে জায়গাজমি দখলের কথাতো বাদই দিলাম ৷ প্রিয় বন্ধু এখন শুধু নিজেদের চেহারাটা একটু আপন আয়নাতে তাকানো বাকি, তাহলে বুঝতে পারবেন কিভাবে আপনারা পাকিস্তানীদের ছাড়িয়ে গেছেন ৷
এটা শুধু আপনি মনে করবেন না পার্বত্য চট্টগ্রামে জলপাই বাহিনীর আর তাদের সহযোগী বাহিনীদের কারনে এটা হয়েছে ৷ আপনি হয়তো 'রাজাকারের বাচ্চা' নামক গালির বদলে 'সেটেলারের বাচ্চা' নামক গালির প্রবর্তন করতে পারেন ৷ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত হয়ে আসা কখনো ধর্ষণ-হত্যা-বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ- পর্যটনের নামে প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ ইত্যাদি কিছু একটা হলেই সেভাবে সেনাবাহিনী আর সেখানে তাদের কিছু সহযোগীকে একটা সুখকর গালমন্দ করে আপনি আত্ম- তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে যেতে পারেন ৷ কিন্তু প্রিয় বন্ধু/বন্ধুরা আমার, আমার অপরিচিত অসংখ্য মানবতাবাদী ছাত্র- যুবক সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ, আপনি পার্বত্য সেনাবাহিনী আর তাদের সহযোগী বাহিনীদের উপর সকল অন্যায়ের ভার চাপানোর আগে আপনার দিকে কি একটু ফিরে দেখবেন ? আপনারাই সেনাশাসনকে ঘৃণা করেন ৷ পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের, এরশাদের বিরুদ্ধে আপনারা রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন ৷ তাদেরকে ইতিহাসের আস্তাকুরে নিক্ষিপ্ত করেছেন ৷ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই গা শিহরে ওঠা মানব ইতিহাসের অন্যতম বর্বরতম দানবদের বিরুদ্ধে আপনারা জয় ছিনিয়ে এসেছেন ৷ সে কঠোর-কঠিনতম সময়েও আপনাদের বিবেক নাম কথিত সংবাদপত্র -বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- সমাজের চিন্তাবিদ বস্তুনিষ্টতাকে- মানবতাকে সবসময় জাগ্রত রেখেছিলেন ৷ কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রসঙ্গে দেখুন - কখনো কি আপনি সেনাশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন যেমনটা আপনারা করেছিলেন আপনাদের জন্য পাকিস্তানের সময়-আশির দশকে ? আপনি কি সাজেকে - নীলগিরি যাওয়ার লোভ সামলাতে পেরেছেন যেখানে আপনার ব্যয়ের অংশ যায় সেনা পকেটে ? আপনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আন্দোলন করেছেন কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে সেই একই রকম চরম অন্যায়ের বিচার চাওয়ার আর্তনাদ আপনি কি আপনার সেই যুদ্ধাপরাধের আন্দোলনে কিংবা পরের আন্দোলনে সংযুক্ত করেছেন ? আদৌ কি পার্বত্য চট্টগ্রামের সংঘটিত গনহত্যাকে আপনার যুদ্ধাপরাধ মনে হয়েছে ? আপনি কি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে মুক্ত-নিরপেক্ষ সংবাদের অভাব কখনো অনুভব করেছেন, তার জন্য আন্দোলন করেছেন ?
আপনার এ সব প্রশ্নের সব বা অধিকাংশ উত্তরও যদি না হয় প্রিয় বন্ধু বা বন্ধুরা আমার, আমাকে বলতেই হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল কিছুর বড়দায় কিন্তু আপনার বা আপনাদের উপরই পড়ে ৷ আপনার নিরবতা- নিস্পৃহতা-নিষ্ক্রীয়তাই হচ্ছে তার বড় কারণ ৷ আমার যুক্তিতে হয়তো আপনি কষ্ট পাবেন ৷ একটা ঝাঁকুনি খাবেন এমন একটা বিষয়ের মুখোমুখি হতে যা আসলেই আপনি এড়িয়ে থাকতে চান সব সময় ৷ কিন্তু বন্ধু এর দায় কোনমতেই আপনি এড়াতে পারেন না ৷ সেটা বাংলাদেশের অন্যান্য সকল সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ৷
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন