তেইশে শ্রাবণ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৪/১০/২০১৮ - ৭:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সন্ধ্যা প্রায় হয়ে গেছে, রাস্তার পাশের রাধাচূড়া গাছের নীচে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে রাজু। মনে হচ্ছে ঝড় আসবে, বৈশাখ মাসের সন্ধ্যায় আকাশের কোণে এরকম কালো মেঘ দেখলে এর চেয়ে ভাল কিছু চিন্তা করা যায় না। সাথে ছাতাফাতা নেই, সত্যি সত্যি বৃষ্টি চলে আসলে ভিজে চপচপে হয়ে যেতে হবে। আশপাশে গাড়ি ঘোড়া পাওয়া মুশকিল, এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কুষ্টিয়া শহরে যেতে খবর হয়ে যাবে।

এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এতটাই তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে সামনে হঠাত উদয় হওয়া মানুষটাকে খেয়ালই করেনি রাজু। চশমা পরা লোকটা তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন। ভদ্রলোক তার দিকে কেন এভাবে তাকিয়ে আছেন সেটা সে ভালই বুঝতে পারছে, কিন্তু লোকটাকে কেন তার এত চেনা লাগছে সেটা বোঝা যাচ্ছেনা। দমকা বাতাস কোথা থেকে যেন একরাশ ধুলো উড়িয়ে এনে ফেলল। ধুলো থেকে চোখ ঢাকতে গিয়ে সামনে হাত আনার সময় মনে পড়ল ভদ্রলোককে কোথায় দেখেছে। উনি লেখক হুমায়ুন আহমেদ, পত্রিকায় দুই একবার ছবি দেখেছে রাজু। উনি বইও লেখেন শুনেছে যদিও বইটই তেমন পড়েনি রাজু। তবে এইসব দিনরাত্রি নাটকটা দেখেছে, নাটকের ছোট্ট মেয়ে টুনির মৃত্যুতে চোখে পানি এসে গিয়েছিল তার। নাটক লিখে মানুষ কাঁদাতে যথেষ্ট কাবিল লোক হতে হয়, সেই কারনেই উনার নামটা মনে আছে, নাহলে কত লোকই তো বিটিভিতে নাটক লেখে। এরকম একজন মানুষের সামনা সামনি দেখা পাওয়া তো রীতিমত ভাগ্যের ব্যাপার।

-"আপনার নাম কি?" ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।
-"রবি"।রাজু ইচ্ছে করেই উত্তরটি দিল।
আরেকবার চমকালেন হুমায়ুন, পালটা প্রশ্ন-
-"এটা নিশ্চয়ই আপনার আসল নাম না?"
-"নাহ, কিন্তু অপরিচিত মানুষকে এই নাম বলি। এই যে আপনি যেচে এসে আমার সাথে কথা বললেন, সেটা কি রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার চেহারার মিলের জন্যই না?"
-"সেটা অবশ্য অস্বীকার করতে পারছিনা"।সকৌতুকে জবাব দিলেন হুমায়ুন।
-"এই হচ্ছে আমার কপাল, যাহোক এইজন্যে হলেও মানুষজন আগ্রহ দেখায়, কথা বার্তা বলে, তাই বা কম কি? নাহলে কার দায় পড়েছে আমার দিকে তাকানোর?"

আরো কিছুক্ষন হয়তো আলাপ চালানো যেত কিন্তু কোত্থেকে একটা মাইক্রোবাস এসে সামনে দাঁড়াল, ভেতরে শিলাইদহ রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী পালন কমিটির লোকজন।
-"হুমায়ুন ভাই, আপনি এখানে? আমরা খুঁজে অস্থির। উঠুন গেস্ট হাউজে যাবার এটাই শেষ শাটল বাস।" সুতরাং কথা আর বেশি আগালো না। খানিকটা ইতস্তত করে
মাথা নেড়ে হাতের ইশারায় বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে গেলেন হুমায়ুন।

দুইদিন পর সকালে আবার কুঠিবাড়ির সামনে দেখা।
-"সত্যিই দেখেছিলাম তাহলে?" বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করছিলেন হুমায়ুন।
-"হা হা, আপনি কি ভাবছিলেন চোখের ভূল? আচ্ছা স্যার দিনের আলোতেও কি আমাকে রবিঠাকুরের মত লাগে?" রাজু জিজ্ঞেস করে।
-"হুম, আরও বেশি লাগে। কেন, সবাই সেটা বলেনা?" পালটা শুধান হুমায়ুন।
-"বলে স্যার, কিন্তু সেটাতে খুশি হব নাকি দু:খ পাব,সেটা বুঝিনা। সবাই আমার দিকে তাকায়, কিন্তু খোঁজে রবীন্দ্রনাথকে। ব্যাপারটা যে কেমন সেটা অন্যকে বোঝানো সম্ভব না।"
-"-আমি কিছুটা বুঝতে পারছি, আমার কল্পনাশক্তি বেশ ভাল"- মুচকি হেসে বলেন হুমায়ুন।
-"আচ্ছা বাদ দিন, আপনি করেন কি? পড়াশোনা না চাকরি?"- প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করেন হুমায়ুন।
-"স্যার, দয়া করে আমাকে তুমি বলে ডাকবেন। আমি আপনার ছাত্রের মত"
-"আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি কর কি?"
-"বি.এ পাশ করে বসে আছি বছরখানেক হল। চাকরি পাচ্ছিনা। রেজাল্ট তেমন ভালনা, মামা-চাচাও তেমন কেউকেটা নন, চাকরি কিভাবে পাব বলেন?"
-"তাও বটে,আত্মীয় স্বজন কেউ ব্যাবসা করেনা? তাহলে উনাদের কোন একটা ব্যাবসায় ঢুকে পড়।মোদ্দা কথা হচ্ছে কিছু একটা কর, বসে থেকে সময় নষ্ট কোরনা।"
-"এক দুলাভাই এর, মানে দূর সম্পর্কের খালাতো বোনের স্বামীর একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে খুলনায়, সেটার ওয়েটার হতে বলেছিলেন। বেতন খারাপ না, আর ওয়েটার হওয়াটাকে আমি অসম্মানের কিছুও মনে করিনা। কিন্তু তাও গেলাম না, কেন জানেন?"- সকৌতুকে জিজ্ঞেস করে রাজু।
-"কেন?"
-"থাই স্যুপ থিক আর সিজলিং বিফ হাতে রবীন্দ্রনাথ ছোটাছুটি করছেন ব্যাপারটা কল্পনা করাও আমার জন্য কষ্টকর। মানি যে আমি আসল রবীন্দ্রনাথ না, তারপরও ব্যাপারটা জানি কেমন। আমার নাহয় প্রেস্টিজ নাই, রবীন্দ্রনাথের তো আছে? কেউ কেউ হয়তো ডাক দিয়ে বলবে, ভাই কি পেপসি দিলা? এটারে ঠান্ডা বলে? যাও ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে আস!"

রাজুর কথা শুনে ঠাঠা করে হেসে ওঠেন হুমায়ুন-

-"তোমার সেন্স অফ হিউমার ভাল, পছন্দ হয়েছে। তোমার কথা শুনে মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। তুমি কি অভিনয় করতে আগ্রহী?"
-"অভিনয়? জিন্দেগিতে করি নাই স্যার"
-"কর নাই, তো করবা সামনে। জিন্দেগি তো শেষ হয়ে যায়নি, তাই না?"
-"তা ঠিক, কিন্তু কি অভিনয় করব স্যার?"
-"রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা নাটক লিখব ঠিক করছি, সেখানে তোমাকে দিব্যি মানিয়ে যাবে। যুবক রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে গল্পটা, তোমার মত কাউকেই দরকার।"

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আতঁকে ওঠেন হুমায়ুন। কথায় কথায় দেরি হয়ে গেছে, একটা আলোচনা সভায় যোগ দেবার কথা, মিনিট তিনেক বাকি আছে। রাজুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পড়িমরি করে ছুটলেন তিনি। তবে রাজুর মাথায় এই নাটকের ব্যাপারটা ঢুকে গেল। জীবনে এই প্রথম নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ কেউ বলে মনে হল। বিধাতা ওকে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার ছিটেফোঁটাও দেন নি সেটা একটা দু:খের ব্যাপার, কিন্তু চেহারার মিল যে দিয়েছেন সেটা আর ফেলনা বলে মনে হচ্ছেনা। এই যে এই চেহারার সুবাদেই কি একটা দারুন সুযোগই না সে পেতে যাচ্ছে!

এদিকে ঢাকায় ফিরে প্রাত্যহিক ব্যস্ততায় ডুবে গেলেন হুমায়ুন। একটা সময় বেমালুম ভুলেই যান রাজুর কথা কিংবা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নাটক লিখবার কথা। মাস গড়িয়ে বছর পেরিয়ে গেল, রাজু অবশ্য আশা ছাড়েনা। হুমায়ুন আহমেদ ব্যাস্ত মানুষ, চাইলেই তো আর দুই দিনে নাটক লিখতে পারেন না। তাছাড়া শিল্প সাহিত্য হচ্ছে ভাবের ব্যাপার, যখন তখন শুরু করা যায়না। সুতরাং এক বছর হলেও আশা ছাড়ার মত কিছু দেখেনা সে। এদিকে রবীন্দ্রজয়ন্তী আয়োজক কমিটির লোকজনের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখে সে। হুমায়ুন তো আর রাজুর ঠিকানা জানেন না, খোঁজ নিলে নিশ্চয়ই উনাদের মাধ্যমেই নেবেন।

কিন্তু আরও ছয়মাস যখন পেরিয়ে গেল, আশায় খানিকটা চিড় ধরল রাজুর। সন্দেহ হতে লাগল যে নাটকের ব্যাপারটা হুমায়ুনের আদৌ মনে আছে কিনা। গঞ্জে বড়মামা একটা মিষ্টির দোকান দিয়েছেন, ততদিনে মায়ের অনুরোধে মামার সেই দোকানে বসে রাজু, মাসশেষে কিছু টাকা হাতে পায়। সেই জমা টাকা সম্বল করে একদিন ঢাকার বাসে উঠে পড়ে রাজু। কোনভাবে যদি হুমায়ুন স্যারের সাথে দেখা করা যায়। তার পরিচিত একজন ঢাকায় মঞ্চনাটক করে, সেই সুবাদে নাটকপাড়ায় যাতায়াত করে। তার কাছে রাজু খোঁজ নিয়েছে যে হুমায়ুন এখন একটা ধারাবাহিক নাটক লিখছেন, সেকারনে মাঝে মাঝে বিটিভিতে যান।

সুতরাং ঢাকা এসে রাজু সারাদিন বিটিভির গেটে বসে থাকে, 'যদি লাইগা যায়' এই আশায়। তৃতীয় দিন সত্যিই 'লাইগা' গেল, দূর থেকে দেখেই সটান হুমায়ুনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রাজু।

-"স্যার চিনতে পেরেছেন নিশ্চয়ই? ওই যে সেবার শিলাইদহে দেখা হল, বলেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নাটক লিখবেন?"-রাজু গড়গড় করে বলে।

প্রথমে মনে হল হুমায়ুন রাজুকে চিনতেই পারেন নি, পর মুহূর্তেই অবশ্য নিজেকে সামলে নিলেন।

-"হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। নাটক খুব শিগগিরই ধরব, হাতের কাজটা শেষ করে নেই। আর হ্যা শরীরের দিকে খেয়াল রেখ, চেহারা যেন নষ্ট না হয়। নাটকের জন্য কিন্তু তোমার চেহারা একটা ইমপর্ট্যান্ট ফ্যাক্টর।"- রাজুর কাঁধে আশ্বাস দেয়ার মত করে চাপড়ে দিয়ে ভিতরে ঢুকে যান হুমায়ুন।

আশার ফানুশ বড় করে আবার কুষ্টিয়া ফেরে রাজু। যাক, স্যার যখন বলেছেন, তখন একটা কিছু হবেই। এই আশাতেই হয়ত আরো বছর খানেক কাটিয়ে দেয়া যেত, কিন্তু ঠিক সে সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত রাজুর শরীরে লিউকেমিয়া ধরা পড়ল। সেটাও প্রায় শেষ পর্যায়ে, ডাক্তার মাস তিনেকের মত সময় বেধে দিলেন। তখন আর চিকিৎসা শুরু করার মানে হয়না। আত্মীয় স্বজনকে রাজু কিছু জানাল না। বাবা তো আগেই মারা গেছেন, মাকেও কিছু জানাল না। মাকে বললে ভিটেমাটি বেচে চিকিৎসা শুরু করে দেবে। লাভ তো কিছু হবেই না, বরং রাজু চলে যাবার পর টাকার জন্য মাকে মানুষের কাছে হাত পাততে হবে।

দিনে দিনে শরীর আরো খারাপ হতে শুরু করে। মা ব্যাকূল হয়ে রাজুকে ভাল ডাক্তার দেখাতে বলেন। রাজু হেসে মাকে আশ্বাস দেয় যে সে ভাল ডাক্তারই দেখিয়েছে এবং সেই ডাক্তার বলেছে সে ভাল হয়ে যাবে। এই সরল মহিলার সাথে ছলনাটা করতে একদমই মন মানছিল না, কিন্তু সবই কপাল। অদৃষ্টের লেখন খন্ডায়, সে সাধ্য কার?

শ্রাবণ মাসের এক দুপুরে যখন শরীর বেশি খারাপ হয়ে গেল, রাজুর মায়ের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল। কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের এম্বুলেন্স এ চেপে তিনি রাজুকে নিয়ে রওনা দিলেন ঢাকার পথে। ছেলেকে এবার 'বড়' ডাক্তার দেখাতে হবে। এম্বুলেন্স যখন ফেরিতে করে মাঝ পদ্মায়, আকাশ আঁধার করে বৃষ্টি নামল। হঠাত রাজুর মনে পড়ল হুমায়ুনের সেই নাটকের কথা। কল্পনায় কতবার ভেবেছে সে নাটকে রবীন্দ্রনাথ সেজে বজরায় চড়ে পদ্মার বুকে দোল খাবে, সেটা আর তবে হলনা? আসল রবিঠাকুর না হোক, নকল রবিঠাকুর ও এই জীবনে হওয়া হলনা? যাকগে, নাহলে নাই- মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আক্ষেপ রেখে লাভ কি? আজ রাতটা পার করতে পারবে বলেও মনে হচ্ছেনা। আচ্ছা আজ কি বাইশে শ্রাবণ? আজ মরলে অবশ্য এক হিসেবে খারাপ হয়না, জীবনের মত মৃত্যুতেও তো রবীন্দ্রনাথের সাথে সাদৃশ্য থাকবে!

বিধাতা অবশ্য রাজুকে সেখানেও ফাঁকি দিলেন খানিকটা। রাজু মারা গেল তেইশে শ্রাবন বেলা দেড়টায়।

পুনশ্চ : হুমায়ুন আহমেদের কোন এক আত্মজীবনী ধরনের বইয়ে 'সে' শিরোনামে একটা লেখা পড়েছিলাম যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের মত দেখতে একজনের কথা লিখেছিলেন। পুরো নিশ্চিত না করতে পারলেও সম্ভবত ছেলেটার আসল নাম হাফিজুর রশিদ (রাজু)। সেই রাজু কিংবা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আসলেই একটা নাটক লেখার কথা ছিল। কিন্তু নাটক লেখার পর তিনি জানলেন রাজু মারা গেছে, তাই পরে সেই পান্ডুলিপি তিনি পুড়িয়ে ফেলেন। গভীর মমত্ব নিয়ে সেই গল্পটা আমাদের বলেছেন হুমায়ুন। কিন্তু রাজুর দিক থেকে গল্পটা আমরা শুনিনি, লেখকের স্বাধীনতা ব্যবহার করে এখানে সেই চেষ্টাই চালালাম। আসল রাজুর জীবন কেমন ছিল সেটা আমি জানিনা, মারা কবে গিয়েছিলেন সেটাও জানিনা। তাই খানিকটা কল্পনার আশ্রয় নিলাম, ওপারে সব কিছুর ঊর্ধে চলে যাওয়া রাজুর তাতে নিশ্চয়ই কিছু যাবে আসবে না।
-গগন শিরীষ


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।