ছয়।।
কটেজের ভেতরে ঢুকে মন ভরে গিয়েছে মিরাজের। অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ চারিদিকে। আলো আঁধারিতে যতটুকু চোখে পড়ে তাতে বোঝা যায় বিশাল একটা ঘরের সীমান্তে দাঁড়িয়ে সে। এটি সম্ভবত বসবার ঘর। ঘরের একটা অংশের উপরটা খোলা, উঠে গিয়েছে অনেক উঁচুতে, কটেজের ছাঁদ বরাবর। আরেকটা অংশে, হাত দশেক উচ্চতায় যেন ঝুলে রয়েছে শোবার ঘরগুলো।
দু অংশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে বেশ মোটাসোটা একটা পিলার।
বসবার ঘরের খোলা দিকটায় ছোট্ট একটি ফায়ারপ্লেস, পাশেই প্রমাণ সাইজের একটা ভালুকের মূর্তি। সে মূর্তির প্রসারিত হাতে ধিকিধিকি জ্বলছে তেলের প্রদীপ, কোন এক ফাঁকে এসে জ্বালিয়ে গিয়েছেন ইকবাল সাহেব। গন্ধটা ওই প্রদীপ থেকেই আসছে।
রাতিয়ানের পানিতে ঘুরপাক খেতে খেতে মিরাজের এক আধবার মনে হয়েছিলো নিশ্চয়ই আরেকটা পথ আছে এখানে আসার। ধারানাটা তাহলে মিথ্যে নয়! শুধু শুধু ঘোরালেন ভদ্রলোক। সে যাকগে, এখন প্রয়োজন এক কাপ কফি। কিন্তু রান্নাঘরটা কোথায়?
প্রদীপ হাতে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মিরাজ টের পেলো পিলারটা অন্যরকম। রীতিমতো আস্ত একটি গাছের গুঁড়ি কুঁদে বানানো, নিচ থেকে উপর অবধি খোদাই করা অপূর্ব সব নক্সা। একটু ভাবতেই নামটা মনে পড়লো মিরাজের, টোটেম পোল। রয়্যাল অন্টারিও মিউজিয়ামে একটা দেখেছিলো সে। উত্তর অ্যামেরিকার প্রথম মানুষেরা তাদের ইতিহাস, তাদের গল্প, তাদের সুখ-দুঃখ বুনে রাখতো এই সব পিলারে।
টোটেম পোলের গা ঘেঁষে খাড়া একটা সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলার দিকে। পা রাখতেই যেন ককিয়ে উঠলো ধাপগুলো। কাঠের বাড়িতে নানা রকম শব্দ হয় বটে, কিন্তু শহরের হট্টগোলে সে সব শব্দ তেমন একটা ভাবায় না। কিন্তু এখানে, প্রায় দ্বীপমতো এই ভূখণ্ডের এক কোনে, রোদ-বৃষ্টি-তুষারে দাঁড়িয়ে থেকে বুড়িয়ে আসা সিডার কাঠের এই বাড়িটার শব্দ গুলো যেন জীবন্ত। কী যেন একটা লুকিয়ে রয়েছে অবোধ্য সেই ভাষায়। হয়তো টোটেম পোলের গল্পটাই!
দিনের বেলা হলে ভাবনাটাকে বেশ রোমান্টিক মনে হতো। কিন্তু এখন নিশুতি রাত। ভুতে বিশ্বাস না থাকলেও অদ্ভুতকে তো আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না! কেন যেন মনে হচ্ছে ঘরের চেয়ে জঙ্গলই ভালো ছিলো। তাঁবু খাঁটিয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর বেশ গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা যেতো। তাঁবুর বাইরে জ্বলতে থাকা আগুনের পট পট শব্দে ঘুমটাও হতো খাসা। এই বিশাল বাড়িতে নিজেকে ভীষণ ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে মিরাজের।
একটু বেশি আলো, আর খানিকটা উত্তাপের জন্য কখনও এমন হাহাকার অনুভব করেনি সে। ফায়ারপ্লেসটা জ্বালানো যাক।
ফায়ারপ্লেসের ভেতরে আধপোড়া কয়েকটি কাঠের টুকরো। দেখেই বোঝা যায় খুব একটা পুরনো নয়। ইকবাল সাহেব বলেছিলেন কটেজটায় কেউ থাকেনা। মিরাজের মতোই কোন অতিথি এসছিলো হয়তো! অতিথি শব্দটা এতো বেমানান লাগছে!
ফায়ার প্লেসের বামদিকেই শুকনো কাঠের টুকরো গুলো রাখা। কিন্তু এগুলো জ্বলবে কী! প্রদীপটা রয়েছে, একটা ছোটো লাইটারও আছে প্যান্টের পকেটে, কিন্তু আগুন ধরিয়ে সেটাকে জাগিয়ে তলার জন্য চাই বাতাস। ফায়ারপ্লেসে বাতাস ঢোকানোর জন্য হাঁপর টাইপের কিছু একটা থাকার কথা। নিদেন পক্ষে লোহা রাবার কিংবা প্লাস্টিকের একটা পাইপ। নাহয় ফুঁ দিয়েই চেষ্টা করা যেতো।
হাপরের চিন্তা আপাতত স্থগিত রেখে মিরাজ পড়েছে কাঠ নিয়ে। বেশ যত্ন নিয়ে টুকরোগুলোকে একটা আরেকটার উপর আড়াআড়ি রেখে ছোট্ট একটা স্তূপ বানিয়েছে সে। স্তূপটা দেখতে হয়েছে অনেকটা পিরামিডের মতো। হাতের লাইটারটা জ্বালিয়ে একটা কাঠে ছুঁয়েছে কি ছোঁয়নি মিরাজ, দাও দাও করে আগুন জ্বলে উঠলো পিরামিডে।
চমকে পেছন দিকে সরে আসতেই পায়ে বেঁধে আছড়ে পড়লো কিছু একটা। ঝনঝন শব্দে কেঁপে উঠেছে চারিদিক। তিনফুট লম্বা একটা পাইপ, ঢালাই লোহার। ভাগ্যিস মাথায় পড়েনি।
ফায়ারপ্লেসের ভেতর থেকে মৃদু একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে। সেই সাথে অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ। কাঠের টুকরো গুলো সুগন্ধি কোন তেলে ভিজিয়ে শুকিয়ে রাখা, প্রদীপের সেই তেলটা।
আনোয়েতিন ঘুমিয়ে ছিলেন। নাকি জেগে ছিলেন তাঁর সমাধির তলায়! নাকি যেভাবে ঘুম এবং নাঘুমের মাঝামাঝি কেটে গিয়েছে বছরের পর বছর, আঠাশে জুলাই থেকে সাতাশে জুলাই, সেই অমোঘ তন্দ্রায় তলিয়ে ছিলো তাঁর দেহ মন? কিছুক্ষণ বসে বসে ভাবলেন, তারপর হাতড়ে হাতড়ে বাড়িয়ে বাইসনের চামড়া কেটে বানানো হিসেবের খাতাটা খুঁজে মিরাজের টিপ সই আলা কাগজটা সেঁটে দিলেন তিনি। গন্ধটা এসেছে। নিশ্ছিদ্র আঁধারে বসে বসে ভাবছেন ৯২ কার্লাইল পার্কের বাড়িটার কথা। সে বাড়ির আকাশ ছোঁয়া চিমনি দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া উঠছে নিশ্চয়ই! মাকালেমিকেবের আবির্ভাবের আর বেশি দেরি নেই।
সাত।।
নিবুত জানেও না সে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো। নাহয় বয়সটা তার পক্ষে নেই, তবুও একটুখানি আরাম পেতেই টুপ করে এভাবে ঘুমিয়ে যাওয়া ঠিক হয়নি। আরও ঠিক হয়নি মরে কাঠ হয়ে যাওয়া হাঁসটার উপর ভর করা। ওসব ছেলে ছোকরাদের কাজ, যখন সদ্য ফেলে আসা শরীরটার জন্য একটা হাহাকার থাকে মনে। সেই সব তৃষিত আত্মাদের কোন বাছ বিচার নেই, মানুষ হোক পশু হোক, জ্যান্ত কি মৃত, একটা কিছু তাদের হলেই হলো। তবে মৃতদেহের সীমাবদ্ধতা অনেক। বুদ্ধিমানেরা তাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। চাই ঘুটঘুটে আঁধার, কিংবা বিষণ্ণ দুপুর, আর পথ ভুলে বেরিয়ে আসা একলা একটি মানুষ। ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেলো মারভিনদের বাচ্চাটার কথা।
অ্যালেক্স তখন হাঁটতে শিখেছে কেবল, একপা দুপা করে সামনে এগোয়, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, উঠে দাঁড়িয়ে আবার হাঁটে। নিবুতও অনেকটা তাই। জমাট বাঁধা একটা ছায়া মাত্র। চলতে ফিরতে সেকি কষ্ট তার! বাচ্চাটা সেদিন একলা একলা বেরিয়ে এসেছিলো উঠোনে। ওইটুকু আত্মার কী ভয়ানক শক্তি! নিবুতের অনেকক্ষণ লেগেছিলো শরীরের দখল নিতে। অ্যালেক্সের একরত্তি সেই আত্মা অনেকদিন পর্যন্ত ওর পেছন পেছন ঘুরতো। কাঁদতো ভারি! কে জানে কোথায় আছে এখন! ভর করেছে কোন সে দেহে?
নাহ, দেড় ফুটি এই শরীরটা নিয়ে তার কোন অভিযোগ নেই। কেবল ঝাপসা হয়ে আসা চোখ দুটোই যা একটু ভোগায় আজকাল।
মাকালেমিকেবের কাছে এক জোড়া চোখ চাইবে সে, শিশিরের মতো টলমলে, আর রাতিয়ানের পানির মতো সবুজ একজোড়া চোখ! তিনি চাইলে কীই না পারেন!
কে জানে কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে! যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে পড়া দরকার। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কায়দা কানুন গুলো মৃতদেহে ওভাবে কাজ করেনা। তুড়ি বাজিয়ে লাভ নেই। একমাত্র উপায় যেদিক দিয়ে এসেছে সেদিক দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া। কিন্তু নাকের ফুটো দুটো কোথায়? ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে ঢুকে কোন ঘুপচিতে এসে যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো কিছুতেই আর মনে পড়ছে না। চারিদিকে অসংখ্য গলি, অনেক রাস্তা, কোনটার জায়গায় জায়গায় জমে রয়েছে থকথকে তরল। পা ফেলাই দায়! অথচ সময় বয়ে যাচ্ছে দ্রুত। অ্যালেক্সের শরীরটা পড়ে রয়েছে রাতিয়ানের পাড়ে। কে আবার দখল নিয়ে নেয়!
একটা গলি ধরে কিছু দুর এগিয়ে ঠিক যেখান থেকে শুরু করেছিলো সেখানেই ফিরে এলো নিবুত। তারপর আরেক বার, আবার এবং পুনর্বার- বারংবার। হাঁসের শরীরটা যেন এক গোলোক ধাঁধা, রীতিমতো হাঁসফাঁস লাগছে!
দুপায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে কত টুকু মাটি লাগে একটা হাঁসের! পাঁচ, সাত, দশ ইঞ্চি! সেই হাঁসটাকেই গোর দিতে খুঁড়তে হয়েছে দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে দুই দুগুণে চার ফুট, গভীরতায় আরও এক। কিন্তু তাতে হাঁসের কোন হেলদোল নেই। যতো ভাবনা মিরাজের। পাথুরে মাটিতে লোহার পাইপ দিয়ে গর্ত খোঁড়া কি সহজ কাজ!
কাজটা সে কেন যে করেছে তার কোন ব্যাখ্যা নেই। নাকি আছে! হয়তো মিরাজের মনে হয়েছিলো হাঁসটাকে মাটির কাছে পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন। কে জানে কতো শত মাইল উড়েছিলো সেই হাঁস ক্লান্ত ডানায়! একটা কোন গন্তব্য ছিলো নিশ্চয়ই! দীর্ঘ যাত্রা শেষে পরম আরাধ্য এক ডাঙা।
বিচ্ছিরি একটা শূন্যতা, একটা অবসন্নতা পেয়ে বসেছে মিরাজকে। কটেজে ফিরে আরেক মগ কাফি খাবে কি? নাহ, শুধু শুধু ঘুম নষ্ট। এখন সময়ে বিশ্রামের।
চাঁদের আলোয় বেশ হাঁটছিলো মিরাজ। হঠাৎ খটকা লাগলো। ও কিসের শব্দ! খুব হালকা, খসখসে একটা আওয়াজ। শব্দটা এসেছে রাতিয়ানের দিক থেকে। ভালুক নাকি? কিন্তু অন্টারিওর এই দিকটায় তো ভালুক থাকার কথা নয়! অবশ্য নিশ্চিত বলা যায়না। কিছুদিন পর শীত নেমে আসবে, জন্তু জানোয়ারেরা এখন সরে যাচ্ছে দক্ষিণে। এক দুটো ভালুক এদিকে চলে আসা বিচিত্র নয়। এই দেশে বাঘ নেই সিংহ নেই, নেই চিতা কিংবা হায়েনা। এখানে জঙ্গলে রাজত্ব করে ভালুক। সার্কাস কিংবা চিড়িয়াখানায় দেখা আদুরে আদুরে ভালুক নয়, রীতিমতো রক্ত হিম করে দেওয়া বিভীষিকা এরা।
কটেজটা এখান থেকে আরও অন্তত দুশ গজ দুরে। কালো ভালুকেরা দেখতে নাদুসনুদুস হলে কী হবে, ওদের সাথে দৌড়ে কুলিয়ে উঠা অসম্ভব। বরং মূর্তি হয়ে থাকাই ভালো। হয়তো আগ্রহ হারিয়ে চলে যাবে উল্টো দিকে। দুহাতে শক্ত করে পাইপটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মিরাজ। মনে প্রাণে প্রার্থনা করছে রাতিয়ানের দিক থেকে বয়ে চলা মৃদু বাতাসটা যেন উল্টো দিকে বইতে শুরু না করে।
অসহ্য এই দাঁড়িয়ে থাকা! বুকের ভেতরে ধুকপুক ধুকপুক কেঁপে চলা হৃদপিণ্ডটা যেন লাফিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। খুব সাবধানে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপাল বেয়ে নেমে আসা হিম শীতল ঘামের ধারা মুছলো মিরাজ। দুরে, অনেক দুরে, কে জানে হয়তো রাতিয়ানের উল্টো পাড়ে, ডাক ছেড়ে ককিয়ে উঠলো রাত জাগা একটি পাখি। এছাড়া আর কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। নেই ঝোপঝাড়ের আড়ালে চকিতে সরে যাওয়া কোন অপচ্ছায়া।
আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলতে শুরু করলো মিরাজ, কটেজকে পেছনে রেখে উল্টো পায়ে ভুতের মতো। পাঁচিলের কাছে এসেই দিলো দৌড়।
হাঁচড়েপাঁচরে কোনমতে দরজা বন্ধ করতে করতে আবারও তার কানে এলো সেই শব্দটা। ৯২ কার্লাইল পার্কের আকাশ আলো করে রাখা চাঁদটা এখন হারিয়ে গিয়েছে মেঘের আড়ালে। অন্ধকারে কিছুই আর চোখে পড়ছে না। নইলে সে দেখতে পেতো ভালুক নয় নেকড়ে নয়, রাতিয়ানের পাড় থেকে থপথপিয়ে, ঘষটে ঘষটে এগিয়ে আসছে একটি হাঁস। সেই হাঁসটা, যাকে কিছুক্ষণ আগেই মিরাজ মাটি চাপা দিয়ে এসেছে।
হাঁসটার ভেতরে বন্দি হয়ে পড়েছে নিবুত। আত্মা যেমন দেহ খোঁজে, হাঁসের শরীর তেমনি যেন আঁকড়ে ধরেছে পড়ে পাওয়া আত্মাকে। একশ আটত্রিশ বছর ধরে এই একটি ভয়েই অ্যালেক্সের শরীর ছেড়ে যায়নি নিবুত। লড়াই করে অর্জন করা শরীরের উপর অধিকার জন্মায়, তাকে ব্যাবহার করা যায় নেড়ে চেড়ে, ছেড়ে থাকা যায়, ফিরে আসা যায় বারংবার। মৃতদেহ যেন হত দরিদ্রের মলিন বস্ত্র, নতুন আরেকটা না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়বার উপায় নেই। একটা জ্যান্ত শরীর চাই নিবুতের। সেই শরীরটা এখন হেঁটে বেড়াচ্ছে কটেজে। হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছে। তার চোখ দুটো শিশিরের মতো টলমলে। রাতিয়ানের পানির মতো সবুজ।
আট।।
ছেলেটার সমস্যা কী! এতদূর ভ্রমণ করে ক্লান্ত হয়ে কোথায় ঘুমিয়ে পড়বে, সেখানে কিনা পায়চারি করে বেড়াচ্ছে ঘর জুড়ে। দুম করে একবার বেরিয়েও গিয়েছিলো। ফিরে এসেছে ঘণ্টা খানেক, কিন্তু এখনও শোবার ঘরে যাবার নাম নেই। এক একবার মনে হচ্ছে উপরতলায় গিয়ে ব্যাটার ঘাড় ধরে নামিয়ে আনেন। কিন্তু মেকেলেমিকাবের স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে জোর খাটানো যাবেনা। ইকবাল হাসান তল কুঠুরিতে বসে চিন্তিত মুখে দাঁত দিয়ে হাতের নখ কেটে চলেছেন আর ভাবছেন কী করা যায়।
নবু আর নিরুর কোন বিকার নেই। যমজদের এই একটা সুবিধা, সারাক্ষণ নিজেদের ভেতর কী কী সব গুজগুজ করে কে জানে!
মিথিলা কী ভাবছে, আদৌ কিছু ভাবছে কিনা, সেটা তার মুখ দেখে বোঝার কোন উপায় নেই।
ইকবাল সাহেবের চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মিথিলাকে কাছে আসার জন্য ইশারা করলেন।
মিথিলা চাপা একটা হাসি দিয়ে বললো,
“অতো ভাবছো কেন বাবা? এমন তো হয়ই। এবার তো তাও একজন। গেল বারের কথা মনে নেই? পুরো একটা পরিবার ছিলো। আর বাচ্চাটা কী দস্যি! ঘুমুতে ঘুমুতে রাত তিনটে বেজে গিয়েছিলো ওদের। এও ঘুমুবে। একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর চিন্তা কীসের?”
মিথিলা এরকমই, দুশ্চিন্তার মধ্যেও মাথাটা বরফের মতো ঠাণ্ডা। অবশ্য ও তো আর আনোয়েতিনের ব্যাপারটা জানে না। সূর্য উঠার আগে বাক্সটা সমাধিতে পৌঁছে দিতে না পারলে আরও একটা বছর!
উপর তলার পায়চারিটা থেমে না আসা পর্যন্ত ঠায় বসে রইলেন তিনি।
তারপর আরও কিছুক্ষণ। হঠাৎ মাথার উপর ঝাড়বাতিটা ঝলমলিয়ে উঠলো। তলকুঠুরি ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়। ৯২ কার্লাইল পার্কের উপর তলায় এখন নিঃসীম অন্ধকার। মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে আলোর আর কী প্রয়োজন! সময় হয়েছে সময় হবার।
মিথিলা শান্ত মুখে একটা আসনে গিয়ে বসলো। নবু-নিরু ফিসফিসানি থামিয়ে কাজলদানি হাতে দাঁড়িয়ে ওর পাশে। ইকবাল সাহেব মুখ খুললেন। কিছু একটা বলছেন তিনি। কথা গুলো অস্পষ্ট। অচেনা ভাষায় বিষণ্ণ কোন একটা গান।
গান শুনতে শুনতে আবেশে চোখ বুজে আসছে মিথিলার। নবু-নিরু তার চোখে পড়িয়ে দিচ্ছে কাজল, ইকবাল সাহেবের কণ্ঠস্বর ঘুরে ঘুরে আছড়ে পড়ছে তলকুঠুরির এপাশ ওপাশ।
হঠাৎ ঘরে দমকা একটা হাওয়া বয়ে গেলো।
ইকবাল হাসান গান থামিয়ে বললেন,
“বাক্সটা খোলো মিথিলা”
মিথিলা কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সটা খুললো।
একটা পাখি।
একটা ছোট্ট গোল্ড ফিঞ্চ। হলদে সবুজ রঙের পাখিটা উড়ে এসে বসলো মিথিলার বাড়িয়ে দেওয়া আঙুলের উপর। আঙুল থেকে কাঁধে, কাঁধ থেকে মাটিতে। পাখিটার যেন কোন ভয়ডর নেই।
ইকবাল সাহেব চকচকে একটা ছুরি এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“পারবে না মা?”
পাখিটার জন্য বুক ভেঙে যাচ্ছে মিথিলার। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে শক্ত হয়ে বসলো সে।
প্রদীপের আলোয় ঝলসে উঠলো ছুরি। একটা ছটফটানি।
মুখোমুখি বসে চারজন। পিতা এবং তিনকন্যা। মিথিলার হাতে মৃত পাখি। মুণ্ডুহীন ধর থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝড়ে পড়ছে রক্ত।
ইকবাল হাসান ধীর লয়ে বলে চলেছেন,
“রাতিয়ানের তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা সিডার গাছের চুড়োয় ছিলো একটি পাখির বাসা। সে বাসায় ছিলো নীলচে সবুজ তিনটে ডিম। তিনটে প্রাণের জন্ম হয়েছিলো শেষ বসন্তে। তার একটাকে আমি ছিনিয়ে এনেছি। মিথিলা একে যত্ন করেছে, খাইয়েছে, বড় করেছে বুকের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে। সেই প্রাণ আমরা আজ উৎসর্গ করেছি আপনার জন্য। আঁধারের অধীশ্বর আপনি। অনুগ্রহ করে আলোয় আসুন একটিবার। মাকালেমিকেবে, দয়া করে আসুন আমাদের এই ঘরে”।
ইকবাল সাহেবের কালো বাক্সের ভেতর থেকে ধোঁয়ার একটি সরু রেখা বেরিয়ে পাখির শরীরটাকে স্পর্শ করতেই তীব্র আলোর ঝলসানিতে যেন ধাঁধা লেগে গেলো সবার চোখে। ধোঁয়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন অতি বৃদ্ধ এক মানুষ। কাশ ফুলের মতো সাদা তার চুল, মুখে অনাবিল প্রশান্তির হাসি।
মিথিলার চিবুক স্পর্শ করে বললেন তিনি,
“শুভ জন্মদিন মিথিলা।”
নয়।।
মিরাজ ঠিক বুঝতে পারছে না সে ঘুমিয়ে আছে, নাকি জেগে! তার ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অনিন্দ্য সুন্দরী এক মেয়ে। শার্সি গলিয়ে পিছলে আসা চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে মেয়েটার মুখ।
নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে সে। বাস্তবের মানুষ এতো সুন্দর হয় না।
মেয়েটা হাতছানি দিয়ে বললো,
“যাবে আমার সাথে?”
“কোথায়?”
“আহা চলোই না! এসো তো, আমার হাতটা ধরো তুমি।”
মোমের মতো একটা হাত। মিরাজের ঘোর ঘোর লাগে।
ঘর থেকে বেরিয়েই বারান্দা, নিচের দিকে নেমে গিয়েছে একটা সিঁড়ি। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছেনা ঠিক কোথায় গিয়ে মিশেছে সিঁড়িটা।
“ভয় লাগছে তোমার?”
একটু যে ভয় ভয় লাগছেনা তা নয়। কিন্তু মেয়েটাকে সেটা বলতে ইচ্ছে করছে না।
“আমার কিন্তু অন্ধকারে দারুণ ভয়!”
মিরাজ পারলে পৃথিবীর সব আলো এনে লুটিয়ে দেয় মেয়েটার পায়ের কাছে। কে এই মায়াবতী?
সিঁড়ির ধাপ মাড়িয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে খিলখিল করে হেসে উঠলো মেয়েটা। হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর। সেই কাঁপুনি মোমের মতো হাতটা বেয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে মিরাজকে। ও এমন করে হাসছে কেন?
“হাসবো না! তুমি দেখছি সেই আদ্যিকালের মানুষ। আর কোন শব্দ খুঁজে পেলেনা মিরাজ?”
মিরাজ অবাক হয়। মেয়েটা তার নাম জানে, পড়তে পারে তার ভাবনা।
“আমি হচ্ছি আমি। সেই বসন্তকাল থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার বোনেরা কী বলেছে জানো?”
“কী বলেছে?”
মিরাজ ঠিক নিশ্চিত নয় প্রশ্নটা সে মনে মনে করলো, নাকি সশব্দে।
“বলেছে তোমার কাছে একটা জিনিস জানতে। একটা প্রশ্নের জবাব।”
“কী প্রশ্ন?”
“আচ্ছা, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বলো তো? আমার নাকটা কিন্তু একটু চাঁপা।”
একটু আলো, আহারে একটু আলো যদি থাকতো কোথাও! মেয়েটার মুখ ভালো করে একবার দেখার জন্য মিরাজের বুক ফেটে যাচ্ছে।
ভয় হচ্ছে, এই বুঝি দুম করে ভেঙে যায় ঘুম, টুটে যায় স্বপ্ন।
কতো ধাপ নামলো তারা? কতগুলো বাঁকে ঘুরলো কাঠের সিঁড়ি?
মেয়েটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো।
“এসে গিয়েছি”
“কোথায়?”
“কোথায় আবার, অনুষ্ঠানে। আজ যে আমার জন্মদিন!”
“শুভ জন্মদিন…”
“মিথিলা, আমার নাম মিথিলা।”
সামনে একটা দরজা খুলে যাচ্ছে। দরজায় দাঁড়িয়ে মাঝবয়সী একজন মানুষ। হঠাৎ করে অন্ধকার থেকে আলোয় এসে চোখে ধাঁধা লেগে গিয়েছে মিরাজের। মানুষটাকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না।
“আসুন, আসুন মিরাজ। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি আমরা।”
আরে, এ যে ইকবাল হাসানের গলা! স্বপ্নের যেন কোন মাথা মুণ্ডু নেই।
ইকবাল সাহেবের পেছন পেছন হেঁটে গিয়ে মাটিতে পেতে রাখা একটা আসনে গিয়ে বসলো মিরাজ। জানালা বিহীন একটা ঘর। ছাঁদটা বেশ নিচু।
সবসুদ্ধ পাঁচজন মানুষ ঘরটাতে। ইকবাল হাসান, মিরাজ, দেবতার মতো সুদর্শন একজন বৃদ্ধ পুরুষ, আর তিনটি মেয়ে। দুজন দেখতে হুবুহু একই রকম। তৃতীয় জনকে সে চিনেছে। মেয়েটার নাকের উপর জমে রয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মেয়েরা এতো মিথ্যেবাদী হয়!
“বাড়ির সবাই এসে গিয়েছে তাহলে? এবারে অতিথিরা আসুক।”
বৃদ্ধ পুরুষটির কেমন গমগমে গলা!
ইকবাল হাসান তিনবার তালি বাজালেন।
কোত্থেকে যেন ভোজবাজির মতো দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো আরও তিনজন। একটি সাত আট বছরের বালিকা আর দুজন তরুণ। ভাগ্যিস স্বপ্ন দেখছে মিরাজ!
অতিথিদের হাতে একটি করে উপহার।
প্রথমেই মুখ খুললো একজন তরুণ-
“শুভ জন্মদিন মিথিলা। আমি তোমার জন্য নিয়ে এসেছি পুবের মাটি। ধরিত্রীর মতো পরিপূর্ণ হোক তোমার জীবন।”
তারপর উঠে দাঁড়ালো বালিকাটি-
“আটেপার মেয়েকে অভিনন্দন। আমি এসেছি দক্ষিণের খোলা হাওয়া নিয়ে। হাওয়ার মতো চির চঞ্চল থাকুক তোমার মন।”
এবারে শেষ জন-
“একুশে স্বাগতম তোমাকে। এই যে এনেছি পশ্চিমের জল। জলরাশির মতো স্বচ্ছ থেকো মিথিলার ভাবনারা।”
ইকবাল হাসান উপহার গুলো একে একে তাঁর কালো বাক্সের ভেতর রেখে দিলেন। সবাই কেমন যেন চুপচাপ। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটবে এখন।
বৃদ্ধপুরুষটি চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন। তিনি চোখ খুলতেই নড়েচড়ে উঠলো সবাই। ইকবাল সাহেবকে খুব বিচলিত দেখাচ্ছে। বৃদ্ধপুরুষ কথা বলতে শুরু করেছেন। তাঁর মুখে ঋষির প্রসন্নতা, চোখে প্রশ্রয়ের হাসি।
“অনন্তের প্রতিদ্বন্দ্বী আমি, কৃষ্ণবিবরের অধীশ্বর। আমি গ্রহণ করি, সংগ্রাহক আমি। অথচ মূর্খের দল, তোমরা কিনা চাও দান! দিতে আমার আপত্তি নেই, যদি তা নিতে জানে কেউ। কিন্তু তার জন্য চাই নিষ্ঠা। কোথায় সেই নিষ্ঠা ইকবাল হাসান। আরেকজন অতিথি কোথায়?”
ইকবাল হাসান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“আমি চেষ্টার কোন ত্রুটি করিনি। বসন্তের শুরুতে জেগে উঠার পর থেকেই নিষ্ঠার সাথে পালন করে এসেছি আমার দায়িত্ব। পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর দক্ষিণ তোলপাড় করে খুঁজে এনেছি মাটি, জল আর খোলা হাওয়া। উত্তর থেকে নিশীথ সূর্যের আলো নিয়ে একজনের আসার কথা। সে এসেছে। কার্লাইল পার্কের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে তার গন্ধ। কিন্তু কেন সে এ ঘরে নেই তা আমি জানিনা। নাইবা থাকলো উত্তরের আলো মেকেলেমিকাবে। আপনার জন্য একটি হৃদয় তো রেখেছি আমরা! সেই হৃদয় ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, যেমন টইটুম্বুর থাকে বর্ষার রাতিয়ান। রক্ত-মাংসে আপনার কোন আগ্রহ নেই আমি জানি, সে সব ঢের রয়েছে কৃষ্ণবিবরে। কিন্তু সেখানে কি হৃদয় আছে? আছেকি ভালোবাসা, মায়া!”
অনুষ্ঠানটি খুব ভালো লাগছে মিরাজের। জন্মদিনে কতো কিছুই তো করে মানুষ। এই পরিবারটি আয়োজন করেছে নাটকের। মিরাজ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে ইকবাল সাহেবের কথা। আসলেই তো, হৃদয় না থাকলে চলে! আর সে হৃদয় যখন ভরে থাকে উপচে পড়া ভালোবাসায় তখন……।
নাটকের এই অংশটা কেমন হতে পারে আঁচ করতে করতে মিরাজের মনে হলো ঘরের আলোটা কমে এসেছে। কেবল যে কমে এসেছে তা নয়, কেমন যেন প্রাণহীন লাগছে সে আলো। বৃদ্ধপুরুষটির দিকে চোখ পড়তেই সে চমকে উঠলো। কোথায় সে সৌম্য পুরুষ? এ কাকে দেখছে মিরাজ!
প্রাণীটা দেখতে অনেকটা বাইসনের মতো। শরীর জোড়া পশমের পুরু আস্তরন। মাথার উপর বাইসনের মতোই বড় আর মোটা মোটা দুটো শিং। মুখটা মানুষেরই, তাতে যেন অযুত নিযুত ফাটল। ফাটল গুলো যেন রক্তে ভেজা। কোন পা দেখা যাচ্ছে না। নেই নাকি! কেন যেন মিরাজের মনে হলো প্রাণীটার অজস্র পা, শরীরের তলায় কিলবিল করছে শুঁয়োপোকার মতো। কিন্তু চোখ দুটো গেলো কই?
কথা বলে উঠলো ভয়ংকর দেখতে সেই প্রাণী। একই কণ্ঠস্বর। মেকালেমিকাবে সৌম্য কণ্ঠে বলছেন,
“চক্র পূরণ হয়নি ইকবাল। মাটি-আলো-জল-হাওয়ার সবকটি না থাকলে রক্তাক্ত ওই হৃদয়টা দিয়ে কী হবে! হৃদয় আমার চাই, নিশ্চয়ই চাই। কৃষ্ণবিবরে দারুণ নিঃসঙ্গ আমি। কিন্তু সে হৃদয় কালো বাক্সে সাজিয়ে রাখার জন্য নয়। আমি পেতে চাই তার উষ্ণতা, অনুভব করতে চাই তার স্পন্দন। চক্র অসম্পূর্ণ রাখার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। তোমরা ফিরে যাবে সেখানে, যেখান থেকে উঠে এসছো বসন্তের শুরুতে। জেগে উঠবে আবার, যখন বরফের স্তূপ ভেদ করে মাথা তুলবে ক্রকাসের কলি।”
জেগে উঠার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে মিরাজ। স্বপ্নটা আর দেখতে চায়না সে। করছেনা। কিন্তু ঘুম যে কেন ভাংছেনা! উফফ, কী বিচ্ছিরি একটা গন্ধ চারিদিকে! বাবা এবং তিন কন্যা থেকে থেকে কুঁকড়ে উঠছে। যে মেয়েটা তার হাত ধরে নিয়ে এসেছিলো, কী যেন নাম সে মেয়েটার? আহারে, নামটা ভুলে গিয়েছে সে! সেই মেয়েটার মোমের মতো হাত দুটো গলে গলে পড়ছে মেঝের উপর।
মিরাজের ঘুম ভাঙলো সূর্য যখন মধ্য গগণে। ঠিক বুঝতে পারছে না জায়গাটা কোথায়। ডান দিকে মাথা ঘোরাতেই চোখে পড়লো একটা স্লিপিং ব্যাগ। পাশেই তার সেই স্টোভটা। মনে হচ্ছে ক্যাম্পিং এ এসেছে! কিন্তু তাঁবুতে না থেকে খোলা আকাশের নিচে ঘুমুচ্ছে কেন সে, তাও এই ভর দুপুরে?
সামনেই একটা বাড়ি। ঠিক বাড়ি নয়, যেন বাড়ির কঙ্কাল। ধ্বংসস্তূপের মাঝে বিশাল একটা পিলার দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু। কিন্তু এখানে সে এলো কখন, কীভাবে?
উঠতে গিয়েই আতংকে চমকে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়লো মিরাজ। একটা হাত। হাত কোথায়, এক গোছা হাড়ের আঙুল! শক্ত করে চেপে রেখেছে তার বাহু।
ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে লাফিয়ে উঠলো মিরাজ। এ কোথায় শুয়ে রয়েছে সে? এক, দুই, তিন, চার, পাঁচটি কবর। অনেক অনেক দিনের পুরনো।
কেন কবর, কার কবর, এসব ভাববার মতো অবস্থায় নেই এখন মিরাজ। সে এখন ছুটছে। ছুটছে আকাশ পাতাল ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে। ছুটতে ছুটতে কেন যেন মনে পড়ছে একটা নদীর কথা। কেউ একজন তাকে বলেছিলো। যেভাবেই হোক সেই নদীটার কাছে চলে যেতে হবে।
সেই নদীর ঘাটে একটা নৌকা রাখা আছে। একটা ক্যানু। কেউ একজন তাকে বলেছিলো।
দশ।।
রাতিয়ানের পানিতে গা এলিয়ে সাঁতার কাটছিলো নিবুত। হাঁসের শরীরটা একেবারে মন্দ নয়! ডানার ব্যাবহার এখনও শিখতে না পারলেও সাঁতারটা সে ভালোই সামলে নিয়েছে। হঠাৎ চিৎকার শুনে পানি থেকে গলাটা তুলতেই সে দেখতে পেলো কাল রাতের ওই ছেলেটা পাগলের মতো দৌড়ে আসছে।
নিবুতের সমস্ত অস্তিত্বে কাঁপন ধরিয়ে সে আসছে। একলা, একাকী জলজ্যান্ত একজন মানুষ। চোখ দুটো তার ভোরের শিশিরের মতো টলমলে। মনি দুটো রাতিয়ানের পানির মতো সবুজ।
প্রথম পর্বের লিংকঃ
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/57208#comment-688757
মন্তব্য
প্রথমপর্ব ভুলে যাবার আগেই দ্বিতীয় পর্ব পড়ার সৌভাগ্য কমই হয়। টান টান উত্তেজনা নিয়ে শেষ দমটা ছাড়লাম।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
ধন্যবাদ নীড় সন্ধানী। লেখাটা একবারেই লিখে শেষ করেছিলাম। কিন্তু বড় হয়ে যাওয়াতে দু ভাগ করে জমা দিয়েছি। কোরবানির হাটে ছোটো গরু বিকোয় বেশি। সচলায়তনের প্রথম দিকটায় যোগ দিতে না পারায় একটা আফসোস হয়। ফেসবুক তখনো এতোটা সর্বগ্রাসী ছিলো না। বড় লেখা মানুষ পড়তো। হয়তো এখনও পড়ে যদি ভালো লেখা হয়।
---মোখলেস হোসেন
ইয়াল্লাহ...! দৌড়ের উপর গল্প শেষ করলাম, বড় বাঁচা বাঁচলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো কই। নিবুতের সোল ইমপ্লান্ট এর ক্ষমতায় নজর দিতে মন চায়।
--জে এফ নুশান
ধন্যবাদ নুশান। শেষ করেছেন শুনে ভালো লাগলো।
---মোখলেস হোসেন
অভিনন্দন ভাইয়া। গল্পটা দারুণ ভাবে শেষ হলো। খুব ভালো লেগেছে পড়ে। এটা তো শেষ, এবার পরের লেখাটা লেখতে বসে যান।
ধন্যবাদ আয়নামতি। এই পরের লেখা পরের লেখা করে আগের লেখাগুলো ফেলে রেখেছি। সেগুলো নিয়েই বসছি এবার।
---মোখলেস হোসেন
হা-হা-হা-হা নিবুতের দামটা পাওয়া গেল ঠিক সময়ে। এই রকমের গল্পগুলো গুছিয়ে শেষ করা বেশ ঝামেলার। পেরেছেন!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
একদম ঠিক কথা বলেছেন এক লহমা। গল্প লেখা আমার কাছে অনেকটা যেন দাবা খেলার মতো। ওপেনিংটা আমি মোটামুটি জানি, মিড গেমে কখনো সখনো উতরে যাই, কিন্তু মুশকিলে পড়ি এন্ড গেমে। খেলার এই অংশটায় গৎবাঁধা কোন নিয়ম নেই। এখানে জয় সৃষ্টিশীলতার।
---মোখলেস হোসেন
কাহিনীটা বারবার অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিলো। কোথায়, তা বলতে পারবো না। কিন্তু ফিরে আসছিলাম আবার। একবারেই দুই পর্ব পড়ে ফেললাম।। সুন্দর।
ধন্যবাদ কর্ণজয়।
খুব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি আপনার গলের জন্য, আর সেই সাথে তৃষ্ণাও বাড়ে কারণ অনেক গল্পই থেমে আছে মাঝপথে। আপনার কাছে আরও একটা কৃতজ্ঞতা এই জন্যে যে আপনার গল্পগুলো আমাকেও লিখতে তাড়না দেয়। আমার ইচ্ছা করে এমন বাস্তব আর কল্পনা আর ফ্যান্টাসির মিশ্রণে এমন সুন্দর ঝরঝরে ভাষায় কিছু গল্প এনে হাজির করতে। বড় পরিসরে আপনি কিছু লিখবেন আর আমি মুখে রসালো একটা হাসি নিয়ে সেটা গোগ্রাসে পড়তে বসব এটা আমার নিজস্ব একটা ইচ্ছা অনেকদিনের। সেই ইচ্ছা কবে পূরণ হবে তার অবশ্য ঠিক নেই!
-সীমান্ত
ধন্যবাদ সীমান্ত রায়। বড় লেখাগুলো নিয়ে একরকম বিপদেই পড়ে গিয়েছি। আলসেমি করে ফেলে রেখেছিলাম, এখন লিখতে বসে দেখি অনেক কাজ বাকি। আশা করছি শেষ করতে পারবো। তবে কি জানেন, নতুন লেখারা মাথায় এসে বড় যন্ত্রণা করে।
---মোখলেস হোসেন
অনেকদিন থেকে দেখছি মোখলেস ভাই আর ভেতরে ভেতরে ছটফট করছি। রোজ ভাবি আজই পড়ে ফেলবো কিন্তু অফিসের কাজ করতে করতে আর সময়ই বের করতে পারিনা। আজ পড়ে ফেললাম। দুর্দান্ত।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
আপনার ভয়েই এটা আর ফেলে রাখা গেলো না সোহেল ইমাম। পড়েছেন দেখে খুব ভালো লাগলো।
---মোখলেস হোসেন
সচলায়তনে পাঠানো বেশ কিছু লেখায় নিজের নাম ট্যাগ দিয়ে রাখিনি। এখন কোথায় খুঁজে পাই সেই সব লেখা! আর যদি খুঁজে পাই তাহলে কি নিজেকে ট্যাগানো যাবে?
---মোখলেস হোসেন
এধরনের লেখা সাধারণত শুরুটা অনেক ভালো হলেও ফিনিশিংটা মন মত হয় না,কিন্তু এটার শেষটাও মাস্টারক্লাস হয়েছে । ধন্যবাদ এও সুন্দর একটা গল্প উপহার দেয়ার জন্য । <৩
অনেক ধন্যবাদ।
---মোখলেস হোসেন
নতুন মন্তব্য করুন