চলচ্চিত্র বীক্ষণ : লুই বুনুয়েল (পর্ব ১)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ১৩/০৬/২০১৭ - ৫:১৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


১৯২৯ সালের এপ্রিল মাসের এক সন্ধ্যা। প‍্যারিসের আরসুলিন স্টুডিওর চারশো আসনের প্রেক্ষাগৃহ সেদিন কানায় কানায় পূর্ণ! আলো নিভে যেতে দর্শকরা এমন এক অনুভূতির মুখোমুখি হলেন যা এযাবৎ ছিল অনাস্বাদিত।

"একদা...
একটা ব‍্যালকনি। রাত। একটা লোক ব‍্যালকনির ধারে দাঁড়িয়ে ক্ষু্রে শান দিচ্ছে।
লোকটা জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল।
পূর্ণিমার চাঁদের ওপর দিয়ে একটা হালকা মেঘ ভেসে যাচ্ছে।
বিস্ফারিত দুচোখ নিয়ে এক যুবতীর মুখ।
ক্ষুরের ফলাটা যুবতীর একটা চোখের দিকে এগিয়ে গেল।
হালকা মেঘটা চলে গেল চাঁদের সামনে দিয়ে।
ক্ষুরের ফলাটা ফালাফালা ক‍রে দিল যুবতীর চোখ।....."

ছবির তরুণ পরিচালক স্পষ্টত‌ই বেশ নার্ভাস। এটি তার প্রথম ছবির প্রিমিয়ার। প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত রয়েছেন প‍্যারিসের সংস্কৃতি জগতের তাবড় তাবড় সব ব‍্যক্তিত্ব। পর্দার পিছনে বসে রেকর্ডপ্লেয়ারে আবহসঙ্গীত বাজাতে বাজাতে একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন তরুণটি। কী হতে চলেছে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া? বিরূপ পরিস্থিতির আশংকায় পকেট ভর্তি করে রেখে দিয়েছিলেন ইটপাটকেল, যাতে প্রয়োজনে শো ভণ্ডুল করে দেওয়া যায়। শেষপর্যন্ত অবশ‍্য সেসব কিছুই কাজে লাগলনা। দর্শকরা স্বতস্ফূর্ত করতালিতে গ্রহণ করলেন 'আঁ শিঁয়া আঁদালু' ছবিটিকে, জণ্ম নিলেন পরিচালক লুই বুনুএল।

বুনুএল অভ‍্যস্ত স্বপ্ন দেখতে। তার বেশিরভাগই অবশ‌্য দুঃস্বপ্ন! কখনও তিনি দেখেন পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় এসে পড়েছেন, ফেরার পথ রুদ্ধ, কখনও বাঘে অথবা ষাঁড়ে তাড়া করে তাকে, কখনও বা এমন পরীক্ষায় তাকে বসতে হয় যার বিষয়ে বিন্দুবিসর্গ‌ও তিনি জানেন না, ট্রেন তাকে নামিয়ে দিয়ে যায় অজানা ষ্টেশনে, মৃত ব‍্যক্তিদের সঙ্গে স্বপ্নে মোলাকাত হয় প্রায়‌ই, হয়ত বা তাকে মঞ্চে তুলে দেওয়া হয় অজানা ভূমিকায় অভিনয় করতে, ইত্যাদি। আবার কখনও দেখেন এমন স্বপ্ন যার ঘটনাপরম্পরা স্বাভাবিক বুদ্ধিতে ব‍্যাখ‍্যার অতীত। এইসব স্বপ্নের অভিজ্ঞতা তার ছবিতে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। যেমন 'আঁ শিঁয়া আঁদালু' ছবির পূর্ববর্নিত দৃশ‍্যটি। চিত্রশিল্পী সলভাদর দালির সঙ্গে তখন বুনুএলের খুব বন্ধুত্ব। একদিন বুনুএল দালিকে স্বপ্নটার কথা বললেন। দালি বললেন গতরাতে তিনিও একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছেন, পিঁপড়েতে ছেয়ে যাওয়া একটা হাত! তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন ছবি তৈরির, দুজনে মিলে লেগে পড়লেন চিত্রনাট্য লিখতে। যৌক্তিকতার ছিঁটেফোঁটা রয়েছে, এমন কিছুকে নির্মমভাবে বর্জন ক‍রলেন তারা। একজন হয়ত একটা চিত্রকল্প প্রস্তাব করলেন, অন‍্যজন সেটা মেনে নিলেই চিত্রনাট্যে লাগিয়ে দেওয়া হল, আপত্তি করলেই সেটা বাতিল। দুজনে শুধু খেয়াল রাখলেন বিষয়গুলো যেন ব‍্যাখ‍্যাতীত হয়, বিস্ময় বা অযৌক্তিক অভিঘাত নিয়ে আসে। বুনুএলের নিজের কথায়, 'conscious psychic automation' বা সচেতন মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা থেকেই এই ছবির প্লট উদ্ভূত হয়েছিল। এইরকম একটা চিত্রনাট্য থেকে ছবি করতে নিশ্চ‌ই কোনও প্রতিষ্ঠিত প্রযোজক এগিয়ে আসবেন না! এইখানে জগতজোড়া চলচ্চিত্রপ্রেমীরা যে ব‍্যক্তির কাছে চির‌ঋণী, তিনি হলেন স্বয়ং বুনুএলের মা মারিয়া। তার আর্থিক আনুকূল্যেই শেষমেশ 'আঁ শিঁয়া আঁদালু' (An Andalusian Dog) ছবিটা তৈরি হয়। তবে বলে রাখা ভালো যে ছবিটা কিন্তু স্পেনের আন্দালুশিয়া অঞ্চল বা সেখানকার কুকুর, কোনও কিছুর সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত ছিলনা!

যখন বুনুএল আর দালি এই ছবি নিয়ে মাতোয়ারা, ঠিক তখনই প‍্যারিসের সংস্কৃতি জগতে ঘটে চলেছিল অন‍্য এক কর্মযজ্ঞ - সুররিয়ালিষ্ট (surrealist) আন্দোলন। মানবমনের গভীরে লুকিয়ে রয়েছে যে অযৌক্তিকতা, সুররিয়ালিষ্ট বা পরাবাস্তববাদীরা চান তাকেই বাইরে বার করে আনতে। তারা বলেন চেতনা দিয়ে উপলব্ধিটাই সব নয়, অবচেতন মন‌ও সমান গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সব দিকেই তখন এই সুররিয়ালিষ্ট পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছে। বুনুএল এরকম একটা ছবি করছেন জানতে পেরে আলোকচিত্রী মান রে এবং কবি লুই আরাগঁ তাকে সুররিয়ালিষ্ট দের রোজকার আড্ডাখানায় নিয়ে গেলেন। সেখানে পরিচয় হল এই আন্দোলনের পুরোধা আন্দ্রে ব্রেতোঁ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে। ছবির প্রিমিয়ার দেখে এরা বুনুএলকে পাকাপাকিভাবে নিজেদের দলে নিয়ে নেন।

এর কিছুদিনের মধ‍্যেই শার্ল দ‍্য নোয়াল নামে প‍্যারিসের এক অভিজাত ব‍্যক্তি বুনুএলকে ছবি করার প্রস্তাব দিলেন। বুনুএল আর দালি আবার একসঙ্গে লিখতে শুরু করলেন নতুন চিত্রনাট্য। কিন্তু গতবারের মত বোঝাপড়া এবারে র‌ইল না। দালির কিছু চিন্তাভাবনা রয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত বুনুএল একাই চিত্রনাট্য লেখা শেষ করলেন, আর প্রযোজক ও অন‍্যান‍্য বন্ধুদের সহায়তায় পুরো ছবির শুটিংও শেষ করলেন‌। তৈরি হল বিশ্বচলচ্চিত্রের অন‍্যতম উল্লেখযোগ্য সুররিয়ালিষ্ট ছবি 'লা'জ দো'র' (The Golden Age)। এই ছবিতে বুনুএল তার অননুকরণীয় চিত্রকল্পের সাহায্যে প্রতিষ্ঠান ও ধ‍র্মকে আক্রমণ করে বেশ কিছু লোককে চটিয়ে বসলেন। ফলস্বরুপ, ছ'দিন হাউসফুলের পর এক সন্ধ্যায় কিছু লোকজন প্রেক্ষাগৃহ ভাঙচুর করল। ছবির উপর জারি হল নিষেধাজ্ঞা আর তা' বলবৎ র‌ইল প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে। এর পরে পরেই পরাবাস্তববাদী আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে আর পরবর্তী ছবিতে বুনুএলের উত্তরণ ঘটে অভিব‍্যক্তিবাদী বাস্তবতায়‌।

'লা'জ দো'র' এর পর বুনুএল ছ'মাসের চুক্তিতে হলিউড গেলেন 'অবজার্ভার' হিসেবে, কিন্তু চার মাসের বেশি টিঁকতে পারলেননা। এবারে ফিরে এলেন জণ্মভূমি স্পেন এ। সেখানে তখন রাজনৈতিক পালাবদল চলছে। রাজতন্ত্র থেকে সদ‍্য বুর্জোয়া প্রজাতন্ত্রে উন্নীত সরকার তখন পুরোনো রাজতন্ত্রবাদী আর ধর্মীয় সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মুখোমুখি। বুনুএল‌ও মুখোমুখি হলেন প্রত‍্যক্ষ‍্য বাস্তবের, তৈরি করলেন চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন‍্যতম সেরা তথ‍্যচিত্র 'লাস হার্ডেস' (The Hardes)। স্পেনের এক অতি দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হার্ডেস, সেখানে কয়েক হাজার অধিবাসী কীভাবে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে বেঁচে থাকেন, তাই ই বিশ্বের কাছে তুলে ধরলেন বুনুএল‌। সীমাহীন দারিদ্র্য, অপুষ্টি ও অন্যান্য রোগভোগ, এসবের উল্টোদিকে গীর্জার স্বচ্ছলতা, বুর্জোয়া শিক্ষাব‍্যবস্থা ও নৈতিকতাকে ব‍্যঙ্গচ্ছলে হাজির করলেন বুনুএল। পরাবাস্তববাদী অনুসঙ্গ র‌ইল একটা বিশেষ চিত্রকল্পে, মৃতপ্রায় গাধার চোখের উপর মৌমাছির আক্রমণ। যথারীতি স্পেনের 'গণপ্রজাতন্ত্রী' সরকার এই ছবিকে 'দেশের পক্ষে অসম্মানজনক' আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। এর পরে বুনুএল বেশ কিছুদিন ছবি ক‍রতে পারেননি। প‍্যারিসে কিছুদিন ডাবিং এর কাজ করলেন, তারপর ওয়ার্ণার ব্রাদার্সের হয়ে আবার স্পেনে ডাবিং। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে স্পেনের গৃহযুদ্ধ। বুনুএল তখন প‍্যারিসে স্পেনীয় দূতাবাসে তথ‍্যবিভাগের প্রধান। ১৯৩৮ এ আবার হলিউড, তারপর নিউইয়র্কে 'মিউজিয়াম অফ মডার্ণ আর্ট' এ তথ‍্যচিত্র বিভাগে কাজ, ১৯৪২ এ কমিউনিষ্ট সন্দেহে বিতাড়ন, এরপর কিছুদিন সাম‍রিক তথ‍্যচিত্রে কন্ঠদান ইত্যাদি নানারকম করে ১৯৪৬ এ কপর্দকশূণ‍্য অবস্থায় এসে পৌঁছলেন মেক্সিকো। শুরু হল বুনুএলের জীবনের এক নতুন অধ‍্যায়।

(চলবে)

- ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র (অতিথি লেখক)


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

চলুক

ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র এর ছবি

ধন্যবাদ। চলবে!
- ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র

সোহেল ইমাম এর ছবি

কেউ একজন ছবিটা দেখছিলো। আমি পেছন থেকে দেখলাম সেই ক্ষুরের দৃশ্যটা। ছবিটা পুরো দেখা হয়নি। আগ্রহ আছে পুরোটা দেখার সময় করে উঠতে পারছিনা। এই লেখাটা আগ্রহ নিয়েই পড়লাম, পরের পর্ব গুলো আশা করি ঠিকঠাক আসবে। সচলে সিরিজ গুলো মাঝপথেই প্রাই বন্ধ হয়ে যায়।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। ছবিটা দেখে নিন, ইউটিউবেই পাওয়া যায়। পরের পর্ব শিগগিরই আসবে।
- ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

ভালো লাগছে। পরের পর্ব আসুক।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। পরের পর্ব শিগগিরই আসবে।
- ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র

অতিথি লেখক এর ছবি

অপেক্ষায় পরের পর্বের জন্য।
মামুন মেহেদী

ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। পরের পর্ব শিগগিরই আসবে।
- ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র

অতিথি লেখক এর ছবি

Luis Buñuel Portolés = লুইস বুনিউয়েল পোর্তোলেস। নামটা ফরাসী বা ইংরেজী নয়, স্পেনীয়।

আর পরবর্তী ছবিতে বুনুএলের উত্তরণ ঘটে অভিব‍্যক্তিবাদী বাস্তবতায়‌

- অভিব্যক্তিবাদী বাস্তবতাটা কী জিনিস? এর ইংরেজীটা কী হয়? evolutionary realism? যদি impressionism বুঝিয়ে থাকেন তাহলে তার বাংলা হবে প্রতীতিবাদ।

ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র এর ছবি

হ্যাঁ, বুনুএল স্পেনীয়। অভিব্যাক্তিবাদ বলতে এক্সপ্রেশনিজম বোঝানো হয়েছে!
- ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক কিছু জানা গেল। ধন্যবাদ।
dipchhandana

ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।
- ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র

জুন 12  এর ছবি

সাথে আছি ।

ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র এর ছবি

ধন্যবাদ। দয়া করে থাকুন!
- ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র

জুন 12  এর ছবি

ভালোলাগলো লুই বুনুয়েলকে আবার আপনার লেখায় দেখতে পেয়ে

ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।
- ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র

অমিতাভ  এর ছবি

লুই বুনুয়েল লেখাটি র খুব ভাল লাগল | আরও এরকম লেখার অপেখাতে রইলাম |

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।