বুমেরাং

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২৭/০৩/২০১৮ - ৭:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি একবার বুমেরাং বানিয়েছিলাম।

স্কুলে কী একটা প্রতিযোগিতায় জেতার পর দারুণ একটা বই দিয়েছিলো আমাকে। রাশান বই, সেই বইয়ে নানান রকম জিনিসের গল্প। একটা গল্প ছিলো বুমেরাং নিয়ে। লেখার শেষে ছোট্ট করে বলে দেওয়া কী ভাবে বুমেরাং বানাতে হয়- নিখুঁত বর্ণনা, একেবারে ধাপে ধাপে, মাপে মাপে।

প্রথমে বানালাম কার্ডবোর্ড দিয়ে। এটা মডেল, দেখতে চাই কাজ করে কিনা।

খুবই ছোট্ট সে বুমেরাং, বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনী দিয়ে আলতো করে চেপে ডান হাতের আঙুল দিয়ে একটা টোকা। ব্যাস, বুমেরাং এগিয়ে চললো সামনের দিকে, তবে ফিরে এলো না। জ্যামিতির বাক্স খুলে কম্পাস আর চাঁদা দিয়ে মাপজোক করে বানালাম আরেকটা, তারপর আরেকটা, আরও একটা। কী দারুণ ভাবেই না বাতাসে সাঁতার কেটে সেটা ফিরে এসেছিলো আমার কাছে! ভাবলে এখনো মনে শিহরণ জাগে।

কদিন বেশ কাটলো কার্ডবোর্ডের বুমেরাং নিয়ে। কিন্তু এতে কি আর মন ভরে? একদিন ভাবলাম, বানিয়েই ফেলি প্রমাণ সাইজের একটা। কিন্তু কী দিয়ে বানাই! বাসায় তখন নতুন ফার্নিচারের কাজ চলছিলো, কাঠ মিস্ত্রির কাছে গিয়ে একটুকরো কাঠ চেয়ে আনলাম। আরও এক মাস গেলো করাত আর শিরীষ কাগজ কেনার টাকা জমাতে। ছোট্ট একটা করাত দিয়ে মাপ মতন কাটা কি আর মুখের কথা। প্রতি দিন একটু একটু করে কাটি, আমাকে মুগ্ধ করে দিয়ে ধীরে ধীরে কাঠের ওই টুকরোটা থেকে একদিন বেরিয়ে এলো আমার বুমেরাং। শিরীষ দিয়ে ঘষে ঘষে পালিশ করতে গেলো আরও কয়েকটা দিন। এবার পরীক্ষা করে দেখার পালা।

কিন্তু কোথায় যাই! এর পাল্লা কতো কে জানে? ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম পরীক্ষাটা আবাহনী মাঠে হলেই ভালো।

তখন সন্ধ্যে হয় হয়। মাঠ ফাঁকা হয়ে আসছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছে অল্প কিছু মানুষ। আমি অপেক্ষা করছি কখন সবাই চলে যাবে। কিন্তু কারও যেন কোন তাড়া নেই। অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে যাচ্ছি, আলো কমে আসছে দ্রুত।একটু পরেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসবে। তখন বুমেরাং ছুড়ে লাভ কী? হারিয়ে গেলে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। আর যদি ঠিক ঠিক কাজ করে ফিরেও আসে, সে ওড়ান, আহা সেই ওড়ান কি আর দেখা যাবে এই আঁধারে!

মন খারাপ করে চলেই যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে মাঠের দক্ষিণ পূর্ব কোনে যে একটা প্যাভিলিয়ন মতো ছিলো তার সামনে এসে আনন্দে দাঁত বেরিয়ে গেলো আমার। এদিকটায় একটু আলো রয়েছে, রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট আর খেলোয়াড়দের সাজঘরের আলো। আলো আঁধারিতে বেশ দেখা যাচ্ছে আশপাশটা। বুমেরাংটা হাতে নিতেই কলজেটা যেন লাফিয়ে উঠলো। নিজেকে মনে হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার কোন এক আদিবাসী বালক, বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্যাংগারু শিকারে বেড়িয়েছি।

লম্বা একটা দম নিয়ে ছুড়ে দিলাম আমার বুমেরাং, সাই সাই করে আলো ছাড়িয়ে চলে গেলো সোজা অন্ধকারে। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালাম, যদি অন্ধকারের চাঁদর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে সে।

নাহ!

কে জানে, হয়তো মাপজোকে ভুল করে ফেলেছি।

বিষণ্ণ মনে হাঁটতে শুরু করেছি কি করিনি, আমার বাম দিকে 'ওরে বাবারে মা রে' বলে একটা চীৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি কপাল চেপে বসে পড়েছে প্যাভিলিয়নের পাহারাদার পুলিশ। এসেছে! আমার বুমেরাং ফিরে এসেছে!!
উফ কী যে একটা দৌড় দিয়েছিলাম আমি! মাঠ ছাড়িয়ে, রাস্তা পেরিয়ে একেবারে বাসস্ট্যান্ডে এসে থেমেছিলো সেই দৌড়।

****************************************

অমিয়র যখন চার বছর বয়স তখন ডে কেয়ার থেকে ফিরে একদিন আমাকে বললো কে নাকি একজন এসেছিলো ওদের ক্লাসে, সে বুমেরাং নিয়ে কথা বলেছে। ওদেরকে ধরতেও দিয়েছে একটা বুমেরাং।

আমি তখন ছেলেকে আমার গল্পটা বললাম। সব শুনে ও খুব অবাক হয়ে বললো,

"তুমি বুমেরাংটা ফেলে চলে এলে!"

আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,

"বাবারে, আমি জান হাতে নিয়ে ফিরে এসেছি"

অমিয় বাংলাটা ভালোই বলে, কিন্তু সবকিছুর মানে ওভাবে তখনো জানেনা।

জিগ্যেস করলো,

"জান হাতে নিয়ে ফিরে আসা কী?"

ভাবলাম বলি বাংলাদেশের পুলিশের কাছে ক্লাস সেভেনের একটা বাচ্চা ছেলে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের মাঝে কোন ফারাক নেই। কিন্তু কী দরকার দেশের দুর্নাম করে?

অমিয় জানে বাংলাদেশটা অপূর্ব, তাইই থাক।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

হো হো হো হো হো হো
সত্যি ভাই "জান হাতে নিয়ে ফিরে আসা কি?"
-বৃদ্ধ কিশোর

অতিথি লেখক এর ছবি

কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে...

পড়ার জন্য ধন্যবাদ বৃদ্ধ কিশোর।

---মোখলেস হোসেন

অতিথি লেখক এর ছবি

এইটাও কিন্তু একরকম বুমেরাং মোখলেস ভাই। একটা ঘটনা জীবন আপনার দিকে ছুড়ে মারলো সেটা ঘুরে ঘুরে এই কত্তগুলো বছর পর আবার ফিরে আসলো - তাই না! নামকরণ সার্থক! চলুক

অন্তরা রহমান

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ অন্তরা রহমান। ভুল করে গল্প বিভাগে জমা দিয়ে দিয়েছিলাম। অবশ্য এটা আমার নিজের ঘটনা হলেও গল্প তো বটেই।

---মোখলেস হোসেন।

সোহেল ইমাম এর ছবি

সচলায়তনে ঢুকে আপনার লেখাটাই আগে পড়বো এ এক রকম ঠিক করাই থাকে। কোনদিন এমন হলোনা আপনার লেখা পড়ে হতাশ হতে হয়েছে। এই ছোট্ট লেখাটার মধ্যেও দারুন মজা পেলাম।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ সোহেল ইমাম। কিন্তু আপনি লিখছেন না কেন!

---মোখলেস হোসেন

এক লহমা এর ছবি

চলুক

আমিও বানিয়েছিলাম, তবে এইরকম মনে রাখার মত কিছু ঘটাইনি! হাসি

"অমিয় জানে বাংলাদেশটা অপূর্ব, তাইই থাক।" - অবশ্যই!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

বুমেরাং তো বুমেরাং, সেবা প্রকাশনীর জুলভার্ন পড়ে গান পাউডার বানানোর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। ঐযে চাঁদে অভিযান গল্পে যেমন ছিল - নাইট্রিক অ্যাসিড না কী একটায় তুলা ডুবিয়ে বানাতে হয়।

----মোখলেস হোসেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।