রাজিব মাহমুদ
আগের ২ পর্বের লিঙ্কঃ
১ম পর্বঃ http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56676
২য় পর্বঃ http://www.sachalayatan.com/guest_writer/56711
সৌম্য’র পরের সপ্তাহটা খুব ব্যস্ততায় কাটলও। একটা ক্রাইম রিপোর্টিং এর কাজে ঢাকার বাইরে থাকতে হল তিনদিন। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাদের চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছেলের বৌকে যৌতুকের জন্য দিনের পর দিন একটা ঘরে বন্দী করে রেখেছিল। তারা মেয়েটাকে খাবার দিতনা ও ভয় দেখাত যে যৌতুক না আনলে ওর পেটের বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে। মেয়েটা শেষ পর্যন্তও যৌতুক আনতে রাজি না হলে তার উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে নেয়ার পথে সে মারা যায়। বস্তাবন্দী লাশ নদীতে ফেলে দিয়ে স্বামী, ভাসুর, আর শাশুড়ি পালিয়ে যায়। পুরো দুই সপ্তাহ অমানুষিক পরিশ্রম করে এসব তথ্য সংগ্রহ করল সৌম্য। ও চায় অন্তত: মেয়েটার পরিবার যাতে ন্যায়বিচার পায়। ঢাকায় ফিরে আসার পরেও রিপোর্ট তৈরি করতে কালঘাম ছুটে গেল। বসের ডেডলাইন মানে আক্ষরিক অর্থেই ডেডলাইন। উনার ভাষায়: “হোয়েদার ইউ আর ডেড অর এলাইভ, এ ডেডলাইন ইজ ডেডলাইন এন্ড ইউ মাস্ট মিট ইট।” আর সেই ডেডলাইন মিট করতে গিয়ে কাজের চাপে ঘুম-খাওয়া সব মাথায় উঠেছে সৌম্য’র। এ কয়দিন দীপার সাথেও ঠিক মত কথা হয় নি ফোনে। তবে শত ব্যস্ততার মধ্যেও সেদিন রাতের ভাষাপোকার সাথে কথোপকথনের টুকরো টুকরো অংশ ওর মগজে ধাক্কা দিচ্ছিল।
ও কি সত্যিই দীপাকে ভালোবাসে না? ও ধন্দে পড়ে যায়। ও দীপার সঙ্গ চায়, ওর সাথে কথা বলার জন্য ও সারাদিন অপেক্ষা করে। ওদের শারীরিক সম্পর্কের সময়ও একে অন্যকে ভরিয়ে রাখে। মনে হয় কোথাও একটুকু ভান নেই। তবে এটাও ঠিক ও সাজিদের দায়িত্ব নিতে ভয় পায়। এছাড়াও যে মেয়ে পুরো পাঁচ বছর আরেকটি পুরুষের সাথে প্রতি রাতে শুয়েছে, তার সন্তান ধারণ করেছে তাকে বিয়ে করে বউ করার কথা সৌম্য ঠিক ভেবে উঠতে পারে না।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল ভাষাপোকা দীপা’র ভাবনা নিয়ে যা বলেছে। সৌম্য এটা নিয়ে আকাশ পাতাল ভেবেছে। দীপা কি সত্যি-ই এমন ভাবতে পারে? যত যাই হোক দীপা সৌম্য’র মা’র মৃত্যু চাইতে পারে না। আর তাছাড়া সৌম্য কখনো দীপাকে এরকম ইঙ্গিত দেয়নি যে সৌম্য তার মা-বাবা কষ্ট পাবে দেখে দীপাকে বিয়ে করতে পারবে না। তবে এটাও আবার ঠিক যে নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে দীপা মা হিসেবে সব করতে পারে। হয়ত কোন নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিতেও পেছপা হবে না। আরেকটা ব্যাপার হল ভাষাপোকা সৌম্য’র অবচেতনের যে ভয় অর্থাৎ দায়িত্ব কাঁধে পড়ে যাবার ভয়, সামাজিকভাবে ছোট হয়ে যাবার ভয়, মা’কে কষ্ট দেবার ভয়-এই সবকটা ভয়কে যেন সুঁই দিয়ে উকুনের মত তুলে এনেছে। আর সেখানেই খটকাটা জিতে যাচ্ছে। তাহলে হয়ত ও দীপা সম্পর্কে যা বলেছে তা ঠিক হলেও হতে পারে। এত নিখুঁতভাবে একজনের সম্পর্কে বলতে পারলে অন্যজনের সম্পর্কেই বা বলতে পারবে না কেন?
কিন্তু ভাষাপোকা কি সত্যিই আছে? নাকি আসলে পুরোটাই নিজের অবচেতনের সাথেই একটা দীর্ঘ কথোপকথন? কিন্তু এত স্পষ্ট সব। এত পরিষ্কার শুনলো সে কথাগুলো। উত্তরও দিল… তাহলে? তবে ওর মনে পড়ে যে ভাষাপোকা একবার বলেছিলো যে সে সৌম্য’র ই একটা অংশ। মনের ভেতরের সব যুক্তি-তর্কে সৌম্য ক্লান্ত হয়ে যায়। এর থেকে পরিত্রাণ দরকার তার। বিশেষ করে দীপা সম্পর্কে বলা কথাগুলো নিয়ে ভাষাপোকার সাথে ওর আরেকবার বোঝাপড়া করতেই হবে।
আজ রিপোর্টটা জমা দিয়ে সন্ধ্যের আগেই বেরিয়ে পড়ল সৌম্য। দীপা’র ওখানে যেতে পারত কিন্তু গেলনা। আজ ওর নিজের জন্য কিছু সময় প্রয়োজন। বাড়ি ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। সটান বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল চুপচাপ। ভাষাপোকার সাথে যোগাযোগের কোন সুনির্দিষ্ট উপায় ওর জানা নেই। এর আগের দু’দিন যোগাযোগটা হয়ে গিয়েছিল বা বলা যায় ভাষাপোকা-ই করেছিলো। কিন্তু ওর দিক থেকে যোগাযোগ করতে হলে কী করণীয় তা জানা নেই সৌম্যের। তবে শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আর তখনই ও টের পায় যে এ ক’দিনের টানা ব্যস্ততার পর ওর শরীর কী ভীষণভাবে বিশ্রাম চাচ্ছে! তবে এই ক্লান্তির ভেতরে ঘুমিয়ে যেতে যেতেও ও প্রছন্ন ভাবে খুঁজতে থাকে ভাষাপোকাকে। ওর মনের প্রশ্নগুলো যেন করোটির ভেতরে কিলবিল করতে থাকে। ওর ভেতর থেকে কে যেন খুঁজতে থাকে ভাষাপোকাকে। কিন্তু এবার আর গত দু’দিনের মত কোন শিস শোনা যায় না। কেমন একটা অদ্ভুত বিষণ্ণ নীরবতা পুরো মগজ জুড়ে।
এরকম একটা মুহূর্তে ওর মনে হল ওর মাথার ভেতরে মগজের ওপর দিয়ে একটা গভীর তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। ধানক্ষেতের সবুজ ধানের ওপর বাতাস বয়ে গেলে যেমন ধানের গাছগুলো নম্র আবেশে পেছনে বা পাশে এলিয়ে পড়ে, ওর মগজের শিরা উপশিরাগুলোর ওপর খেলে গেল সেরকম একটা আবেশ। ও ডেকে উঠল, “ভাষাপোকা”। কেউ জবাব দিল না। তবে বাতাসের মত সেই তরঙ্গ যেন আরো জোরালো হল; একটা ফিশফিশানির মত শোনা গেল। কেউ যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। যেন কেউ কিছু বলতেও চাইছে। এরকম কিছুক্ষণ চলার পর সৌম্য যেন একটা ভাব বা বক্তব্যকে বুঝে উঠল। কিন্তু কোন ধ্বনি বা শব্দে নয়। বরং এক গা ছমছম করা নীরব যোগাযোগের তরঙ্গে। সেই তরঙ্গ থেকে ভাবটুকু ছেঁকে নিলে এরকম দাঁড়ায়:
“ভাষাপোকাকে ধ্বংস করা হয়েছে।”
সৌম্য’র মনে হলো একটা তীব্র হাহাকার ওর অনেক ভেতরের একটা গভীর সুড়ঙ্গে গড়িয়ে পড়লো। চারিদিকে যেন এক ধরণের ভুতুড়ে শূন্যতার মত নীরবতা ছড়িয়ে পড়ছে-কানে তালা ঝুলিয়ে দেয়া এক গম্ভীর স্তব্ধতা। সেই তরঙ্গ-নির্ভর ভাবকে ও আবার শুনতে পায়, “ভাষাপোকা নিহত হয়েছে। তার সমস্ত সৈন্য-সামন্ত সহ সে নিহত হয়েছে। টিকে থাকার চেষ্টায় অনেক যুদ্ধ করেও সে পরাজিত হয়েছে মূক্তাপোকার কাছে। এই পোকা যুদ্ধ করেছে নিমিনদের অস্ত্র হয়ে। বাকিটা তুমি ভাষাপোকার চিঠি থেকে জানতে পারবে। এই চিঠি পাওয়া গিয়েছিল তার গোপন বাংকারে। যেখানে স্বেচ্ছাবন্দী থেকে সে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। সম্ভবত চিঠিটা তোমাকেই লেখা। চিঠিটা তোমার মগজের তরঙ্গে প্রবেশ করানো হচ্ছে। ঠিক যেভাবে তুমি আমার ‘ভাব’ বুঝতে পারছ সেভাবেই চিঠিটাও বুঝতে পারবে:
প্রিয় সৌম্য,
তোমার কাছ থেকে শেষ বিদায়টা নেয়া হল না। আমি গত সপ্তাহের প্রায় পুরোটা জুড়েই তোমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু তোমার মাথায় অনেক ধরণের চাপ থাকায় তোমার মনোযোগ পাইনি। জানি না এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছুবে কিনা আর পৌঁছুলেও কীভাবে পৌঁছুবে। যাই হোক আমি এখন আমার গোপন বাঙ্কারে আছি আর আমার সৈন্যরা প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এটাকে গোপন বাঙ্কার বলা ঠিক হচ্ছে কিনা জানি না কারণ ওরা মানে নিমিনরা এটার কথা জেনে ফেলেছে। আমি বাইরে গোলাগুলির আওয়াজ পাচ্ছি আর এটাও বুঝতে পারছি যে আমার সৈন্যরা হেরে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা বাঙ্কারে ঢুকে আমাকেও মেরে ফেলবে। যাই হোক সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আমি ধ্বংস হওয়ার আগে মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কিছু কথা তোমাকে বলে যেতে চাই। আশা করি তুমি ও তোমরা মানুষেরা তা বিবেচনা করে দেখবে। অবশ্য নিমিনরা যদি সব দখল করে নেয় তখন হয়ত তোমরা এসব কিছু করার সুযোগ-ই পাবে না। যাই হোক আমি শেষ মুহূর্তেও আশাবাদী থাকতে চাই আর যা বলতে চাই সেটা নিম্নরুপঃ
তোমরা মানুষেরা হয়ত জান না যে নিমিন বলে এক ধরণের প্রাণী আছে যারা দেখতে হুবহু তোমাদের মত। ওরা থাকে তোমাদের ছায়াপথ গ্যালাক্সির ভেতরেই কিন্তু তোমাদের সৌরজগত থেকে প্রায় ২০০০ সৌরজগত দূরের একটা বেশ প্রাচীন গ্রহে। ওদের সভ্যতা অনেক পুরনো যার শীর্ষে গিয়ে ওরা অমরত্ব লাভ করেছে। তবে সেই সাথে ওরা পরিণত হয়েছে এক মূক জাতিতে। ওদের পুরো গ্রহটাই একটা দেশ যেটা তোমাদের পৃথিবীর চেয়ে প্রায় পাঁচ গুন বড়। তবে ওদের গ্রহে কারও কোন ভাষা নেই। বলা যায় কথ্য ভাষা নেই। কেননা একজন নিমিনের অন্য নিমিনের সাথে মৌখিক যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই। প্রতিটা নিমিনের একটা জাতীয় আই ডি আছে যে আউ ডি’র বিপরীতে তার সমস্ত তথ্য রাষ্ট্রীয় মেমোরি ব্যাঙ্কে জমা থাকে। রাষ্ট্র যখন কোন ব্যাপারে কোন নিমিন নাগরিকের সাথে যোগাযোগ করতে চায় তখন তার আই ডি তে সাঙ্কেতিক মেসেজ পাঠানো হয়।
নিমিনরা কোন কাজ করে না কারণ তাদের খাদ্য উৎপাদন করতে হয় না। রাষ্ট্র থেকে তাদের জন্য সরবরাহ করা হয় একধরণের ক্ষুধা নির্বাহকারী ডিজিটাল ট্যাবলেট। এই ট্যাবলেট উৎপাদিত হয় স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মাধ্যমে কোন নিমিনের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই। প্রতিটা নিমিন থাকে একটা দশ ফুট বাই দশ ফুট হাওয়া-কাঁচ ঘরে যা ওদের গ্রহের হাওয়ায় ভাসতে থাকে। যেহেতু ওদের কাজ করতে হয় না তাই সময় কাটানোর জন্য ওদের প্রত্যেকের হাওয়া-কাঁচ ঘরে রয়েছে যাবতীয় ডিজিটাল বিনোদনের ব্যবস্থা। ওরা ঐ ঘর থেকে কখনো বের হয় না। যেহেতু ওরা অমরত্ব লাভ করেছে তাই ওদের নতুন জীবন সৃষ্টির কোন প্রয়োজন নেই। প্রতিটা নিমিন অনন্ত জীবন নিয়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত হাওয়া-কাঁচ ঘরে অনন্তকাল ধরে বাস করতে থাকে।
ওদের জীবনে শুধু নতুন প্রাণের সৃষ্টি-ই বন্ধ হয়নি; বন্ধ হয়ে গেছে সবরকম নতুন সৃষ্টি। বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস বা জ্ঞানের অন্য যে কোন শাখায় আর নতুন কোন সৃষ্টি বা উদ্ভাবন নেই কারণ ওরা মনে করে এসবের আর প্রয়োজন নেই। আর নতুন সৃষ্টি হবেই বা কীভাবে? প্রতিটা নতুন আবিষ্কারকে ধারণ ও তা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তো ভাষা চাই। ওদের তো আর ভাষাই নেই। ওরা একটা মূক জাতি। আর তাই কোন নিমিন বিজ্ঞানী আর নতুন কিছু আবিষ্কারের প্রণোদনা পায় না বা কোন নিমিন কবি লেখে না নতুন কোন কবিতা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল নতুন কোন কিছু করার চেষ্টা কোন নিমিনের মধ্যে পরিলক্ষিত হলে রাষ্ট্র তাকে ভয়ঙ্কর শাস্তি দেয়। এই শাস্তির উদ্দেশ্য হল তাকে ভবিষ্যতে এ ধরণের কোন উদ্যোগ থেকে পুরোপুরি বিরত রাখা। নিমিনরা গভীরভাবে বিশ্বাস করে যে ওরা পৌঁছে গেছে চূড়ান্ত সৃষ্টির শীর্ষে যেখানে শুধুই অনন্ত জীবনোপভোগ ছাড়া আর সব কিছুই বাতুলতা মাত্র।
এই নিমিনদের রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়োগ দেয়া কিছু আন্তঃ গ্যালাক্টিক চর আছে যাদের কাজ হল এই গ্যালাক্টির ভেতরে অন্য সভ্যতার খোঁজ করা। এরা এই সভ্যতার খোঁজেই সারা গ্যালাক্সি চষে বেড়ায় আর খুঁজে পেলে সেই সভ্যতাকে নিজেদের অধীনে নিয়ে এসে নিজেদের মত পরিবর্তন করে নেয়। অর্থাৎ নিমিনদের বর্তমান সভ্যতার সাথে যোগ হয় আরেকটি মূক সভ্যতা। এভাবে ওরা বেশ কিছু বেশ উন্নত সভ্যতাকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে এসেছে। এবার ওরা খোঁজ পেয়েছে তোমাদের পৃথিবীর সভ্যতার আর সেটা অচিরেই দখল করে নেয়ার পথে তারা। যেহেতু তোমাদের সভ্যতার সমস্ত অর্জন (বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদি) ধরা আছে ভাষায় তাই তারা প্রথমেই আক্রমণ করেছে আমাকে। আমি শেষ হয়ে গেলেই তোমরা পুরোপুরি চলে যাবে ওদের কব্জায়। তোমাদের সভ্যতার সমস্ত অর্জন যা তোমরা বিভিন্ন ভাষায় রেকর্ড করে রেখেছ তা এক মুহূর্তে মুছে যাবে।
নিমিনদের এই দুরভিসন্ধির কথা আমি টের পেয়েছি এ সপ্তাহেই। ওরা তোমাদের অক্সিজেনের ভেতর মিশিয়ে দিয়েছে ভাষা-ধ্বংসকারী এক বায়বীয় বিষ। এই বিষ অন্য আর কোন ক্ষতি করবেনা। যা করবে তা হল এরা নিঃশ্বাসের সাথে তোমাদের মগজে ঢুকে মগজের ভাষা-এলাকাকে আক্রমণ করে তাকে অকেজো করে দিবে। এদেরকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম নীরব ভাবে। আমার সমস্ত ভাষা- সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। অনেকটা সফলও হয়েছিলাম। কিন্তু তোমাকে সেদিন বলেছিলাম না যে তোমরা মানুষেরা ভাষার মধ্যে মিথ্যের বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছ। তোমাদের মধ্যে কেউ আর এখন সত্য বলে না। তোমরা প্রতিটা পেশার মানুষ কারণে-অকারণে অনর্গল মিথ্যা বলে যাও। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মিথ্যাবাদী হল তোমাদের রাজনীতিবিদেরা যাদের হাতে অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের চাবিকাঠি থাকে। এইসব রাজনৈতিক ব্যবহার করে অনেক শুদ্ধ-পবিত্র শব্দ যেমন “উন্নয়ন”, “সমৃদ্ধি” “আশা”, “মানবিকতা” অথচ তারা এগুলো ভেতর থেকে বিশ্বাস করেই না বরং নিজেরা একত্র হলে এগুলো নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসিও করে।
তোমাদের এই মিথ্যার চূড়ান্ত ও নির্মম শিকার হলো ভাষা। ভাষার শিরা-উপশিরায় এখন এই মিথ্যার গরল। ভাষার ভেতরে এই গরলের ক্রমাগত নিঃসরণে ভাষার শরীর-কাঠামো দুর্বল হতে হতে এখন তোমাদের আলুর চিপসের মতই ভঙ্গুর একটা অবস্থায় এসে ঠেকেছে। এই দুর্বল সৈন্য নিয়েও আমি এতদিন যুদ্ধ চালিয়ে গেছি। কিন্তু এখন ওরা ঐ মূকদের বিরুদ্ধে আর পেরে উঠছে না। ভেতর-ফাঁপা দানবগুলোর ধ্বংসাত্মক শক্তি ভয়াবহ। আমার অনেক শব্দ-সৈন্য লড়তে লড়তে লুটিয়ে পড়ছে। ওদের শরীরে আর বিন্দুমাত্র শক্তিও অবশিষ্ট নেই।
আমার বাঙ্কারের বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে মূকেরা আমার বিশেষ প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙে ফেলেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধরে ফেলবে আমাকে। আর সাথে সাথে শেষ হয়ে যাবে তোমাদের সভ্যতা। তোমরা হয়ে পড়বে মূকেদের দাস। আমি চেষ্টা করেছিলাম প্রাণপণ তোমাদের সভ্যতাকে এ যাত্রায় টিকিয়ে দেয়ার। কিন্তু পারলাম না। তোমাদের মিথ্যার বিষ এতই তীব্র যে ওতে ভাষার শরীরের শেষ ধুকপুকটাও স্তব্ধ হয়ে যায়।
এটুকু জানানোর জন্যই এই চিঠি। আমার আর কিছু বলার নাই। তোমাদের মিথ্যাতেই ধ্বংস হলে তোমরা।
বিঃদ্রঃ তোমাকে এই চিঠি যদি কেউ দেয় সে হবে মূকদেরই একজন। কারণ তখন আমি আর থাকব না।
বিদায়
ভাষাপোকা।
আজকের রাতটা পুরোপুরি অন্ধকার। কোথাও আলোর এতটুকু ফুটকিও নেই। বেশ কিছুক্ষণ হল বিদ্যুৎ চলে গেছে। চারিদিকে গ্রামীণ বরর নীরবতা। কোথাও কোনরকম কোন শব্দ নেই-না বৃষ্টির, না ব্যাঙ ডাকার। সৌম্য জানালার শিক-এ মুখ ঠেকিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। মনের ভেতরটা ভীষণ ফাঁকা লাগছে-একটা অদ্ভুত বিষণ্ন অন্ধকার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে যেন বুকের সামনের দিকে আছড়ে পড়ছে। খুব একা আর অসহায় লাগে সৌম্য’র। কোন কিছু বা কারো কথা মনে করতেও যেন ভুলে গেছে ও। আজকের অন্ধকার ঘুচে গিয়ে যে কালকে একটা নতুন দিন এটা ও আর বিশ্বাস করতে পারে না। মনে হয় সবকিছু অর্থহীন। আলো-অন্ধকার, দিন-রাত সবকিছু অর্থহীন লাগে ওর কাছে। মনে হয় কোন কিছুর-ই কোন মানে নেই।
ঠিক এই সময়ে ও খুব পরিচিত একটা শিসের শব্দ শুনতে পায়, আর তারপরেই একটা বিপ শোনা যায়। একটা গলা খাঁকারি শোনা যায়: “ঘুমাওনি এখনো? কালকে তো রিপোর্টের ফিডব্যাক পাবে অফিসে গেলেই। খুব সম্ভবত রিপোর্টটা ছাপা হবে। সম্পাদক পছন্দ করেছে সরেজমিনে করা রিপোর্ট।”
“ভাষাপোকা? তুমি?”
“হ্যাঁ, মরে গেছি। চিঠিতে তাই লিখেছিলাম।”
“তাহলে?”
“ওটা ঠিকই আছে তবে এটা লিখিনি যে শুধু শরীরটা মরেছে আমার…”
“মানে?”
“মানে তোমাদের ভাষাবিদরা যাকে স্বীকার-ই করেনা তার জোরেই বেঁচে আছি এখনো”
“সেটা কী?”
“আত্মা। ভাষার আত্মা। তোমাদের কেউ কেউ যেটাকে বলে সাব্সটেন্স”
“এখন তোমার আত্মা কথা বলছে?”
“হ্যাঁ। তোমরা মানুষেরা তো এখনো বিশ্বাস কর যে ভাষা হল শুধুই ফর্ম বা খোলস। এর ভেতরে আর কিছু নেই। কত বোকা বোকা তোমাদের ভাষাজ্ঞান।
সৌম্য কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না। এক ভীষণ আনন্দের উজ্জ্বল ছুরিতে ওর ভেতরটা এফোঁড় ওফোঁড় হতে থাকে। কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতার পর ও বলে,
“আমি আসলে আমাদের মিথ্যাচারের জন্য খুব-ই লজ্জিত…আমি…”
“হুম্ম্…শুনে খুশী হলাম যে তুমি লজ্জিত। তবে তোমার সত্য রিপোর্টটার জন্য অভিনন্দন। যেভাবে তুমি মেয়েটার জীবনের সত্যটা বের করে এনে ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছো! তবে তোমার জীবনের সত্যটাও অনেক ট্র্যাজিক। তুমি তোমার জীবনে আসা কোন মেয়েকেই ভালোবাসতে পারো নি। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসলে যৌতুকের বলি হওয়া মৃত একটা মেয়েকে। কালঘাম ছুটিয়ে ওকে নিয়ে রিপোর্টটা করলে। তোমরা মানুষেরা সত্যিই অদ্ভুত। জীবিত মানুষকে ভালোবাসতে পারলে না অথচ মৃত একটা মানুষকে কী অবলীলায় ভালোবেসে ফেললে। তোমাদের সীমাবদ্ধতাটাও আমি বুঝি। সব তো তোমাদের হাতে নেই। মাঝে মাঝে তোমরা ক্রীড়নক মাত্র। তবে তোমরা মানুষেরা এখনো পুরোপুরি শয়তান হতে পারনি। এই শয়তান তো এই ভালো। কে যেন বলেছিল আমাকে একবার যে মানুষ হল শুভ আর অশুভ’র চমৎকার ভারসাম্য। আসলেই তাই। যাই হোক তোমার মাধ্যমে আমি ভাষাদের প্রতিনিধি হিসেবে সব মানুষদের একটা অনুরোধ করে যাই: তোমরা মিথ্যার পথ থেকে যতটুকু পারো সরে আসো। সবটুকু তোমাদের হাতে নেই জানি। যতটুকু আছে ততটুকুতে নিজের কাছে সৎ থাকতে চেষ্টা করো। তোমরা যত সত্য ভাষণ করবে তত শক্তিশালী হবে ভাষা। ভবিষ্যতে ভাষার উপর এরকম আক্রমণ হলে শক্ত হাতে ঠেকাতে পারব তাহলে। তুমি তো সাংবাদিক। এটা নিয়ে একটা রিপোর্ট লেখ। চাই কি আমাকে নিয়ে একটা ফিকশনও লিখে ফেলতে পার। মেসেজটা গেলেই হল। তবে সত্যভাষণটা দীপাকে দিয়েই শুরু কর। ভালবাসলে বলে দাও আর না বাসলে তাও বলে দাও। ওর দিক থেকেও শুনে নাও ও কি চায়। ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলো। আর কোনদিন তোমার সাথে হয়ত কথা হবে না। সেটার আর প্রয়োজনও নেই। তবে আমার অনুরোধটা রাখার চেষ্টা কোরো!” সৌম্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সৌম্য’র মগজের ভেতরে হঠাৎ-ই শিস-ওঙ্কারের মিশ্রণটা থেমে গেল।
বাইরে আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। জীবনের জেগে ওঠার নানা শব্দ পাওয়া যায়। আজ বৃষ্টি নেই। নেই ব্যাঙের ডাকও। একটা চাপা ফর্শা আলোয় সবকিছু কেমন নতুন দেখাচ্ছে।
কয়েকজন মর্নিং ওয়াকার উচ্চস্বরে কথা বলছে, ওদের পাড়ার নতুন নেড়ি কুকুরটা ঘেউ শব্দ করে দুই পাশে মাথা ঝাঁকিয়ে দুই কানে পটপট শব্দ তোলে। আর এ সময়ই সৌম্য’র ফোনটা মিষ্টি সুরে বেজে ওঠে। ফোনটা দীপার। সৌম্য ফোনটা ধরে, “হ্যালো।”
মন্তব্য
পড়ে ভালো লেগেছে, প্রথম পর্বটা একটু ধীরগতির মনে হলেও, শেষের দুটো সাবলীলভাবে এগিয়েছে।
শুভেচ্ছা
পাঠ ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ,মেঘলা মানুষ। পাশে থাকুন। শুভকামনা।
সাধারণত কবিতা, গল্প প্রভৃতি বিষয়কে মানবায়িত একটা চরিত্র করে আখ্যান গুলো তেমন টানেনা। আপনার রচনা এর ব্যতিক্রম। আপনার কাহিনিটা ভালো লেগেছে। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে রাজিব মাহমুদের আরো কিছু বলার ছিলো। লেখা চলুক।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ,সোহেল ভাই। আপনি বেশ নিয়মিত আমার লেখা পড়েন ও মন্তব্য করেন। প্রশংসা ও গঠনমূলক সমালোচনা দু'টোই করেন। কৃতজ্ঞতা ও শুভকামনা জানবেন।
নতুন মন্তব্য করুন