[ধারাবাহিক উপন্যাস]
আকাশলীনা নিধি, নজরুল ইসলাম দেলগীর
১.
’আছে মুরগী, দেশি মুরগী, মুরগী নিবেন মুরগীইইইই’ বলে রাস্তায় ফেরিওয়ালা চেঁচাচ্ছে। সেই শব্দে জয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মুরগীওয়ালা রাস্তা দিয়ে এখনো ন্যাকা স্বরে ’আছে মুরগী, মুরগী নিবেন মুরগীইইইই’ বলে চেঁচাচ্ছে। জয়া বিরক্ত হয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে আবার ঘুমুতে নেয় আর তক্ষুণি তার মনে পড়ে যায়, ইশকুল!
জয়া ধড়ফড়িয়ে উঠে ঘড়ির দিকে তাকায় আর অবাক হয়ে যায়। অবিশ্বাসের সাথে দেখে সকাল ৮টা বাজে। সে চোখ কচলে আবার তাকায়, কিন্তু ঘড়ির তাতে কিছুই যায় আসে না, ঘড়িতে তখনো ৮টাই বাজে, কয়েক সেকেন্ড এগিয়ে গেছে বরঞ্চ। জয়া ভয় পেয়ে যায়, কষ্টও পায়, স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাবে? এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে না?
মন খারাপ করে জয়া বিছানা থেকে উঠলো। গোসলঘরে গেলো তৈরি হওয়ার জন্য। তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুয়ে, ইশকুল-পোশাক পরে বের হয়ে খাবার ঘরের দিকে গেলো, গিয়ে দেখে বাবা আর মা নাশতা খেতে বসে গিয়েছে তাকে রেখেই। সে তো অবাক! এরকম তো কখনো হয় না। মা তো নিজে ঘুম থেকে উঠার পরেই ’জয়া ওঠো জয়া ওঠো’ বলে চেঁচায়! আজ যে সে দেরি করে উঠলো, কিছু তো বললোই না, উল্টো তাকে রেখেই নাশতা খেতে বসে গেছে?
জয়া যখন এসব ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছে তখন জয়ার মা সোমা ঘুরে তাকিয়ে জয়াকে দেখে অবাক হয়। ’কী রে, তুই এতো সকাল সকাল? আর ইশকুলের পোশাক পরে আছিস কেন?’
এবার জয়ার অবাক হওয়ার পালা। ’উঠবো না? ইশকুল-পোশাক পরবো না? ইশকুলে যাবো না? কত্তো দেরি হয়ে গেছে! সাড়ে ৮টা বাজে!’
জয়ার বাবা আদনান তখন মজা করে বলে ’হ্যাঁ হ্যাঁ অনেক দেরি হয়ে গেছে তো, চলো চলো জয়াকে তাড়াতাড়ি ইশকুলে নিয়ে যাই!’
জয়া স্পষ্ট বুঝতে পারে যে বাবা মজা করছে তার সাথে। তা দেখে আরো অবাক হয়। তার ইশকুলে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে আর সবাই করছে মজা? আজব! তখন সোমা বলে ’হুহ্, যেদিন ইশকুল থাকে সেদিন মাইক দিয়ে ডেকেও বিছানা থেকে তোলা যায় না, আর আজ ইশকুল নেই, ফুলবাবু সেজে যাওয়ার জন্য তৈরি!’
তখন জয়ার মনে পড়লো, আরে তাই তো! আজ তো ছুটি! কালকেই বার্ষিক সমাপনী পরীক্ষা শেষ হলো মাত্র। জয়ার এবার একটু লজ্জা লজ্জা লাগলো আর নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগলো। বোকার মতো সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। আর তখন বাবা গান গেয়ে উঠলো, ’এলাটিং বেলাটিং টিং টিং টিং, ইশকুল নাই কোনো নাচো তাধিন।’
বলে আদনান জয়াকে কোলে করে চেয়ারে বসালো। তারপর তারা নাশতা খেলো। আর তারপর জয়ার বাবা মা দু’জনে বের হয়ে গেলো। সারাদিন তাদের অনেক অনেক কাজ আর ব্যস্ততা। সেই দৈনন্দিন জীবন। দুপুরবেলা খবর নেবে জয়া খেয়েছে কি না, বিশ্রাম নিয়ে তারপর পড়তে বলবে, আর বেশি টিভি দেখতে নিষেধ করবে। এতোদিনে জয়ার সব মুখস্ত হয়ে গেছে। সারাদিন তার সঙ্গী শুধু মায়া খালা, ঘরের কাজ যে দেখাশোনা করে।
জয়ার বয়স ১৩ বছর। একটা ইংরেজি মাধ্যম ইশকুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে, এবার সপ্তমে উঠবে। এমনিতে শুক্র শনিবারে ছুটির দিন থাকে তাতে জয়ার মন খারাপ হয় না। বরং পড়ার চাপ একটু কম থাকে বলে তার ভালোই লাগে। ঘরে বসে বসে অনেক শিল্পকর্ম করা যায়। কিন্তু আজ তার ভালো লাগছে না। কারন এখন টানা বেশ ক’দিন ছুটি। এই লম্বা ছুটিটা তার একা একা কাটাতে হবে? ঘরে বসে বসে? টিভি দেখে বই পড়ে আর মন খারাপ করে? বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে না? ধ্যাৎ
টিভি দেখে টেখে দুপুর পার করে দিলো, খেয়ে দেয়ে গেলো বাবার পড়ার ঘরে। সেখানে অনেক বই। তার জন্যও কিছু বই আলাদা করা আছে, ছোটদের বই সেগুলো। বেশিরভাগই তার ইতোমধ্যে পড়া শেষ। জয়ার সবচেয়ে ভালো লাগে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের লেখা কিশোর উপন্যাস পড়তে। অবশ্য সবগুলোই তার পড়া। লোকটা যে কেন প্রতিদিন একটা করে নতুন উপন্যাস লেখে না! এই অভিযোগ জানিয়ে মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে একটা চিঠিও লিখেছিলো জয়া। উত্তরে লিখেছে এবারের বইমেলায় জয়ার জন্য নতুন একটা উপন্যাস লিখবে। জয়া সেটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আর দেড়মাস পরেই বইমেলা, কী মজা কী মজা!
এসব ভাবতে ভাবতে জয়া বই দেখতে লাগলো। তার নিজের জন্য রাখা বইগুলো আজ কেন যেন পড়তে ইচ্ছে করছে না। সে বাবার বইয়ের দিকে গেলো। একটা তাকে অনেকগুলো বই রাখা, মুক্তিযুদ্ধের বই সব। বাবা এই বইগুলোই বেশি পড়ে আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প তাকে শোনায়। হঠাৎ তার মনে হলো, আচ্ছা কেমন হয় যদি আজ সে নিজেই এখান থেকে একটা বই পড়ে মুক্তিযুদ্ধের একটা গল্প রাতে বাবাকে শুনিয়ে দেয়? বাবা নিশ্চয়ই ভীষণ অবাক হবে, খুশিও হবে। জয়ার ভারি মজা লাগলো। আর জয়া তো আর ক’দিন পরেই সপ্তম শ্রেণীতে উঠবে! রীতিমতো বড় হয়ে গেছে। এখনো কি ছোটদের বই পড়লে চলে?
খুঁজতে খুঁজতে জয়া একটা বই পছন্দ করে ফেললো, ’মুক্তিযুদ্ধ ও আমার রেনু’, লেখকের নাম পলাশ হাসান। বইটার প্রচ্ছদে একটা ছোট বাচ্চা মেয়ের ছবি, জয়ার বয়সীই, আর সেই বাচ্চার হাতে একটা ছোট্ট পুতুল। এই প্রচ্ছদ দেখেই বইটা তার ভালো লেগে গেলো। মনে হলো এটা মুক্তিযুদ্ধের বই হলেও এখানে নিশ্চয়ই তার বয়সী কোনো বাচ্চা মেয়ের কথা আছে। তাই সে বইটি পড়তে নিলো।
শুয়ে শুয়ে জয়া বইটা পড়তে লাগলো আর কেবলই মন খারাপ হতে থাকলো। বইটা লিখেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা পলাশ হাসান। যুদ্ধের শেষদিকে তিনি গুলি খেয়েছিলেন, হাসপাতালে ছিলেন। হাসপাতালে শুয়ে বসেই তিনি এই বইটি লিখেছিলেন। বইটি পুরোপুরি শেষও করে যেতে পারেননি, আগেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিলো। বইতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা লিখেছেন। তাঁর একটা ছোট মেয়ে ছিলো, ১৩ বছর বয়স, নাম রেনু। একবার গ্রামের মেলা থেকে বাবা রেনুকে একটি ছোট্ট পুতুল কিনে দিয়েছিলেন। সামান্য একটা প্লাস্টিকের পুতুল। তখনো যুদ্ধ শুরু হয়নি, চারদিকে শুধু মিছিল আর মিছিল। রেনুর তখন সারাদিন এই পুতুলটার সঙ্গে কাটতো। তাকে খাওয়াতো, গোসল করাতো, তাকে নিয়ে ঘুরতে যেতো, গাছ চেনাতো, পাখি চেনাতো, বই পড়াতো, একসঙ্গে গল্প করতো, খেলতো। একটা মুহূর্তও পুতুলটাকে কাছ ছাড়া করতো না।
যুদ্ধ যখন শুরু হলো, একদিন পলাশ রাতের অন্ধকারে ছোট্ট মেয়ে রেনুর কপালে চুমু খেয়ে বিদায় নিয়ে যুদ্ধে চলে গিয়েছিলো। তারপর থেকে আর কোনোদিন রেনুর সঙ্গে দেখা হয়নি বাবার। যুদ্ধের শেষদিকে যখন তারা তাদের গ্রাম নরসিংদির গাছিয়া গ্রামে যায়, গিয়ে দেখে তাদের বাড়িঘর পাকিস্তানী সেনারা তছনছ করে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। গ্রামবাসীর কাছ থেকে জানতে পারে পাকিস্তানীরা তার স্ত্রী আর সন্তান রেনুকে মেরে ফেলেছে। মৃত্যুর সময়ও নাকি রেনু পুতুলটাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো, কিন্তু পাকিস্তানীরা তার কোল থেকে ছোঁ মেরে পুতুলটাকে ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো একটা গর্তে। তারপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলেছিলো রেনুর ছোট্ট শরীর আর মনটাকে।
এসব শুনে পলাশ হাসান যেন উন্মাদ হয়ে যায়। পাগলের মতো ছুটে যায় সহযোদ্ধাদের নিয়ে। সেদিনই পাকিস্তানী ক্যাম্পে হামলা করে আর রাইফেল নিয়ে একাই ঢুকে যায় বাঙ্কারে। সেই যুদ্ধে পলাশরা জিতে যায়, সবগুলো পাকিস্তানীকে তারা মেরে ফেলে। কিন্তু পলাশের মাথায়ও একটা গুলি লাগে। সৌভাগ্যক্রমে সে বেঁচে যায়। তাঁকে ভারতের হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই কিছুদিন পর তার মৃত্যু হয়।
ছোট্ট বইটা পড়তে পড়তে জয়ার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেলো, রেনুর জন্য মন খারাপ করে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছে তা সে বলতে পারবে না। হঠাৎ সে দেখে রেনুকে। রেনু যেন গাছিয়া গ্রামের তাদের বাড়ির উঠোনে বসে কাঁদছে আর জয়াকে বলছে ’জয়া জয়া, আমার পুতুলটাকে খুঁজে দাও না, দাও না!’
জয়ার ঘুম ভেঙে যায়। স্তব্ধ হয়ে সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বিছানায় এখনো বইটা রাখা। প্রচ্ছদে ছোট্ট একটা ফুটফুটে মেয়ের ছবি। জয়ার মনে হয় বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে রেনু তার দিকে তাকিয়ে আছে আর কাঁদছে আর বলছে ’জয়া জয়া, আমার পুতুলটাকে খুঁজে দাও না, দাও না!’
জয়া চারপাশে তাকিয়ে দেখলো, তার ঘরভর্তি অসংখ্য পুতুল। আত্মীয়রা, মা বাবার বন্ধুরা সবসময় তাকে অনেক পুতুল উপহার দেয়। ঘর ভরে গেছে পুতুলে। কিন্তু সেই দামী পুতুলগুলোর ভীড়ে কোথাও রেনুর সেই ছোট্ট পুতুলটা নেই। জয়ার মন খারাপ হয়। জয়ার কান্না পায়।
[চলবে]
মন্তব্য
স্যালুট, নিধি ও নজরুল।।।।
খুব সুন্দর।।। সবকিছু।।।
ধন্যবাদ
আকাশলীনা নিধি, নজরুল ইসলাম দেলগীর
চলুক লেখা। উৎসাহ বোধ করছি শুরুটা দেখে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ
আকাশলীনা নিধি, নজরুল ইসলাম দেলগীর
তারপর কী হল?
..................................................................
#Banshibir.
পরের পর্ব আসছে
আকাশলীনা নিধি, নজরুল ইসলাম দেলগীর
হ্যাঁ, তারপর কী হলো নিধি?
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
পরের পর্ব আসছে
আকাশলীনা নিধি, নজরুল ইসলাম দেলগীর
গল্পের ভেতরের গল্পটা মন খারাপের।
গল্পটা নিধিবুড়ি লিখছে, এটা দারুণ আনন্দের।
পরের লেখা আসুক জলদি জলদি
ধন্যবাদ
আকাশলীনা নিধি, নজরুল ইসলাম দেলগীর
আমাদের নিধি এবার উপন্যাস হাতে নিয়েছে বাপের সাথে!! অভিনন্দন!
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ
আকাশলীনা নিধি, নজরুল ইসলাম দেলগীর
ভালো লাগছে। সাগ্রহে অপেক্ষা করছি পরের পর্বের।
-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -
ধন্যবাদ। পরের পর্ব আসছে।
আকাশলীনা নিধি, নজরুল ইসলাম দেলগীর
চলুক।
(ছোট্ট নিধি আর ছোট্ট থাকছে না, বড় হয়ে যাচ্ছে। অনেক শুভেচ্ছা নিধিকে)।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ
আকাশলীনা নিধি, নজরুল ইসলাম দেলগীর
যখন অ্যানা ফ্র্যাঙ্ক এর ডায়েরী পড়েছিলাম, তখন আমি ঠিক জয়ার সমান। মনটা অনেকটা ভালো হলো যখন জানলাম রেনু ওর বাবা মা'র সাথে আছে। আর পুতুল খুঁজে পাওয়ার এই যাত্রায় সঙ্গে আছি।
--- জে এফ নুশান
নতুন মন্তব্য করুন