আমি অনেক রাত জাগি। রাত জেগে যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করি তা না। ইন্টারনেটে ঘোরাঘুরি করি, মুভি দেখি কি়ংবা বই পড়ি। খাজুইরা কাজ আর কি। ফলাফল – সকালে মাথা ব্যাথা নিয়ে ঘুম থেকে উঠা। সকাল নয়টাতে অফিস। আটটার মধ্যে বাসা থেকে বের হতে হয়। ছেলেদেরকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে বাস ধরে অফিসে যাওয়া। আমার স্ত্রীর সকাল শুরু হয় অন্ধকার থাকতে থাকতে। সকালের নাস্তা আর আমাদের দুপুরের টিফিন রেডি করে যখন সে আমাদেরকে ডাকে তখন সকাল সাতটা। আমি আরও মিনিট দশেক বিছানাতে মোড়ামুড়ি করি। এর মধ্যে সে ছেলেদেরকে উঠিয়ে স্কুলের জন্যে রেডি করে দেয়। আমি বিরস মুখে চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা থেকে উঠি। আমি আবার সকালে হাতে বানানো রুটি আর আলুভাজি ছাড়া নাস্তা করতে পারিনা। সাথে ডিম ভাজা। নাস্তা করে আরেকটু ঘুমাতে পারলাম না বলে গজগজ করতে করতে বাসা থেকে বের হই।
সেদিন একটু সকালেই আমার স্ত্রী আমাকে ডাকাডাকি শুরু করল। কোন একটা বিষয় নিয়ে সে বেশ উত্তেজিত। ঘুমের ঘোরে মনে হল সে হাঁস নিয়ে কিছু একটা বলছে। দুনিয়ার কোন কিছুই আমার সকালের ঘুমের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ না। কাজেই আমি কম্বল দিয়ে মাথা আরও ভালো ভাবে ঢেকে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখলাম একটা বড়সড় হাঁস আমার মাথার পাশে বসে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলছে, ‘এতো ঘুমাস ক্যান?’ বলেই হাঁসটা গলা ফুলিয়ে কপালের উপর একটা ঠোকর দিল। আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। দেখি আমার ছোট ছেলে আমার কপালে টোকা দিচ্ছে। আমাকে উঠতে দেখে সে হড়বড় করে বলল, “বাবা, আমাদের পেছনের উঠানে একটা হাঁস এসেছে!”
- “কি এসেছে?”
- “হাঁস। মা রুটি দিয়েছে খেতে। কেমন কপকপ করে খাচ্ছে।”
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। পাগল ছাগলের দেশ। মানুষের চাইতে জন্তু জানোয়ার নিয়ে লাফালাফি বেশী করে। কাজেই এদেশে কারও বাগানে হাঁস আসা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এইটা নিয়ে এতো আহ্লাদ করার কি দরকার? আমি আমার স্ত্রীকে কঠিন গলাতে বললাম, “ঘটনা কি?”
- “ঘটনা ভয়াবহ। ভোরবেলায় রান্নাঘরে কাজ করছি। মনে হল উঠানে কি যেন প্যাঁক প্যাঁক শব্দ করছে। পেছনের দরজা খুলতেই দেখি একটা হাঁস বাগানে হাঁটাহাঁটি করছে। আমাকে দরজা খুলতে দেখে হেলতে দুলতে আমার কাছে আসলো। একটুও ভয় পেল না!”
- “এখানকার হাঁস, পাখীরা মানুষকে ভয় পায়না। এদেরকে মারা যাবেনা, আইন খুব কঠিন”।
- “খুব ভালো আইন।”
- “হাঁসকে খাবার দিয়েছ কেন?”
- “দেখে খুব মায়া লাগল।”
- “সবকিছুতে এতো মায়া লাগে কেন? এখন খাবারের জন্য প্রতিদিন আসবে। যন্ত্রণা করে মারবে।”
- “যন্ত্রণা করুক। আমি এই হাঁস পুষবো।”
আমি বিরক্ত গলায় বললাম, “এইসব ঝামেলা করবেনা। এর চাইতে ধরে খেয়ে ফেললেই হয়। বেশ মোটা তাজাই তো মনে হচ্ছে”। আমার স্ত্রী আঁতকে উঠল, “খবরদার, আমার হাঁসের দিকে ওভাবে তাকাবে না”। আমি মনে মনে ভাবলাম, এখনি ‘আমার হাঁস’ হয়ে গেলো? এই জিনিষ অনেক ভোগাবে! আমার স্ত্রী কেমন মায়া মায়া গলাতে বলল, “এইটা মেয়ে হাঁস। আর কয়েকদিনের মধ্যে ডিম পাড়া শুরু করবে।”
- “তুমি কিভাবে জানলে?”
- “আমাদের বাড়ীতে ছোট বেলাতে হাঁস পুষতাম।”
- “ও আচ্ছা।”
এর মধ্যে কয়েক মাস পার হয়ে গেছে। হাঁসটা প্রায় প্রতিদিন ভোর বেলাতে আসে, খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ বাগানে হাঁটাহাঁটি করে, তারপর চলে যায়। একদিন আমার স্ত্রী খুব আনন্দিত গলাতে আমাকে বলল, “জানো, ফুলির পাঁচটা বাচ্চা হয়েছে?” আমি হতবাক গলাতে বললাম, “কার বাচ্চা হয়েছে?”
- “ফুলির বাচ্চা হয়েছে”
- “ফুলি কে? আর একসাথে পাঁচটা বাচ্চা হল কিভাবে?”
- “আরে ফুলি হল আমাদের হাঁসটার নাম।”
- “ও আচ্ছা। তো বাচ্চা পাঁচটার নামও কি রাখা হয়ে গেছে।”
- “না রাখিনি এখনো। এতগুলো বাচ্চার নাম! মুশকিল হয়ে গেলো। কি নাম রাখা যায় বলত?”
আমি অবাক হয়ে আমার স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। সে হাঁসের বাচ্চাদের নাম রাখার জন্য উৎসাহে টগবগ করছে। আমিও উৎসাহ দেখিয়ে বললাম, “মায়ের সাথে মিলিয়ে রাখা যেতে পারে। যেমন ছেলে হলে মদন বিন ফুলি, মেয়ে হলে সায়মা বিনতে ফুলি।” আমার স্ত্রী আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। বলে, “তুমি ঠাট্টা করছ, তাই না? তুমি আমার ফুলিকে নিয়ে মশকারি করবে না।”
আমাদের পেছনের বাগানের বেড়ার ওপাশে বেশ কিছু ঝোপঝাড় আছে। হাঁসটা মনে হয় ওখানেই তার সংসার পেতেছে। বাচ্চা নিয়ে সে বেড়া টপকে আমাদের পেছনের বাগানে আসতে পারে না। কিন্তু সে তার বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের সামনের বাগানে আসে। মাঝে মাঝে রাস্তা পার হয়ে ওপাশের ওল্ড হোমের বাগানে চলে যায়। দৃশ্যটা খুব সুন্দর। ফুলি হেলতে দুলতে হাঁটছে, আর তার পিছনে পাঁচ পাঁচটা তুলতুলে হাঁসের বাচ্চা যাচ্ছে। যখন তারা রাস্তা পার হয় তখন আমার স্ত্রীও তাদের পাশে পাশে হেঁটে রাস্তা পার হয়, যাতে কোন গাড়ী ভুল করে চাপা না দিয়ে দেয়। অবশ্য এই রাস্তাটা ভিতরের দিকের রাস্তা, তাই গাড়ী চলাচল কম।
আমাদের বাসাটা দুইটা রাস্তার কর্নারে। একটা ভিতরের দিকে, আর একটা সেইন্ট বার্নারডস রোড। সেইন্ট বার্নারডস খুব ব্যস্ত রাস্তা, দিনরাত গাড়ী চলে। সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পেছনের বাগানে কাজ করছি। হঠাৎ আমার বড় ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আতঙ্কিত গলাতে বলল, “বাবা, মা মেইন রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।” আমি পড়িমরি করে ছুটে গেলাম। গিয়ে দেখি এক অভাবিত দৃশ্য। আমার স্ত্রী রাস্তার মাঝখানে ট্রাফিক পুলিশের মতো করে দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে, আর ফুলি তার বাচ্চাদেরকে নিয়ে হেলতে দুলতে রাস্তা পার হচ্ছে। আমার স্ত্রীর দুই পাশে গাড়ীর বিশাল লাইন দাঁড়িয়ে গেছে। গাড়ী থেকে মানুষজন মাথা বের করে অবাক হয়ে দেখছে। হাঁসটা আস্তে আস্তে রাস্তা পার হয়ে গেলো। আমার স্ত্রীও রাস্তার মধ্যে থেকে হেঁটে হেঁটে লজ্জিত মুখে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম যে গাড়ীগুলো থেকে একে একে সবাই বের হয়ে আসল আর হাততালি দিতে লাগল। আর আমার আটপৌরে স্ত্রী আমার হাত শক্ত করে ধরে মলিন ওড়না দিয়ে তার বিব্রত মুখটা লুকানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে লাগল।
সারোয়ার জাহান
রস্ট্রেভোর, অ্যাডিলেইড
মন্তব্য
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
দারুণ গল্প!
______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন
সিল্ক কটন
লেখা ভালো লেগেছে সারোয়ার জাহান।
---মোখলেস হোসেন
বাঃ! মন ভালো করে দেওয়া গল্প।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আপনাকে এখানে লিখতে দেখে ভালো লাগছে, লিখন ভাই। আশা করি নিয়মিত লিখবেন।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ভাল মানুষের দাম নাই না হলে ভাল বৌডারে এভাবে আটপৌড়ে বলে। আপনার লেখা পড়ে ভাল লাগলো।
আমাদের বাসায়ও একজন আছেন বেশ আটপৌরে।
সারাদিন বাসায় থেকে সবার দায়িত্ব নিয়ে আছেন। কোনদিন কাউকে "না" বলেন না। সারাদিন বাসায় থেকে বিরক্ত হলেও কোন অভিযোগ নাই তার। মাঝে মাঝে খেয়েদেয়ে ফুল হয়ে গেলে আমি বলি যাও না একটু বাহিরে গিয়ে হালকা হয়ে আসো। কিন্তু না সে একা একা কোথাও যায় না, হয় আমাকে না হয় আমার বউকে তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে হয়। খুব লক্ষ্মী সে।
সে আর কেউ না, সে আমাদের বাসার ডাস্টবিন।
যাই হোক, পাতাটার নাম সচলায়তন। অচলদের গল্প না লিখে সচলদের সামনে আনুন।
- তালুকদারবাড়ির ছেলে।
"পদাঘাতে ধসিয়ে দিবো নারীর প্রতি অবিচার, নারীর চেয়ে পৃথিবীতে হয়নি কেহ মহীয়ান"
তালুকদার বাড়ির ছেলে, পাতাটার নাম সচলায়তন, এখানে সচল-হাচল-অচল (অতিথি) সবার লেখা যেমন প্রকাশিত হয় তেমন নড়নক্ষম-অনড়নক্ষমদের কথাও প্রকাশিত হয়। আপনি গল্পটা মন্তব্যে না দিয়ে পোস্ট আকারে দিতে পারতেন।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভালো লেগেছে।
বেশ। চালিয়ে যান সারোয়ার জাহান ...
নতুন মন্তব্য করুন