সুবোধ তুই পালিয়ে যাসনে, প্রতিরোধের মিছিলে চলে আয় .....

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০২/০৭/২০১৭ - ১২:৪২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হরিপূর্ণ ত্রিপুরা

'আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না প্লিজ ' - উর্ধ্বাকাশে পিস্তলের গুলি ফুশং ফুশং ছুড়তে ছুড়তে পুলিশের দারোগা অলৌকিকভাবে হাজির হন তার অধীনস্ত সেপাইরা সহ যখন কিনা ক্ষিপ্ত হিরো ভিলেনকে আচ্ছামত ধোলাই দেওয়ার পরে ঘেচাং করতে উদ্যত হন ৷ বাংলা ছবির এটা একটা বহুল পরিচিত দৃশ্য ৷ একটা আধুনিক রাষ্ট্রে আইন আছে, বিচারক আছে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে, সুতরাং ন্যায়-অন্যায়ের বিচারের ভার রাষ্ট্রের উপর ছেড়ে দাও - হয়তো উপরের উক্তির মধ্যে দিয়ে সিনেমার পরিচালকরা সে কথা সাধারণ মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিতে চান ৷ কিন্তু যে রাষ্ট্রের নিজস্ব ধর্ম-জাতি আছে, যেখানে ন্যায় অন্যায় ধারণার চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতার, পেশিশক্তির দাপট আছে সেখানে নির্যাতিত মানুষেরা যাবে কোথায় ? কার কাছে ন্যায় বিচার আশা করবে ? আপনি আপনার নায্য অধিকার ( বা আপনি যেটাকে নায্য মনে করছেন) চাইতে যাবেন তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকজন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বলে ওঠবে - 'তাহলে ভোটাভুটি হোক ৷' পৃথিবীতে ন্যায় অন্যায়ের ফয়সালা কি সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে হয় ? নাকি তা আপাত একটা মানদন্ডের বিচারে ? সেখানে একজন মানুষের ন্যায়ের মূল্যও হাজার মানুষের অন্যায়ের উপরে ৷ কিন্তু না, আপনাকে ভোটের রাজ্য সে জোর করে টেনে নিবে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠার জোরে নিষ্পেষিত করবে ৷ এই ধরণের রাষ্ট্রে বেঁচে থাকলে হলে, বৈষম্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে তাই ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া কোন বিকল্প নাই ৷

একইভাবে, যে রাষ্ট্রে কিনা পিস্তল হাতের পুলিশ ও ন্যায়ের ঝান্ডাধারী বিচারকগণ , আপাতদৃষ্টিতে, আইনকে প্রয়োগ করেন জাতি-ধর্ম-বর্ণের উর্ধ্বে ওঠ - সেখানেও কিন্তু মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চেতনা ও চর্চার মূল্য কমে যায় না ৷ জনগণকে পরনির্ভরশীলতার কাঠামোর মধ্যে ফেলে রাষ্ট্র তার ক্ষমতার চর্চা করবে এটাই মনে হয় রাষ্ট্রের অন্যতম কৌশল ৷ জনগন যেন তাদের জীবনের নিরাপত্তা থেকে সব বিষয় রাষ্ট্রের উপর ছেড়েই দেয়, এটাই হয়তো রাষ্ট্র চায় ৷ তাই নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র, দুর্যোগ মোকাবেলায় রাষ্ট্র , শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থান সবই রাষ্ট্রের দায়িত্ব ৷ ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের কাঠামোর উপর দাঁড়ানো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অসংঘবদ্ধ- বিক্ষিপ্ত -বিছিন্ন -দুর্বল আমজনতার কাছে এটা ছাড়া নিশ্চয় কোন বিকল্প ব্যবস্থাও তেমন নেই ৷ রাষ্ট্রের কাছে মানুষের চাওয়াও অনায্য কিছু নয় যদি সে রাষ্ট্র ব্যবস্থা আপাত একটা ন্যায়পরায়ণ ও সমতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ও তার চর্চা করে ৷ তবে সে রকম রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যেও অতিশয় নির্ভরশীলতাও অনেক সময় আসলে মানুষকে পরনির্ভর প্রাণী হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে ৷ পরনির্ভরশীলতার অভ্যাস হতে হতে মানুষ অনেকটা ফার্মের মুরগীর মতো চলৎ-শক্তিহীন হয়ে যায়, লড়াই করার মতো শক্তি ও সাহস তাদের থাকেনা ৷ তাই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ডাইরেক্টলি- ইন্ডাইরেক্টলি মানুষের নিজেদের মধ্যে সংঘবদ্ধ হওয়ার চেতনা ও প্রতিরোধের চর্চাকে গুড়িয়েই দেয় ৷ তাৎক্ষণিক বিপদে মানুষ রাষ্ট্রের সাহায্য সব সময় পায় না (পাওয়া সম্ভবও নয় ), অন্যদিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই বিপদের মোকাবেলা করবে সেটার চেতনা ও চর্চাও থাকেনা ৷

এ মাসের প্রথমদিকে লন্ডনের লন্ডন ব্রিজে ছুরি হাতে সন্ত্রাসী হামলা ও সে হামলায় অর্ধ শতাধিক মানুষের আহত আর সাতজন নিহত হওয়ার ঘটনাই প্রমাণ করে একটি রাষ্ট্রে নাগরিকরা কিভাবে নিজেদের সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, রাষ্ট্রের উপর সবকিছুতে অতিশয় নির্ভর করার কারণে ৷ লন্ডন ব্রিজের যে জায়গায় সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় সেখানকার আশেপাশের রেস্টুরেন্টে-দোকানে নিশ্চয় চেয়ার- টেবিল- ছুরি -মদের বোতল কত কি থাকার কথা, যা দিয়ে আক্রমনকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো যায় ৷ কিন্তু খবরে বেরোয়- মানুষেরা পালাচ্ছে আর সন্ত্রাসী তিনজন মাত্র বার ইঞ্চি ছুরি দিয়ে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাদের উপর ৷ নিশ্চয় হতভাগ্য পলায়নরত অনেকে প্রার্থনা করেছে- বাংলা ছবির ম্যাজিকময় দৃশ্যের মতো মুহূর্তের মধ্যে পুলিশ যেন হাজির হয় ৷ হয়তো এমনই হতে পারে ‘সন্ত্রাসী হামলা হচ্ছে’ শোনা মাত্র মানুষ যে যেদিকে পারে দৌড়াচ্ছে, সে সন্ত্রাসী কি মাত্র বার ইঞ্চি ছুরি নাকি একে ৪৭ নিয়ে হামলায় আসছে সেটা জানার আর সময় নাই ৷ অথবা এমনই হতে পারে মানুষ পালাতেই অভ্যস্ত হয়ে ওঠেছে ৷ না পালানোর অভ্যাস, প্রতিরোধের চেতনা ও কৌশল তাদের হারিয়ে গেছে চর্চার অভাবে ৷

মিলওয়াল ক্লাবের এক সমর্থক, যিনি ও যার সঙ্গীসাথীরা কিনা ফুটবল মাঠে দাঙ্গা হাঙ্গামার জন্য কুখ্যাত, নাকি বুক চেটিয়ে 'আমিই মিলওয়ালের সমর্থক' বলে চেঁচিয়ে তিনজন সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধে একা এগিয়ে আসেন এবং তাদের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ছুরিকাঘাতে নিজে জখম হন কিন্তু বাঁচিয়ে দেন অনেক মানুষের জীবন ৷

তাই রাষ্ট্রের চরিত্র যা হোক সাধারণ মানুষদের আসলে সংঘবদ্ধ হয়ে অন্যায় ও আক্রমনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার চর্চা থাকাটা জরুরি ৷ ধর্ম-জাতি-বর্ণে আছন্ন রাষ্ট্রে তো আরো বেশি কারণ রাষ্ট্র-তার সেনাবাহিনী-পুলিশ যেখানে নিরপেক্ষ ভূমিকা না নিয়ে নিজেই নিপীড়কের চরিত্রে অবতীর্ণ হয় সেখানে ন্যায় বিচারের আশা করা- ''আপ্নে আমার ঘরে ক্যান আগুন দিসেন হুজুর , আপনে তার বিচার করুন''- এমন বিচার প্রার্থনার সমতূল্য ৷

আর তাই
সুবোধ তুই পালাসনে ৷ পালাবেইবা কোথায় ? চারিদিকে কাঁটাতার আর অস্রহাতে অতন্দ্র সীমান্তের প্রহরীরা সর্বদা জাগ্রত ৷ পাখির মতো গুলি করে মানুষকে মারতে তারা পারদর্শী ৷ তাই পালানোর জন্য আপাত কোন রাস্তা নেই ৷ আর যদি থেকেইবা থাকে, পালালেই যে 'চাচার আপন প্রাণ বাঁচাতে' পারবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই ৷ বরং মৃত্যুরাই দ্বিগুণবেগে ধেয়ে পারে পিছন পিছন ৷ ঝাঁপিয়ে পড়বে লন্ডন ব্রীজের সেই সব সন্ত্রাসীদের মতো ৷ কারণ হায়েনা-দুর্বৃত্তরা, অত্যাচারী শাসকেরা ততক্ষণে জেনে যায় তুই একটা নখদন্তহীন দুর্বল প্রাণী ৷ ফলত; আক্রমণের তীব্রতা ও উৎসাহ উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়া ৷ তাই পালানো কোন সমাধান নয় বন্ধু ৷ তারচেয়ে এসো বন্ধু আমরা মিলওয়াল ক্লাবের অকতোভয় সেই বীরই হই, ভড়কে দেই মৃত্যুকে, বুক চেটিয়ে রুখে দাঁড়াই ৷

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

সুবোধকে যারা পালিয়ে যা বা পালাসনে ইত্যাদি বলবে তাদের অবস্থাইতো সুবোধের চেয়ে শোচনীয়।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আবশ্যিক। তবে সেটার জন্য সাংগঠনিক শক্তি, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকতে হবে। অপরিকল্পিত, অসংগঠিত উত্থান শক্তি ক্ষয় ছাড়া আখেরে কোন ফল দেবে না।

এক্সোডাস একটা স্ট্র্যাটেজিক মুভ। তবে সেটা কোনদিকে করা হলো তার ওপর এর সফলতা নির্ভর করে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

কোনবা পথে নিতাই গঞ্জ যাই ? ধরণের গানের মতো এটা হচ্ছে জাস্ট আমার চিন্তা ভাবনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।