অনেকদিন ধরে বিষয়টা নিয়ে একটা লেখা লিখতে চাচ্ছিলাম। লেখাটার মুখ্য উদ্দেশ্য আসলে যারা ‘বাংলা লেখা’ বিশেষত অভ্র অথবা রিদ্মিক নিয়ে লেখালেখি করে বা বিষয়টা জানে তাদের কাছে সরাসরি পৌঁছানো। সেজন্য ফেসবুকে নিজের দেয়ালে না লিখে সচলায়তনের দ্বারস্থ হলাম। সম্প্রতি নতুন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রীর নাম শুনে মনে পড়ে গেলো এই বিষয় নিয়ে লেখাটা আর হয়ে ওঠেনি। তাই ব্লগের উপর নতুন কোন আইন পাশ হবার আগেই আমি আমার প্রশ্নগুলো করে ফেলি আমার লেখার মাধ্যমে, এই প্লাটফর্মে।
সাল ২০১৫ তে আমি অনেকদিনের ব্যবহৃত এন্ড্রয়েড ফোন সিস্টেম থেকে আইওএস সিস্টেম ব্যবহার শুরু করলাম। শুরতেই ধাক্কা খেলাম যে আমি রিদ্মিক খুঁজে পেলাম না এপ-স্টোরে। কাহিনী কি বুঝতে গিয়ে জানলাম বিজয়ের কর্ণধার কেস করেছেন এবং এপ-স্টোর থেকে উনার অভিযোগের ভিত্তিতে রিদ্মিক সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আগে যারা আইওসে রিদ্মিক নামিয়েছিল তারা ব্যবহার করতে পারবে। আর বরাবরের মতন আমার এমনই ফাটা কপাল যে আমি আই-ফোন কিনে চালু করার আগের সপ্তাহ থেকেই রিদ্মিক এপ-স্টোরে নাই। তখন এই বিজয়/অভ্র নিয়ে অনেক লেখালেখি পড়লাম। আগের লেখা খুঁজে খুঁজে বের করলাম। মুজা সাহেবের লেখা ও উনার অনেক বক্তব্য পেলাম। উনার লেখা থেকে বুঝলাম, উনি অভ্রর ব্যাপারে খুবই অনমনীয়। কোনভাবেই চান না যে ছেলেরা অভ্রতে লেখালেখি করুক।
এক সময় হুট করে অতি সরল চিন্তাতে উনাকে মেসেঞ্জারে জানালাম যে, উনার কারনে আমি রিদ্মিক ব্যবহার করতে পারছি না, যার ফলে আমি বাংলা তে লিখতে পারছি না। আপনি কি তাই চান যে বাংলা লেখা কমে যাক! আমার মতন সমস্যা অনেকেরই হচ্ছে এবং সামনে আরও হবে। আপনি কি বোঝেননা যে বাংলা তে এত এত লেখা হচ্ছে, এত অনলাইন সম্পদ যা অভ্র বের হবার পর থেকেই। আমার মনে আছে, ১৯৯৭ সালে আব্বার জন্য কম্পিউটারে বিজয় ব্যবহার করে একটা চিঠি বাংলা তে লিখতে গিয়ে অনেক সময় লেগেছিল। খুব দরকার না হলে বাংলাতে এরপর থেকে লিখি নাই, অভ্র ব্যবহারের আগে পর্যন্ত। যাই হোক, একজন অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও উনি আমাকে ত্বরিত জবাব দিয়েছিলেন যে, রোমান হরফে বাংলা লেখা উনি পছন্দ করেন না। এটি নাকি বাংলা হরফ ও বাংলা ভাষাকে মেরে ফেলবে। দুনিয়ার কোন ভাষা এই পথে যায়নি - প্রয়োজনে রোমান হরফ নিয়েছে, কিন্তু এই পথ ভয়ংকর, উনি ডেনমার্কের উদাহরণ দিয়ে বললেন। আরো বললেন, ইউজিয় বা ইউনিবিজয় উভয়েই বাংলা লেখার পদ্ধতিটা বদলে ফেলে। উনি বলেছিলেন তার বিজয় গবেষনার জন্য উন্মুক্ত কিন্তু ছেলেরা সহজ পথ নিয়েছে, উনি রোমান হরফে বাংলা লেখার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন। আমি রোমান হরফে বাংলা লিখলে কি সমস্যা সেটা বুঝিনি সেভাবে, কিন্তু উনাকে আর ঘাটালাম না তখন। এম্নিতেই জাতীয় পরিচয়পত্র প্রোজেক্ট থেকে বিজয় সরিয়ে অভ্র ব্যবহার হবার পর থেকেই উনার মাথা গরম। আর এই বিষয়ে পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও সময় হয়ে ওঠেনি আর। তখন রিদ্মিকের শামিম কেও জিজ্ঞেস করেছিলাম আপিল করেছে কিনা, আপডেট কি জানতে।
যাই হোক এরপর কিছুদিন কিছু ফ্রী কীবোর্ড ডাউনলোড করে ব্যবহার শুরু করলাম, কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে খুবই কম টাকা দিয়ে একটা কীবোর্ড ডাউনলোড করলাম আই-ফোনে। ব্যবহার করতে গিয়ে বুঝলাম একটা অনেকটা বিজয় কীবোর্ডের মতন। খুঁজে খুঁজে অক্ষর দিতে হয়। ফলে যা হলো, ফোনে আমার বাংলা লেখা কমে গেলো। ফেসবুক, মেসেঞ্জার ইত্যাদি তে ইংরেজি অথবা বাংরেজি তে লেখা বেশি হতে থাকলো, যেহেতু নতুন বাংলা কীবোর্ড লে-আউটে অভ্যস্ত ছিলাম না। কিন্তু ল্যাপটপে আগের মতই পুরোদমে অভ্র চলে থাকলো, এই লেখাও অভ্রতেই লেখা।
এবার একটু অন্যদিক দিয়ে কথা শুরু করি। আমার ছেলের বয়স বর্তমানে সাত বছর। ছোট থেকে ওর সাথে আমারা বাসাতে বাংলাতেই কথা বলি। বাসাতে বাংলা আর স্কুলে ইংরেজিতে কমিনিউকেশনে ওর কখনো কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু বিদেশে ব্যস্ততার মাঝে সন্তানের সাথে বাংলাতে কথা বলা ছাড়া ওর বাংলা লেখা ও পড়া নিয়ে নিয়ে আর আগানো যায় নি। মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রবাসি বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছড়া, কবিতা ও নাটকের অনশগ্রহণ পর্যন্তই ছিল ছেলের বাংলা ভাষা চর্চা। আমার আফসোস থাকতো, আমার ছেলে কি কখনই নন্টে-ফন্টে পড়বে না, ফেলুদা-শঙ্কু পড়তে পারবে না! যাইহোক, সমমনা কয়েকটি পরিবার মিলে গত দুই বছর হলো বিশজন বিভিন্ন বয়সি ছেলেমেয়ে নিয়ে ‘শেকড় বাংলা গ্রুপ’ নামে বাংলা শেখানো শুরু হলো। অন্য শহরের একই রকম সেচ্ছাসেবী বাংলা স্কুলে খোঁজ নিয়ে ওদের পড়ানোর নিয়ম জানলাম। সবার কাছ থেকে সবরকম তথ্য নিয়ে আমরা আমাদের মতন নিয়মে পড়ানো শুরু করলাম, যা অনেকটা ইংরেজি থেকে বাংলা শেখা। অনেকটা ka = ক, kha = খ। kola থেকে ‘কলা’ নিয়মে। একইভাবে হয়তো আপনাদের অনেকেই সন্তানদের প্রবাসে বাংলা ভাষা শেখাচ্ছেন। আমাদের ক্ষেত্রে দেখা গেলো ছেলেমেয়েরা ভালই শিখছে। এক মাসের মধ্যেই নিজের নাম লিখতে পারে, মা-দিবসে মা এর জন্য কার্ড দেখে বাবা-মা খুব খুশি। স্বাভাবিক ভাবে, এই নিয়মে অক্ষর চেনা ও লেখা সহজ, কিন্তু বাংলা শব্দ পড়া কঠিন। তখন বাচ্চাকে বাংলা শব্দকে ইংরেজি অক্ষর করে পড়তে হয়, তারপর তার মানে বুঝে নিতে হয়। আমার ছেলে বাংলা পড়তে একদম আগ্রহ পেতো না। বাংলা স্কুলের একটা প্রোজেক্টে ওকে কম্পিউটারে বাংলা লিখতে হবে, তাই ওকে দেখালাম অভ্র ব্যবহার করে লিখতে। ওর সরল প্রশ্ন ছিল, কীবোর্ডে বাংলা অক্ষর নাই কেন? ওকে বোঝালাম এটা সহজ, দেখালাম বাংরেজি অটোমেটিক বাংলা হয়ে যাচ্ছে। সাত বছরের বাচ্চাকে বেশি জোড়াজুড়ি করতে পারলাম না। ইউনিবিজয় লে-আউট দেখায় তখন ঠান্ডা করলাম, কিন্তু ব্যকরণ সমস্যার কারনে সুবিধা করতে পারলো না। এরপর স্কুলে আমরা ইংরেজি থেকে বাংলা শেখার সাথে সাথে ব্যকরণ মেনে বাংলা শেখান শুরু করলাম। যে কোন ভাষাতেই ব্যকরণ শেখা কঠিন। এ পদ্ধতিতে বাংলা শেখানো ধীর হয়ে গেলো, কিন্তু পরিণত ও আগ্রহী বাচ্চাগুলো ধীরে ধীরে বাংলা পড়া শিখে গেল।
একদিন অফিসে প্রোজেক্টের কাজে বাসাতে যেতে দেরি হচ্ছিল (বুয়েটে পিএলের আগেয় না পড়ার অভ্যাসের কারনে এখনও সব কাজ ডেডলাইনের আগে আগে করে অভ্যাস)। হঠাৎ মেসেঞ্জার এর স্ত্রী এর একাউন্ট থেকে লেখা ভেসে উঠলো, ‘বাবা, কখন আসবা।‘ আমার উত্তরে দেখলাম ও খুব তাড়াতাড়িই জবাব লিখতে পারছে, একটু আকটু ভুলসহ। অফিসের ফোন থেকে বাসাতে ল্যান্ডফোনে ফোন করে ওর মা এর কাছে থেকে জানলাম মা-এর সাহায্য ছাড়াই সে লিখছে। এরপর থেকে ওকে মাঝে মাঝে উতসাহ দেই আমাকে বাংলা তে মেসেজ দেয়ার উপর। লক্ষ্য করলাম এভাবে তার বাংলা অক্ষর চেনার অনুশীলন হচ্ছে ও ব্যাকরণ মেনে া, ি এর সঠিক ব্যবহার করতে পারছে। আমার ফোনে রিদ্মিক থাকলে ও হয়তো সেটাই ব্যবহার করে আমাকে লিখতো, কিন্তু বাংলা অক্ষর চেনার জন্য ও পড়ার জন্য ওকে আলাদা ভাবে আরও চর্চা করতে হতো। এরপর থেকে আমি ঠিক করলাম, ছেলে মোটামুটি ভাবে বাংলা লেখা ও পড়া শিখে গেলে, টাইপ করার বিষয়টা ওর উপরই ছেড়ে দিব, তার আগে পর্যন্ত ওকে রোমান হরফে বাংলা টাইপ করতে উতসাহ দিব না।
রোমান হরফে বাংলা লেখা বিরোধিতার কারন এরপর থেকেই আমার মাথায় একটু করে উপলব্ধি হয়েছে। ব্যবসায়িক কারন বাদ দিয়ে চিন্তা করলে, মুস্তাফা জব্বার কি এটাই বলতে চেয়েছিল! আমি যেই প্রজন্ম, আমরা বাংলা শিখেছি আগে, এরপর রোমান হরেফে বাংলা লিখতে শিখেছি। আমাদের রোমান হরফে বাংলা লেখাটা সহজ হয়েছে। পরবর্তি প্রজন্মও কি এভাবেই বাংলা লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে? নাকি তারা এখন ব্যাকরণ মেনে শিখছে, এরপর রোমান হরফ অথবা বাংলা হরফ যেটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে সেটা ব্যাবহার করে লিখবে। বাংরেজিতে লেখাতে অনেক অদ্ভুত বাংলা শব্দের উদ্ভব হয়েছে, সেটা কি রোমান হরফে বাংলা টাইপ করার ফল? রোমান হরফে বাংলা লেখাতে কি আসলেই দীর্ঘমেয়াদে বাংলা ভাষার ক্ষতি হচ্ছে? নাকি এই বিষয়ে গবেষণা সেভাবে হয়নি বা হচ্ছে না? বিশ্বের অন্যান্য শক্তিশালী ভাষার ক্ষেত্রে কি হয়েছে বা হচ্ছে? বাংলা কীবোর্ড লে-আউট কি গবেষণা করে আরও উন্নত করা হয়েছে? বিজয় নাকি গবেষণার জন্য উন্মুক্ত - কথাটি কতটুকু সত্য? কেউকি এপ্রোচ করে দেখেছে? শুনেছিলাম প্রিন্টিং এ নাকি বাংলা হরফে বাংলা লেখা দিতে হয়, অভ্রর লেখা বিজয়ে রূপান্তর করে নিতে হয়। এটা কেন করতে হয়? এর প্রযুক্তিক কারন কি?
পরিশেষে বলি, আমার লেখাটি সম্পূর্নভাবে ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। ইচ্ছা ছিল আরও পড়াশোনা করে জ্ঞ্যান-অর্জন করে লিখতে, সময়ের অভাবে সম্ভব হয়নি। ভুল-ত্রুটি হলে জ্ঞ্যানের অভাব বুঝে তা সংশোধন করে দিবেন। লেখাতে আমি আমার ছেলেকে বাংলা শেখার বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা বলেছি। প্রবাসে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে (স্কুলে স্প্যানিশ শিখানো শুরু হয়েছে, আবার চাপ বাড়ছে সামনে আরবী ধরতে হবে) বাংলা শেখানো কষ্টসাধ্য – বিস্তারিত অন্য কোন লেখাতে হবে, কিন্তু এ সম্পর্কিত আপনাদের যে কোন অভিজ্ঞতা, উপদেশ স্বাগত।
- খালেদ তমাল
মন্তব্য
এটা বলা যেত যদি বিজয়যুগে এরকম অদ্ভুত বাংলার উদ্ভব না হতো। কিন্তু সেই সময়ে কি সেটা হয়নি? তাছাড়া জনসংখ্যার খুব অল্প একটা অংশ বাংলা টাইপ করতে জানে। যে বিশাল অংশটা বাংলা টাইপ করতেই জানে না তারা কি এই অদ্ভুত শব্দ ইত্যাদি থেকে মুক্ত? উত্তরটা খুব সম্ভবত - না। অতএব কীবোর্ড লেআউট ভাষাকে নষ্ট করে দিচ্ছে ব্যাপারটা এরকম না মনে করি।
নীড়পাতা.কম ব্লগকুঠি
আমি তো তাহলে ডিফল্ট বাংলা কীবোর্ড দিয়েই লিখি, টাকা দিয়ে কি ডাউনলোড করেছিলাম কে জানে!
গতকাল একটা লিখা দিলাম সচলে অনেকটা প্রবাসে বড় হওয়াদের বাংলা শিখা বিষয়ে, আসবে কিনা জানি না। আমিও বলতে চাই অভ্রতে বাংলা লিখা সহজ হয়। আর বাচ্চাকে শিখানোর ক্ষেত্রে বলতে হয়, আগে ধ্বনিটা বের হোক, ধীরে ধীরে শব্দ হোক, ভাষা হোক( সেটা যদি বাংরেজী দিয়েও আসে আসুক)। তারপর না ব্যাকরন।
এ্যানি মাসুদ
ামি বলতে চাইছি
এ নিয়মে প্রথমে শিখে পরে অক্ষরগলো সামনে দিলে বাচ্চারা আগ্রহ হারাবে না মনে হয়। মনে করছি যেহেতু kha তাদের কাছে পরিচিত তাই আওয়াজটা তাড়াতাড়ি বের হয়। খ" তো একদম নতুন তাদের কাছে । তাই প্রথমে উৎসাহ পাবার জন্য kha = খ নিয়মে কাছে টানলাম পরে খ = kha স্টাইলে সামনে দিলাম। জানি না ব্যাপারটা কেমন হবে আমারটা এখনো ছোট্ট বুজতে পারছি না।
এ্যানি মাসুদ
বুঝলাম না! লিখেছিলাম তো ঠিকই, মূল লেখাতেও ঠিক দেখাচ্ছে। এখন কিছু কিছু যুক্তাক্ষর ভচকাইয়া গেলো কেমনে?
- খালেদ তমাল
গত বছর আমার ছেলে বাঁ হাতের অনামিকা ভেঙে ছয় সপ্তার জন্য মোটামুটি ঘরে বসে গেলো। নয় বছরের একটা ছেলে দেড় মাস ফুটবল ক্রিকেট ব্যাডমিন্টন কিছুই খেলবেনা, তার প্রিয় বাদ্যযন্ত্রটা বাজাবে না, মহার্ঘ্য সামারে একটা হাইকিং এ যাবে না এটা মেনে নেয়া বড়ই কষ্টের। কিন্তু কিছু করার নেই, ডাক্তারের কড়া নির্দেশ কোন ঝুঁকি নেয়া যাবে না। সামারে আমার ক্লাস না থাকায় ছেলেকে সময় দেয়ার দায়িত্ব পড়লো আমার ঘাড়েই। ঠিক করলাম এই সুযোগে ওকে বাংলা শিখিয়ে ফেলি। বাংলাদেশে জন্ম কিংবা বাংলাদেশে থাকার সুযোগ না হলেও আমার ছেলে ছোটো বেলা থেকেই খুব পরিষ্কার করে বাংলায় কথা বলে। কিন্তু আমার আলস্যের কারণেই লিখতে কিংবা পড়তে শেখেনি। খুব বেশি না ভেবে একেবারে আদর্শলিপি স্টাইলে শুরু করলাম। হাতের কাছে কোন বই নেই, তাই নিজের মতো করে করছি সব।
প্রথম সপ্তাহে স্বরবর্ণ আর ব্যাঞ্জন বর্ণ শেষ করলাম আমরা। প্রতিদিন আধঘণ্টা, দুজনে পাশাপাশি বসে পড়ি আর লিখি, লিখি আর পড়ি। একেবারে সেই ক বর্গ, চ বর্গ, ট বর্গ মানে যেমনটা আমার মা আমাকে শিখিয়েছিলেন সেই ভাবে। অস্টমদিনে আমরা শিখলাম আকার, একার, ইকার.........য-ফলা, ঋকার... ইত্যাদি যা যা আছে। পরের সপ্তায় আমরা মাতলাম যুক্তাক্ষর নিয়ে।এর মাঝে ফাঁকে ফোঁকরে, 'বাবা তুমি পচা' কিংবা 'মা অনেক বেশি আদর করে' ধরনের বাক্য তৈরি করে লেখা চলছে। কেমন করে করে যেন ছয় সপ্তা কেটে গেলো! ডাক্তার যখন শেষ এক্স রে দেখে বললেন অমিয় তার বেহালা বাজানো শুরু করতে পারে, তখন সে রীতিমতো বাংলা লিখছে, পড়ছে, সবচে বড় কথা, যা পড়ছে তা বুঝতে পারছে।। এই ছয় সপ্তাহে আমি খুব অবাক হয়ে উপলব্ধি করলাম, বাংলা শেখানো অতোটা কঠিন নয়। আমার ছেলে একদম ঠিক বয়সেই লিখতে পড়তে শিখেছে। নয় বছর বয়সে যুক্তি দিয়ে বোঝার, প্যাটার্ন নিয়ে খেলবার আনন্দটা চলে আসে বোধ হয়। আর একটু বড়াই করেই বলি, বাংলা ভাষাটা দারুণ স্ট্রাকচার্ড। সময়ে সেটা বুঝিনি বলে স্ট্রাকচার্ড শব্দটার পরিভাষা আমার জানা নেই।
তিনটি জিনিস আমাদেরকে দারুণ ভাবে সাহায্য করেছিলো। এক, সামারে আমি ফ্রি ছিলাম। দুই, আঙুল ভেঙে ছেলের তেমন কিছু করার সুযোগ না ছিলোনা। তিন, প্রথম থেকেই ছেলের বাংলায় স্পষ্ট করে কথা বলার অভ্যাস। খাবার কে আমার ছেলে খাবার হিসেবেই পড়েছে, লিখেছে। KHABAR হিসেবে নয়। এটা নিতান্তই একটা ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা, জেনারেলাইজড করার চেষ্টা করবো না। তবে অভিজ্ঞতাটা আমি দারুণ দারুণ উপভোগ করেছি।
---মোখলেস হোসেন।
সন্তানকে বাংলা শেখাবার জন্য আপনারা যে পরিশ্রম করছেন তার জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ। আপনাদের সন্তানও যে ধৈর্য্যধরে মাতৃভাষা শিখছে তার জন্য তাকে অভিনন্দন। স্নেহাশীষ থাকলো, একদিন নিশ্চয়ই সে বাংলা ভাষা শুদ্ধরূপে ‘শুনিয়া বুঝিতে, বলিতে, পড়িতে ও লিখিতে’ পারবে।
লেখা বাটালি দিয়ে খুঁটে পাথরে, কীলক দিয়ে মাটিতে, তুলি দিয়ে চামড়ায়, খাগের কলম দিয়ে তুলট কাগজে, বলপেন দিয়ে নিউজপ্রিন্টে, ফাউন্টেনপেন দিয়ে সাদা কাগজে, ‘বিজয়’ দিয়ে ডেস্কটপে নাকি ‘অভ্র’ দিয়ে ল্যাপটপে লেখা হলো সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে কী লেখা হলো, এবং যা লেখা হলো তা শুদ্ধভাবে লেখা হলো কিনা।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
আইফোনে বা আইওএস অপারেটিং সিস্টেমে ফোনেটিক পদ্ধতিতে বাংলা লেখার জন্য সম্প্রতি "অমর একুশে (Omor Ekushey)" নামক একটি অ্যাপ যুক্ত হয়েছে। এটি তৈরী করেছেনঃ শামসুদ্দোহা রতন। ডিফল্ট কি-বোর্ডে অক্ষর খুঁজে খুঁজে টাইপ করার চাইতে এই কি-বোর্ডে টাইপ করা অনেক আরামের। আমি বিগত এক বছর যাবত বেশ স্বাচ্ছন্দের সাথেই টাইপ করছি। সবকিছুই রিদমিকের মতো, শুধু চন্দ্রবিন্দু ও খন্ড-ত (ৎ) টাইপ করতে গেলে একটু ঝামেলা হয়। তখন ডিফল্ট কি-বোর্ডে গিয়ে এই ঝামেলা মিটাতে হয়।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এই এপটির খোজ দেবার জন্য। আক্ষরিক অর্থেই আইফোন নেবার পর মোবাইল দিয়ে বাংলা লেখা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আইফোনের ডিফল্ট কিবোর্ড দিয়ে বাংলা লেখা গেলেও দ্রুত যেতনা বলে ক্রমেই বাংলা লেখা কমে যাচ্ছিল। এখন থেকে সবখানে আবার পুরোদমে বাংলা লেখবো!!
-আতোকেন।
আপনার বাংলা শেখাবার আগ্রহ এবং আপনার সন্তানের ঊৎসাহ -দু'টোই অভিনন্দনযোগ্য।
আরেকটা জিনিস, ট্যাবলেট বা বড় স্ক্রিনের ফোনের জন্য গুগলের Hand Writing Input বেশ ভালো স্টাইলাস ব্যাবহার করলে। আমার কাকের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং মার্কা লেখাও বুঝতে পারে বেশ।
আপনি আপনার ছেলেকে বাংলা হরফে লেখা শেখানোর জন্য যে উদ্যোগ গ্রহন করেছিলেন তা প্রশংসার যোগ্য, তবে যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, আমার কাছে মনে হয়েছে তা বরং সহজ বিষয়কে আরও জটিল তুলেছে। উপরে মোখলেস ভাই এবং পাণ্ডবদা'র প্রদত্ত বক্তব্যের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, বাংলা অক্ষরকে সরাসরি চিনে নেয়া এবং তার ব্যকরণগত ব্যবহার শেখাটাই উত্তম। তারপর সেটা কী দিয়ে কী ভাবে লিখলেন, সেটা খুব একটা বড় ব্যাপার নয়। আর খুব একটা দেরী নেই, যখন মানুষকে কষ্ট(?) করে হয়ত লিখতেই হবে না, তার সেই কাজটি করে দিবে ডিভাইস এবং এ্যাপস। মানুষের মস্তিষ্ক যা লিখতে চাইবে, ডিভাইসের স্ক্রিনে তাই লেখা হয়ে ফুটে উঠবে। সুতরাং বলা যায় কালের প্রবাহে লেখার টুলস গৌণ হয়ে পড়বে অচিরেই, তবে বর্ণমালা এবং ভাষা নিশ্চয়ই টিকে থাকবে আরও অনেকদিন। সুতরাং সেই ভাষা এবং তার বর্ণমালাটা শেখাটাই জরুরী।
মোস্তফা জব্বারকে পেশাগত কারনে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁর বিরুদ্ধে প্রচলিত নেতিবাচক কিছু ধারনাকে মাথায় রেখেই বলছি- বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত নানা কারনে তাঁর কাছে অশেষ ঋণী বলেই আমার অভিমত। কিন্তু বিজয়, অভ্র, রিদমিক তথা বাংলা ফন্টগুলো নিয়ে তাঁর ধারনার সাথে একমত হতে পারি নি তেমন। প্রথমত অভ্র কিংবা রিদমিক যে অর্থে রোমান হরফ নির্ভর, বিজয়ও সেই একই কারনে রোমান হরফ নির্ভর। বিজয় যে কি-বোর্ড লে-আউট ব্যবহার করে, তা আসলে মোটেই বাংলা কি-বোর্ড নয়। সেটাও মূলত "QWERTY" নামক রোমান হরফ সম্বলিত কি-বোর্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন বাংলাদেশে কম্পিউটারের কি-বোর্ডগুলো দ্বি-ভাষিক, সেখানে ইংলিশ অক্ষরের পাশে বাংলা হরফ বসিয়ে দেয়া হয়েছে, যে লে-আউট টি মোস্তফা জব্বার সাহেব পেটেন্ট করে নিয়েছেন। মনে আছে, প্রথম যখন তিনি তাঁর আনন্দ কম্পিউটারে বাংলা ওয়ার্ড প্রসেসর শেখার ট্রেনিং দিতেন, তখন শিক্ষার্থীরা কি-বোর্ডের ইংলিশ লে-আউটের কোন অক্ষরের পাশে বাংলা কোন অক্ষরটি বসবে, তাই মুখস্থ করতো। তিনি যেটা করেছিলেন তা হল সারা বিশ্বে বহুল প্রচলিত "QWERTY" কি-বোর্ডেই একটি নতুন বাংলা অক্ষর বিন্যাস করেছিলেন। যে রকমটা তিনি ছাড়াও অন্যান্য কেউ কেউ করেছিলেন। বিভিন্ন কারনে অন্যান্য বাংলা ইন্টারফেস বিজয়ের সাথে প্রতিযগীতায় টিকতে পারে নি, তার প্রধান কারন এর স্বল্প মূল্য, অন্যান্য কারনও ছিল। অভ্রের সাথে তাঁর বিরোধের কারন হল অভ্র প্রথমে মূলত তাঁর(বিজয়) ফন্টটি ব্যবহার করেছিল। রিদমিকের বিরুদ্ধে তাঁর আনীত অভিযোগের সারবত্তা ছিল না, ফলে তা ধোপে টেকে নি।
মানুষ যেটাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করবে সেটাতেই লিখবে। মোস্তফা জব্বরের সাধ্য কি তাকে রুখে দেওয়ার। আমার কম্পিউটারে বাংলা লেখার হাতেখড়ি বিজয় দিয়ে। মনে পড়ে কি আপ্রাণ চেষ্টাই না করেছিলাম একটু দ্রুত বাংলা লেখার অভ্যাস করতে। কিন্তু কিছুতেই কী-বোর্ডের দিকে না তাকিয়ে লেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারছিলাম না। এমন সময় খোজ পাই অভ্র'র । অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম মাত্র কয়েক দিনেই কাঙ্খিত মাত্রার চেয়েও দ্রুত গতিতে বাংলা লেখা শিখে গেলাম। তারপর থেকে অনেক মানুষকেই কম্পিউটারে বাংলা লেখা শিখিয়েছি (আমি একটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কম্পিউটার শিক্ষক) এবং সব ক্ষেত্রেই বেছে নিয়েছি অভ্র।
সৌমিত্র বিশ্বাস
নতুন মন্তব্য করুন