অন্ধকার। ঘন কালো অন্ধকার। সূক্ষ্ম একটা দাগের মতন আলোটা এলো। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে, চারপাশে। কিন্তু সব ঝাপসা, সব ঘোলাটে।
আলোটাই কি ফ্যাকাসে? নাহ, ফ্লুরোসেন্ট বাতির সাদাটে আলো, সাদা সিলিং। বাম দিক থেকে হালকা ঠাণ্ডা বাতাস। কিছু কিছু বুঝতে পারছি। কিন্তু তার মধ্যে দেখার অংশটা কম, অধিকাংশই ধারনা করে নেয়া।
চোখ খোলার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালালাম। এই ফ্যাকাসে-ঘোলা পৃথিবীর মাঝে একটু ঝকঝকা রঙের ছোঁয়া যদি পাওয়া যায়। আমার সমস্ত মনোযোগ এনে আমার চোখের তারায় বসালাম। কিছুটা দেখতে পাচ্ছি। অসংখ্য টিউব, পাইপ আমার দৃষ্টির সীমানায়।
ডানে, বামে, উপরে - চারদিকেই। ডান হাতের সাথে ষ্টীলের শীতল স্পর্শ। একটা টিউব আমার মুখের ভেতরে প্রবেশ করেছে, একটা নাকে। পাশেই কোন মেশিন থেকে একঘেয়ে বিপ বিপ শব্দ সবাইকে জানিয়ে চলছে, আমাকেও - আমি বেঁচে আছি!
ডানে বা বামে তাকানোর চেষ্টা করেও পারলাম না। হাল ছেড়ে দিলাম। ভীষণ পরিশ্রান্ত লাগছে। কোথাও কোন ব্যথার অনুভূতি নেই। অদ্ভুত একটা ভোঁতা ভাব। কেমন অসার একটা বোধ শরীর জুড়ে। এমন এক অনুভূতি যার সাথে এই প্রথম আমার পরিচয় হল।
হাসপাতালে আছি সেটুকু বুঝতে পারছি। এসির ঠাণ্ডাটা একটু বেশিই বাড়ানো। কিংবা আমারই খুব ঠাণ্ডা লাগছে হয়তো। বুক পর্যন্ত চাদর টেনে দেয়া আছে তাও শীত করছে। একটু কেঁপে উঠলাম বুঝি। আলোটা যেন নিভে আসছে। ধীরে, ধীরে। আমি জেগে থাকতে চাই তবুও চোখ বন্ধ হয়ে আসলো... অন্ধকার।
...
আবার আলো।
এবার আরেকটু স্পষ্ট।
নাহ, শুধু আলো নয়। ছায়াও আছে। পাশেই কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে। দেখতে পারছি না। ঘাড় ঘুরানো যাচ্ছে না। হয়তো সেটা কোনভাবে আটকে রাখা হয়েছে, আমার ভালোর জন্যই নিশ্চয়। চেষ্টা করলাম না আর। হালকা ঘষটানো, খস খস আওয়াজ আসছে। পায়ের শব্দ সারা রুম জুড়েই ঘুরে বেড়াচ্ছে। খস খস, খস খস। কানে লাগছে। রুম পরিষ্কার করছে কেউ।
মুখের টিউবটা না থাকলে ডাক দিতাম। নাকি, ডাক দেওয়ার একটা চেষ্টা করে দেখবো এর মাঝেও।
এটুকুই ভাবতে পারলাম। দুই চোখ লেগে এলো আবার। এভাবে বার বার অন্ধকারে ডুবে যেতে ভালো লাগছে না। ভালো লাগছে না একদম।
...
চোখ মেলে তাকালাম। অন্ধকার মিশে আছে আলোর সাথে। রুমের ভেতরের বাতিটা নেভানো। এক ফালি আলো দরজার কাঁচের ফাঁক দিয়ে এসে পরেছে সিলিং এ। করিডরে বাতি জ্বলছে। কেউ একজন ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেলো রুমের সামনে দিয়েই। গলাটা শুকনো লাগছে ভীষণ। একটু পানি যদি খেতে পারতাম।
নার্সকে ডাক দিলেই তো চলে। কিংবা রুমে কেউ কি আছে। বুঝতে পারছি না। আচ্ছা আমি নিশ্চয়ই কেবিনে নেই। সবচেয়ে সাধারণ ধারনায় বলা যায় আমি আইসিইউ তে। তার মানে এখানে এই রুমেই একজন নার্স আছে। কিন্তু আমি ডাক দিতে পারবো না। মুখের ওরোগ্যাস্ট্রিক টিউবটা না সরালে সেটা সম্ভব নয়। হাতের ইশারা, কোন কল বাটন আছে কি? কোন ইঙ্গিত দেয়া যাবে কি? হাত-পা গুলো হালকা লাগছে খুব। মনে হচ্ছে আমার শরীরে সাথে সংযুক্ত নেই। আচ্ছা, বাম হাত তুললেই নিশ্চয়ই দেখবে নার্স। আশ্চর্য, হাতটা নড়ছেই না। কপালে হালকা ঘাম জমে গেলো। কিন্তু, হাত নাড়াতে পারছি না। কিছুতেই না। ডান হাত - না, ডান পা, বাঁ পা - না। বুকের ভেতরটা ধক ধক করছে। একটা আঙ্গুলও যদি নড়ে উঠত।
প্যারালাইজড? আমি কি প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছি?
না, কিছুতেই না। একটা আঙ্গুল। একটু হলেও নড়ে উঠুক। ওহ আল্লাহ, প্লিজ প্লিজ প্লিজ...
হঠাৎ করেই আমার মনে হল আমি আর হাসপাতালে নেই। আমি আমার বাসায়। ঐ যে সামনে আমার অফিসের দরজা। আমি জানি, দরজাটা খোলা যাবে না। দরজাটা খুললেই একটা দুপ করে শব্দ, আর প্রচণ্ড ধাক্কা। না না না। আমি চাইছি না। তাও হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছি দরজার দিকে। আমি শুধু জানি খুলতেই হবে দরজাটা। লকে হাত দিলাম। এই যে চাবি। আমিই লাগিয়ে রেখেছি। থার্টি-ফাস্টের দিন। একটা মোচর দিলেই এখন খুলে যাবে। আমি খুলবো না, কিছুতেই খুলবো না। তারপর আস্তে করে মোচর দিলাম।
প্রচণ্ড একটা চিৎকার গলা চিড়ে বের হয়ে আসতে চাইলো কিন্তু শব্দহীন হয়ে হাড়িয়ে গেলো আমার ভেতরেই। এক অনিঃশেষ অন্ধকারে আবার ডুবে গেলাম।
...
“...কতটা ভাগ্যবান আপনি কি বুঝতে পারছেন?”, অচেনা একটা কণ্ঠস্বর। ভরাট, ধীর, স্থির। প্রফেশনাল? ডাক্তার। “এধরনের ফ্যাটাল উন্ডের ক্ষেত্রে আমরা আশা বলতে গেলে ছেড়েই দিই। কোমাতে যদি নাও চলে যান পেশেন্ট, বেঁচে থাকেন একটা কাঠের গুড়ির মতন। আল্লাহ নিজের হাতে উনাকে বাঁচিয়েছেন একথাটা বলতে আমি বাধ্য হচ্ছি।“
“কোন সুনির্দিষ্ট ডায়াগনোসিস?” এই কণ্ঠটা আমার পরিচিত। এই কণ্ঠটা আমাকে ভরসা দেয়, দিনে ও রাতে - সবসময়। ঋদ্ধি।
“দেখুন, উনার যা হয়েছে তা তো এক কথায় ট্রমাটিক ব্রেন ইনজুরি। এর বেশি আমরা কিছু বলছি না এখনই। তবে, উনাকে তুলনামূলক সহজেই স্ট্যাবিলাইজ করা গিয়েছে। সিটি স্ক্যান যা বলছে তা হল উনার রাইট ফ্রন্টাল লোব দিয়ে গুলিটা ঢুকে, ব্রেনের স্ট্যান্ডার্ড এক্সিসের উপর দিয়ে তিরিশ ডিগ্রী কোনে কানের কিছুটা উপর দিয়ে বের হয়ে গিয়েছে। এর ফলে ভেতরে ব্রেনের কোন প্রাইম টিস্যুতে আঘাত লাগে নি।“
“অপারেশন যেটা হল?”
“সেটা মাথার ভেতরে রক্ত যেটা জমাট বেধেছিল তা সরানোর জন্য, কিছু বোন ফ্রাগমেন্ট আমরা পরিষ্কার করেছি। ব্রেনে একটা এক্সটারনাল প্রেশার তৈরি হয়েছিল। সেটা সরানোর জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। উনার ব্লাড প্রেশার নর্মাল আছে এখন। ফিডিং টিউব দিয়েই আপাতত খেতে হবে আর ভেন্টিলেটরটা চলুক। কাল-পরশু ভেবে দেখা যাবে।“
“এমনিতে আপনার কি মনে হচ্ছে ডাক্তার?”
“দেখুন এভাবে তো বলা যায় না। তবে উনার ব্রেন ওয়েভ এক্টিভিটি বেশ ভালো। আমরা আশাবাদী। এখন পর্যন্ত উনার কিছুটা প্যারালাইটিক সিম্পটম দেখা যাচ্ছে। আজ থেকে একজন ট্রেইনড ফিজিশিয়ান সেদিকটা দেখবেন। আমার মনে হয় আপনি এখন একটু স্বস্তির শ্বাস নিতে পারেন।“
ঋ চুপ করে রইলো। আমি জানি ওর ভেতরটা ভেঙ্গেচুরে যাচ্ছে, যেমনটা আমার হচ্ছে। ডাক্তার আরও কিছু কথা বলছেন। গলার আওয়াজটা এত নিচু যে আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। তার মানে যেটুকু বুঝা গেল আপাতত আমিও একটা কাঠের গুঁড়িই। কথা বলতে পারবো না, নড়তে পারবো না। ফিডিং টিউব, ভেন্টিলেটর, ব্যান্ডেজ, কত কি লাগিয়ে একেবারে একটা মমি হয়ে বসে আছি। দরজা লাগানোর শব্দ হল। ডাক্তার বেরিয়ে গেলেন বোধ হয়। হালকা পায়ের শব্দ। সরে আসছে আমার বিছানার দিকে। এই শব্দ ফার্মগেটের হাজারো ভিড়ভাট্টার মাঝেও আমি চিনে নিতে পারব। ঋদ্ধি এসে আমার ডানদিকে দাঁড়ালো। ওর মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে পারছি না।
কিছু একটা যদি বলতে পারতাম, একটা শব্দ। কিংবা যদি একটু নড়ে উঠত আমার হাতের আঙ্গুলগুলো। কিছুই না। শুয়ে রইলাম জীবন্মৃত হয়ে। ঋদ্ধি ওর হাতটা রাখল আমার মাথায়। ভীষণ পরিচিত এই স্পর্শ আমার শরীর জুড়ে অদ্ভুত ভালোলাগা এনে দিলো। মনে হল, এইতো, এই বুঝি ভালো হয়ে যাবো।
“অতু, তুই বুঝতে পারছিস আমি এখানে আছি। তোর পাশেই।“
ঋ জানে না আমি যে সবকিছু শুনতে পাচ্ছি, বুঝতে পারছি। আমার চোখের দিকে একটু তাকাও ঋ...
“ভয় পাবি না মোটেও, আমি তোর একদম কাছাকাছি আছি। এটা কোন ব্যাপারই না। দেখতে দেখতে সব ঠিক হয়ে যাবে। আই লাভ ইউ তণা।“
আমিও তোমাকে অনেক অনেক অনেক ভালো বাসি ঋ...
টুং করে একটা শব্দ, তারপরই যান্ত্রিক একটা গলার স্বর অস্পষ্ট উচ্চারণে বলে উঠলো “বেসমেন্ট ওয়ান।“
“এক্সকিউজ মি?” সামনে থেকে ছুড়ে দেয়া প্রশ্নটা আমাকে সম্বিতে ফেরালো। চোখে বিরক্তি নিয়ে কাঁচাপাকা চুলের এক ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। “আপনি কি উপরে যাবেন?” স্বাভাবিক প্রশ্ন। বেসমেন্টে সাধারণত গাড়ি ছাড়া কেউ আসে না। অন্তত তাই হওয়ার কথা। আর এই মুহূর্তে আমাকে দেখে একেবারে গাড়িতে চড়ে ঘোরাফেরা করা কেউকেটা ভাবার অবকাশ নেই। তিন দিন ধরে এখানেই আস্তানা গেড়েছি আমি - স্কয়ারে। গায়ের জামাটা কুঁকড়ে মুকরে আছে, চুলটা এলোমেলো। গালে অল্প গজিয়ে ওঠা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ঠিকঠাক নয় মোটেও।
“আই এম এক্সট্রিমলি সরি। এখানেই নামবো। আই ওয়জ জাস্ট ডিসট্রাক্টেড।“ বলতে বলতে পা চালিয়ে বের হয়ে আসলাম লিফট থেকে। আইল বি৩ এর কাছে আমার প্রিয় মোটরসাইকেলটা রাখা। ভিন্টেজ ইন্ডিয়ান চিফ, ১৯৪৮ মডেল। সাদা লাল মোটরসাইকেলটার পাশে এসে দাঁড়ালাম। তাকিয়ে আছি, কিন্তু কিছুই দেখছি না। মাথার ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা। বুকের ভেতর প্রবল আক্রোশ। সেটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি আমি। খুব ভালো করেই জানি, এই উদগ্র রাগ এমুহূর্তে অন্তত: ভালো কিছু ডেকে আনবে না। এখন পা ফেলটে হবে বেড়ালের মতন সন্তর্পণে, চাল দিতে হবে দক্ষ হাতে।
প্যান্টের পকেট থেকে দুমড়ানো মোচড়ানো প্যাকেটটা বের করে আনলাম। এ কদিনে সিগারেট খাওয়া হয় নি বললেই চলে। তণা প্রায়ই বলতো,”এটা তো তোমার নেশা না। তাও যে কেন খাও।“ চোখ জ্বালা করে উঠলো আমার। জীবন খুব একটা বেশী কাটে নি আমার তবে এই অল্প সময়ের মধ্যে কারো প্রতি এমন টান কখনো অনুভব করি নি আমি। অতর্ণা ব্যতিক্রম। সব দিক দিয়েই। আগুন ধরিয়ে জোরে একটা টান মারলাম। হালকা মিষ্টি গন্ধে চারপাশটা ভরে গেল। অতর্ণা একদিন জোর করে কেড়ে নিয়ে দুই-তিন টান দিয়েছিল, তারপর ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “তাও যদি একটু জাতের কিছু খেতে। কিসব বালের গুদান গরম না কি খাও। তোমার রুচিটাই খারাপ।“ আমি অনেকক্ষণ হেসেছিলাম মনে পড়ে। সিগারেটের আবার জাত-পাত।
এমনটাই হয়। পাশে থাকা মানুষটা দূরে সরে গেলেই তার কথা মনে পড়তে থাকে। আমার কাছের মানুষটা হারিয়েই যেতে নিয়েছিল। ডাক্তারের মতে আল্লাহতালা নিজের হাতে তাকে ফিরিয়ে এনেছেন। তাই সই। এসবে কখনো তেমন কোন বিশ্বাস ছিল না আমার, অবিশ্বাসও নয়। সেটা নিয়েও কত তর্ক বিতর্ক অতর্ণার সাথে। গালটা শক্ত হয়ে এলো আমার, দাঁতগুলো চেপে বসেছে। আমার মধ্যে একটা ক্ষুব্ধ জানোয়ার চিৎকার করছে। সেটাকে আটকে রাখতে কষ্ট হচ্ছে আমার।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে আনলাম। সাইলেন্ট করা ছিল। অসংখ্য ফোনকল, মেসেজ। এসব দেখতে ইচ্ছে করছে না। কল লিস্টে মাসুদের ফোন দেখে মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম। কবে অফিসে যেতে পাড়ব ঠিক নেই। আশা করি ও সামলে নিতে পারবে। এককালে মিলিটারিতে ছিল। মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে। এখন আমার সিকিউরিটি কোম্পানিটার এডমিনটা মোটামুটি ওই চালাচ্ছে। ইন্সপেক্টর আহসানের ফোন দেখলাম। এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এক কাহিনী দুই দশবার বলতে আর ভালো লাগছে না। আর এই সমস্যার সমাধান আপাতত পুলিশ করতে পারবে না। হয়তো পারতো যদি সবগুলো সুতো খুঁজে পেতো। কিছু সুতো আমার হাতেই আমি রেখে দিয়েছি।
অতর্ণাকে একা রেখে যেতে প্রথমে মন চাইছিল না। অর্ণব আর জয়িতা এসেছে, কিন্তু ওদেরকে সকালেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম বাসায়। ওরা হয়তো দুপুরের দিকে চলে আসবে। তার আগেই আমি বের হয়ে যাচ্ছি। কিছুটা অশান্ত লাগছে নিজের ভেতরটা। গত তিনটা দিন কেমন যেন ফাস্ট ফরোয়ার্ডের মতন ঝড়ের বেগে চলে গেল চোখের সামনে দিয়ে। মনে হয় আমি সেইসব ঘতণায় সামনে দাড়িয়েই ছিলাম একটা ছায়া হয়ে মাত্র। স্মৃতিগুলো একদম এলোমেলো। আমাকে প্রথম ফোন করেন সামনের বাসার নাহার আপা। আমি তখন উত্তরায়। অফিস থেকে বের হচ্ছি। অডিট চলছিল অফিসে তারই ভর্তুকি দিচ্ছিলাম। পাঁচ মিনিটও হয় নি অতর্ণাকে ফোন করেছি। ফোনটা ধরেনি। এরকম হয় অনেকসময়। তাছাড়া আমি জানি ওর এখন খিলগাঁও চৌরাস্তায় অঙ্গন-এ থাকার কথা। ওখানেই যাচ্ছিলাম আমি। কাজেই ফোন ধরার পর নাহার আপার কথাটা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু, সামলেও নিয়েছিলাম। স্কয়ারে ফোন, এম্বুলেন্স পাঠানো, নাহার আপাকে সাথে থাকতে বলা - সিদ্ধান্ত নিতে এক মুহূর্তও লাগে নি আমার। আমি জানতাম, এই উত্তরা থেকে আমি যাওয়ার চাইতে এম্বুলেন্স পাঠানোটাই ঠিক হবে। এম্বুলেন্স যখন হাসপাতালের পার্কিং-এ ঢুকছিল ততক্ষণে আমি দাঁড়িয়ে আছি সেখানেই। সেই থেকে শুধু অপেক্ষা, ধৈর্য আর নিঃশব্দ প্রার্থনায় কাটানো সময়।
অক্সিজেন সাপ্লাই ঠিক ঠাক বসানো হয়েছে...
রক্ত চলাচল আর প্রেশার নর্মালে হচ্ছে ধীরে ধীরে...
ব্লাড প্রেশার ফল করেছে... আবার ফিরে আসছে নর্মালে...’
অপারেশন ঠিকঠাক হয়েছে, এখন আমরা অবজারভেশনে রাখবো আইসিইউ তে...
ওষুধের প্রতি ভালোই রেসপন্স দেখাচ্ছে পেশেন্ট...
নাহ, ওষুধ পালটানোর প্রয়োজন হতে পারে। বডি রেজিস্ট করছে। টিবিআই-তে এমনটা হয়...
আপনি বরং বাসায় চলে যেতে পারেন স্যার, এখানে থেকে আসলে কন লাভ হবে না। আমরা দেখছি তো...
বাসায় যাবো? এখানে একা অতর্ণাকে ফেলে? গত দুই দিন আইসিইউর সামনে, ভিজিটিং আওয়ারে অতর্ণার বিছানার পাশে - কোন পরিবর্তন, কোন চিহ্ন? এই বুঝি ডাক্তাররা বলে উঠবেন কোন আশার বাণী। নাহ। মাঝে মাঝে সবচেয়ে খারাপ চিন্তাটাই মাথায় আসতে চেয়েছে। সেটাকে গলা টিপে মেরেছি প্রতিবার। অতর্ণা ছাড়া এই জীবনের কথা ভাবতে পারি না এখন আর। কিছুতেই না। দেড় বছরে এই যে পালটে যাওয়া আমি, ঐ মেয়েটার জন্যই তো। এখন ওকে ছাড়া আমার আর পৃথক কোন অস্তিত্ব নেই। অতর্ণা আর আমার মধ্যে একটা অদৃশ্য সংযোগ আছে। এটা দেখা যায় না, ধরা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়, হৃদয় দিয়ে বোঝা যায়। আমরা দুজন পারি। সেই সংযোগের টানটা আমি এই কয়দিন টের পেয়েছি। যতবার এসব চিন্তা মাথায় এসেছি, দেখেছি সেই অদৃশ্য তারে কোন টান পড়েনি। সব ঠিক। এবং বুঝে নিয়েছি, আমার অতর্ণা আমার কাছেই আছে। শুধু একটু অপেক্ষা।
মাথাটা পেছনের পিলারে ঠেস দিয়ে উপরে তাকালাম। এইমাত্র ছাড়া সর্বশেষ ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা মিশে যাচ্ছে সোডিয়াম আলোর সাথে। সিগারেট আমার নেশা নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে মাথাটা ঠাণ্ডা রাখতে বেশ সাহায্য করছে। প্রথম প্রথম আইসিইউ-র সামনে আমি একটা খাঁচায় আটকানো জানোয়ারের মতন ত্রস্ত পায়ে হাঁটাচলা করতাম। এই দুদিনে সেটা পালতে গিয়েছে। এখন আমি ধীর-স্থির-শান্ত আর হিসেবি। চিফ-এ উঠে বসলাম। কোথায় যাবো এখন? বাসায়? সেখানে গিয়ে কি লাভ? টম আর টমটম-কে দেখে রাখতে হয় না, ওরা ওদের মতন থাকবে।। অফিসে যেতে হবে না আপাতত:। কাজের মধ্যে মন যদি ডোবাতেই হয় সেটা আসল কাজে দেয়াই ভালো। মন স্থির করে ফেললাম, অতর্ণার বাসার দিকে যাবো। ওর অফিস রুমে কিছু কাজ আছে আমার।
...
বাসার সামনেই দাড় করালাম বাইকটা। বক্কর উঠে দাঁড়িয়ে একটা সালাম দিল। বেচারার চোখের নীচে হালকা কালি পড়েছে, গাল দুটোও ঝুলে গেছে। পুলিশ নাকি এক-দেড় ঘণ্টার জন্য জেরা করতেও নিয়ে গিয়েছিল ওকে। “কি অবস্থা, বক্কর ভাই? সব ভালো?”
এই প্রশ্নটা মনে হয় আশা করে নি বক্কর আমার কাছ থেকে। চমকে তাকাল। আমি মুখে মেকি হাসিটা ধরে রেখে পাশ কাঁটিয়ে যেতে যেতে বললাম, “বাইকটা দেখো একটু। ঠিক আছে। চিন্তা করো না। আমি পুলিশকে বলে দেব যাতে তোমাকে আর ঝামেলায় না ফেলে।“ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আমার দিকে বক্করের তাকিয়ে থাকাটা ঠিক বুঝতে পারলাম। দরজার লকে চাবি লাগিয়েই বুঝতে পারলাম, বাসায় কেউ আছে। দরজার ছিটকিনি ভেতর থেকে দেয়া। অর্ণব আর জয়িতা কি যায় নি এখনও? বেল টিপ দিলাম দুইবার। ভেতর থেকে একটা পায়ের শব্দ এসে দরজার ওপাশে দাঁড়ালো। পীপহোল দিয়ে দেখল, দরজা খুলে সরে দাঁড়ালো জয়িতা। “কি ব্যাপার? কখন আসলে হাসপাতাল থেকে?”
“এই তো। সরাসরি এখানেই এসেছি।“
“সেটা বুঝতে পেরেছি। আমরা এই তো আর অল্প কিছুক্ষণ পরেই বের হতাম।“
“হুম, ভালো, যা তোরা। আমার একটু কাজ আছে।“ জুতা খুলতে খুলতে সামনে তাকিয়ে দেখলাম অফিস-রুমের দরজাটা খোলা। নিশ্চয়ই অর্ণবের কাজ। আমি জানি। পরে দেখা যাবে। আগে একটু ফ্রেশ হতে হবে। সোজা গিয়ে ঢুকলাম বেডরুমে। এখানে আলমারিতে আমার কিছু জামাকাপড় সবসময়ই থাকে। গোসল করে বেরিয়ে আসলাম দশ মিনিটের মধ্যেই। দাঁড়ি পরে কাটলেও চলবে। আপাতত বাড়তে থাকুক আগাছার মতন। মাথাটা মুছতে মুছতে অফিস রুমে ঢুকলাম। ডানে সোফায় বসে আছে অর্ণব। আমার আসার শব্দ পেয়ে একবার মাথা তুলে তাকাল, আবার ফাইলের দিকে তাকিয়ে পড়া শুরু করলো। জয়িতা বসেছে টেবিলের সামনে রাখা ক্লায়েন্ট চেয়ারে। তার সামনেও দুটা ফাইল। আমার দিকে ফিরে তাকাল। “বসো না। কিছু খাবে? চা? কফি? দুপুরের খাবার খেয়েছ?”
“নাহ। কিছু লাগবে না রে? কি করছিস তোরা?”
উত্তরটা আসলো ডান দিক থেকে। “অতর্ণার কেস ফাইলগুলো পড়ে দেখছি। তুমিও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, এই ঘতণার সাথে কোন না কোন সম্পর্ক আছে অতর্ণার এখনকার কোন একটা কেসের। তা না হলে তো আর এখানে আসতে না।“
একদম টু দ্য পয়েন্ট। অর্ণবটা এরকমই। অতর্ণার চাইতে মাত্র এক বছরের ছোট ও। অর্ণবের সাথে আমার প্রথম যেদিন দেখা করিয়ে দিয়েছিল অতর্ণা, খুব চিন্তায় পরে গিয়েছিল ও। যদিও আমরা দুইজনই খুব আন্তরিক ছিলাম কিন্তু, কথা বার্তা খুব অল্পই হয়েছিল। খাওয়া দাওয়া হয়েছিল ধীরলয়ে। সব শেষে হালকা কোলাকুলি করে, বাসায় আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নেয়াও হয়েছিল। কিন্তু, ফোন করে অতর্ণার সে কি প্রশ্নের পর প্রশ্ন, “এত কম কথা বললে কেন? কোন সমস্যা? অর্ণবকে কেমন লাগলো তোমার? ওকে তোমার ব্যাপারে প্রশ্ন করলেও তো তেমন কিছু বলছে না।“ আমিও বলিনি। কিছু কথা বলার প্রয়োজন পরে না। প্রথম নজরেই আমি অর্ণবকে চিনে ফেলেছি, যেমন অর্ণব চিনতে পেরেছে আমাকে। ওর মধ্যে একটা ভীষণ চঞ্চলতা বাস করে। বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছিল কাউকে কিছু না বলেই, চান্স পেয়ে পরে পুলিশ ক্যাডারে জয়েন করেছিল। সেই চাকরি যখন ছেড়ে দিয়ে চলে আসলো, অতর্ণা নাকি প্রথমবার অর্ণবের গায়ে হাত তুলতে গিয়েছিল। সে সবই শোনা কথা - অতর্ণার কাছ থেকে। আমি বুঝতে পারি অর্ণবকে ঠিক, ও আসলে আমিই। একটু অন্য ছাঁচে গড়া। একটু অন্যরকম।
“সেটা জরুরী না। পুরানো কেউও হতে পারে। এই আট মাসে পনেরো-ষোলোটা কেস হাতে পেয়েছে অতর্ণা। সমাধান করেছে তার মধ্যে বেশিরভাগেরই। কাজেই তাদের মধ্যে থেকেও তো কেউ হতে পারে। তাই না?”
“হ্যাঁ পারে। তবে সেটার সম্ভাবনা কম। যেসব কেস সমাধান করেছে, অতর্ণা তার সবগুলোই সমাধান শেষে পুলিশের হাতে দিয়ে দিয়েছে। যারাই অপরাধী ছিল, সবাই চৌদ্দশিকের আড়ালে। দুইজন জামিনে বাইরে আছে ঠিকই। তবে মামলা টিকে যাবে যা বুঝলাম পুলিশের সাথে কথা বলে।“
“আর যেগুলো এখনো সমাধান হয় নি?”
“সেগুলো নিয়ে ভাবার যায়গা আছে ঠিকই। কিন্তু সেগুলো অতর্ণা আপাতত ক্লোজই করে রেখেছিল। এখন কাজ করছিল এই তিনটা কেস নিয়ে। কাজেই এই তিনটা কেসে একটু নজর বুলানো দরকার।“
“কে নজর বুলাবে? তুমি?”
“আমিও।“ বলে উঠলো জয়িতা। ওর সাথে আমার সম্পর্কটা অনেক সহজ, অনেক স্বাভাবিক। অতর্ণার একটা মিনি ভার্সন বলা যায় জয়িতাকে। সিলেটে শাবি-তে মাস্টার্স শেষ করছে। কম্পিউটার সায়েন্সে। সেখানেই একটা কম্পিউটার ফার্মও দিয়ে দিয়েছে বন্ধুরা মিলে। ঢাকায় আসে খুব কম। আসলেও ঘর ছেড়ে বাইরে বের হতে ভীষণ অনীহা ওর। আমরা একবার কক্সবাজার যাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম, তখন অতর্ণা জয়িতাকে সিলেট থেকে গিয়ে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছিল। লম্বা, ছিপছিপে গড়ন জয়িতার, প্রচণ্ড জেদি হিসেবে বদনামও আছে। সেই সাথে যোগব্যায়ামের পাগল। আর খুব ভালো রান্না করতে পারে। এটা অবশ্য অতর্ণার পরিবারের সবার বৈশিষ্ট্য।
“তা কি বুঝলে নজর বুলিয়ে?”
“কেসগুলো খুবই ঘোরালো। এর সাথে আপুকে গুলি করার সম্পর্ক থাকতেই পারে। কারণ কেসের সাথে যদি সম্পর্ক নাই থাকবে, তবে ঐ রাত্রে এই বাসায় এসে ঢুকতো না আততায়ী। তার জন্য এবার আমরাই খোঁজখবর নেয়া শুরু করবো।“
“বাসা থেকে কিছুই খোয়া যায় নি। টাকা, গয়না কিছুই না। কাজেই মোটিভ এখানে পরিষ্কার।“ অর্ণব যোগ করলো।
আমি হাত তুলে বাঁধা দিলাম। “সেটা নাও হতে পারে। এমনও তো হতে পারে যে চুরিটা করার আগেই তণা এসে ঢুকেছিল আর তখন চোর সহজাত প্রবৃত্তির বশে গুলি করেছে পালানোর জন্য।“
“বাংলাদেশের কোন চোর হাতে পিস্তল নিয়ে চুরি করতে যায় বাসায়?” এটা অবশ্য কিছুটা ঠিকই বলেছে অর্ণব। তবে এখন যেভাবে অলিগলিতে পাইপ আর শাটার গান পাওয়া যায়। কিন্তু এটা সেই কেস নয় - আমিও জানি।
“শুনো, আমার কি মনে হয়েছে।“ জয়িতা বলল, “যেই সেদিন রাত্রে এসেছিল সে কয়েকটা ব্যাপার জেনেই এসেছিল। সে হয়তো অনুমান করেছিল কয়টার দিকে আসলে অফিস ফাঁকা পাওয়া যাবে কারণ কমবেশি সবাই যে পার্টিতে যাবে সেদিন তা একরকম সাধারণ ব্যাপার। তার উপর সে এটাও জানতো যে বক্কর ভাইয়ের মাঝে মাঝেই এমন গেট ফেলে হাওয়া হয়ে যান। অফিস রুম কোথায় সেটাও সে জানতো নিশ্চয়ই বা এই বাসাটার সাথে সে পরিচিত।“
“এটা ভালো বলছিস। কারণ যে কোন চোর এই অবস্থায় লুকিয়ে পড়তো বা পালিয়ে যেত, গুলি করতো না।“ অর্ণব চুপ করে থেকে কিছুক্ষণ আবার বলল, “সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে আপা মনে হয় ওর চেহারা চিনে ফেলবে। আর আপার ব্যাপারে যদি জেনে থাকে তবে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক।“
আমি টেবিলটা ঘুরে রিভলভিং চেয়ারটা টেনে নিলাম কাছে। অতর্ণা কখনোই আমাকে এই চেয়ারটায় বসতে দেয় না। এটা নাকি ওর নিজস্ব মাথা খোলতাই করার চেয়ার। অফিস শুরু করে সবার আগে এই চেয়ারটাই অর্ডার করেছিল পান্থপথ গিয়ে। কোথায়, কবে নাকি দেখেছিল - ব্যস, এটাই লাগবে। চেয়ারে বসে জয়িতা আর অর্ণবের কথাগুলোই মাথায় খেলাতে লাগলাম। জয়িতা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অর্ণব যথারীতি পাতা উলটে চলছে।
“তোমাদের কথা কিন্তু ঠিকই আছে। এ থেকে যা বোঝা যায় যে এসেছিল তাকে তনা চিনতো। সে ক্লায়েন্টও হতে পারে, কোন সাসপেক্টও হতে পারে। আবার হয়তো কোন ঘতণার সাক্ষী, বা নিতান্তই জিজ্ঞাসাবাদের সময় হয়তো এক দুইবার দেখা হয়েছিল। কিন্তু, তনা ওকে চিনতো।“
“কিন্তু, সেদিন যে এসেছিল সে যদি কোন তথ্য সরানোর জন্য এসে থাকে তবে ফাইলগুলো তো সরিয়ে ফেলার কথা।“ জয়িতা চিন্তিত স্বরে বলল। “তাহলে এই ফাইলগুলো আসলো কোত্থেকে?”
এ কথাটার উত্তর আমি জানি কিন্তু চুপ করে থাকলাম। অর্ণবই বলল, “নিশ্চয়ই আপু কোন ফাঁকিবাজি করেছে এখানে। কারণ এই ফাইলগুলো আমরা খুঁজে পেলাম একাউন্টস লেখা ড্রয়ারে। ২০১৬ লেখা ফাইলে যখন কি না এই এজেন্সিই ছিল না। তাহলে রানিং কেস ফাইল লেখা ড্রয়ারে নিশ্চয়ই দুই নাম্বারি ফাইল রেখেছে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে ভেবে।“
“হ্যাঁ, সেটাই সবসময় অতর্ণা করে। আর আমিও জানতাম ব্যাপারটা। তাই ফাইলগুলো দেখতে আসছিলাম। এসে দেখি তোমরা এক কদম আগেই কাজ সেরে ফেলেছ। তা এখন বল দেখি কি বুঝলে ফাইলগুলো পড়ে?”
অর্ণব তার হাতের ফাইলটা উঁচু করে দেখিয়ে বলল, “এটা খুব জরুরী একটা ফাইল। এটা এভাবে আপা এখানে ফেলে রেখেছে সেটা ভাবতেই আমার অবাক লাগছে।“
আমি জানি ঐ ফাইলটা কোন কেসের কাজেই আমি চুপ করে শুধু মাথা নাড়লাম। অর্ণব বলতে থাকলো, “এই ফাইলের লেখাগুলো যদি সত্যি হয় তবে আমার মনে হয়ে এই বাসায় ঢোকার পর থেকেই আমরা চিহ্নিত হয়ে গিয়েছি এবং আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। তবে হ্যাঁ, এই ফাইলটাই যদি চোরের লক্ষ্য থাকত তবে আপাকে জীবিত রাখা হতো না বলেই আমার মনে হয়।“
“অত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিও না। জলের উপরটা দেখলে নীচে মাছ কতগুলো আছে তা বোঝা যায় না। এই ফাইলের ভেতর তোমার আপা আসল কোন কথাই লিখে রাখে নি। সেগুলো আমি তোমাকে বলবো পরে। তার আগে জয়ি, তুই বল তোর ফাইলগুলোর ব্যাপারে। কি ধারনা পেলি?“
“এক নাম্বার ফাইলের কথাই আগে বলি। প্রায় বছর খানেক আগের ঘটনা। পত্রপত্রিকাতেও এসেছিল। ওয়ালি আহসান নামের এক ব্যাংকার আনুমানিক রাত এই আটটার দিকে ফার্মগেটের পার্কটা পার হতে গিয়ে ছিনতাইকারীর এলোপাথাড়ি ছুরিকাঘাতে আহত হন। জখম খুব ভয়ানক ছিল, ডান হাতটা এখন প্রায় অকেজো, মুখটা স্কিন গ্রাফটিং করে কিছুটা ঠিক করা হয়েছে - তাও বীভৎস, চাকরিটাও এখন আর নেই। পুলিশ অনেক আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছে। তিনি এই কেসটা নিয়ে আপুর কাছে এসেছিলেন।“
“খুব সাধারণ একটা কেস বলেই মনে হচ্ছে। এটা নিয়ে তো মাথা না ঘামালেও চলে। নাকি?”
“সেটা আমিও ভেবেছিলাম। কিন্তু এখানে আরেকটা কেস ফাইলের রেফারেন্স দেয়া। আপু একটা স্লিপ লিখে রেখেছে “জিলাপি নয় আমিত্তি!!!” সেই কেস ফাইলটা পড়ে এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে কোন কাহিনী থাকতেও পারে।“
“কি কেস ফাইল সেটা?”
“গত মে মাসের ফাইল। অর্থাৎ একেবারে আপুর একেবারে প্রথম দিকের একটা কেস। প্রীতি জামান নামের একটা মেয়ে। নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কোনই খোঁজই আর পাওয়া যায় নি। বাবা - মার মতে এমন কিছুই ঘটতে পারে না তাদের মেয়ের সাথে। কোন বয়ফ্রেন্ড ইস্যু নেই, নেই কোন বাজে কিছুর সাথে যোগাযোগ। অবশ্য আমাদের দেশের যা অবস্থা তাতে ঘটনাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন বডি খুঁজে পাওয়া যায় নি তাই বাবা-মা হাল ছাড়তে নারাজ। সে কারণেই আপুর কাছে আসা। কিন্তু আপু ফাইলের পেছনে ছোট স্লিপে লিখে রেখেছে “ঢাক গুড় গুড়।“ আমার মনে হয় এখানে কোন একটা লুকোচুরি চলছিল যা আপু বুঝতে পেরেছিল।“
“বেশ ভালোই দেখি মাথা চলছে তোর। দারুণ। থামলি কেন? বলতে থাক দুই নাম্বার ফাইলে কি আছে?”
“দুই নাম্বার ফাইলটা একটা নারী স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা এনজিও-র। “সাহসিনী”। ওদের প্রধান কাজ হচ্ছে পতিতা-দের পুনর্বাসনে কাজ করা। এরকমই এক মেয়েকে- যে কিনা পুনর্বাসনের আওতায় ছিল, একদিন মৃত খুঁজে পাওয়া যায় ওর বাসার পেছনের গলিতে। কেউ একজন ছুড়ি দিয়ে গলাটা প্রায় ধর থেকে আলাদা করে ফেলেছিল। মেয়েটার - যার নাম ইতি ভৌমিক; যে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ছিল সংস্থার কাছে দেখা গেল সেটা ভুয়া। ওর হাতের ছাপ বা কিছুই ঠিক নেই। নামটাও মনে হয় ভাঁড়ানো ছিল। লাশটাও কেউ দাবী করতে আসে নি। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়ে যায়। এই কেসটা আপু কেন নিয়েছে সেটাই বুঝতে পারছি না।“
“এই ‘কেন?’-র তো কোন উত্তর নেই। ওই এনজিও-র সিইওর সাথে একটা ডিনার পার্টিতে গিয়ে দেখা হয়েছিল তোর আপুর। উনিই কথায় কথায় ব্যাপারটা খুলে বলেন। তনাও ধরে বসে কেসটা নেবে বলে তাও আবার ফ্রি-তে। বিষয়টা ওর মাথায় ঢুকে গিয়েছিল যে একটা মেয়ে ভালো হতে চাইলো কিন্তু বেঘোরে মারা গেল। এই তো।“
“বুঝলাম। শুনো, এগুলো নিয়ে আমাদের মনে হয় আরও কথা বলা দরকার। কিন্তু এখন সময় নেই। আমি আর অর্ণব যাচ্ছি হাসপাতালে। তুমি একটা ঘুম দাও। সকালে খিচুড়ি রান্না করেছিলাম, সাথে ডিম ভেজে দিচ্ছি। খেয়ে একটা ঘুম দিয়ে ওঠো। রাতে খেয়ে এরপর হাসপাতালে যেও আমরা আসার পর।“
“ডিম ভাজা লাগবে না, আমিই ভেজে নিচ্ছি। মা-কে ফোন দিয়েছিলি? কিছু বলেছিস?”
“পাগল। সোজা হার্ট এটাক করবে। অর্ণব ভুংভাং বলে দিয়েছে যে আপু নাকি শর্ট ট্রিপে সিঙ্গাপুর গিয়েছে কাজে। সপ্তাহ খানেক এটাই চলুক।“
“তোদের মা কে কি তোরা বোকা ভাবিস নাকি? আর দুই তিন দিনের মধ্যে ফোন না দিলে ঠিক ঠিক এখানে এসে হাজির হবে। তণা মা-র সাথে এতদিন কথা না বলে থাকে না জানিসই তো?”
“সে তখন দেখা যাবে।“ অর্ণব উঠতে উঠতে বলল। “আমরা বরং এখন যাই। দেরী হয়ে যাচ্ছে। এই, জয়ি - আমি উবার ডাকলাম। দেরি করিস না।“
...
ওরা বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর অফিস-রুমে এসে বসলাম। তিন নাম্বার ড্রয়ারের পেছনে একটা খোপ আছে। না জানলে কেউ খুঁজেও পাবে না। ভেতরের স্টিল বক্সটা বের করে কম্বিনেশন লকটা খুললাম। নরম ফোমের বিছানায় শুয়ে আছে চকচকে ওয়ালথার সিসিপি। তনার প্রিয় বন্দুক। ও মজা করে বলতো বন্ধু-ঠুক। আমি একবার বলেছিলাম ওকে গ্লক নিতে, ও হেসে শুধু বলেছিল “রানার ছায়া থেকে কি আর বেরিয়ে আসা যায় অত সহজে।“ চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সবসময় একা চলতে অভ্যস্ত আমি। এবার জয়িতা আর অর্ণব সাথে আছে। আমি না চাইলেও মানবে না। অর্ণবকে নিয়ে আমার চিন্তাটা কম। ওর সাথে কেউ লাগতে এলে পার পাবে না। কিন্তু, জয়ির মধ্যে চাপা জেদটা আমি টের পেয়েছি। ওদের তিন ভাই বোনের মধ্যে অদ্ভুত টান। ওদের দেখে রাখতে হলে আমাকে দরকার হলে পুরনো খোলসেই ফিরে যেতে হবে। আর অর্ণবের হাত থেকে ঐ ফাইলটা নিয়ে নিতে হবে। তা না হলে ওর ঝুঁকি নেয়ার স্বভাব ওকে বন্দুকের নলের সামনে টেনে নিয়ে যাবে। আজ আর কিছু খাবো না, বরঞ্চ এই বেলায় একটু ঘুমিয়ে নেই। খিচুরি আমার খুব পছন্দ, তনার একটুও না। তনার এক কথা, “ডাল ভাত একসাথে মাখিয়ে কাঁচামরিচ আর লেবু দিয়ে খাও। খিচুড়িটা আবার কেন?” তাও এমন খুব কমই হয়েছে আমি এ বাসায় এসেছি অথচ খিচুরি পাই নি টেবিলে।
সোজা হয়ে বসে হাতে তুলে নিলাম পিস্তলটা। চোখের বদলা চোখ - ব্যস।
প্রথম অংশঃ সংযোজনা - ০১
অন্তরা রহমান
মন্তব্য
উদগ্র রাগ কথাটা অনেকদিন পর পড়লাম।
"তুমিও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, এই ঘতণার সাথে কোন না কোন সম্পর্ক আছে অতর্ণার এখনকার কোন একটা কেসের" এই লাইনটা পড়ার পর মিনিট খানেক আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম ঘতণাকে। হা হা হা।
ভালে লেগেছে পড়ে।
----মোখলেস হোসেন।
আর বইলেন না ভাই। প্রচুর বানান ভূল। কোথা হইতে কি হইয়া গেলো - বুঝতে পারলাম না। সমানে থেকে আরো সচেতন হতে হবে। আমি নিজেই হতাশ ও অনুতপ্ত।
অন্তরা রহমান
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন