স্বপ্ন কিংবা গল্প

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৭/১০/২০১৮ - ১১:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পিঠের রুকস্যাক ব্যাগের ওজন বেশী না, তবু খাড়া রাস্তা বেয়ে উপরে উঠে আমার হাঁপ ধরে গেল। পাহাড়ের খাঁজে তৈরি হওয়া এই শহরের রাস্তাগুলো সবই এমন উঁচুনিচু, আর ভীষণ কনফিউজিং। এখানে আমি আগেও এসেছি একবার, তবু এবার এসে কিছুই যেন চিনতে পারছি না। অবশ্য সেবার এসে পৌঁছেছিলাম সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে। আবার বেরও হয়ে গেছিলাম সূর্য ওঠার বেশ আগেই খানিকটা দূরের অন্য পাহাড়ে সূর্যোদয় দেখতে। সেবার সূর্যোদয় বা শহর কোনটাই দেখা হল না ঠিকমত। এবার স্বপ্নে এসে তাই যাই দেখছি নতুনের মত লাগছে, আর সেই সাথে রাস্তাও গুলাচ্ছে।
ঝকঝকে একটা দিন, দূরের বরফে ঢাকা পর্বতের চূড়াগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। বাস্তবে যখন এসেছিলাম তখন মেঘ-কুয়াশায়ঘেরা ছিল চারপাশ। এবার স্বপ্নে এসে এত সুন্দর ভিউ পেয়ে কী যে খুশী লাগছে! এই উঁচু আঁকাবাঁকা রাস্তায় পথ ভুল করেও যখনই সেই আকাশে হেলান দেওয়া শিখরগুলোর দিকে চোখ পড়ছে, মনটা ফুরফুরে হয়ে যাচ্ছে নিমেষেই। তবে এভাবে উদ্দেশ্যহীনভাবে তো বেশীক্ষণ ঘোরা চলে না, একটা জায়গা টার্গেট করে এগোলে সুবিধা হয়। আমি খুঁজছি মল রোড, যা শহরের মূল প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু সেটা আরও উপরে নাকি নীচে সেটা বুঝতে পারছি না। যতদুর জানি মল রোডটা উচ্চতার দিক থেকে একদম মাঝামাঝি। আমি যে কোথায় আছি তাও জানি না, উঠছি তো উঠছিই। এদিকের বাড়িঘরগুলোও বেশ সুন্দর। কাঠের বড় বড় বাড়ি, আর কী সুন্দর নকশা কোন কোনটার গায়ে। একটা বাড়ির সামনে কিছু স্থানীয় মানুষ বসে আছে, হয়ত নেপালি। এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইলাম মল রোডটা কোনদিকে। ইংরেজি বুঝল না কিছু। এমনকি হিন্দিও না। তাহলে কি আমার উচ্চারণে ভুল হচ্ছে? মল রোড নামটার সাথে কি তারা পরিচিত না? নাকি আমি স্বপ্নে অন্য কোনও শহরে চলে এসেছি? স্বপ্নে কীই না হয়!
এ অবস্থায় আরও এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে এবার আমার ভাগ্য ভাল, বাঙালি চেহারার কয়েকজনের দেখা পেলাম আরেকটু এগোতেই। অতীত অভিজ্ঞতা বলে বিদেশ বিভূঁইয়ে মেয়েদের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত বেশী হেল্প ও রেসপন্স পাওয়া যায়। তাই ছিপছিপে এক তরুণীর দিকে এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে জানতে চাইলাম, “বাঙালি?”
মেয়েটা সম্ভবত কথা কম বলে। চেহারায় কেমন একটা শান্ত গাম্ভীর্য জায়গা করে আছে। চোখের দৃষ্টিতে যে গভীরতা সেখানে ঢেউ তোলা কঠিন তবে ডুব দেওয়া সহজ। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে ভ্রূ একটু বাঁকা করে তাকিয়ে রইল।
এবার সরাসরি কাজের কথায় চলে গেলাম, “মল রোডটা কোনদিকে বলতে পারেন? এর আগেও কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কিছুই বোঝাতে পারলাম না!”
এবার মেয়েটা নীচের দিকে নামার রাস্তাটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, “অনেক উপরে চলে এসেছেন। এই রাস্তা ধরে নেমে যান। প্রায় দেড় কিলোমিটার এগিয়ে এসেছেন।”
আমি বললাম, “আপনি কি আরও উপরে যাবেন?”
মেয়েটা স্বভাবমত কোনও জবাব দিল না এবার। আমিও আর কী করা, নীচের দিকে পা বাড়ালাম। এবার ধকল কম, আয়েশ করে নেমে যাওয়া শুধু। তবু আমার গতি কমে আসছিল। কেন জানি নামতে ইচ্ছা করছিল না। একটা চাপা অস্বস্তি আমাকে বলছিল আমার মেয়েটার কাছাকাছি থাকা দরকার। কিন্তু অপরিচিত একজনের কাছাকাছি চাইলেই থাকা যায় না যদি না সে চায়। আর আমি গিয়ে যদি বলি, “প্লীজ কিছু মনে করবেন না, আমার একলা নীচের দিকে যেতে কেমন অস্বস্তি বা ভয় ভয় লাগছে, আপনি আমার সাথে যাবেন? বা, আমি নাহয় এখানে থাকি?” সেটা খুবই অ্যাবসার্ড হয়ে যাবে।
এসব ভাবতে ভাবতে নীচের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পথের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন রকম দোকান পাওয়া যাচ্ছে। তবে প্রায়ই যেটা দেখছি সেটা হল কাঠের কারুকাজ করা ছোট খোলা শেলফে বই সাজিয়ে রাখা। বেশীরভাগই ইংলিশ ক্লাসিক। তবে বেশ পুরনো কিছু বইও দেখলাম। বইয়ে আমার আগ্রহের কমতি নেই। তাই বই দেখলেই সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়াচ্ছি। তবে আজকে বইয়ের প্রতি ভালোবাসার থেকেও নীচে যাওয়ার প্রতি অনীহাও একটা কারণ হতে পারে। বই যেখানে যেখানে সাজানো সেখানের কোথাওই কোনও মানুষকে দেখলাম না। বইগুলো বিক্রির জন্য কিনা তাও জানি না। আমি যখন বই দেখার জন্য তৃতীয়বারের মত থেমেছি আর অলসভাবে বইয়ের মলাট উল্টাচ্ছি, তখন দেখলাম মেয়েটি নেমে আসছে।
আমি মনে মনে ভীষণ খুশী হয়ে গেলাম। অবচেতন মনে এটাই হয়ত তীব্রভাবে চাইছিলাম। মেয়েটাও যদি নীচের দিকে যায় তাহলে তো অনেকটা পথ একসাথে যাওয়াই যায়! আর তো কোনও রাস্তা নেই। সে কাছাকাছি আসতেই খুশী খুশী গলায় বললাম,
“কী আশ্চর্য দেখেছেন! এখানেও দেখি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই রেখে দিয়েছে। আপনি সুনীল পড়েছেন?”
মেয়েটা এবারও উত্তর দিল না। তবে শান্ত একটা হাসি দিয়ে নিজেই এসে বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। আমি বই নিয়ে বকবক করে চলেছি, সে শুনেছে অথবা শুনছে না। তারপর যখন তার বই দেখা শেষ হল আমার দিকে ফিরে সে বলল, “চলুন, এবার নামা যাক।”
দুইজন নামছি নিঃশব্দে। চারিদিকের এই অপার্থিব সৌন্দর্যের মাঝে কথা যেন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। এই সময় শুধুই অনুভবের। দিনটা এখনও বেশ পরিষ্কার। পাহাড়ি এই শহরে প্রায়ই মেঘ এসে চারিদিকে কুয়াশায় ঢেকে দেয়, স্বপ্ন বলেই হয়ত আজ এমন ঝকঝকে।

মল রোডটা বেশ জমজমাট। সেখানে পৌঁছে কখন যে মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললাম নিজেও জানি না। তবে সেটা নিয়ে বেশী মন খারাপের আগেই দেখা হয়ে গেল ছোটবেলার এক বন্ধুর সাথে। সঞ্জু আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিল। পরে যখন চীনে ডাক্তারি পড়তে গেল তখন থেকে আস্তে আস্তে যোগাযোগটা কমে এসেছে। ওর সাথে গত দু’বছরে দেখাই হয়নি। এখানে এভাবে দেখা হয়ে যাবে সেটাও ভাবিনি। সঞ্জুও ঘুরতে এসেছে একাই। দুইজনে আবার যেন ফিরে গেলাম সেই স্কুলের দিনগুলোর মত। মেয়েটার কথা আমার মাথা থেকে উধাও হয়ে গেল।
তবে এত সহজে হারানোর জন্য তো সে স্বপ্নে আসেনি। শহরের এদিক সেদিক ঘুরে আমি আর সঞ্জু একটা বিখ্যাত ভিউ পয়েন্টে গেলাম। এখানে খুব সরু একটা পথ সিঁড়ির মত ধাপে ধাপে অনেক উঁচুতে একটা জায়গায় গিয়ে থেমেছে। সেখান থেকে কী দেখা যায় তা অবশ্য জানি না। এখানে আমি আগে কখনও আসিনি বা স্বপ্নেও দেখিনি। দূরে একটা ঝরনা থেকে নেমে আসা ছোট নদী বয়ে এসেছে, সেখানে তেমন জল নেই। হেঁটেই পার হওয়া যায়। আশেপাশে কয়েকটা কটেজ বানিয়েছে, সেখানে কিছু মানুষজন। সবই ওই ছোট্ট নদী ঘিরে। উঁচু ট্রেকিং পথে খুব একটা মানুষের ভীড় নেই। আমি আর সঞ্জু ঐ পথে ওঠার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে তার আগে নীচেও একটু ঘুরে দেখা যাক।
কটেজগুলো আশেপাশে পশমী কিছু কুকুর আরাম করছে। এই অঞ্চলে কুকুরগুলো পুরু পশমে ঢাকা, শীত থেকে বাঁচার জন্য। সঞ্জুকে দেখে কিছু কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। কুকুরে আমার একসময় ভয় ছিল, এখন আর নেই। কিন্তু সঞ্জু দেখি বেশ বড় একটা পাথর তুলে ডাকতে থাকা কুকুরদের দিকে তাক করেছে। পাথরের সাইজ দেখে আঁতকে উঠলাম। এত বড় পাথর কোনও কুকুরের গায়ে লাগলে মারাত্মকরকম জখম তো হবেই, মরেও যেতে পারে। সঞ্জুকে আটকালাম জোর করে, সঞ্জু পাথর ফেলে দিলেও চোখেমুখে একটা তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে থাকল কুকুরগুলোর দিকে। এদিকে আমাদের পিছনে কখন যে তৃতীয় একজন এসে দাঁড়িয়েছে সেটা আমরা কেউই খেয়াল করিনি।
ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। লোকটা বেশ বয়স্ক, আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আতঙ্কের সাথে দেখলাম তার নাক থেকে রক্ত গড়িয়ে নেমেছে। জমাটবাঁধা রক্ত। তবে সেদিকে তার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। কেমন একটা তীক্ষ্ণ চাহনি দিয়ে সে যেন আমাদের এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। আমার সেই পুরনো অস্বস্তি যেন আবার বাড়তে লাগল, সঞ্জুকে নিয়ে লোকটার থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে ওখান থেকে সরে এলাম। নদীর পারের এই এলাকায় আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছা করছিল না। সঞ্জুকে নিয়ে আবার সেই উপরে যাওয়ার সরু সিঁড়ির মত পথটার মুখে এসে দাঁড়ালাম। এবার আমাদের উপরে ওঠা উচিৎ, আরও দেরী করলে রাত নেমে যাবে। এমনিতেও দিনের সেই ঝকঝকে ভাবটা আর নেই। কেমন একটা স্থির কুয়াশা যেন ঘিরে আছে এই এলাকাটাকে। আমরা যখন উপরে ওঠা শুরু করব তখন দেখি মেয়েটাও এগিয়ে আসছে এদিকেই। আগের মতই এখনও সে একাই। সে কাছে আসতেই সঞ্জুকে বললাম মেয়েটাকে আমি চিনি। মেয়েটা আমাকে দেখে হাসল। আমিও খুশী খুশী গলায় বললাম,
“কী ব্যাপার দেখুন! স্কুলের ফ্রেন্ডকে পেয়ে গেছি এখানে! উপরে যাবেন তো নাকি?”
মেয়েটা এবার হেসে বলল, “নিশ্চয়ই।”
সঞ্জুর দিকে তাকিয়ে দেখি সে একদৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগে যখন কুকুরগুলোর দিকে সে তেড়ে গেছিল তখনও একটা অপরিচিত দৃষ্টি দেখেছিলাম সঞ্জুর চোখে। এখনও সঞ্জুর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, একে আমি চিনি না।

তিনজনে উপরে উঠে চলেছি। মেয়েটা আমার সাথে সাথে, সঞ্জু কিছুটা এগিয়ে। এখন আমরা বেশ কথাও বলছি। মেয়েটা বলল,
“জীবন কত সুন্দর তাই না?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, তা তো বটেই। এমন জায়গায় আসলে আবার সেটা আরও ভালভাবে বোঝা যায়।”
মেয়েটা কেমন দুঃখমাখা গলায় বলল, “জীবন এত সুন্দর হলে মানুষ এত অসুন্দর হয় কেন?”
আমি থমকে গেলাম কিছুটা। মেয়েটা এভাবে কেন ভাবছে? তার জীবনে কি কোনও অসুন্দর ঘটনা থাবা বসিয়েছে? সেইজন্যই বুঝি অমন শান্ত কিন্তু বিষণ্ণ একটা ছায়া খেলা করে ওর মুখে? খুব মায়া জন্মালো সেই মুহূর্তে। ইচ্ছা হল তার মাথায় হাত দিয়ে বলি, “লক্ষ্মী মেয়ে, মানুষের অসুন্দর দিকটা ভুলে গেলে কেমন হয়?”
কিন্তু বলা হল না, অপরিচিত একজনের সাথে এভাবে বলা হয়ত শোভা পায় না।
এখানে পথ বেশ সরু। একপাশে অনেক নীচের সেই নদীটা দেখা যাচ্ছে যেখান থেকে আমরা উঠে এসেছি। সঞ্জু চলা থামিয়েছে কারণ সরু পথটায় আড়াআড়ি করে শুয়ে আছে একটা কুকুর। সঞ্জু ততক্ষণে হাতে তুলে নিয়েছে একটা পাথর। আমি নিষেধ করার আগেই সে পাথরটা ছুঁড়ে মারল কুকুরটার দিকে। কুকুরটার গায়ে লাগল কিনা সেটা আমি দেখলাম না কিন্তু সঞ্জু দেখি সারা শরীর দুলিয়ে হাসছে। আমি আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে দেখি সঞ্জুর পা খাদের খুব কিনারে, পাথর ছুঁড়ে মারতে গিয়ে ও যে বেখেয়ালে এত কিনারে চলে গেছে সে নিজেও বোঝেনি। হাসতে হাসতে যখন আমাদের দিকে ফিরতে গেল তখন চোখের পলকে ঘটল ঘটনাটা, আমার বন্ধু আমার থেকে দুইহাত দূরত্ব থেকে চোখের সামনেই পা হড়কে পড়ে গেল। শেষবারের মত হাত দিয়ে খামচে ধরতে গেছিল খাদের কিনারা, কিন্তু হারিয়ে গেল অনেক নীচে। মেয়েটা চিৎকার করে উঠল, আমিও ভয়ে কাঁপছি। চোখের সামনে যা দেখলাম সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না। সঞ্জু পড়ে গেল? সঞ্জু আর নেই? কীভাবে সম্ভব!

আমি আর মেয়েটা নীচে ছুটে চলেছি যত তাড়াতাড়ি নামা যায়। মনে মনে ভাবছি কোনওভাবে কি ওর বেঁচে যাওয়া সম্ভব না? কোথায় পড়েছে নীচে জানি না, হয়ত কোনও অলৌকিকভাবে এখনও বেঁচে থাকতে পারে। যখন নীচে নেমে আসলাম, তখন আর দিনের আলো নেই। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। খুব দ্রুতই চারিদিকে অন্ধকার হয়ে যাবে। সেই নদীর পার ঘেঁষে আমরা দুইজন খুঁজে বেড়াচ্ছি এমন একটা জিনিস যা কখনও কল্পনাতেও আসেনি। আমরা লাশ খুঁজছি। সঞ্জুর লাশ।
কেমন একটা ভয়ে আমি আচ্ছন্ন হয়ে আছি। মেয়েটা সাথে না থাকলে আমি হয়ত সাহস পেতাম না সঞ্জুর লাশ খুঁজে বের করতে। যদিও মনের ভিতর এখনও একটা ক্ষীণ আশা আছে যে গিয়ে দেখব সঞ্জুর দেহে এখনও প্রাণ আছে। আশেপাশের কটেজগুলোর কোন কোনটা থেকে মানুষের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে এই নদীর পার ঘেঁষে কেউই নেই। আমিই দেখলাম প্রথম। বড় একটা পাথরের উপর সঞ্জু পড়ে আছে। আরেকটু কাছে যেতেই বুঝলাম পাথরের উপর পড়ে থাকা ঐ মাংসপিণ্ডে আর যাই থাকুক, কোনও প্রাণ নেই। আমি ভয় পেলাম হঠাৎ, প্রচণ্ড ভয়। আরও কাছে গিয়ে সঞ্জুকে ওই অবস্থায় দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হল না। আমি মেয়েটার হাত ধরে ছুটে চলে আসলাম সেখান থেকে। কিন্তু বেশীদূর নয়। সামনে এগোতেই দেখি সেই বয়স্ক লোকটা, নাক থেকে বের হওয়া জমাট রক্ত।

সে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সে শুধু আমাকেই দেখছে, মেয়েটার দিকে ফিরেও তাকাল না। লোকটার চোখের দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝলাম ঐ চোখের পাতা কখনও নড়ে না।
কোনরকমে বিড়বিড় করে বললাম, “আমাদের যেতে দিন। আমরা কারও কোনও ক্ষতি করিনি।”
এই প্রথম লোকটা কথা বলল, প্রাণহীন ঠাণ্ডা একটা হাওয়া যেন বয়ে গেল। সেইভাবেই তাকিয়ে থেকে সে বলল, “তুমি এখনও বেঁচে আছ সেই কারণেই।”
এবার যেন আমার চোখের পাতাও অনড় হয়ে আছে। আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে।
সে বলে চলল, “তোমার বন্ধু জীবনে অনেককিছুই তোমার থেকে বেশী পেয়েছে। তার মূল্য হয়তো বোঝেনি বরং অনেকের জীবন থেকে কেড়েও নিয়েছে কতকিছু।”
সে একটু একটু করে যেন এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি সম্মোহিতের মত তাকিয়ে আছি তার দিকে। আমার চোখের পাতা নড়ছে না।
সে বলে চলেছে, “তুমি মন খারাপ করে পথ চলো। উদাস হয়ে ঘুরে বেড়াও পাহাড়-জঙ্গলে। বহু আগেই তোমার জীবনহানিকর বিপদে পড়ার কথা ছিল। যেমন আজই অন্যমনষ্কতায় মনের বেখেয়ালে তোমার পড়ে যাওয়ার কথা ছিল নীচে। সঞ্জু যেখানে পড়ে আছে সেখানে তোমার লাশ পড়ে থাকার কথা ছিল।”
আমি যেন পাথর হয়ে শুনছি এসব। মেয়েটা শক্ত করে আমার হাত আঁকড়ে ধরে আছে।
সে বলে চলেছে, “কিন্তু তুমি জীবনে তেমন কোনও অন্যায় করোনি। তোমার থেকে হয়ত আরও ভালবাসা ছড়াবে প্রকৃতি ও মানুষে। সেইজন্যই হয়ত এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছ।”
এতক্ষণে আমি যেন নিজের ভেতর শক্তি ফিরে পেলাম। তাই তো, আমি তো কোনও অন্যায় করিনি, কারও কোনও ক্ষতির চেষ্টা করিনি, অমঙ্গল কামনা করিনি। কীসের ভয় আমার? যদি এখানে এই অবস্থায় মারাও যাই, তাতেই বা ভয় কীসে। মেয়েটার জন্য আবার সেই তীব্র মায়া জন্মালো, মনে হল একে যদি এর থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারতাম! আমি প্রবল আশ্বাসে মেয়েটাকে ঘিরে ধরলাম যাতে সে ভয় না পায়।

-সীমান্ত রায়


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক শব্দ একসাথে ঠাসা দেখলে আমার কেমন যেন দম বন্ধ লাগে। স্বপ্নদৃশ্যের বেলায় একটু বেশিই লাগে। অন্যদের কী হয় আমি জানিনা, আমার স্বপ্নগুলো সাধারণত খুব এলোমেলো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে চিত্রনাট্যের খসড়ার মতো। বাক্য নয়, বাক্য গঠনও নয়, বাক্যগুলোকে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে আরেকটু ভাবা যেতো হয়তো।

দক্ষিনারঞ্জন মিত্র যখন ঠাকুরমার ঝুলিতে লেখেন,

তারপর

যেতে

যেতে

যেতে

তখন আমি যেন সেই ভ্রমণটা দেখতে পাই চোখের সামনে। ওই স্পেইসটুকু খুব দরকার এই ধরনের গল্পে। তবে এটা নিছক আমার ব্যাক্তিগত ধারণা সীমান্ত রায়। আরও লিখবেন আশা করি। আর নিজের নামটা দয়া করে ট্যাগ করে দেবেন কী ওয়ার্ডে। নইলে পরে এই লেখাগুলো আর খুঁজে পাবেন না।

---মোখলেস হোসেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

মোখলেস ভাই, আপনি যে লেখাটা পড়েছেন এতেই কৃতজ্ঞতা অনুভব করছি আর সেই সাথে লজ্জাও। এই লেখাটা সচলে দেওয়ার পর থেকেই জিভ কেটে ভাবতে বসেছি যে এটা তো সাহিত্য হয়নি। এটা নিতান্তই আমার স্বপ্নের বর্ণনা। এটা ডায়েরিতে মানাত হয়ত, কিন্তু এমন গল্প হিসেবে অন্যদের কাছে তো অখাদ্য হতেই পারে। বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমার স্বপ্ন বেশ গোছালো হয় প্রায়ই আর উপরের লেখাটা তেমনই এক স্বপ্নের হুবুহু বর্ণনা। এই হুবুহু বর্ণনা দিতে গিয়েই গল্পের আমেজ নষ্ট হয়েছে, ভাষা হয়েছে আড়ষ্ট। তবে এই পটভুমিতে আমার সত্যিই একটা গল্প লেখার ইচ্ছা আছে, সেখানে আশা করি এই সমস্যা থাকবে না। কারণ লেখার ফ্লো ঠিক থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। নতুন গল্প নিয়ে হাজির হোন তাড়াতাড়ি। ভাল থাকবেন।

-সীমান্ত রায়

তুলিরেখা এর ছবি

স্বপ্নদৃশ্যকে গল্প আকারে লেখা খুব কঠিন। মানে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়। বেশ কয়েকবার স্বপ্নদৃশ্যকে গল্পের মতন লিখতে গিয়ে দেখেছি কিছুই হচ্ছে না, স্বপ্নে যে অনুভূতি আর অভিঘাত সেটা মানুষের ভাষার এইসব অক্ষরে শব্দে বাক্যে কিছুতেই আনতে পারিনি তুলে। আপনি স্বপ্নের গল্প লিখেছেন দেখে খুব ভালো লাগল। বুঝলাম, তাহলে কেউ কেউ পারেন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।