সাধারণত কাউকে আমরা যখন অমুকের আব্বা বা তমুকের মা সম্বোধনে ডাকি, সেটা বড় ছেলের বা বড় মেয়ের নামেই হয়।যেমন আমার বাবাকে অনেক আত্মীয় রাহাতের আব্বা নামে ডাকেন,এটা নিয়ে ছোট বেলায় আমার ছোট ভাইয়ের খানিকটা অনুযোগও ছিল।যাই হোক এখন যার কথা বলব তাকে আমার মা-বাবা বা আত্মীয়রা রিনার মা নামে ডাকতেন,মজার ব্যাপার হল রিনা সেই মহিলার তিন ছেলেমেয়ের সবচেয়ে ছোট। উনি আমাদের বাসায় কাজ করতেন,আমি আর আমার ছোটভাই উনাকে বুয়া নামে ডাকতাম। ছুটা নন,তিনি ছিলেন যাকে বলে 'বান্ধা' বুয়া। আমাদের পরিবারের সাথেও তার জীবন এক অর্থে 'বান্ধা'ই ছিল।
১৯৯২ এর জুলাই মাসে সম্ভবত তিনি আমাদের বাসায় কাজ করতে এসেছিলেন।তখন আমরা ফেনিতে থাকতাম,আমি ক্লাস ফোরে পড়ি আর আমার ছোট ভাই উদোম হয়ে ঘুরে বেড়ায়। বুয়ার সাথে শুরুতেই বেশ খাতির হয়ে গেল কারন আমাদের দুই ভাইয়ের ছোটখাট কুকর্মে তার সর্বাত্মক সহযোগিতা ছিল।আমাদের বাসা ছিল মহিপালে,বাসার ঠিক সামনেই ফেনি-নোয়াখালি হাইওয়ে। বারান্দায় দাঁড়ালেই সারাক্ষন গাড়িঘোড়া চোখে পড়ে। আমি আর আমার ছোটভাই মাঝেমধ্যে বারান্দা থেকে ছোটখাটো জিনিস রাস্তায় ছুড়ে মারতাম। সেটা দেখে বুয়া একটা উদ্ভাবনি আইডিয়া নিয়ে এলেন। তিনি বিস্কিটের খালি প্লাস্টিকের প্যাকেটে পানি ভরে চুলায় আগুনের আচে প্যাকেটের মুখ বন্ধ করে আমাদের হাতে দিতেন।তারপর সেটাকে আমরা যথারীতি রাস্তায় ছুড়ে মারতাম।দুয়েকজন কৌতুহলি পথচারী প্যাকেট কুড়িয়ে নিয়ে খুলে অবাক হয়ে দেখত ভেতরে পানি।মাঝে মাঝে সেই পানি বোমা কারো কারো গায়ে যেয়ে পড়ত।খুবই নিন্দনীয় ব্যাপার,কিন্তু আমরা বারান্দা থেকে সেটা দেখে হেসে হুটোপুটি খেতাম।
তিনি কথার মাঝখানে মাঝে মাঝে ভুলভাল উচ্চারনে ইংরেজি শব্দ বলতেন,আমি আর ছোটভাই সেগুলো লিস্ট করে মুখস্থ রাখতাম। আত্মীয়স্বজনের সামনে গড়্গড় করে সেই লিস্ট উগড়ে দিয়ে আমার ভাই স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান হিসেবে ভালোই হিট হয়েছিল। একটা উদাহরন হচ্ছে এম্বুলেন্স, যেটাকে তিনি বলতেন টেম্পুলাস। যে টেম্পুতে করে লাস(মানে লাশ) নেয়া হয়। যুক্তিটা কিন্তু একেবারে ফেলে দেয়ার মত না!তার মুখে শুনতে শুনতে তার বাড়িঘর,আত্মীয় স্বজনের নামশুদ্ধ আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।তার জন্মের পর তাকে নাকি গরুর দুধ দিয়ে সাত বার গোসল করান হয়েছিল,সম্ভবত এককালে উনাদের আর্থিক অবস্থা ভালই ছিল। বসে খেলে রাজার ধনও ফুরায়,জমি বেচে বেচে উনার বাবারও সেই হালই হয়েছিল। বিয়ের কয়েক বছর পর স্বামীও লাপাত্তা হয়ে যায়,জীবনের তাগিদেই তাকে কাজের সন্ধানে নামতে হয়েছিল। তিনি প্রথম কাজ করতেন চট্টগ্রামের মাদারবাড়ীর কোন এক বাসায়,এরপর সেই যে আমাদের বাসায় এলেন আর কোথাও যান নি।
ফেনি থেকে তিন বছর চট্টগ্রামে থেকে ঢাকায় চলে এসেছি তাও আজ বিশ বছর হয়ে গেল। বুয়া আমাদের সাথে ছিলেন বিশ বছরের বেশি সময়,শেষের দিকে ডায়াবেটিস আর বয়স কাবু করে ফেলায় তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যান। তত দিনে ক্লাস ফোরের সেই আমি এক ছেলের বাবা,উদোম গায়ে ঘুরে বেড়ানো আমার ছোট ভাই চাকরিতে ঢুকে গেছে।
পরশু ভোরে বুয়া মারা গেছেন,তার মেয়ে আমাকে যখন খবরটা জানায় আমি তখন কাজে ব্যাস্ত। কাল পর্যন্ত কাজে আকণ্ঠ ডুবে ছিলাম বলে বেশি ভাবার সময় পাইনি, কিন্তু কাল রাতে কাজ কমে যাওয়ার পর থেকে যখন ভাবার সময় পেয়েছি,তখন দেখি খারাপ লাগতে শুরু করেছে। লাগারই কথা, আমার জীবনের বড় একটা অংশে তিনি ছিলেন। এক হিসেবে তিনি পরিবারের একজনের মতই ছিলেন,কুড়ি বছর আমাদের সাথে একই বাসায় থেকেছেন। বুয়া গ্রামে ফিরে যাবার পর আমার সাথে আর বোধহয় কথা হয়নি।আমার মোবাইলে তার নাম্বার ছিলই,বড় জোর দশ সেকেন্ড লাগত একটা কল করতে,আলসেমি করে করা হয়নি।আর কিছু না হোক, তার মুখে সেই পুরনো 'বড় মামা' সম্বোধন শুনতে তো পারতাম! নাম্বারটা এখনো আছে,কিন্তু কলটা আর জায়গামত পৌছুবে না। দশ সেকেন্ডের আলসেমি যে এক জীবনের আক্ষেপ হয়ে থাকবে,কে জানত? তার মৃত্যুর খবর শুনে ক্ষণিকের জন্য হলেও নিতান্তই অনাত্মীয় এই অধমের দুচোখের কোনা ভিজে উঠেছিল সে খবর কি এখন আর কোনভাবে তার কাছে পৌছুবে?
-গগন শিরীষ
মন্তব্য
কি জানি, এরকম অনেক আক্ষেপই আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়। মানুষ হবার এই সমস্যা!
ভালো থাকুন, শুভেচ্ছা
পড়ার জন্য ধন্যবাদ!
পড়লাম। অনেকদিন পর আপনার লেখা পেয়ে ভালো লাগলো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আপনাকেও ধন্যবাদ সোহেল ভাই!
নির্মম সত্য কথা,ধন্যবাদ চমৎকার মন্তব্যের জন্য। সচল আজকাল।অনেক স্লথ মনে হয়,আপনি এর মাঝে একজন একটিভ মানুষ
আবার আসলাম। অনলাইনে ঘুরতে গিয়ে একটা Quote পড়ে আপনার এই পোস্টটার কথা মনে পড়ল। যদিও Anne Frank এর নামে এটা অনলাইনে শেয়ার হয়, আমি নিশ্চিত না।
ভালো থাকবেন, শুভেচ্ছা।
এখানের কমেন্ট ভুলে উপরে চলে গেছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
কেউ মারা গেলে লোকে কাজ ফেলে দেখতে আসে, বেঁচে থাকতে কেউ খোঁজ নেয় না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
সেটাই দু:খের ব্যাপার ভাই!
নতুন মন্তব্য করুন