ভণিতা ১।।
অনুবাদে আমার দারুণ ভয়। একটা সময় তীব্র আনন্দ নিয়ে সেবার অনুবাদ পড়েছি, অপেক্ষায় থেকেছি কখন রিটার্ন অব শি কিংবা কাউন্ট অব মন্টিক্রিস্টো ছাপা হয়ে আমাদের পাড়ার সুমন ভাইয়ের দোকানে আসবে। পড়তে পড়তে ভাবতাম ইংরেজি পড়ার এবং সেইসাথে ইংরেজিতে লেখা বই কেনার মুরোদ হলে লেখাগুলো আবার পড়ে ফেলবো।
প্রথম ধাক্কাটা খাই জেরোম কে জেরোমের ‘থ্রি মেন অন এ বোট’ পড়তে গিয়ে। বই এর ব্যাপারে আমি অনেকটা বাংলা ছবির দর্শকদের মতো, আসলে পড়িনা- দেখি। এবং মুশকিলটা সেখানেই। পড়ছি জেরোমের লেখা কিন্তু চোখে ভাসছে এ টি এম শামসুজ্জামানের “ত্রিরত্নের নৌবিহার”। শামসুজ্জামানকে একই সাথে ধন্যবাদ এবং অভিশাপ এই চমৎকার অনুবাদকর্মটি উপহার দেবার জন্য।
বয়েস বেড়েছে, দীর্ঘদিন ইংরেজি কথাআলা দেশে থেকে থেকে ভাষাটায় বেশ সড়গড় হয়ে উঠেছি। তারচেয়েও বড় কথা, আমি জানতে পেরেছি পয়সা খরচ না করেও ইচ্ছে মতো বই পড়া যায়, এদেশের লাইব্রেরিগুলো দারুণ। ভিনভাষায় লেখা বইগুলোর বাংলা অনুবাদ আজকাল আর তাই পড়া হয় না। তবে এটা সেবার বইগুলোর ক্ষেত্রে সত্যি নয়। সেবার কিশোর ক্লাসিক, কিংবা অনুবাদ সিরিজের বইগুলোর বাংলা ছবিটাই রয়ে গিয়েছে আমার মনে। আমি ড্রাকুলার মূল বইটি কোন দিন পড়িনি, আঠারোবার লাইব্রেরি থেকে ধার করে এনেও শেষমেশ ইচ্ছে করেনি। আমার সৌভাগ্য যে বাবা মার চোখে সেবার বই ছিলো বইদের শহরে বখাটে ছেলেদের মতো। মন খুলে মেশার সুযোগটা হয়ে উঠেনি।
সেই আমি আজ ঠিক করলাম একটা লেখার অনুবাদ করবো, করেই ফেলবো। লিখতে গিয়ে টের পেলাম এটাকে ঠিক অনুবাদ বলা যাচ্ছে না। আমার সে ক্ষমতা নেই।
ভণিতা ২।।
বিশ্বকাপ ফুটবলের দ্বিতীয় সপ্তা চলছে এখন। শহর জুড়ে উন্মাদনা। বাড়ির ছাঁদ, গলির মোড়, চায়ের দোকান, ডাক-তার-টেলিযোগাযোগের খাম্বা- সব ছেয়ে আছে ভিন দেশের পতাকায়। সংবাদপত্রের কলামে, টেলিভিশনের টক শোয়ে, ড্রইং রুমের আড্ডায়, ফেসবুকের স্ট্যাটাসে ব্যাবচ্ছেদ চলছে পছন্দ-অপছন্দের তারকাদের সাফল্য-ব্যার্থতার।
আমি ফুটবলের খবর তেমন একটা রাখিনা। চার বছর পর পর বিশ্বকাপ আসে, সময় সুযোগ পেলে কয়েকটা খেলা দেখি, ওই পর্যন্তই। এবারও দেখছি, দেখতে দেখতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম।
আর্জেন্টিনা দলে কোন কালো মানুষ নেই। শুধু যে এবারের দলে নেই তা নয়। কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। না কোন খেলোয়াড়, না একজন কর্মী- কর্তা তো দুর অস্ত।
অথচ তাদের প্রবল প্রতিপক্ষ যে দল, সেই ব্রাজিলে রয়েছেন বেশ কয়েকজন। দুটো দেশই দক্ষিণ অ্যামেরিকায়, দুটোই পেরিয়ে এসেছে উপনিবেশিক শাসন, একটিতে রাজ করেছে পর্তুগাল, অন্যটিতে ছড়ি ঘুরিয়েছে স্পেন। দুটো দেশই গড়ে উঠেছে আফ্রিকা থেকে ধরে আনা কালো মানুষদের রক্ত আর ঘামে। যেমনটি গড়ে উঠেছে উত্তর, দক্ষিণ, আর মধ্য অ্যামেরিকার আর সব কটি দেশ। সময়ের পরিক্রমায় দাস প্রথার অবসান ঘটলেও দুর্ভাগা সে মানুষগুলোর উত্তর প্রজন্মের আর ফিরে যাওয়া হয়নি কিলিমাঞ্জেরোর কোলে। এখানেই থিতু হয়েছেন তাঁরা, বেড়ে উঠেছেন ভূমিপুত্র হয়ে। বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, নির্যাতন সয়ে তাঁরা টিকে রয়েছেন, বিকশিত হচ্ছেন দিন দিন। আনুপাতিক ভাবে কম হলেও তাঁদের উপস্থিতি এখন চোখে পড়ে সমাজের সর্বত্র। বিশেষ করে খেলার ভুবনে কালো মানুষদের পদচারনা রীতিমতো আশা জাগানিয়া।
কিন্তু আর্জেন্টিনা ব্যাতিক্রম কেন?
উইকিপিডিয়ায় ঢু মেরে আমি বেকুব হয়ে গেলাম। আর্জেন্টিনার জনসংখ্যার ৮৫ ভাগ সাদা, এগারো ভাগের ধমনিতে বইছে ইউরোপিয়ান এবং আদিবাসীদের মিশ্র রক্ত। এশিয়ানও আছে তিন শতাংশ। ছুটকা ছুটকা আরও কয়েক জাতির মানুষ থাকলেও কালোদের সংখ্যা শূন্য! উইকিপিডিয়ার তথ্যে বিশ্বাস করা মুশকিল সেটা জেনেই আরও খুঁজলাম আঁতিপাঁতি করে। খুব একটা ভুল বলেনি উইকি। কালো যে একেবারেই নেই তা নয়। লাখখানেক আছে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দেশ জুড়ে, শতাংশের হিসেবে ওই শুন্যই।
খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম একটা লেখা। লেখকের নাম হেনরি লুইস গেইটস জুনিয়র। ভদ্রলোক হার্ভার্ডের অধ্যাপক। লেখার শেষে পরিচিতি পড়ে বুঝলাম বেশ নামডাক আছে তাঁর। কী পেলাম সেই লেখায়?
তারা এসেছিলো দলে দলে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে।।
প্রায় পাঁচশ বছর আগে, ১৫৮৭ সালের কোন এক দিনে আফ্রিকান ক্রীতদাসদের প্রথম চালানটি এসে পৌছয় বুয়েন্স আইরেসে। চালান বলতে বলতে খারাপ লাগছে, কিন্তু ইতিহাসকে অস্বীকার করি কী করে? ক্রীতদাসেরা তো আর মানুষ ছিলো না, আর দশটা পণ্যের মতোই দেখা হতো তাদের। পরবর্তী ষাট বছর বুয়েন্স আইরেসের প্রধান বাণিজ্য ছিলো দাস ব্যাবসা। যা কিছু আমদানি হতো তাঁর সত্তুর ভাগেরও বেশি ছিলো ক্রীতদাস, আনা হতো ব্রাজিল থেকে। ব্রাজিল তখন পর্তুগীজদের উপনিবেশ। পর্তুগীজ বনিকেরা অ্যাঙ্গোলা এবং পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে হানা দিয়ে জাহাজের খোল বোঝাই করে নিয়ে আসতো সেই সব হতভাগ্য মানুষদের।
বুয়েন্স আইরেস ছিলো মূলত একটা জংশন। সেখান থেকে কালো মানুষদের পাঠানো হতো পেরু, চিলি, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া সহ দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন জনপদে। শুধু যে পর্তুগীজরাই ছিলো এ ব্যাবসায় তা নয়। ফরাসি এবং ব্রিটিশরাও রাঙিয়ে নিয়েছে হাত।
ঠিক কতোজন কালো মানুষকে চালান দেয়া হয়েছিলো এই বাণিজ্যপথে তার সঠিক হিসেব না পাওয়া গেলেও বিভিন্ন দলিল দস্তাবেজ থেকে ধারণা করা যায় যে সংখ্যাটা বিশাল।
আঠারো শতকের শেষের দিকের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় আর্জেন্টিনার গ্রামগঞ্জের পঞ্চাশ ভাগ মানুষই ছিলো কালো, বুয়েন্স আইরেসের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ত্রিশ থেকে চল্লিশ, সাদা এবং কালোর সংমিশ্রণে জন্ম নেয়া মুলাটোরাও ছিলো এই দলে।
বুয়েন্স আইরেসের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমৃদ্ধির মূলে রয়েছে এই দাসের মিছিল। আজকের আর্জেন্টাইনদের অনেকেই এটা জানে না, মানে না। এদের ধারণা, দেশটা কোন এক অলৌকিক উপায়ে দাস ব্যাবসার ঘৃণিত ছোঁয়াচ থেকে বেঁচে গিয়েছিলো।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এতো এতো মানুষ হারালো কোথায়!
আমাদের ফিরে যেতে হবে আর্জেন্টিনার স্বাধীনতা সংগ্রামে। ১৮১০ থেকে ১৮১৬, এই ছয় বছর ধরে আর্জেন্টাইনরা লড়ছিলো স্পেনের বিরুদ্ধে। ১৮১৩ সালে প্রদেশগুলোর সম্মিলিত নেতৃত্ব আনুষ্ঠানিক ভাবে দাস আমদানি নিষিদ্ধ করেন। দেশের ভেতরে থাকা দাসদের বাধ্যতামূলক ভাবে জুড়ে দেওয়া হয় লিবারেশন আর্মির অধিনায়ক জেনারেল স্যান মার্টিনের বাহিনীতে। তারপরও আড়ালে আবডালে দাস বাণিজ্য চলছিলো যার অবসান ঘটে ১৮৪০শে, ব্রিটেনের সাথে চুক্তির মাধ্যমে। শেষমেষ ১৮৫৩ তে এসে অবসান ঘটে আর্জেন্টিনার দাসপ্রথার। আর ঠিক তারপর থেকেই শুরু বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে মুছে ফেলার প্রক্রিয়া।
--চলবে (অভিজ্ঞতা থেকে জানি লোকে দীর্ঘ লেখা এড়িয়ে চলেন। নীড়পাতা থেকে সরে গেলেই পরের পর্ব)
মন্তব্য
মিচ্কা স্লেভ-ট্রেডার?
নাকি গডফাদারের ডন মাইকেল কর্লিয়নির মতো, যে পুরনো পাপের সব দৃশ্যমান চিহ্ন মুছে ফেলে, ভুলিয়ে দিয়ে, পারলে মাথার উপর সেইন্টলি হেলো লাগিয়ে আধুনিক দুনিয়ায় নতুন করে 'ভদ্দরনোক' সেজে বসতে চায় - ঐ পাপজাত যাবতীয় লাভজনক উত্তরাধিকারের বিন্দুমাত্র বিসর্জন না দিয়ে ও আত্নসাৎ করে, কিন্তু বর্তমানে অলাভজনকগুলি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে? নাকি "সিভিলাইজ্ড ওয়ার্ল্ড" নামক ভোল-পালটানো আন্তর্জাতিক নব্য-মাফিয়ার উত্তরাধুনিক সভ্য সদস্যপদের প্রার্থী?
****************************************
সবগুলোই প্রযোজ্য।
---মোখলেস হোসেন
এই পোস্টটা পড়তে পড়তে বহু কাল আগে পড়া ইসাবেল আযেন্দের করা একটা মন্তব্য কথা মনে পড়লো। তাঁর কোন বইয়ে সেটা ছিল তা আজ আর আমার মনে নেই। মন্তব্যটা মোটামুটি এমন ছিল — লাতিন আমেরিকাতে আর্জেন্টাইনরা নিজেদেরকে তাদের প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোর মানুষদের চেয়ে বেশি ‘সাদা’ মনে করে; এবং এটা নিয়ে তাদের মধ্যে একপ্রকার উন্নাসিকতা কাজ করে।
শাখাপ্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ইসাবেল আযেন্দের ‘My Invented Country’ বইটি থেকে তিনটি অংশ বঙ্গানুবাদ না করেই দিলামঃ
----------------------------------------
“African blood was never incorporated into Chilean stock, which would have given us rhythm and beauty; neither was there, as there was in Argentina, significant Italian immigration, which would have made us extroverted, vain, and happy; there weren’t even enough Asians, as there were in Peru, to compensate for our solemnity and spice up our cuisine.”
----------------------------------------
“Just as in the rest of Latin America, the upper class of Chile is relatively white, and the farther one descends the steep social ladder the more Indian the characteristics become. Nevertheless, lacking other points of comparison, most of us consider ourselves white. It was a surprise for me to discover that in the United States I am a “person of color.” (Once, when I was filling out a form, I opened my blouse to show my skin color to an Afro-American INS officer who was intent on placing me in the last racial category on his list: “Other.” He didn’t seem to think it was funny.)”
----------------------------------------
“In the United States, in contrast, the past doesn’t matter; no one asks your last name; the son of a murderer can be president . . . as long as he’s white.”
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বইটি পড়া হয়নি। সময় পেলে পড়বো।
---মোখলেস হোসেন
ভাল। কিন্তু আমেরিকার দাসরা কিলিমাঞ্জেরোর কোলে ফিরবে কেন? আমেরিকায় সাপ্লাই দেওয়ার জন্য দাস যোগাড় করা হতো পশ্চিম আফ্রিকার আটলান্টিক উপকুলের দাস-বাজার থেকে। কিলিমাঞ্জেরোর কোলে যারা থাকতো তাদের দাস হিসাবে সাপ্লাই দিতে গেলে সবচে কাছের বন্দর মোম্বাসা, এখান থেকে দাস যেতো আরবে। আপনি আমেরিকার দাসদের কোনো পাহাড়ের কোলে ফিরত পাঠাতে চাইলে পশ্চিম আফ্রিকার কিছু পাহাড়ের নাম যোগাড় করে লিখেন।
আমার ভূগোল জ্ঞান লালমোহন গাঙ্গুলির মতো। আবেগটাও তাঁরই মতোন। লিখে ফেলেছি হাউশ করে।
---মোখলেস হোসেন
সাগ্রহ অপেক্ষায় থাকলাম।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ এক লহমা
---মোখলেস হোসেন
অনুবাদটা কি কোন গল্প? নাকি ইতিহাস ভিত্তিক প্রবন্ধ? ভনিতার পর্বগুলো শেষ করে আসল রচনা পর্যন্ত লেখা যাবেতো, নাকি আবার প্রজেক্টআইবেক এর পরের পর্ব এসে পড়বে হুট করে। ভাবছি মোখলেস হোসেনের অসমাপ্ত রচনাবলী সমগ্র সম্পাদনা করবো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
হা হা হা। না এটা শেষ কড়াই আছে সোহেল ইমাম। গল্প নয়, ছোটখাটো একটা প্রবন্ধ।
---মোখলেস হোসেন
এ্যাপেটাইজারের কোয়ালিটি ভাল, কিন্তু কোয়ানটিটি একেবারেই যৎসামান্য। রেজাল্ট বলাবাহুল্য একই রকম, অতৃপ্তিকর!
ধন্যবাদ আবদুল্লাহ এ. এম. এর আগে অনেকবার আন্ট্রে পরিবেশন করে ধরা খেয়েছি। এবার তাই অ্যাপেটাইজারেই ক্ষান্ত দিলাম।
---মোখলেস হোসেন
পরের পর্ব 'কড়াই'তে না পড়ে, আমাদের পাতে পড়ুক। ঠিক কিনা ভ্রাত!
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
-তারেক সিফাত
নতুন মন্তব্য করুন