বুরিদানের গাধা ও একটি মৃত্যুরহস্য

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৫/০৮/২০১৭ - ১১:৫৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দেশ ও বৈদেশের হালহকিকত দেখি আর মনে খালি ‘বুরিদানের গাধা’র ছবি ভাসে। রকমারি ঘটনায় ঠাসা ইতিহাসের পাতায় ফরাসি যুগচিন্তক বুরিদান সাহেবের গাধাটিও নিজের জায়গা করে নিয়েছে। সে যাকগে, গাধার সঙ্গে ফরাসি সাহেবের সংযুক্তি কেমন করে ঘটলো সে প্রসঙ্গে যাবার আগে ছোট করে মূল গল্পটি বলে ফেলা যাক। গাধা নিয়ে গল্পগাছার অভাব নেই মানবসংসারে। গাধা-কাহিনীর বড়ো অংশ হাস্যরসের যোগান দেয়। নিজের গাধাটিকে নিয়ে তুরস্ক দেশের মোল্লা নাসিরউদ্দিনের সরস গল্পগাছা এখনো লোকের চিত্তবিনোদন ঘটায়। তামাশাভরা মানবজীবন নিয়ে এই স্বভাব-দার্শনিকের রঙ্গ ও সেটি উদযাপনের ভঙ্গি সেকালের মতো একালেও সমানে প্রাসঙ্গিক। মহামতি শেকসপিয়ার বলে গেছেন জীবনের নাট্যমঞ্চে মানুষ হলো অভিনেতা। মোল্লা নাসিরউদ্দিনের বোকামিঠাসা বুদ্ধিরসের ছটা সেইসঙ্গে মনে করিয়ে দেয় দুঃখ-সুখে ভরা অভিনয়মঞ্চে মানুষ আসলে নিজেকে নিয়ে হাসে ও অন্যকে হাসিয়ে মারে। বুরিদান সাহেবের গাধার গল্পটি সেদিক থেকে গুরুতর হলেও কৌতুকরস সেখানেও ঠিকরে পড়ে, যদিও সাহেবকে সেটা কৌতুকরসে না ভাসিয়ে গুরুতর এক দার্শনিক কূটপ্রশ্নের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। দার্শনিকরা ভাবনা ও কথার কারবারি এবং লোকের তাতে থোড়াই কেয়ার। জগতের আমজনতার কাছে গাধা হচ্ছে চিরকালের কিংবদন্তি যার কাঁধে জীবনের কঠিন বোঝা অক্লেশে চাপানো যায় এবং গাধা সেই ভার বহনে দ্বিধা করে না।

মানবসমাজে যারা চালাক বলে খ্যাত তারা সর্বদা সেই গাধাটির খোঁজ করে যার নাকের সামনে মূলা ঝুলালে সে ছুটতে শুরু করবে। মূলা তার নাগালের বাইরে ঝুলে আর ওই অসম্ভবকে পাওয়ার আশায় গাধা বেচারা কথা না-বাড়িয়ে কেবল ছুটে। মনে কোনো প্রশ্ন ও সংশয় না উঠিয়ে ঝুলন্ত মূলাকে পাওয়ার আশায় এভাবে ছুটতে পারে বলে গাধা হলো শ্রেষ্ঠ জীবন-শিক্ষক। জীবনে সেই লোক সবচেয়ে সুখী যে কোনো প্রশ্ন বা সংশয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে না, সে শুধু ছুটে আর ছুটে, এবং হঠাৎ একদিন অনেকিছু পাওয়ার আশা করে কিছু না পাওয়ার গাধামি সয়ে দুম করে ঢলে পড়ে। জীবনরহস্যের কৌতুককর এই দিকটি বুরিদান সাহেবকে খুব বেশি টেনেছে বলে মনে হয়নি, তিনি বরং গাধার চিরন্তন গাধামি নিয়ে অন্য প্রসঙ্গে ভেবেছেন। সে তিনি ভাবতেই পারেন, তাতে লোকের কিছু যায় আসে না। জগতে যারা নিতান্ত সাধারণ তারা গাধাকে সরস এক নির্বোধ বলে জানে। লোকে গাধাকে বোকাসোকা ভাবলেও বিজ্ঞানীদের মত অবশ্য সেখানে ভিন্ন। তাঁদের মতে লোকের গাধা সম্পর্কিত ভাবনায় গলদ রয়েছে। তাঁরা বলেন নিজের স্বার্থের হেফাজতে গাধা আর সবার মতো তৎপর ও সচেতন। বিজ্ঞান আরও বলে গাধার যুক্তি ও কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে হাসাহাসির কিছু নেই, কারণ এ-ব্যাপারে সে যথেষ্ট টনটনে। তার সহ্যশক্তি অপার, শতচড়ে রা কাড়ে না, গায়ে হাতির বল না থাকলেও পরিশ্রমে তুলনাহীন, এবং জগতের সকর গাধার কাছে জীবন হচ্ছে ‘চরৈবতি’। সুতরাং গাধাকে খাটো করে দেখা মানে নিজেকে খাটো করা।

এটা তো ঠিক, সেই লোক জীবনে ইষ্ট লভেছে যে ধরায় আসে শুধু পথ চলবে বলে, এবং তার এই পথচলার খেয়াল মরণের আগে অব্দি থামতে জানে না। গাধা সেই কাজটি অনায়াসে করে। জগতে গাধা হওয়া তাই সহজ না। যারা এটা বোঝে তারা গাধার গাধামি দেখে হাসলেও তাদের সেই হাসির আড়ালে দরদী এক দীর্ঘশ্বাস লেগে থাকে, একাধারে সেটা গাধার জন্য এবং নিজের জন্যও বটে; কারণ তারা জানে জীবনের মিষ্টি ও তিক্ত অভিজ্ঞতার চাপ সয়ে এবং লোকের অজস্র ঠাট্টা-তামাশা হজম করে গাধার মতো নির্বিকার স্বভাবে পথচলা সহজ কথা নয়। যে-কারণে জগতের দূরদর্শী লোকেরা নিজেকে গাধার কাতারে ফেলে অহরহ বিচার-বিবেচনা করেন, গাধার রকমারি গাধামি দেখে অন্যকে তারা বুঝতে শিখেন এবং নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া সেরে নেন। জীবনের পথে চলতে গেলে মনের মধ্যে ‘গাধার ছবি’ ভাসিয়ে তোলা এ-কারণে জরুরি। বহুপ্রজ জীবন-দর্শক কৃষণ চন্দর সেটা বুঝেছিলেন বলে ‘একটি গাধার আত্মকাহিনী’ লিখে জীবনের সঙ্গে নিজের রফা করে গেছেন।

এই প্রতীকীভাষ্য তাই তাদের জন্য যারা বহুবিধ কারণে চাপে আছেন। ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার এই জগতে তাদের অনেকে গাধার খাটুনি খেটে ক্লান্ত। ‘অনেক কিছু পাওয়ার আশা করে কিছু না পাওয়ার’ ক্ষোভে তাদের মনে নিরাশার মেঘ জমেছে, ঘনায়েছে নির্বেদ। রচনাটি তাদের জন্য যারা প্রশ্ন ও উত্তরের দোটানায় পড়ে খামোশ হওয়াকে মনের নিরাময় বলে ভাবছেন। সত্যি, ‘জীবন বড়ো আনখা বাগে চলে’! জগতের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি ঠিকঠাক বলতে পারে না আনখা বাগে চলা জীবন নিয়ে আসলে কী করা যায়! সেই ঊনিশ শতকে বসে বঙ্কিম নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘এই জীবন লইয়া কী করিবো?’ উত্তরটি তাঁকে সন্তুষ্ট করেছিল বলে মনে হয়নি। এই জীবন লইয়া কী করিবো কিংবা কোনদিকে অগ্রসর হইলে মন সুস্থির হইবে?, -এসব প্রশ্নের আসলে কোনো উত্তর হয় না। উত্তর খুঁজতে গেলে মনে সেই গাধার ছবি ভাসে। জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে সওয়াল-জবাব হয়তো এ-কারণে নিরর্থক। এতে বড়োজোর কিছু বাচালতা ঘটে, দার্শনিকতা হয়, মনের দ্বিধা কিন্তু ঘুচে না।

যাকগে, এবার গল্পে ফিরি। সে অনেককাল আগের কথা, সুতরাং আমার বলার মধ্যে কোনো ভুলচুক হলে পাঠক ক্ষমা করবেন। গল্পে বলে এক লোক (তার নাম-ঠিকানা সেভাবে স্পষ্ট নয়) নিজের সাধের গাধাটিকে নিয়ে লম্বা সফরে বেরিয়েছিল। পথের কঠিন চড়াই-উৎরাই পার হওয়ার ধকল সইতে না পেরে গাধাটি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পশুজীবন বা মানবজীবনের কোনোটাই কোনো কালে দুখের সাগরে নিমজ্জিত ছিল না, আবার সেটি সুখের নহরে প্লাবিত ছিল এমন প্রমাণ কিন্তু মিলে না। একালে লোকে অনেকিছু পাওয়ার আশায় গাধার মতো ছুটে, সেকালেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সংখ্যালঘু দু’চারজন বাদে সকলে গাধার খাটুনি খাটতো আর তাদের পথ চলার অবলম্বন গাধা খাটতো মানুষের দ্বিগুণ। একালের মতো সেকালেও হাড়ভাঙ্গা খাটুনির বিনিময়ে পর্যাপ্ত খাবার সবসময় জুটতো না। নিজের খাটুনি লাঘব করতে মানুষ তখন গাধার নাকের ডগায় মূলা ঝুলিয়ে তাকে লম্বা পথ পাড়ি দিতে বাধ্য করতো। মূলা হলো সেই প্রতিশ্রুতি যেটি নাকের ডগায় ঝুলে বলে পাওয়াটা সহজ মনে হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওটা আর পাওয়া হয় না। তাতে কি, পাওয়ার আশাটি বাস্তবিক কিছু পাওয়ার চেয়ে অনেক দামি। জ্ঞানীরা বলেন জীবনে কিছু পেতে হলে কিছু-না-কিছু পাওয়ার আশা করতে হয় এবং না পাওয়ার দুঃখটি পাওয়ার সেই আশা দিয়ে পূরণ করে নিতে হয়, নতুবা জীবনের রস থাকে না। একালের যারা ক্ষমতার রাজনীতি করেন তারা সেটা বোঝেন বলে লোকের নাকের ডগায় মূলা ঝুলিয়ে গদিতে বসার রাস্তা পাকাপোক্ত করার ফন্দি আাঁটেন। সে যাকগে, পাওয়ার আশায় ছুটন্ত গাধার পক্ষে জীবনের সার্থকতা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ থাকে না। সেটা একালে যেমন নেই, সেকালেও তথৈবচ। সেই প্রসঙ্গে আর নাই-বা গেলাম। আপাতত পথশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত গাধার কাহিনী ধরে আগাই।

বিবরণে প্রকাশ লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত গাধাটি পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে। গাধা-জীবনের এটি এক দিক বটে। যে খালি ছুটে সে যখন ছুটে চলার ক্লান্তিতে হঠাৎ বসে পড়ে তাকে উঠানো মুশকিল হয়। ক্ষুধা ও শ্রান্তির ধকল তাকে কাবু করে ফেলে এবং মনে বিষণ্নতা ও নির্বেদের মেঘ এসে জমে। একালের বৈদেশে লোকে এটাকে মনোরোগ বলে ডাকে। হতাশায় জেরবার মন মন্দাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, মনের আকাশে অগণিত কালো মেঘ জমেছে, মেঘগুলো সরাতে হলে ঈশ্বরকে ডাকাডাকি করে লাভ নেই। তিনি সেই কবে থেকে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন, উঠবার নামটি নেই। অগত্যা মেঘ সরাতে জানে এমন লোকের প্রয়োজন। বৈদেশে এনারা মনোরোগ বিশারদ বলে আজকাল সুনাম কিনেছেন। মনের এলাজ করাতে লোকজন তাদের কাছে ছুটে। লম্বা ফি দিয়ে ‘অনেক কিছু পাওয়ার আশায় কিছু না পাওয়া’র বয়ান শোনায়।

মনোরোগ বিশারদের জন্য বিষয়টি বেশ চাপদায়ক। তার মনের মেঘ কে সরায় সেটি জানা না গেলেও যারা মেঘ সরাতে আসে তাদের কাছে তাকে আশাবাদী এক মানুষের বেশভূষায় হাজির হতে হয়। একালের মনোবিশারদ তাই আশাবাদী। আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, মনকে প্রফুল্ল ও সজীব করে, জীবনের ক্লেশ ও যাতনাকে লঘুচিত্তে বহন করার প্রেরণা যোগায়। মনোবিশারদকে এসব মাথায় রেখে চিকিৎসার নিদান দিতে হয়। জীবনের সকল অবস্থায় আশাবাদী হও, সুখপাখিকে ধরতে হলে আশায় বসতি গড়ো, আজ না হলে কাল পাখি নিশ্চয় ধরা দেবে, তুমি আশায় বুক বেঁধে সর্বদা প্রফুল্লচিত্তে ছুটে চলো, -এইসব প্রবচন নতুন কিছু নয়, তবে একালের মনোবিশারদকে বাণীগুলা শুনাতে হয় গম্ভীর মুখ করে। মনমরা রোগীর বয়ান শুনে তাকে হাসলে চলবে না, প্রফুল্ল মুখ করে হাতাশায় নিমজ্জিত রোগীকে আশার আলো দেখানো রুচির পর্যয়ে পড়ে না সুতরাং রোগী ও মনোবিশারদের সংলাপকথনে কৌতুকের রেশ লেগে থাকে। দিনশেষে রোগী কতোটা আশা নিয়ে তেজিয়ান গাধার মতো ছুটতে পারে সেই পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না, তবে আংরেজিতে লোকে যেটিকে ডিপ্রেশন ও ডেসপায়ার (অর্থাৎ বিষণ্নতা ও হতাশা) বলে ডাকে স্বদেশে এখন তার চল বেড়েছে। বৈদেশের মতো স্বদেশেও লোকজন আজকাল মনের মেঘ কাটাতে মনোবিশারদ খোঁজে। তাদের পসার এখানেও বাড়তে চলেছে। বুরিদানের গাধা বেচারা কতোটা মনের বেদনে বসে পড়েছিল সে খবর দিতে ইতিহাস অপারগ। এটুক শুধু জানা যায় গাধাটিকে বসে পড়তে দেখে মালিকের মনে অশেষ দয়ার সঞ্চার ঘটে এবং গল্পের শুরু সেখান থেকে।

গাধাকে অবসন্ন দেখে মালিক তার সমুখে এক গামলা খাবার ও এক গামলা জল রাখেন। জীবনে বেঁচে থাকার দুটি অর্থ হয়, এর একটি খাদ্য এবং অন্যটি হচ্ছে পানীয়। বস্তু দুটি ছাড়া শরীর চলে না আর শরীর না চললে মনে বিকারের বেগ উঠে না। যে-কারণে হয়তো দেহের বিকার কমাতে সেকালে মুনী-ঋষি-দরবেশরা খাদ্য ও পানীয় যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতেন। একালেও অনেকে বিকার থামাতে উপবাসে ক্ষয় করেন সাধের মানবজীবন। মনে অপার আশা এই আত্মত্যাগে দেহের বিকার ঘুচবে, নরকাল শেষ হলে পরকালের পারানীতে দেহতরণী ভরে উঠবে। তাদের তরণী ভরে উঠে কিনা সে খবর জানার উপায় নেই, তবে অভিজ্ঞতা বলে উপবাসে-অনশনে জরাজীর্ণ দেহকে খাদ্য ও পানীয় দিয়ে পুনরায় চাঙ্গা করে নিলে বিকারের বেগ উঠতে সময় লাগে না। মন তখন দেহকে অনেককিছু পাওয়ার আশায় ব্যাকুল করে আর দেহচক্ষু দেখে নাকের ডগায় কিংবদন্তির মূলাটি ঝুলছে, সুতরাং তাকে এবার ছুটতে হয় জোর কদমে, গাধা যেমন ছুটে চলেছে যুগ-যুগান্তর ধরে। তো উপবাসে-অনশনে দেহ-মনের গতিলাভ যেহেতু হয় না, খাদ্য ও পানীয়ে উদরপূর্তি করা সেদিক থেকে বেহতর। বুরিদান সাহেবের গাধার সমস্যাটি সেখানেই ঘটে। সেই কাহিনীতে এবার ফিরি।

ইতিহাস বলে গাধাটি ক্ষুৎপিপাসায় কাতর ছিল। তার দেহযোগ ও মনোযোগ সেই অবস্থায় পতিত ছিল মানবভাষা যাকে মুমূর্ষু বলে সম্বোধন করে। এখানে ‘মুমূর্ষু’ শব্দের মাজেজা নিয়ে কিঞ্চিৎ কথা কওয়া প্রয়োজন। গুনীজনরা বলেন জগতে সদা সুখী (ওম সচ্চিদানন্দ) মন নিয়ে বাঁচতে হলে ‘নিজেকে জানা’ জরুরি। অন্যকে জানতে হলে সবার আগে নিজের খবর করা চাই এবং সেই খবর লোকে তিনভাবে করে থাকে, তিনটি স্তরের যে কোনো একটি ধরে নিজেকে তারা জানার চেষ্টা করে। প্রথম স্তরটি জ্ঞানীর, জ্ঞানী নিজেকে নিয়ে যেমন প্রশ্ন তোলে, জগতের সকল কার্য-কারণ নিয়ে সমানে প্রশ্নের রথ ছোটায়। জ্ঞানী হচ্ছে প্রশ্নভাবিক। সে প্রশ্ন করে-করে উত্তর খোঁজে এবং উত্তর পেয়ে গেলে আবার প্রশ্নে ফেরত যায়, কারণ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে তার মনে সন্দেহের উৎপত্তি ঘটে এবং সেটা নিরসনের জন্য স্বয়ং উত্তরকে সে প্রশ্ন করে বসে। জ্ঞানীর জন্য প্রশ্ন হলো নিয়তি। তার জীবন-জিজ্ঞাসা প্রশ্ন ও পালটা প্রশ্নের ছুতো ধরে জ্ঞানের নিশানা খোঁজে। জ্ঞানী তাই প্রশ্নের কারবারি। তার মন খালি প্রশ্ন আর উত্তর খোঁজে। জগতে জ্ঞানী ব্যক্তিরা এ-কারণে নির্ণয়বাদী। একালের পৃথিবীতে নির্ণয়বাদী জ্ঞানীরা বুদ্ধির কারবারি বলে নাম কিনেছেন। দেশে-বৈদেশে বুদ্ধি বিক্রয় করে তারা জীবন নির্বাহ করেন। বুদ্ধি দিয়ে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় বৈকি, তবে মনের মধ্যে সদা ‘সুখীভাব’ ধরে রাখার আরাম জোটে না। সোজা কথা ‘নিজেকে জেনে ফেলা’র বিষয়টি নিয়ে মনে সারাক্ষণ অস্থির এক তোলপাড় চলে। এটা সুখীভাবের সঙ্গে বসতি করার উপযুক্ত নয়। সুতরাং জ্ঞানী তার নিজের অজ্ঞাতে অহংকারী হয়ে পড়ে। অহংকার দিয়ে কী আর সুখপাখিকে ধরা যায়! কাজেই জ্ঞানীর জ্ঞানবিদ্যা অসুখী মন নিয়ে সুখের ফিকির করে। এই অর্থে জ্ঞান হচ্ছে মনের অসুখ এবং বুদ্ধিজীবীরা মোটের ওপর অসুখের কারবারি।

বুরিদানের গাধা এই মুহূর্তে আর জীবনে নেই। জিহবা বের করে চিৎপটাং শুয়ে আছে জীবনহীন এক নিঃস্তব্ধতার দিকে। মালিক তার গায়ে হাত রাখলেন। তার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না যে জীবনের নাট্যমঞ্চে দাঁড়িয়ে গাধাটি এতোক্ষণ ধরে যুক্তির দোটানায় ক্লান্ত হওয়ার গাধামি করেছে। সে যাহোক, তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে। আর কখনো সে জল ও খাবারের গামলায় মুখ ডুবিয়ে জীবনের জন্য কোনটা ভালো সেই যুক্তিতে নিজেকে কাহিল করবে না।

এবার দ্বিতীয় স্তরে আসা যাক। এই স্তরে যারা বিরাজ করেন তারা হলেন মূর্খভাবিক। তাদের মনে ‘নিজেকে জানা’র উদয় ঘটে, তবে সেই উদয়ের যবনিকা ঘটাতে অন্যের মুখপানে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকে না। পরের মুখের ঝাল খেয়ে এইসব লোকের দিন কাটে, অন্যলোকের বচন-প্রবচনকে জীবনের অর্থ ও সারাৎসার গণ্য করে তারা জগৎ-সংসারে চাকা ঘোরায়। প্রশ্ন, সন্দেহ ও মীমাংসার টানাপোড়েনের মাঝে যে ফাঁক থাকে মূর্খভাবিকরা সেই ফাঁক গলে ‘সুখীভাব’-এ বিরাজ করার মওকা খোঁজে। মূর্খভাবিক হয়ে জীবন কাটানোয় সুখের দেখা মিলে কিনা বলা মুশকিল। কারণ এমতো ভাবের লোক বাক্য নিয়ে কচলাকচলির ধার ধারে না। যে করে হোক একটা সিদ্ধান্ত তার চাই এবং ওতেই নিশ্চিন্ত হয়ে সে দিন কাটায়। মূর্খভাবিকের জীবনপদ্ধতিকে দূর থেকে বেশ লাগলেও কাছে গেলে তাকে রুক্ষ মরুভূমি মনে হয়। সেই মরুভূমিতে স্বর্গোদ্যান থাকলেও থাকতে পারে, তবে অহংকারশূন্য মন নিয়ে মূর্খভাবিক লোক দেহের খিদে মেটায় বলে মনে হয় না। অন্যের ‘জানা’কে কবুল করে নিজেকে সে জানার চেষ্টা করে। জগতের রঙ্গমঞ্চে এই ভাবের ক্ষুরে যারা মাথা মুড়িয়েছেন তারা হচ্ছেন সবচেয়ে সহজ শিকার। জ্ঞানী থেকে যোগী, ভোগী থেকে ত্যাগী, সরকার বাহাদুর থেকে সরকার বিরোধী... মূর্খভাবিক সকলের মুখের পানে ধায়, সবাইকে কবুল করে ‘নিজেকে জানা’র সন্তোষ পুরা করে। বিষয়টি কৌতুককর নিশ্চয়, তবে সেকালের সমাজে যেমন মূর্খভাবের জয়গান ছিল একালেও ভিন্নতা নেই।

তৃতীয় স্তরটি মুমূর্ষুর। ‘নিজেকে জানা’র একশো উপায় নিয়ে মুমূর্ষুর মনে দোটানা ও সংশয় উৎপন্ন হলেও জ্ঞানভাব বা মূর্খভাব দিয়ে তাকে বিচার করা যায় না। সে না জ্ঞানী না যোগী। না অহংকারী না নিরহংকারী। না সে প্রশ্নবাণে নিজেকে অস্থির করে, না রেডিমেড কোনো উত্তরকে তার জন্য অন্তিম বলে মানে। মুমূর্ষু কেবল জানতে চায় কীভাবে সুখী হওয়া যায়। ‘সুখীভাব’-এ স্থির থেকে জীবন কাটানোর জন্য সে যেমন জ্ঞানী ও যোগীর খোঁজ করে তেমনি ব্যক্তিজীবনের অলিগলি থেকে নানা অভিজ্ঞতা শুষে নেয়; অতঃপর নিশানা সঠিক মনে হলে ওতেই নিজেকে বিভোর করে জীবনের তৃষ্ণা জুড়ায়। জগতে সদা সচ্চিদানন্দের সুখ পেতে হলে মুমূর্ষুভাব ধারণ মন্দ না হলেও নিজেকে ওই স্বভাবে রপ্ত করানো দুরূহ। আত্মতুষ্টির জন্য মানুষ জানতে চায় এটা যেমন ঠিক, সেইসঙ্গে এটাও মিথ্যে নয় আত্মতুষ্টিকে অন্য লোকের কাছে জাহির করার আশায় মানুষ আসলে নিজেকে ও অন্যকে ‘জানতে চায়’। জগতে আত্মতুষ্টির বিকল্প কিছু নেই এবং সকলে সেটা চায়, তবে নিজের আত্মতুষ্টি দিয়ে অন্যের এলাজ করা বিপত্তির কারণ হতে পারে এবং লোকে সেই বিপত্তি আকছার ঘটায়। ‘নিজেকে জানা’র মাল-মশলা দিয়ে অন্যকে বিচার করার সুখ ও পরিতোষ আসলে মুমূর্ষুভাবের বিপরীত। যে মুমূর্ষু সে শুধু তার নিজের জন্য মুমূর্ষু এবং অন্যকে এলাজ করার দায় তার নেই, -এই অনুভবে রাস্তা খুঁজলে আত্মমুক্তি ঘটে, অন্যথায় জ্ঞানীর অহং মুমূর্ষুকে পেয়ে বসে, যার থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন। সমাজে এমতো লোকেরা অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী বলে নাম কিনে জগতের অনিষ্ট ঘটায়।

বুরিদান সাহেবের গাধার মুমূর্ষুভাব আসলে কেমন ছিল সেটা আর জানার সুযোগ নেই। মানুষ মানুষের ভাষা বুঝলেও পশুর ভাষা ঠিকঠাক বোঝে না। ইতিহাস শুধু সাক্ষ্য দেয় গাধাটি মুমূর্ষু হয়ে পড়েছিল। জীবন রক্ষার জন্য খাদ্য ও পানীয় দুটোই তার জন্য সমান জরুরি ছিল সেদিন। মালিক তো গামলা রেখে নিশ্চিন্তমনে দিবানিদ্রার আয়োজন করতে গেলেন। ওইদিকে গাধা বেচারা এক উভয় সংকটে পতিত হয়। আসলে তার ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিলো। তাই সে ভাবলো প্রথমে এক ঢোঁক জল পান করে তেষ্টা মেটানোর পর খাবার দিয়ে পেটের ক্ষুধা মেটাবে। পরিকল্পনাটি মন্দ ছিল না, তবে দেহের শিরা-উপশিরায় যখন আশা ও নিরাশার মতো খাদ্য ও পানীয়জলের দড়ি টানাটানি চলে তখন পরিকল্পনায় কাজ হয় না। বুরিদান সাহেবের গাধার ক্ষেত্রে সেটা ঘটে বলে ইতিহাসে লেখে।

বিবরণে প্রকাশ জলের গামলায় মুখ দেয়ার সময় খাদ্য গ্রহণের ক্ষুধা তার উদরে লেলিহান দাবালনের মতো জ্বলে উঠে। অগত্যা গাধা বেচারা খাবারের গামলাকে জীবন রক্ষার জন্য সমুচিত ভাবতে বাধ্য হয়। তার এই সিদ্ধান্তটিও মন্দ ছিল না, যদিও ফলাফল সেখানেও অনিশ্চিত। জীবনে সুখ ও দুঃখ হচ্ছে দুই ভাইবোন। তাদের জন্মদাত্রী জননীর কাছে দুই সন্তানের মধ্যে তফাত করা কঠিন। দুঃখকে ছেড়ে দিলে সুখের কী-বা প্রয়োজন! সুখ ছাড়লে দুঃখ বলে কিছু থাকে কি? দেহের জন্য খাদ্য ও পানীয় হলো ভাইবোন এবং তারা এখন বুরিদান সাহেবের গাধার দেহে একত্রে একসঙ্গে একমুহূর্তে থাকবে বলে পণ করেছে। এটা হচ্ছে সমরূপতাআংরেজি ভাষায় সমরূপতা বা সাদৃশ্যের একাধিক অর্থ হয়। একালের যন্ত্রযুগে অনেকে এটাকে সিমুল্যাক্রাম বা সিমুল্যাশন ডেকে সুখ পায়, সাদৃশ্য যেখানে মনের মধ্যে প্রতিরূপতার বিভ্রম তৈয়ার করে।

বিদ্যমান জগৎ আসল না নকলি সে তর্ক বহু পুরানা। সিমুল্যাক্রাম সে-তর্কের আগুনে খানিক ঘি ঢেলেছে মাত্র। মোদ্দা কথাটি হলো, বাস্তবের যে দুনিয়ায় লোকে চলেফিরে খায় সেটা নকলি, সদা বিরাজমান বাস্তবতার ম্যাট্রিক্স, ওই বাস্তবতার কারখানায় তৈরি একথান প্রতিলিপি। সেইক্ষেত্রে সদা বিরাজমান বাস্তবতা জিনিসটা কী? আংরেজি ভাষায় অনেকে এটাকে কনশাসনেস নামে ডাকে। বাংলায় চেতনা ও চৈতন্য দুভাবেই ডাকা হয়, যদিও ডাকাটি কতোটা সঠিক সেটা নিয়ে মনে সংশয় রয়েছে। কারণ, চেতনা আর চৈতন্য শুনতে সমার্থক হলেও গুণগত বিচারে তাদের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। সে যাহোক সদা বিরাজমান বাস্তবতাকে আপাতত কনশাসনেসের অর্থে চেতনা বলে যদি ভাবি তবে এর সৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন উঠে। সেক্ষেত্রে রেডিমেড উত্তরটি হলো, মন যখন দেহের সাহায্য নিয়ে দেখে ও ভাবে তখন যে বোধের জগৎ মনে তৈরি হয় সেটাকে চেতনা বলা যেতে পারে।

এই চেতনা প্রতিরূপতাকে একখান আলাদা বাস্তবতা বলে শনাক্ত ও ব্যাখ্যা করে। চেতনা দিয়ে লোকে আসলে নিজের অস্তিত্বকে নির্ণয় করে, এখন চেতনা যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় কিংবা সেটা যদি না থাকে তাহলে কী হয়? সদা বিরাজমান বাস্তবতা বলে কিছু থাকে কি? নাকি সেটাও বিলুপ্ত হয়? এখানে এসে নানা মুনি নানা মত দিলেও সোজা-সাপটা উত্তর হলো, যে বাস্তবতা সর্বদা রয়েছে সেটি নিজে সেই চেতনা। তার জন্ম, মৃত্যু, শুরু বা সমাপ্তি বলে কিছু নেই। লোকের মন (অথবা চেতনা) যাকে বাস্তব বলে ভাবছে সেটা আসলে ওই সদা বিরাজমান বাস্তবে একখণ্ড প্রতিরূপ। ওই বাস্তবের কারখানা থেকে যে জগতে বেরিয়ে এসেছে।

কম্পিউটার সিমুল্যাশনের মাধ্যমে প্রোগ্রামার এক প্রোগ্রামের কোড খানিক এদিক-সেদিক করে আরও পাঁচটা প্রোগ্রাম তৈয়ার করে, সদা বিরাজমান বাস্তবতা হচ্ছে সেরকম প্রোগ্রামার; নিজের প্রতিলিপি সে নিজে অহরহ নানা রূপে তৈরি আর বিনষ্ট করছে। তৈরি হওয়ার পরে যেটি মূর্ত হয় সেটি হলো বস্তু বা ম্যাটার, বস্তুবাদির সাধের ম্যাটারিয়ালিস্টিক ওয়ার্ল্ড বা বস্তু দিয়ে গড়া বিশ্ব। প্রশ্ন হলো বস্তু বা ম্যাটার ধ্বংস হলে কী থাকে? এটা নিয়ে শত মুনির শত মত। শটকার্ট মতটি সম্ভবত এরকম, -সদা বিরাজমান বাস্তবতা হচ্ছে এনার্জি বা শক্তির খনি; সেখানে বস্তু বলে কিছু নেই, বস্তুর কারিগর অনু-পরমাণুর কোনো অস্তিত্ব নেই, সোজা কথা এমন কোনোকিছু নেই যাকে শনাক্ত বা চিনতে পারা যায়। নিকষ এক ভূতূড়ে আঁধারে শক্তির বিনাশহীন স্রোত শুধু বইছে। যে-কারণে ওটাকে ভাবতে গেলে ‘কুছ নেহি’ বলে মনে হয়। শক্তিপুঞ্জের অপার এই স্রোতপ্রবাহকে অনেকে তাই ‘নাস্তি বা ‘নাথিংনেসের’ খনি বলে থাকেন। সেই খনি আসলে শক্তির কারখানা, যেখানে রূপ-প্রতিরূপ সৃষ্টির খেলাটি আদিঅন্তহীন কাল ধরে চলছে।

‘খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে/বিরাট শিশু আনমনে’ –কবি বলে খালাস, কিন্তু শিশুটি কে? এর উত্তর বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞাস করলে একরকম, দার্শনিকের কাছে জবাব চাইলে অন্যরকম, মরমীকে প্রশ্ন করলে হয়তো আরেকরকম, তবে সব রসূনের গোড়া যেমন এক, সদা বিরাজমান বাস্তবতার গোড়াটিও এক, আর সেটি হলো অদৃশ্য শক্তিপুঞ্জের অহর্নিশ ভাঙা-গড়া ও রূপ-প্রতিরূপের খেলায় মহাজগৎ বইছে তার নিজের খেয়ালে। লোকেরা দিনে-রাতে যে বাস্তবে চলেফিরে কিংবা গাধার খাটুনি খাটে সেই বাস্তবতা হয়তো ওই শক্তিপ্রবাহের একখণ্ড প্রতিলিপি, কম্পিউটারের কোড দিয়ে লেখা সিমুল্যাশন। হলিউডের কারখানায় তৈরি দ্য মেট্রিক্স নামের ছবিখানা যারা দেখেছেন তারা উক্ত বাক্যের রহস্য সম্যক বুঝিতে পারিবেক।

জগতে আত্মতুষ্টির বিকল্প কিছু নেই এবং সকলে সেটা চায়, তবে নিজের আত্মতুষ্টি দিয়ে অন্যের এলাজ করা বিপত্তির কারণ হতে পারে এবং লোকে সেই বিপত্তি আকছার ঘটায়। ‘নিজেকে জানা’র মাল-মশলা দিয়ে অন্যকে বিচার করার সুখ ও পরিতোষ আসলে মুমূর্ষুভাবের বিপরীত। যে মুমূর্ষু সে শুধু তার নিজের জন্য মুমূর্ষু এবং অন্যকে এলাজ করার দায় তার নেই, -এই অনুভবে রাস্তা খুঁজলে আত্মমুক্তি ঘটে, অন্যথায় জ্ঞানীর অহং মুমূর্ষুকে পেয়ে বসে, যার থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন। সমাজে এমতো লোকেরা অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী বলে নাম কিনে জগতের অনিষ্ট ঘটায়।

সে যাহোক, গল্পগাছাকে ইতিহাস বলে মান্য করার রেওয়াজ অনেকদিন আগে উঠে গেছে, যদিও সেকালে ইতিহাস ও গল্পগাছায় বিশেষ ফারাক ছিল না। সেই ইতিহাসে চোখ রাখলে বুঝতে বাকি থাকে না বুরিদান সাহেবের গাধা সমরূপতার সংকটে পতিত হয়েছিল। জীবনরক্ষকারী দুটি উপাদান সমানে তাকে জ্বালিয়ে মারছিল। খাবারের গামলায় মুখ দিতে দিলে জলতেষ্টা প্রকট হয়ে উঠে, যেন এই মুহূর্তে জল পান না করলে গলা দিয়ে এক গ্রাস খাবার ঢুকবে না, ওটা গলায় আটকে তার জীবন দফারফা করে দেবে। অন্যদিকে জলের গামলায় মুখ বাড়ালে পাকস্থলীর ভিতর থেকে কে যেন তাকে খাবারের গামলায় মুখ ডুবাতে হুকুম করে। জল না খাবার, -কোন বস্তু দিয়ে দেহের এই সর্বগ্রাসী প্রলয় থামাবে সেই দুর্ভাবনা গাধাটিকে ক্রমশ কাবু করে ফেলে। জীবন কৌতুকময় আর জগৎ-সংসারের অধিবাসীরা হলো সেই কৌতুকের আদি উৎস; এই মানুষ যেমন। প্রতিটি মানুষের মনে দ্বন্ধ চলে। সুকুমার বাবু এটা বুঝতে পেরেছিলেন বলে লিখে রেখে গেছেন:-

...এই দুনিয়ার সকল ভাল,/ আসল ভাল নকল ভাল,/ সস্তা ভাল দামীও ভাল,/ তুমিও ভাল আমিও ভাল,/ হেথায় গানের ছন্দ ভাল,/ হোথায় ফুলের গন্ধ ভাল,/ মেঘ-মাখানো আকাশ ভাল,/ ঢেউ-জাগানো বাতাস ভাল,/ গ্রীষ্ম ভাল বর্ষা ভাল,/ ময়লা ভাল ফরসা ভাল,/ পোলাও ভাল কোর্মা ভাল,/মাছ পটোলের দোলমা ভাল,/ সোজাও ভাল বাঁকাও ভাল,/ কাঁসিও ভাল ঢাক্ও ভাল,/ টিকিও ভাল টাকও ভাল,/ ঠেলার গাড়ি ঠেলতে ভাল,/ খাস্ত লুচি বেলতে ভাল,/ গিটকিরি গান শুনতে ভাল,/ শিমুল তুলো ধূনতে ভাল,/ ঠাণ্ডা জলে নাইতে ভাল,/ কিন্তু সবার চাইতে ভাল-/ পাঁউরুটি আর ঝোলা গুড়।

সত্যি বটে, ভালো ভাবলে সব্বাই ভালো, মন্দ ভাবলে মন্দ। সমাধান সোজাসাপটা হলেও মনের দ্বন্ধ মনকেই ঘুরিয়ে মারে। দ্বন্ধ ঘুচে না বলে মন ‘নিজেকে জানতে’ গিয়ে খালি প্রশ্ন তোলে, -হ্যাঁ রে বলতো দেখি আসলেই কোনটা ভালো, সুখী হওয়ার চেষ্টা ভালো নাকি সুখের ভান করা ভালো? ভোগী হওয়া ভালো নাকি যোগী সাজার চেষ্টা ভালো? জ্ঞানী ভালো নাকি মূর্খের জীবন কাটানো ভালো? ‘কোনটা ভালো’র দ্বন্ধ জীবনের শুরু থেকে সমানে চলেছে। বুরিদানের গাধা সেই দ্বন্ধে কতোখানি জেরবার হয়েছিল সেটা আর জানার উপায় নেই, তবে সে যে মুমূর্ষুভাব ধরে মালিকের বোঝা টেনে চলছিল এটা সুনিশ্চিত। খাদ্য ও পানীয়জল নিয়ে তার এই মাথাঘোরানো দোটানায় বুঝি সেটার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো আজ!

দেহের ওই অবস্থায় মনের চরকা ঘোরানো বেহতর কঠিন কাজ হলেও সাহেবের গাধাটি ইতিহাসের সমুদয় গাধাকুলের মধ্যে ব্যতিক্রম। খাবার ও পানীয়জলের গামলায় পাক খেতে-খেতে, ক্ষুধা ও তৃষ্ণার মারণসম দোটানা সইতে না পেরে বেচারা অবশেষে কাহিল হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে। বাকিটা করুণ ইতিহাস। মালিক ঘুম থেকে উঠে আস্তাবলে গিয়ে দেখতে পায় জল ও খাবারের গামলা যেমন ছিল তেমনি পড়ে আছে, শুধু গাধাটি আর বোঝা টানার জন্য ইহলোকে নেই। পথের ক্লান্তি ভুলতে নিজেকে সে শীতল করেছে মরণে। ডেথ ইজ দ্যা আলটিমেট সাইলেন্স; তারপরে আর কোনো কথা নেই। মরণের দেশ বলে কিছু আছে কিনা সেটা কেউ জানে না। যদি থাকে তবে সেই দেশে হয়তো কোনো বাক্য নেই, কোনো সিদ্ধান্তের দরকার নেই, বিধাতা বা অপদেবতার আয়োজন ও প্রয়োজন নেই, ভালো নেই বলে মন্দের প্রয়োজন নেই, সোজা কথা ‘তারপর’ বলে আর কিছু নেই; হ্যাঁ কিছু যদি বাকি থাকে সেটা শুধু মিশে যাওয়া অনন্ত এই মহানভে।

বুরিদানের গাধা এই মুহূর্তে আর জীবনে নেই। জিহবা বের করে চিৎপটাং শুয়ে আছে জীবনহীন এক নিঃস্তব্ধতার দিকে। মালিক তার গায়ে হাত রাখলেন। তার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না যে জীবনের নাট্যমঞ্চে দাঁড়িয়ে গাধাটি এতোক্ষণ ধরে যুক্তির দোটানায় ক্লান্ত হওয়ার গাধামি করেছে। সে যাহোক, তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে। আর কখনো সে জল ও খাবারের গামলায় মুখ ডুবিয়ে জীবনের জন্য কোনটা ভালো সেই যুক্তিতে নিজেকে কাহিল করবে না।
...

বুরিদান সাহেবের গাধার ঘটনাটি সত্য না মিথ্যা, গল্প না ইতিহাস সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। কাহিনীটি মনের মধ্যে যে দাগ রেখে যায় সেটা নিয়ে হয়তো খানিক ভাবনা করা যায়, প্রশ্নও তোলা যেতে পারে। প্রশ্ন তোলা অবশ্য অনুচিত, কারণ প্রশ্নের মধ্যে যুক্তির দৌরাত্ম থাকে, যুক্তিতর্কের বাটখারা দিয়ে সবকিছু মাপামাপি করার প্রবণতা সেখানে এড়ানো যায় না এবং দিনশেষে আরও একঝাঁক নতুন প্রশ্ন ছাড়া বিশেষ কিছু মিলে না। কিন্তু মানুষ হলে প্রশ্নের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া মুশকিল। গাধার জীবন মানুষের অজানা নয় কিন্তু তার মনের তল পাওয়া মানুষের অসাধ্য। গাধামনের তাবত খুটিনাটি আজ-অব্দি কেউ জেনেছে বলে শোনা যায় না। তবে গাধা যেহেতু বিচিত্র ও বোধগম্য বহু কারণে মানুষের চিরসখা সেকালের বুরিদান সাহেবের মতো একালেও ‘একটি গাধার মৃত্যুরহস্য’ নিয়ে গুটিকয় প্রশ্ন তোলা যেতে পারে:-

প্রশ্ন-১. গাধাটি কি গাধা হওয়ার কারণে সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না? সে কি চিন্তাশীল ছিল বলে ক্ষুধা ও তেষ্টার মধ্যে কে প্রধান সেটা নিয়ে যুক্তি-তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল? যেহেতু, চিন্তার অপর নাম হচ্ছে তর্ক আর তর্ক মানেই বিড়ম্বনা?

প্রশ্ন-২. দ্বন্ধ-কবলিত গাধা কি কোনো নৈতিক সংকটে ভুগছিল? তার দেহ দুটি বস্তুকে চাইছে, কিন্তু মন সেখানে প্রাধান্যের প্রশ্ন তোলায় বেচারা নৈতিক সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল। তবে কি দেহ ও মন পৃথক রেখা ধরে চলে? যেখানে দেহের দাবি মন শুনতে পায় না? অথবা শুনলেও ওটাকে আমলে নিতে বাধ্য থাকে না? দেহ ও মন কি তবে একত্রে থাকার পরেও আলাদা? নাকি অভিন্ন হলেও তারা আসলে একে অন্যের সখা নয়? মন কি তবে দেহের চেয়ে বেপরোয়া? ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদীর মতো জেদি ও আপসহীন?

প্রশ্ন-৩. ঘটনাদৃষ্টে মনে হয় খিদে ও তেষ্টার প্রশ্নে গাধা বেচারার সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল। যুক্তি ও কাণ্ডজ্ঞানকে সেক্ষেত্রে ভিন্ন দুটি বস্তু বলে মানতেই হয়। গুরুতর কোনো সংকটে মন আসলে কাকে প্রাধান্য দেবে? যুক্তিকে? নাকি কাণ্ডজ্ঞানকে জীবনের সার ধরে ওতেই আস্থা রাখবে?

প্রশ্ন-৪. গাধার জায়গায় মানুষ হলো কী ঘটতো? মানুষ কি চিন্তাশীলতা বজায় রাখতো? দেহের দাবিকে মনের উপরে প্রাধান্য দিতো? নৈতিক সংকটে ক্ষতবিক্ষত হতো? নাকি যুক্তির দোটানা বাদ দিয়ে পানীয়জল ও খাবারের মধ্যে একটিকে বেছে নিতো? তাই যদি হয় তবে মানুষ গাধার চেয়ে অধিক চিন্তাশীল ও বিচক্ষণ, -এই দাবি যুক্তিসঙ্গত হয় কী করে!

প্রশ্ন-৫. বুরিদান সাহেবের গাধাটি যুক্তি, বিবেচনা ও চিন্তাশীলতা প্রয়োগ করতে গিয়ে মারা পড়ে বলে মনে হচ্ছে। এর অর্থ কি তবে এই যে, প্রাণ বাঁচানোর প্রশ্নে যুক্তি ও চিন্তাশীলতার তুলনায় দেহের দাবি সবার আগে? পরিণাম ভালো-মন্দ যেমন হোক, জান বাঁচানো ফরজ হলে সত্য-মিথ্যায় প্রভেদ থাকে না। মিথ্যা তখন সত্য নামে গণ্য হয় এবং সেটাই কি হওয়া উচিত নয়?

পাঠকদের উদ্দেশে প্রশ্নগুলো রাখলাম। আসলে বুরিদান সাহেবের গাধাকে নিয়ে ভাবতে বসলে গুরুতর গাধামির কবলে পতিত হওয়া বিচিত্র নয়। ফরাসি দেশে বসে সাহেব যখন এই ঘটনার দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তখন মানবজীবনে নীতি-নৈতিকতার ভূমিকা ও সংকট নিয়ে ঘোরতর কোন্দল চলছে সেই দেশে। সে এক অন্য ইতিহাস। অনুসন্ধানীরা ইচ্ছে করলে তার খবর নিতে পারেন।

আপাতত এই প্রশ্নটিকে সহি ধরা যেতে পারে, -‘বুরিদানের গাধা কি সত্যি গাধা ছিল নাকি যুক্তি ও কাণ্ডজ্ঞানের দোটানা তাকে গাধায় পরিণত করলো?’ যেভাবে আমরা জীবনের অস্তিত্ব ও অর্থ খুঁজতে গিয়ে হয়রান হয়ে পড়ি এবং দোটানায় পড়ে ভ্যাবাচেকা লাগা মানুষের নিয়তি বরণ করতে বাধ্য হই! যেখান থেকে আমাদেরকে বোকা বানানোর বিবিত্র সব ব্যবস্থা ও কাণ্ডকাহিনীরা জন্ম নিতে থাকে! দেশ ও বৈদেশের হালফিল ঘটনারা যেন এরকম সব ইঙ্গিত দিয়ে যায়।

এই প্রতীকীভাষ্য তাই তাদের জন্য যারা বহুবিধ কারণে চাপে আছেন। ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনার এই জগতে তাদের অনেকে গাধার খাটুনি খেটে ক্লান্ত। ‘অনেক কিছু পাওয়ার আশা করে কিছু না পাওয়ার’ ক্ষোভে তাদের মনে নিরাশার মেঘ জমেছে, ঘনায়েছে নির্বেদ। রচনাটি তাদের জন্য যারা প্রশ্ন ও উত্তরের দোটানায় পড়ে খামোশ হওয়াকে মনের নিরাময় বলে ভাবছেন। সত্যি, ‘জীবন বড়ো আনখা বাগে চলে’! জগতের সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি ঠিকঠাক বলতে পারে না আনখা বাগে চলা জীবন নিয়ে আসলে কী করা যায়! সেই ঊনিশ শতকে বসে বঙ্কিম নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন ‘এই জীবন লইয়া কী করিবো?’ উত্তরটি তাঁকে সন্তুষ্ট করেছিল বলে মনে হয়নি। এই জীবন লইয়া কী করিবো কিংবা কোনদিকে অগ্রসর হইলে মন সুস্থির হইবে?, -এসব প্রশ্নের আসলে কোনো উত্তর হয় না। উত্তর খুঁজতে গেলে মনে সেই গাধার ছবি ভাসে। জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে সওয়াল-জবাব হয়তো এ-কারণে নিরর্থক। এতে বড়োজোর কিছু বাচালতা ঘটে, দার্শনিকতা হয়, মনের দ্বিধা কিন্তু ঘুচে না

দ্বিধা ঘোচানোর জন্য কী করণীয় সেটা এই রচনাকারের পক্ষে বলা মুশকিল। দ্বিধার অবসান সওয়াল-জবাবে মিটবে নাকি জগতের সকল প্রশ্ন ও কোলাহলে নিরুত্তর থেকে ঘুচবে তা কে বলতে পারে! কারণ মনের দ্বিধার কোনো জগৎস্বীকৃত মাপকাঠি নেই। জনে-জনে সেখানে বৈচিত্র্য বা ভিন্নতা আছে। রচনাটি তাদের জন্য যারা প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য এখনো সরব এবং যারা জবাব না পেয়ে ইতিমধ্যে নীরব। জীবনকে নিয়ে ভাবতে বসলে সেটা হয়তো অপার দুঃখের মধ্যে রঙ্গকৌতুকের খনি, ‘অনেককিছু পাওয়ার আশায় কিছু না পাওয়া’র প্রতিধ্বনী। অন্যদিকে কোনোকিছু না ভাবলে সেটা অকারণ গাধার খাটুনি ও অর্থহীনতার জয়ধ্বনী। মন এখন কোনটাকে বেছে নেবে সেটা পাঠকের নিজস্ব বিবেচনা।
...

আহমদ মিনহাজ
৫ আগস্ট ২০১৭

ছবি: 
01/06/2007 - 1:46পূর্বাহ্ন
01/06/2007 - 1:46পূর্বাহ্ন
01/06/2007 - 1:46পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

বাহ্!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।