সম্প্রতি বাংলাট্রিবিউন এর অনলাইন সংস্করনে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে নিয়ে একটা খবর চোখে পড়ল ( http://www.banglatribune.com/country/news/306261/৯৫টি-শহরকে-পেছনে-ফেলে-সেরা-হিসেবে-আন্তর্জাতিক )১ সোস্যাল মিডিয়ার কল্যানে হয়তো আপনাদের চোখেও খবরটি এসেছে। খবরের শিরোনাম অনেকটা এরকম -
৯৫টি শহরকে পেছনে ফেলে সেরা হিসেবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাচ্ছে চট্টগ্রাম ওয়াসা
আগ্রহভরে খবরটা পড়া শুরু করলাম এবং সেখানে বেশ কয়েকটা যায়গায় কেন যেন নজর আটকে গেল। বাংলাট্রিবিউন থেকে সেই অংশগুলো আপনাদের সাথে শেয়ার করছি-
...গত ১৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে সংস্থার জেনারেল সেক্রেটারি রিকার্ডো রসো লিওপিজ স্বাক্ষরিত এক চিঠির মাধ্যমে এ পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন সংক্রান্ত তথ্য জানানো হয়। গ্লোবাল ট্রেড লিডার্স ক্লাব বিশ্বব্যাপী তাদের কার্যক্রমের মধ্যে অসামান্য কোম্পানি সম্পর্কে তথ্য নিয়ে একটি অনলাইন জরিপ প্রতিষ্ঠা করেছে। এ সংস্থার পরিচালিত জরিপে চট্টগ্রাম ওয়াসা নগরীর ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা পূরণে এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সক্ষমতা দেখাতে পেরেছে। তাই এবার চট্টগ্রাম ওয়াসাকেই নির্মাণ পুরস্কারের জন্য শ্রেষ্ঠ বিজয়ী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়।...
...পুরস্কৃত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন...তিনি বলেন, ‘স্পেনের এই প্রতিষ্ঠানটি ওয়াসা নিয়ে কাজ করেছেন সেটা আমরা জানতামও না। উনারা বিভিন্ন অ্যাংগেল থেকে যাছাই করে বিশ্বের ৯৫ শহরের মধ্যে আমাদের সার্ভিসকে ভালো মনে করেছেন এবং ভালো পেয়েছেন। তাই হয়তো তারা আমাদের এই স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি সরকারের সহযোগিতা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।...
এই অংশগুলো পড়ে কি কোন খটকা লাগছে? কোন কিছুর সাথে মিল পাচ্ছেন? "গ্লোবাল ট্রেড লিডার্স ক্লাব" নামে কোন সংগঠনের নাম এর আগে কখনো শুনেছেন? এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ওয়াসার কাউকে না জানিয়েই বিশ্বের ৯৫ টি শহরের মধ্যে ওয়াসাকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করে ফেলছে!! তাদের শ্রেষ্ঠত্ব নির্বাচনের মাধ্যম হল 'অনলাইন জরিপ'!! বিষয়টা কি বিশ্বাসযোগ্য?
এরপর 'Global Trade Leaders´ Club' লিখে গুগোলে সার্চ দিলাম। সার্চ রেজাল্টের শুরুতেই আসলো প্রতিষ্ঠানটির ওয়েব সাইট (http://www.gtleadersclub.com/)২, যা খুবই সস্তামানের এবং কিভাবে এইখান থেকে এওয়ার্ড নিতে হয় সে বিষয়ে কিছু তথ্য দেয়া আছে। এর বাইরে উইকিপিডিয়ায় এই সাইটকে দেখানো হয়েছে 'trophy-for-sale organization' অর্থাৎ যেখানে টাকার বিনিময়ে এওয়ার্ড কনতে পাওয়া যায় তেমন একটি সাইট হিসেবে। আমি জানি উইকিপিডিয়ার সব তত্যই যে সঠিক হবে তার কোন মানে নেই। তাই উইকিপিডিয়ায় এই তথ্যের সূত্র হিসেবে যে নিবন্ধের লিংক দেয়া আছে, সেই The Organized Crime and Corruption Reporting Project (OCCRP) এর সাইটে একটি অনুসন্ধানী নিবন্ধে গেলাম (https://www.occrp.org/en/investigations/2662-what-price-honor)। সেখান থেকে জানা গেল গ্লোবাল ট্রেড লিডারস ক্লাব সহ আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর এই ধরনের ধাপ্পাবাজি করে যাচ্ছে। তাদের কর্মকান্ড যেভাবে পরিচালিত হয় তা ছবিতে দেখুন-
বড় করে দেখতে এই লিংকে যান- https://imgur.com/bQpr0XQ
প্রথমে তারা বিভিন্ন অনুন্নত দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের বিজয়ী ঘোষণা করে গাদাগাদা ইমেল বা চিঠি পাঠায়। কেউ যদি সেই ইমেইল বা চিঠির জবাব দেয়, তাদেরকেই বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর তাদের কাছে বিভিন্ন ফী বাবদ টাকা নেয়া হয় (পড়ুন পুরষ্কারের দাম নেয়া হয়)। এরপর তথাকথিত পুরষ্কারজয়ী তার কেনা পুরষ্কার বগলদাবা করে বিজয়ীর বেশে নিজ দেশে ফেরে। প্রতি বছর তারা কয়েকবার এই ধরনের পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তথাকথিত বিজয়ীদের কাছে থেকে হাজার হাজার ডলার ফী বাবদ নেয়া হয়। একবার কেউ এদের ফাঁদে পা দিলে এই ধরনের অন্য আরেক কোম্পানী আবার তাকে আরেক পুরষ্কারের চিঠি পাঠায়! বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধাপ্পাবাজেরা পাবলিক বা সরকারী কোম্পানীগুলোকে টার্গেট করে তাদের শিকার হিসেবে। ওয়াসার ক্ষেত্রেও সেই একই কান্ড হয়েছে। হয়তো চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্তারা না জেনে অথবা জানার পরেও বিদেশ ভ্রমনের লোভে বিষয়টা নিয়ে আর তেমন ঘেটে দেখেনি। হয়তো সেখনার কর্তারা এখনো এই সব অনলাইন স্ক্যামের সাথে পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু একজন প্রকৌশলী হিসেবে তাদের এই না জানার বিষয়টা আমার নিজের কাছেও লজ্জার। দোষ শুধু তাদেরই নয়, আমি হয়তো বাংলাট্রিবিউনের খবর কোট করেছি, কিন্তু গুগোল করে দেখুন এই খবর আরো ডজন খানেক পত্রিকা ছেপেছে একটুও রিসার্চ না করেই। তাদের কি কোনই দায় নেই?
আপনাদের কি মনে আছে ২০১৩ সালে বেশ কিছু পত্রিকায় খবর এসেছিলো যে 'রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়' দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে? তাদেরকেও এই একই ভাবে চিঠি পাঠিয়ে বোকা বানানো হয়েছিল। পরে দেখা গেল একই চিঠি আরো হাফ ডজন বাংলাদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে! এই বিষয়ে সচল রাগিব হাসানের এই লেখাটা পড়তে পারেন - (https://web.facebook.com/photo.php?fbid=10151812611358670&set=a.10150212635053670.326981.513618669&type=3&permPage=1)। এই চিঠি এসেছিলো 'ইউরো বিজনেস এসেম্বলি' নামে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডভিত্তিক একটি সংস্থার নামে, এই সংস্থার বুজরুকির কাহিনীও The Organized Crime and Corruption Reporting Project (OCCRP) এর সেই আর্টিকেলে দেয়া আছে (https://www.occrp.org/en/investigations/2662-what-price-honor)। সেই সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের খবর অনেকগুলো নিউজ সাইটেই এসেছিলো, পরে যখন দেখা গেল বিষয়টা ভূয়া, অনেকেই সুন্দর করে কোন ডিসক্লেইমার ছাড়াই খবরগুলো মুছে দিয়েছে। হয়তো এবারের বুজরুকি ধরা পরার পরেও সেই একই কান্ড হবে। সেকারনে নিউজটার ব্যাকাপ রাখা হল।
বাংলাট্রিবিউনের এই খবর অনুসারে স্পেনের মাদ্রিদে আগামী ১৪ মে এই পুরষ্কার প্রদান করা হবে। সরকারী কোষাগার থেকে যাতে শুধু শুধু এই আজগুবি পুরষ্কারের জন্য পয়সা গচ্চা না যায়, সেজন্য কোন সংবাদ মাধ্যমকে বিষয়টি জানাতে পারলে ভালো হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই লেখার তথ্যগুলো ছড়িয়ে দিতে পারলে হয়তো এই বুজরুকি থামানো যাবে এবং ভবিষ্যতেও এই ধরনের ফাঁদে মানুষ ভেবে চিন্তে পা দিবে।
সংযুক্তিঃ
১। বাংলাট্রিবিউনের নিউজটির ব্যাকআপ https://imgur.com/a/1o5yz এবং http://archive.is/3LT0I
২। The Organized Crime and Corruption Reporting Project (OCCRP) এর সাইটে একটি অনুসন্ধানী নিবন্ধের ব্যাকআপ http://archive.is/WBKJu এবং https://imgur.com/W8sfiL4
৩। রাগিব হাসানের পোস্টের ব্যাকআপ http://archive.is/uS6iK
লেখকঃ মোঃ নাযিবুল্লাহ
মন্তব্য
এডমিন কে অনুরোধ করছি এই লেখাটি যদি প্রকাশ করা হয়, তাহলে শিরোনামের ভুলটুকু শুধরে "চট্টগ্রাম ওয়াসা আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়ার নামে প্রতারিত হতে যাচ্ছে" করে দিতে।
ধন্যবাদ।
মোঃ নাযিবুল্লাহ
নতুন মন্তব্য করুন