জুলমত আলির মন ভালো নেই। মনের আর কী দোষ! আয়না বানুর পাল্লায় একবার যে পড়েছে তার কি কোন উপায় আছে!
পেয়ারা গাছের শক্তপোক্ত একটি ডালে পা ঝুলিয়ে বসে হাতের দড়িটার দিকে তাকালো জুলমত আলি। কী সুন্দর দেখতে! ভারি নরম, যেন কাঠবিড়ালির ফোলা ফোলা লেজ। চারিদিকে আজকাল নাইলনের ছড়াছড়ি, সে দড়িতে গিঁট দিতে গেলে হয় পিছলে যায়, নয়তো খুলে আসে হালকা টানেই। আর নাইলন জিনিসটা খুব বাড়াবাড়ি রকমের রুক্ষও, টান লাগলে চামড়ায় দাগ রেখে যায়।
একই সমস্যা নারকেলের ছোবড়া দিয়ে বানানো দড়িতে। অনেক খুঁজে পেতে শেষটায় রায়েরবাজারের গুড়পট্টির পেছনে যে ঘুপচি ঘুপচি দোকান গুলো রয়েছে তারই একটা থেকে মেলা টাকা খরচ করে কিনে এনেছে এই দড়িটা। পাটের দড়ি, পনেরো ষোল হাত হলেই চলতো, কিন্তু দোকানদার গোছা থেকে কেটে দিতে রাজি হয়নি। কত কষ্টের টাকা, আহারে!
এখন প্রয়োজন মনের মতো একটি ডাল। নিচের দিকের ডালগুলো ভীষণ পলকা, অতো ওজন নিতে পারবে না। ওপরের গুলো আবার খুব বেশি ঘন, ঠেসাঠেসি করে বেড়ে উঠেছে। একেকটা গিয়েছে একেক দিকে। এমন একটা ডাল দরকার যার নিচে এবং আশেপাশে আর কিছু নেই, নইলে মুশকিল ভারি।
হাতের ডান দিকের একটি ডাল বেশ মনে ধরেছে তার। কিন্তু সেখানে পৌঁছুনো খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। গাছের ওই পাশটা প্রায় ন্যাড়া। কষ্টে সৃষ্টে উঠে পড়তে পারলেও নাগালে এমন কিছু নেই যা ধরে শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। শেষটায় পড়ে গিয়ে হাড়গোড় না ভাঙ্গে।
একবার হাতের দড়ির দিকে, আরেকবার ওই ডালটার দিকে তাকিয়ে খানিকটা দমে যায় সে। কী কুক্ষণেই না এই কাজটা করার কথা ভেবেছিলো! কিন্তু যা হবার তা হয়ে গিয়েছে, আর ফিরে যাবার উপায় নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দড়ির গোছাটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাচড়েপাঁচড়ে ডালটার দিকে এগোয় জুলমত আলি।
এদিক থেকে আয়না বানুদের বাড়িটা পরিষ্কার দেখা যায়। ওদের বাইডাগ ঘর, পুকুর ঘাট, রান্না ঘর, রান্না ঘরের পেছনে গোলাপি গোলাপি ফুল ফুটে থাকা জামির গাছের দিকে তাকিয়ে তার রাগ হয় খুব। কিন্তু এখন রাগ করেই বা কী লাভ! আয়না বানুর পাল্লায় পড়লে জীবন যে ফানা ফানা হয়ে যেতে পারে এ কথা তার আগে বোঝা উচিৎ ছিল।
আয়না বানুদের বাড়ির উঠানে কেউ নেই। মনে হয় খেয়ে দেয়ে আরাম করে ঘুমাচ্ছে সবাই। হায়রে জীবন!
দড়ির একটা প্রান্ত ডালের সাথে বেশ কয়েকবার পেঁচিয়ে নিয়ে কষে বাঁধে জুলমত আলি। গিঁটের মতো গিঁট হয়েছে একটা, ফস্কা গিঁট নয়, একেবারে হালের বলদ বাঁধার মতো রাম গিঁটি। এইবার আরকটা গিঁট, তারপরেই……। ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায় সে।
হঠাৎ চুড়ির ঝনঝন শব্দে চটকা ভেঙে নিচে তাকাতেই চোখে পড়ে আয়না বানুকে। কখন যে সে এখানে এসছে টের পায়নি জুলমত আলি। আয়না বানু এক গাল হেসে বলে,
- তুমার খালি বড় বড় কতা গো জুলমত বাই। খুব না কইছিলা আমি আইতে আইতেই সব শ্যাষ অইয়া যাইবো! হপায় নি দড়ি বান্দো! তুমার মুহর কতার কুনু দাম নাই গো।
জুলমত আলির গায়ের রক্ত যেন টগবগ করে উঠে। খেঁকিয়ে জবাব দেয়,
- রান্দা হরিস না আয়না। মন মিজাজ বালা নাই।
গজগজ করতে করতে দড়ির গোছা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে সে।
জুলমত আলির বয়স বারো, আয়না বানুর দশ। চৈত্রের এই গনগনে দুপুরে পেয়ারা গাছের ডালে বসে আয়না বানুর জন্য দোলনা বাঁধছে সে। খরখরে গাছটায় উঠতে গিয়ে পেটের কাছে নুনছাল উঠে গিয়েছে তার।
মন্তব্য
ভাই আমি তো অন্যকিছু মনে করছিলাম। যদিও শুরুতে প্রশ্ন জাগসে পেয়ারা গাছ ক্যান? একন দেখি অন্য কথা !
-বৃদ্ধ কিশোর
ধন্যবাদ বৃদ্ধ কিশোর। আর কোন গাছের কথা কেন যেন মাথায় আসেনি।
---মোখলেস হোসেন
হা হা হা কত কিছুই না ভাবলাম। এখন দেখি এই খবর!!
সোহেল লেহস
-------------------------------------------------------
এইটা কি লেখলেন ভাই! গল্পের ট্যুইস্ট দেইখা পেটে কেমন জানি একটু মোচড় দিল
ধন্যবাদ সোহেল লেহস।
---মোখলেস হোসেন।
এতো সোহেল লেহোস ভাইয়ের অনুগল্পের টুইস্ট !!! মজা পেলাম।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
দড়ি জমা দিয়েছিলাম মাস দেড়েক আগে। শেষ পর্যন্ত গিঁট খুলেছে। গল্পটি লেখার পেছনে একটা কারণ রয়েছে। কেউ কেউ আমার লেখা পড়তে এসে ঢোক গিলে বলেন, 'এতো দীর্ঘ লেখা' আবার কেউ কেউ আশ্বাস দেন, 'সময় পাইলে পড়ুম'। এই লেখাটা নিয়ে আর যাই হোক এমন কথা বলা যাবে না, কী বলেন সোহেল ইমাম?
---মোখলেস হোসেন।
নাহ, সচলে আর গল্প পড়া যাবে না। গল্প পড়তে গেলে বুকটা ধুকপুক করতে থাকে যে না জানি গল্পের শেষে কি প্যাচ দিয়ে রাখসে লেখক। আপনিও সেই দলে পড়লেন ভাই! দারুন হইসে। চালিয়ে যান।
(চুপি চুপি একটা কথা বলে যাই। আমি কিন্তু এই লেখাটা প্রকাশিত হওয়ার আগেই পড়ে ফেলেছিলাম। )
অন্তরা রহমান
ধন্যবাদ অন্তরা রহমান। আমিও দুটো নতুন লেখা পড়লাম একটা জায়গায়। একটি বাংলা, আরেকটি ইংরেজি। বাংলা লেখাটি প্রথম কিস্তির চেয়েও টানটান এবং গতিময়। ইংরেজি লেখাটিও চমৎকার। আশা করি অন্যরাও সুযোগ পাবেন লেখা দুটো পড়ার।
---মোখলেস হোসেন
আমিও নিদারুন অপেক্ষায় আছি। এই প্রথম পাতায় দুই লেখা দেয়া যাবে না সেই ঝামেলায় আটকে গিয়েছি।
অন্তরা রহমান
টানটান উত্তেজনা নিয়ে পড়তে পড়তে এমন আছাড় দিলেন? আয়নাবানুর জন্য অনেক শুভকামনা।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
পড়ার জন্য ধন্যবাদ নীড় সন্ধানী। আছাড় আর কোথায়! হোঁচট মাত্র।
---মোখলেস হোসেন।
পেয়ারা গাছ যে শক্ত সমর্থ বড় গাছ হতে পারে ভার বহন করার মতো, তা বোধহয় এখন আর কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই গাছের নাম পাল্টে দিলে ভালো হতো।
জমছিলো খুব, শেষটায় খুব তাড়াহুড়া মনে হলো।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
আমার স্মৃতিতে পেয়ারা গাছ অমনই। গাছের নামটা হয়তো পাল্টে দেওয়া যেতো। কিন্তু সম্পাদনার সুযোগ আমার নেই। তাড়াহুড়া ঠিক নয়, আমার ওই অতটুকুই বলতে ইচ্ছে করেছিলো। তাড়াহুড়া হয়ে যায় যখন বড়সড় কোন লেখা লিখি। এই ধরেন 'কাৎলাসেন' গল্পটি।
---- মোখলেস হোসেন।
রসঘন টুইস্ট ! মজা পেলাম।
ধন্যবাদ করবী মালাকার।
--- মোখলেস হোসেন
জুলমত আলী, আয়না বানু নামের ভারেই তো পেয়ারার ডাল গেছে!
এইটা কি আর শাইখ সিরাজের ছাঁদে টবে লাগানো কাজি পেয়ারা গাছ! এই গাছ বিশাল, তার অনেক অনেক ডাল, ডালে অনেক অনেক পাতা, আর থোকায় থোকায় ফল। সে ফল দারুণ শাঁসালো, ভারি কচকচে, তার বাইরে সবুজ আর ভেতর হলো টুকটুকে লাল। আয়না বানুর জল ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে নিষ্ঠুর কাঠবিড়ালিরা কুটুস কুটুস খায়, আর পুটুস পাটুস চায়।
----মোখলেস হোসেন
কি সুন্দর একটা অনুগল্প!
- অপ্রকৃতিস্থ
অনেক ধন্যবাদ।
--মোখলেস হোসেন
নতুন মন্তব্য করুন