ক’দিন ধরেই আমার কানের ভেতর ডাকাডাকি করে চলেছে তিনটে পোকা। একটা ঝিঁঝিঁ, একটা এঁটুলি- আরেকটা যে কী ঠিক ধরে উঠতে পারছি না। অন্যদের চেয়ে লাজুক এটি, যখন খুব করে খুঁজি তখন লুকিয়ে পড়ে। খোঁজাখুঁজি থেমে গেলেই ক্ষীণ স্বরে জানান দিয়ে যায় সে আছে। ডাক্তার কাউল নানান রকম যন্ত্রপাতি দিয়ে দেখে জানালেন আমার কানে কোন সমস্যা নেই। আমি কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থেকে বললাম,
“সমস্যা নেই মানে! রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা শব্দ শুনতে পাচ্ছি।”
“ওসব তোমার কল্পনা”
“তুমি বলতে চাও আমি মিথ্যে বলছি?”
“আমি সেটা বলিনি।”
“তাহলে যে বললে কল্পনা!”
“কল্পনা বলতে তুমি কী বোঝো নুফেল?”
“নওফেল।”
“আমি দুঃখিত নওফেল। যা বলছিলাম, কল্পনা বলতে তুমি কী বোঝো?”
“কল্পনা হচ্ছে সেই জিনিস যেটা বাস্তবে নেই।”
“তাই নাকি! আচ্ছা বাস্তবটাই বা কী তাহলে?”
আমি খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে যাই। ডাক্তার কাউল চোখ থেকে চশমা খুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমার হাতে এটা কী দেখছো?”
“কী আবার, তোমার চশমা।”
“তুমি দেখতে পাচ্ছো!”
“পাবো না কেন!”
“আমিও দেখতে পাচ্ছি, আমার সেক্রেটারি এলাকে ডেকে জিগ্যেস করো ও দেখতে পায় কিনা।”
“না না, তার দরকার নেই।”
“আরে দেখোই না, আমি এলাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
এলা বুকে কাঁপন ধরানো সুন্দরী। আগেও দেখেছি বুড়ো ডাক্তারদের সেক্রেটারিগুলো সব চোখ ধাঁধানো রূপ নিয়ে জন্মায়।
এলাকে দেখে আমার কান গরম হয়ে গেলো। সৌন্দর্যের ঝলসানিতে নয়, এমন সুন্দরী একটি তরুণীকে যে বোকা বোকা প্রশ্নটি করতে যাচ্ছি সে কারণে। একটা ঢোক গিলে বললাম,
“এলা, টেবিলে এটা কী?”
কোথায় যেন পড়েছিলাম, আলো শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী, তাই মুখ না খোলা পর্যন্ত বোঝা যায় না মানুষের বুদ্ধির দৌড়।
এলা আঙুল দিয়ে তাঁর সোনালি চুলের একটা গোছা পেঁচিয়ে আদুরে গলায় বলল,
“কোওওওনটা নুফেল?”
ভাবলাম নামটা শুধরে দিই, পরক্ষনেই মনে হোলো, বলছে বলুক না! নুফেল নামটা তো খারাপ নয়। যতটা সম্ভব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললাম,
“এই যে টেবিলের উপরে।”
“ও ——ও ——এ—— এ——টা! এটা একটা গ্র্যানাইটের স্ল্যাব। তুমি জানতে না?”
“তা জানবো না কেন, স্ল্যাবটা তো টেবিলেরই অংশ। আমি জানতে চাইছি টেবিলের উপরে যেটা রাখা তার কথা।”
“একটা চশমা!”
এলা খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। আমি ওর চোখের দিকে না তাকিয়েই বলি,
“আচ্ছা তুমি এবার ডাক্তার কাউলকে আসতে বলতে পারো।”
কাউল ঘরে ঢুকে মিটিমিটি হেঁসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“কী, এলা দেখতে পেয়েছে?”
“পেয়েছে”
ডাক্তার কাউল বাচ্চাদের মতো লাফিয়ে উঠে একটা হাততালি দিয়ে বললেন,
“তাঁর মানে আমার চশমাটা সত্যি সত্যি আছে! এমনকি আমি না থাকলেও আছে। এটাই বাস্তব। তোমার শব্দগুলো তুমি ছাড়া কেউ শুনতে পায় না। আমি না, এলা না, আমার অফিসের এই যে এতো এতো যন্ত্রপাতি দেখছো, এর একটাও না। তুমি নেই তো শব্দও নেই। সেজন্যেই বলেছি এসব তোমার কল্পনা।”
“তুমি একবার বললে শব্দগুলো আমার কল্পনা, আবার বললে আমি মিথ্যে বলছি না। আমি নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যাই নি!”
“না না, তা হবে কেন? তোমার হয়েছে টিনিটাস”
“কী টাস!”
“টিনিটাস। তোমার মস্তিষ্ক এই শব্দগুলো তৈরি করছে। তোমাকে শোনাচ্ছে, শুনতে না চাইলেও শোনাচ্ছে। ঠিক এই মুহূর্তে তোমার মতো প্রায় একশ মিলিয়ন মানুষ রয়েছে পৃথিবীতে। এদের কেউই উন্মাদ নয়।”
“অন্যদের কথা জানিনা, আমি কিন্তু পাগল হয়ে যাচ্ছি ডক্টর। দয়া করে আমাকে সাহায্য করো।”
“টিনিটাসের কোন চিকিৎসা নেই নওফেল। ডাক্তার হিসেবে আমি বলতে পারি তোমার শ্রবণক্ষমতা দুর্দান্ত, একটা উনিশ বছরের টগবগে তরুণের মতো তুখোড়। আমি তোমার মাথাটা একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই। এই কাগজটা এলার হাতে দিও, এম আর আই এর রেফারেল।”
“ধন্যবাদ ডাক্তার।“
“তোমার দিনটা শুভ হোক। আরেকটা কথা, খুব বেশি হট্টগোলের মধ্যে যাবে না কিছুদিন। যদি যেতেই হয় তাহলে কানে ইয়ার ফোনটা লাগিয়ে নেবে।”
ডাক্তারের অফিস থেকে বেরিয়েই মনে পড়লো শহরে এখন শরৎ কাল, বছরের শ্রেষ্ঠ দিন গুলো চলে যাচ্ছে হাতের মুঠো গলে। উদ্যানে, চাতালে, নদীর ধারে, এমনকি খোলা রাস্তা জুড়ে বসেছে মেলা, জমেছে সংগীত। যেদিকে তাকাই কেবল মানুষ আর মানুষ। মা’র হাত ফাঁকি দিয়ে টলমল পায়ে ছুট লাগানো শিশু, সংসারের হাড়িকুড়ি-বাজারসদাই-লন্ড্রি ভুলে হাত ধরে হাঁটতে থাকা পুরনো দম্পতি, একটা আইসক্রিম পালা করে খেয়ে চলা প্রেমিক- প্রেমিকা, দুরন্ত স্পর্ধায় মাথার টুপি সরিয়ে শেষ বিকেলের রোদ্দুরে বিহ্বল আপাত উদাসীন টেকো, কে নেই সেই ভিড়ে? আমার খুব ইচ্ছে করছে মিশে যাই, কিন্তু পারছিনা। বড় সশব্দ এই পৃথিবী। দুহাতে কান চেপে পালিয়ে এলাম নিজের ঘরে।
বড়জোর এগারো সেকেন্ড, প্রথমে এলো লাজুক পোকাটি। খ্যা খ্যা হাসিতে আমার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়ে পালিয়ে গেলো। সে হাসিতেই বোধকরি ঘুম ভেঙেছে বাকি দুজনের। পৃথিবীর কোনো ইয়ার প্লাগের সাধ্য নেই আমাকে এই ঐকতান থেকে বাঁচায়।
ভেবেছিলাম টেলিভিশনের শব্দে বুঝি চাপা দেওয়া যাবে অন্তর্নিহিত এই নিরন্তর কোলাহল। টিভি ছাড়তেই মনে হলো ভলিউমটা কেউ বুঝি স্বাভাবিকের তুলনায় পাঁচগুণ বাড়িয়ে রেখেছে। আসলে তা নয়, টেলিভিশন যেমন ছিল তেমনই আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সবকিছু অনেক জোরে, অনেক অনেক জোরে শুনতে শুরু করেছি আমি।
কী যেন একটা ভাবনা এসছিল মনে, কিন্তু শব্দের প্রবল অত্যাচারে সেটা ভুলে গিয়েছি। খিদেও পেয়েছে খুব, কিন্তু ফ্রিজ থেকে খাবার নিয়ে গরম করে খেতে সাহস হচ্ছে না। যদি হাত থেকে একটা চামচ পড়ে যায়! যদি মান্ধাতার আমলের মাইক্রোওয়েভটা হঠাৎ বিপ বিপ করে ওঠে কোন কারণ ছাড়াই?
অসুখ বিসুখ হলে আর যাই হোক গুগলকে জিগ্যেস করতে নেই। তারপরও করবো না করবো না করে গুগলে টাইপ করে ফেললাম, টিনিটাস। পাতা জুড়ে একটার পর একটা ভিডিওর লিংক। ভলিউম বন্ধ করে প্রথম লিংকটা খুললাম, অপশনে সাবটাইটেল থাকলে তাই দিয়েই চালিয়ে নেবো। আট মিনিটের এই ভিডিওটা দুইশ একাত্তুর হাজারবার দেখেছে মানুষ! আমি মিনিট খানেক দেখে বন্ধ করে দিলাম। শব্দ বন্ধ করে শব্দ নিয়ে লেকচার দেখা বেদনাদায়ক।
গুগল একটা আজব জায়গা। কোত্থেকে যে কোথায় নিয়ে যায়! কানের সমস্যা নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে গেলাম একটা গল্প। প্রাচীনকালের এক রাজার কাহিনী।
সে রাজার নাম নমরুদ। নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন তিনি। একদিন ঈশ্বরের নির্দেশেই নাকি একটা মশা ঢুকে পড়েছিলো তাঁর কানে। ডাক্তার এলো, বদ্দ্যি এলো, এলো মন্ত্র জানা শামান। কিন্তু কিসের কী? মশা জেগে রইলো তার সঙ্ঘারামে, আর একটানা গুনগুন শব্দে বিষময় হয়ে উঠলো নমরুদের জীবন। দিন যায়, রাত যায়। কাটে সপ্তা, মাস, বছর। নমরুদ না পারেন ঘুমুতে, না পারেন থাকতে জেগে। তিরিক্ষে মেজাজ নিয়ে ঘুরে বেড়ান এঘর থেকে ওঘর, কিন্তু কোথাও শান্তি নেই।
এমনি একদিনের কথা, রাজা তাঁর কপাল চেপে বসে রয়েছেন সিংহাসনে। পাশেই দাঁড়িয়ে খাস ভৃত্য। ভৃত্যের হাতে সুদূর চীন দেশ থেকে আনা সুদৃশ্য একটি পাত্র। পাত্রটা চীনা মাটির। নমরুদ সেখান থেকে একটা আঙ্গুর, দু কুঁচি আপেল, অথবা এক দানা বেদানা তুলে মুখে দেন, কিন্তু বিস্বাদ ঠেকে সে খাবার। বেদনার্ত রাজা ক্ষোভে দুঃখে আছড়ে ফেললেন পাত্রটি। ঝনঝন শব্দ তুলে ভেঙে খান খান হয়ে গেলো সে চৈনিক কীর্তি। রাজার চোখে আনন্দাশ্রু। যতক্ষণ ওই ঝনঝন শব্দটা ছিলো ততক্ষণ তিনি ভুলে ছিলেন নিদারুণ এই মশকরা।
কিন্তু রাজার ভাণ্ডারও একদিন ফুরোয় । রাজবাড়ির সমস্ত চিনামাটির পাত্র ভেঙে খানখান করার পর রাজা নজর ফেরালেন মন্ত্রিদের ঘরে, তারপর যথাক্রমে সেনাপতি, কোটাল, বিদূষক……। রাজ্যের চেনা অচেনা সবার চীনা পাত্র উজাড় করেও শান্তি এলো না। রাজা পড়লেন দারুণ চিন্তায়। নিজের রাজ্য থেকে নাহয় ছিনিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু চীন থেকে ছিনিয়ে আনা তো দূরের কথা, চেয়ে চিন্তে আনারও কায়দা নেই! চাই নগদ কড়ি, আর চাই সময়। কম পক্ষে ছয় মাস। রাজা ভাবেন আর ভাবেন।
একদিন ভাবতে ভাবতে তন্দ্রামতো এসে গিয়েছিলো। একটু ঢুলে উঠতেই মাথাটা গিয়ে ঠোকর খেলো সিংহাসনের কাঠে। আনন্দে ঝলমল করে উঠলো রাজার মুখ। আসল ওষুধ চিনতে পেরেছেন তিনি। রাজ্যের সেরা কাঠমিস্ত্রি ডেকে বানানো হলো চন্দন কাঠের মুগুর। দায়িত্ব বাড়লো খাস ভৃত্যের। সেই মুগুরের ঘায়েই একদিন পটল তুললেন রাজা।
ইতিহাস নমরুদের প্রতি অবিচার করেছে। তাঁর কানে মশা ঢোকেনি। আর ঢুকলেই বা কী? কতদিন বাঁচে একটা মশা? তিন, চার, সাত? আমি নিশ্চিত, তাঁকে পেয়েছিলো টিনিটাসে। তিনি তাতেই টেঁসে গিয়েছেন। কিন্তু আমার কী হবে? আমিতো খাই স্টাইরোফোমের প্লেটে। খাওয়া সেরে ধোয়াপাল্লার ঝুটঝামেলা নেই। মাসে খরচা পনেরো ডলার। ধূতে গেলে পানির বিলই আসতো এর চেয়ে বেশি।
*************************
সাতদিন পর অফিসে ফিরতেই আমাকে দেখে সবাই কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেলো। প্রয়োজন না পড়লে কেউ কথা বলছে না। আর বললেও বলছে ফিসফিস করে। এরা জেনে গিয়েছে দেখছি!
একটা ই-মেইল পাঠিয়েছিলাম ছুটি চেয়ে। এমনিতে বেশ হাট্টাকোট্টা মানুষ আমি। কোনোদিন সিক লিভ জমিয়ে রাখার কথা মাথায়ও আনিনি। শীতকালে ছুটি নিয়ে হবেটা কী! মাইনাস থার্টি ডিগ্রিতে আমোদ করতে বাইরে যায় কোন মূর্খ? নেহাৎ বিপদে পড়ে টিনিটাসের কথাটা লিখতে হয়েছে, সেই সাথে ডাক্তার কাউলের চিঠি। মিরেলা যে এতো পেট পাতলা কে জানতো!
মিরেলা আমার বস।
এদেশের অফিস আদালতের নিয়ম কানুন বড় অদ্ভুত। ধুপধাপ একে তাকে ধরে বস বানিয়ে দেয়। আমি যে সাতটা বছর খেঁটে মরলাম তার কোন মূল্যই নেই। জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হয়ে ঢুকেছিলাম, এখনও তাইই আছি। অথচ এই সেইদিন ইন্টার্ন করতে আসা বাচ্চা মেয়েটা তরতর করে ম্যানেজার হয়ে গেলো! এই দেশে পরিশ্রমের দাম নেই, দাম আছে সম্ভাবনার। পঁচিশ বছরের খুকি খুকি চেহারার মেয়েটার ভেতর কী এমন সম্ভাবনা দেখেছে হেড অফিস, আমি ভেবে পাই না।
মিরেলা নিজেই এলো আমার অফিসে। এমনিতে সে বেশ খটখটিয়ে হাটে। আজ এসছে বেড়ালের মতো, নিঃশব্দে। বোধহয় আমার কথা ভেবে। সেই লাল রঙের হাতুড়ি মার্কা হিল উঁচু জুতোজোড়া পড়েই। কেমন করে পারে! অবশ্য মেয়েরা নাকি অপার্থিব কিছু ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়।
বসে বসে আমার ফাইলগুলো ঘাঁটছিলাম। হাতে বেশ কয়েকটা প্রজেক্ট ছিলো, তার কোনটাই এখানে দেখতে পাচ্ছি না। এক একবার মনে হচ্ছে যেন ভুল করে অন্য কারও অফিসে চলে এসেছি। মিরেলার গলা শুনে চমকে উঠলাম। তার চেয়েও বেশি চমকালো মিরেলা। খুব দ্রুত সামলে নিয়ে বললো,
“আমি কি বেশি শব্দ করে ফেলেছি নওফেল?”
ডাক্তার কাউল আমাকে একজোড়া ইয়ারফোন দিয়েছেন। সে ইয়ারফোনে অবিরাম ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে, অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা আর কি। ইয়ারফোনের শব্দ আর ইয়ারফোনিক শব্দে কাটাকাটি। এঁটুলিটা এখনও জ্বালিয়ে মারছে, তবু মন্দের ভালো। তিন নম্বরটা এখন আসে কেবল ঘুমোনোর সময়।
আমি গদগদ গলায় বললাম,
“কী যে বলো মিরেলা? আসলে তুমি যে এসেছো আমি টেরই পাই নি।”
“তোমার কানের ব্যাপারে আমি দুঃখিত। আশা করি সুস্থ হয়ে উঠবে দ্রুতই। তবে কিনা এই কান নিয়ে তোমার উপর ঠিক ভরসা করতে পারছি না এখন।”
আমার শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল একটা স্রোত নেমে গেলো। ছাঁটাই করে দেবে নাকি!
মিরেলা আমার ফাইলগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে বললো,
“ভয়ের কিছু নেই। তোমার উপর হেড অফিসের পূর্ণ আস্থা রয়েছে। ধরে নাও এটা শুধুই একটা সাময়িক ব্যাবস্থা। আমাদের কাজের যা ধরন, তোমার এই টিনিটাং নিয়ে……”
“টিনিটাস, মিরেলা।”
“ ও হ্যাঁ, টিনিটাস। ভুলের জন্য দুঃখিত। যা বলছিলাম, তোমার এই টিনিটাস নিয়ে শহরের ভেতর প্রজেক্ট চালিয়ে যাওয়া মুশকিল হবে। আমি শুধু তোমার বস নই, একজন কলিগ হিসেবেও বলছি নওফেল, অফিস তোমার অভিজ্ঞতার কদর করে। আগামী কিছু দিন তুমি কান্ট্রি সাইডের কাজকর্ম দেখবে। ঝটপট গুছিয়ে নাও। তারপর সোজা গ্লুটেনবার্গ, নতুন প্রজেক্ট। এই কান নিয়ে প্লেনে যেতে পারবে? নাকি ড্রাইভ করতে চাও?”
“প্লেনেই যাবো মিরেলা। শব্দটায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু। শহরেই রাখতে পারতে।”
মিরেলা অদ্ভুত সুন্দর একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো।
মিরেলার কী সম্ভাবনা আছে আমি জানিনা। তবে দয়া মায়া বা এই জাতীয় মানবিক কোন অনুভূতিই মেয়েটার নেই। ফেব্রুয়ারির কনকনে শীতে পার্কিং লটে জমে থাকা বরফের চাঁইয়ের মতোই শীতল সে।
মনটাই দমে গেলো আমার। শহরের প্রজেক্টের কোন তুলনা হয়! এখানে আমার কাজ সব অল্প বয়স্ক মানুষদের নিয়ে। কান্ট্রি সাইডে গিয়ে তো পাবো হয় ঘাটের মরা বুড়ো, নইলে যমের অরুচি কোন বুড়ি! শেষ বয়সে ছুটি কাটাতে আসা ফালতু মানুষ সব। অবশ্য এসব ভেবে এখন কী লাভ! মিরেলার কথার কোন নড়চড় হবে না। এই প্রগাঢ় হিমশৈল বসন্তে কেন, অগাস্টের গনগনে গরমেও গলবার নয়।
*****************************
গুগল ম্যাপে শহর কথাটা লেখা থাকলেও গ্লুটেনবার্গ আসলে একটা গ্রাম। সব মিলে বড়জোর হাজার দুয়েক মানুষের বসবাস এখানে। সংখ্যাটা গ্রীষ্মকালে কিছুটা বাড়ে টুরিস্টদের কারণে। কয়েক দশক আগেও মাছ ধরা ছিলো এখানকার মানুষদের প্রধান পেশা। তখন পাথুরে সৈকত জুড়ে বাঁধা থাকতো সারি সারি নৌকা। সৈকত ছাড়িয়ে রাস্তা পেরুলেই চোখে পড়তো তিনশ বছরের পুরনো একটা বাজার। সে বাজারে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতো সদ্য ধরে আনা কড মাছের তাজা গন্ধ আর বোতল উপচানো বিয়ারের ফেনার সুবাস। গ্লুটেনবার্গ ছিলো নোভাস্কশিয়ার গমগমে জনপদগুলোর একটি।
তিনশ বছরের ক্রমাগত অত্যাচারেই বোধহয়, মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে রুপোলী মাছেরা। বদলে গিয়েছে গ্লুটেনবার্গ। পেশা পাল্টে অনেকেই নেমেছে পর্যটনের ব্যাবসায়, কিন্তু সে ব্যাবসা খুবই সীমিত। এখানে ভালো কোন হোটেল নেই, হবার কোন সম্ভাবনাও নেই। সরকার আইন করে দিয়েছে যাতে পুরনো স্থাপনা ভেঙে কেউ নতুন কিছু করতে না পারে। ঐতিহ্য সংরক্ষণ বলে কথা! পুরনো সেই বাড়ি-বাজার-গুদাম-গির্জা সব রয়েছে, কিন্তু কমছে মানুষ। চলে যাচ্ছে যে যেদিকে পারে। আটলান্টিকের জলে সূর্য ডুবিয়ে ফিরে আসা নৌকা নয়, এখন সন্ধ্যে বেলায় সৈকতে গেলে চোখে পড়ে প্লাস্টিকের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকা কিছু মানুষ, সূর্যাস্তের দিকে যাত্রা তাঁদের। এমন হতশ্রী একটা শহরে যে আমাদের প্রজেক্ট থাকতে পারে সেটা মিরেলা না বললে আমার বিশ্বাস হতো না।
টরন্টো থেকে গ্লুটেনবার্গের দূরত্ব আঠারো ‘শ বাহাত্তুর কিলোমিটার। পুরোটা রাস্তা একটানা হাইওয়ে স্পিডে চালিয়ে গেলেও আঠারো ঘণ্টা লাগে। প্লেনে মাত্র ঘণ্টা তিনেক। মিরেলা হয়তো ঠাট্টা করেই বলেছিলো ড্রাইভ করার কথা! যদিও ঠাট্টা করার মেয়ে সে নয়। মানুষকে অহেতুক যন্ত্রণা দেবার আশ্চর্য একটা ক্ষমতা যে ওর রয়েছে তার প্রমাণ আমি অনেকবার পেয়েছি।
হোটেলের নাম ‘রাম রানার ইন’। গ্লুটেনবার্গের তিনটে হোটেলের মধ্যে এটার অবস্থাই সবচেয়ে খারাপ। তার চেয়েও খারাপ রিসেপশনে বসে থাকা ম্যানেজার স্যামুয়েল ডেভিডের মেজাজ। আমাকে দেখেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলো।
“গুড মর্নিং। কতো দিন থাকবে?”
ডেস্কের উপর ক্যাপ্টেন মর্গ্যানের বোতল দেখে বুঝলাম ডেভিড রামভক্ত। যেন তেন ভক্ত নয়, কঠিন ভক্ত, নইলে সাত সকালেই ভক্তিরস এমন উথলে ওঠে!
“আপাতত এক মাস, ভালো লাগলে দুমাসও থাকতে পারি।”
“পুরো টাকাটাই কিন্তু অ্যাডভান্স দিতে হবে।”
আমার কোন আপত্তি নেই। নিজের টাকা তো আর না, অফিসের প্রজেক্ট, অফিসের টাকা।
চেক ইন করতে করতে জানলাম বিল্ডিঙটা একটা সময় মাছের গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সে অবশ্য বলে না দিলেও চলে। দেয়ালে দেয়ালে গন্ধ যেন এখনও লেপ্টে রয়েছে। শহরের ভেতরে দেখা অন্য হোটেলদুটোর কথা ভেবে মনটা হুহু করে উঠলো আমার। কিন্তু ভেবে আর কী লাভ! মিরেলা পই পই করে বলে দিয়েছে যেন সৈকতের কাছাকাছি থাকি। রুমের চাবি বুঝে নিয়ে নাক চেপে সরু করিডোর ধরে চললাম দোতলার দিকে। সব সুদ্ধ আঠাশটা রুম রাম রানার ইন এ।
কী প্রজেক্ট তা এখনও জানিনা, অফিস থেকে কাগজপত্র এলে জানতে পারবো। কাল সকালের ডাকেই চিঠি এসে যাবার কথা। মিরেলার কথার কখনো নড়চড় হয় না।
গোসল করে জামা কাপড় পাল্টে নিচে নেমে দেখি আরও বেশ কয়েকজন ভিড় জমিয়েছে ডাইনিং হলে। একদল বুড়ো বুড়ি, একটা বড় টেবিলের চারদিকে গোল হয়ে বসে কলকল করছে। পাশের টেবিলে আমি যে এসে বসেছি সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। অবশ্য বুড়োদের দিকে আমিই বা ফিরে তাকিয়েছি কবে? কিছুক্ষণ বসে থেকে কান লাল হয়ে গেলো আমার। বয়সের সাথে সাথে মানুষের মুখের আগল টাগল চলে যায় নাকি! বুড়োরা তো বটেই, বুড়িরা পর্যন্ত রীতিমতো খিস্তি করে কথা বলছে। আর খিস্তির সে কি ধরন! টিন এজারদেরকেও ছাড়িয়ে যাবে। কোনমতে দুটো টোস্ট আর একটা ডিম পোঁচ গিলে কফি হাতে বেরিয়ে এলাম।
ভেতরে যতটা খারাপ, বাইরে থেকে ততোটাই সুন্দর রাম রানার ইন। এবড়ো থেবড়ো পাথর গেঁথে গড়ে তোলা কলোনিয়াল স্থাপত্যের বিল্ডিং। বিল্ডিঙের তিনদিক জুড়ে পাইন গাছের সারি। সামনের খোলা উঠোন থেকে একটা পাথুরে সিঁড়ি নেমে গিয়ে মিশেছে সৈকতের বালুতে। কিছুদূর হাঁটলেই আটলান্টিক। বালু আর জলের মাঝখানে পাথরের দেয়াল। প্রকৃতিই বানিয়ে রেখেছে, কে জানে কতো লক্ষ বছর আগে!
এই মুহূর্তে আমি ছাড়া সৈকতে আর কেউ নেই। থাকার কথাও নয়। বুড়োরা ব্রেকফাস্ট করে আবার ঘুম দিয়ে বেরুতে বেরুতে সেই দুপুর। সকালের মিঠে রোদে তাদের আকর্ষণ নেই, তারা চায় মধ্য দিনের উত্তাপ। আমি একটা পাথরের উপর গিয়ে বসলাম।
কতক্ষণ বসেছিলাম বলতে পারবো না, পেছনে একতা হৈচৈ শুনে তাকিয়ে দেখি পাঁচ ছয় জনের একটা দল সমুদ্রের দিকে আসছে। সব কজনই কালো। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। তার মানে এই নয় যে আমি রেসিস্ট। বন্ধুদের মধ্যে কালোদের সাথেই আমার ওঠাবসা বেশি। মুশকিল হচ্ছে এরা বড় আমোদ প্রিয়। কে কী ভাবলো তার খুব একটা তোয়াক্কা করেনা। ছেলে বুড়ো সবাই।
আমি ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছি। এই বুঝি একটা স্পিকার বের করে নাচানাচি শুরু করে দেয় ওরা। আজকাল স্পিকারগুলোও যা বেরিয়েছে! দেখতে ছোটো কিন্তু আওয়াজে বিশ্বকর্মার কামারশালাকেও হার মানায়।
সব মিলে ছয়জন মানুষ।
দুজন মাঝবয়সি মহিলা, তিনজন অল্পবয়স্ক মুশকো মুশকো তরুণ।
আর দেবী প্রতিমার মতো একটি মেয়ে। বয়স খুব বেশি হলে বিশ কি একুশ।
কেমন যেন একটা বিপন্নতা ছড়িয়ে রয়েছে দেবীর চোখে মুখে- ছোট ছোট করে ছাঁটা তার কোঁকড়া চুলের ভাঁজে।
চোখে চোখ পড়তেই মাথা থেকে টুপিটা খুলে একটু ঝুঁকে বললাম,
“সুপ্রভাত! সকালটা কিছুক্ষণ আগেও এতো ঝলমলে ছিলো না। আমার নাম নওফেল। নওফেল আনোয়ার।”
দলটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। মাঝবয়সী মহিলা দুজন ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে। মুশকো তিনজন খুব একটা পাত্তা না দিলেও বোঝাই যাচ্ছে এমন উটকো ঝামেলায় মোটেও আহ্লাদিত নয় তারা।
মেয়েটা আমার দিকে ফিরেও তাকালো না।
ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এমনটা সাধারণত ঘটে না। আমি মানুষটা দেখতে খারাপ নই, কথাবার্তায় পোশাক আশাকে একজন ধারালো এক্সিকিউটিভ যেমন হয় তেমনই। কী করবো বুঝতে না পেরে বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
হঠাৎ আকাশ পাতাল ফাটিয়ে চিৎকার করে একটা লাফ দিয়ে আমার কোলে উঠে পড়লো মেয়েটা। পড়ে যেতে যেতে সামলে নিয়ে দেখি, একটা কাঁকড়া। লাল টুকটুকে সেই কাঁকড়াটি মেয়েটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখান দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাচ্ছে। ভয় সেও কম পায়নি।
মেয়েটা আমার ঘাড়ে মুখ গুঁজে থরথর করে কাঁপছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে কাঁপুনি রূপ নিলো খিলখিল হাসিতে। খিল খিল হাসি পরিণত হলো অট্টহাস্যে। হাসছে আর কী যেন বলছে হড়বড় করে।
“হি হি হি হি। মার্সি, মার্সি। হি হি হি হি হি। জে সুই ডেজোলে। জে নেইম পা’লে ক্র্যাব। হি হি হি হি হি”
শব্দগুলো কানে গেলেও মাথায় ঢুকতে কিছুটা সময় লাগলো যেন! ভাগ্যিস চাকরিতে ঢোকার পর ফ্রেঞ্চটা আমাকে শিখতে হয়েছিলো!
আমার কোল থেকে ঝুপ করে নেমে পড়ে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি ফরাসিতেই বললো,
“আমার নাম ওডে। আর তুমি বোধহয় নওফেল, তাইনা?”
******************************
ভেবেছিলাম বিকেলে শহরটা ঘুরে দেখে আসবো। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে যাওয়ায় সে পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আপাতত বসে রয়েছি হোটেলের রিসেপশনে। দেয়ালে ঝোলানো মান্ধাতার আমলের একটা টিভিতে বিদঘুটে এক খেলা চলছে।
খেলার নাম কার্লিং। ছেলেবেলায় মোহাম্মদপুরের অলিতে গলিতে আমরা যেমন মার্বেল খেলতাম অনেকটা সেই ধরনের খেলা। এক এক দলে তিনজন করে খেলোয়াড়, এদের একজনের কাজ বরফের উপর দিয়ে পিছলে গিয়ে হাতল আলা একটা ঘটিকে হাত দিয়ে সামনের দিকে ঠেলে দেওয়া, বাকি দুজন ঝাঁটা হাতে প্রাণপণে ঝাড়ু দিয়ে মসৃণ করে চলেছে ঘটির চলার পথ। মার্বেল খেলার সেই তুমুল উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও নেই কারলিং এ। কেন যে এই খেলাটি এতো জনপ্রিয় সে আমার মাথায় ঢোকে না। শুধু যে জনপ্রিয় তাই নয়, প্রথম সারির খেলোয়াড়েরা নাকি রীতিমতো মিলিওনিয়ার। অনেক কষ্টে মিনিট দশেক সহ্য করার পর যখন ভাবছি কী করা যায় তখনই পেছন থেকে খুক খুক কাশির শব্দে ঘুরে দেখি স্যামুয়েল ডেভিড, কাশছে না বরং হাসছে। ভদ্রতা করে জিগ্যেস করলাম,
“এতো হাসির কী হলো ডেভিড?”
“স্যাম। লোকে আমাকে স্যাম বলেই ডাকে। হাসছি কারণ রাম ফুরিয়ে গিয়েছে।”
“এতে হাসির কী আছে!”
“হাসবো না! দিনের অর্ধেকটাই যে বাকি এখনো। বাদ দাও সে কথা, তোমার খবর বলো। গিয়েছিলে কোথাও?”
“সকালে সৈকতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে এসেছি। এখন এই বৃষ্টিতে আর বেরুতে ইচ্ছে করছে না।”
“এটা কোনো কথা হলো নাকি? সমুদ্রপারের শহরে বৃষ্টি তো থাকবেই। এক কাজ করো, মাইল খানেক হাঁটলেই ওয়ার মিউজিয়াম। এমন জিনিস আর কোথাও পাবেনা, হু হু।”
“কোথাও পাবো না মানে? এরকম মিউজিয়াম তো অনেক জায়গাতেই আছে।”
“গ্লুটেনবার্গে সব মিলিয়ে কতগুলো যুদ্ধ হয়েছে জানো? ফ্রেঞ্চ-ইন্ডিয়ান লড়াই থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সব মিলিয়ে এগারোটা। মিউজিয়ামে সবগুলো যুদ্ধের কিছুনা কিছু সুভেনির রয়েছে। পুরো আড়াই’ শ বছরের ইতিহাস।”
স্যামের কাছেই জানলাম এ এলাকাটা আগে ছিলো ছিলো মিকম্যাকদের। এরা যাযাবর, ঋতুর সাথে তাল মিলিয়ে যখন যেখানে সুবিধা সেখানেই তাঁবু গেঁড়ে কাটিয়ে দিতো কিছুদিন। তিনশ বছর আগে যখন আট ঘর ফরাসি এখানে এসে বাড়ি বানিয়ে থাকতে শুরু করলো তখন মিকম্যাকরা খানিকটা অবাক হলেও বাধা দেয়নি। দেশটাতো আর কম বড় নয়, তাছাড়া মাটিকে যে মালিকানা দিয়ে আটকে ফেলা যায় সেই ধারণাটাই ওদের ছিলোনা।
গ্লুটেনবার্গের ইতিহাস যুদ্ধের ইতিহাস, তবে সে ইতিহাসে ভূমিপুত্র মিকম্যাকদের ভুমিকা সামান্যই। পড়ে পড়ে মার খাওয়াকে তো আর যুদ্ধ বলে না। কামান বন্ধুকের কাছে মিকম্যাকদের তীর-ধনুক আর বর্শা পাত্তাই পায়নি। ফরাসিদের পথ ধরে পরবর্তীতে এসেছিলো পর্তুগীজরা, কিছুদিন পর মাস্তুলে ইউনিয়ন জ্যাক উড়িয়ে ব্রিটিশ জেনারেল এডওয়ার্ড কর্নওয়ালিস। যুদ্ধ যা করার ওরাই করেছে। আর মিকম্যাকরা ছড়িয়ে পড়েছে মূল ভূখণ্ডের আনাচে কানাচে। এখন একটা টোটেম পোল ছাড়া ভূমিপুত্রদের কোন চিহ্নই আর খুঁজে পাওয়া যায় না গ্লুটেনবার্গে।
টোটেম পোলটা নিয়ে নাকি রয়েছে আজগুবি সব গল্প। রাম ভক্ত স্যামের তাড়া থাকায় গল্পগুলো আর শোনা হলো না।
একটা ছাতা যে কেন সংগে করে আনিনি সেই দুঃখে বুক ফেটে যাচ্ছে। এক মাইল হাঁটা কি মুখের কথা? নেতিয়ে পড়া মুড়ির মতো ঝিমোনো বৃষ্টি নয়, বৃষ্টি হচ্ছে ঝমঝমিয়ে। তবে এখানে বসে থাকতেও খুব একটা খারাপ লাগছে না। বৃষ্টির শব্দে ঢাকা পড়ে গিয়েছে টিনিটাসের যন্ত্রণা।
ওডের সাথে সকালটা দারুণ কেটেছিলো। মা, খালা আর তিন ভাইকে নিয়ে গ্লুটেনবার্গে বেড়াতে এসেছে ওরা। উঠেছে শহরের ভেতরে কোন একটা বাড়িতে। কথায় কথায় ওডে বললো, সমুদ্র ওর একদম পছন্দ নয়। কেমন যেন অসম্পূর্ণ লাগে। মনে হয় কী যেন থাকার কথা ছিলো, কিন্তু নেই। শুনে আমার এতো অবাক লাগলো! জীবনে অনেক সৈকতে ঘুরেছি, আমারও এই একই অনুভূতি হয়েছে প্রতিবার। এমনকি কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত এই সৈকতটাকেও খুব একটা আলাদা কিছু মনে হয়নি। আমি জিগ্যেস করলাম,
“ভালো না লাগলে সমুদ্রের কাছে এলে কেন?”
ওডের হাসি যেন জোয়ারের বাঁধ ভাঙা ঢেউ। আমার কলজেটাকে একেবারে দুমরে মুচড়ে দিয়ে থামলো সে। তারপর লম্বা একটা নিশ্বাস ছেড়ে আদুরে গলায় বললো,
“ফারগুসন আসতে বললো তাই।”
এই ফারগুসনটা আবার কে? ওর বয়ফ্রেন্ড নাকি! আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওডের চোখের দিকে তাকাই। ওডে মাছি তাড়াবার মতো একটা ভঙ্গি করে বললো,
“মিস্টার ফারগুসন আমাদের পারিবারিক ডাক্তার। বলেছে কিছু দিন যেন সমুদ্রের খোলা হাওয়ায় বেড়িয়ে আসি। আমার খুব শক্ত একটা অসুখ করেছে কিনা!”
আমি কী বলবো ঠিক বুঝে পাই না। মানুষ সাধারণত অসুখ বিসুখের কথা অচেনা কাউকে এমন হাসতে হাসতে বলে ফেলে না। আর ওডেকে দেখে এতোটুকুও অসুস্থ মনে হচ্ছেনা আমার। মেয়েটার সম্ভবত খেলছে আমাকে নিয়ে। অন্যায়, এ ঘোরতর অন্যায়।
খেলছে খেলুক, আমিও তো আর ঘাস চিবিয়ে বড় হইনি।
ওডের তিন ভাই হাত ছোঁয়া দূরত্বে বসে তাস খেলছিলো। বয়স্ক মহিলা দুজন ওদের কানে কানে কিছু একটা বলতেই একজন উঠে এসে আমার পিঠে হাত দিয়ে বললো,
“অনেক ধন্যবাদ নওফেল। তোমার দিনটা শুভ হোক।”
দারুণ অভদ্র না হলে এভাবে কথার মাঝখানে কেউ চলে যেতে বলে না। ওডে নিজেও খুব বিব্রত হয়েছে। একবার মনে হলো কিছু একটা বলবে, কিন্তু বলতে গিয়েও বললো না।
ওরা চলে যাবার পর একটা পাথরের উপর বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ বসে ছিলাম। মনে হচ্ছিলো পায়ের তলায় ঢেউয়ের আছড়ে পড়া, আমার কানের তিনটে পোকা, আর অযুত-নিযুত-অর্বুত বালুর কণায় আচ্ছন্ন এই সৈকত, কোন কিছুই সত্য নয়। খাপছাড়া কিছু স্বপ্ন দেখে চলেছি আমি। হয়তো কাজের ফাঁকে তন্দ্রায় ঢুলে পড়েছিলাম। এক্ষুনি শক্ত হিলের খটাস খটাস আওয়াজ তুলে মিরেলা আসবে, জানতে চাইবে প্রজেক্ট এগুলো কতদূর!
ওডে আমাকে একটা কথা মিথ্যে বলেছে। হোটেলে ফিরেই ওর নামটা গুগল করেছিলাম। এমন নাম এর আগে কখনো শুনিনি। গুগল বললো শব্দটা নাইজেরিয়ান। অনেক অনেক আগে সেখানকার এক রাজকন্যাকে এই নামে ডাকতো লোকে। সেই রাজকন্যা ছিলো ভীষণ বোকা। ওডে শব্দের মানে ‘বেকুব’। এখন নিজেকেই আস্ত একটা বেকুব মনে হচ্ছে আমার।
****************************
কাল আর বের হইনি। দুদিন পরেই প্রজেক্ট শুরু হয়ে যাবে, কী লাভ এখন বৃষ্টিতে ভিজে, শুধু শুধু জ্বর বাঁধিয়ে? আজ ঘুম থেকে উঠেই সকাল সকাল নাস্তা করে বেরিয়ে পড়েছি, গন্তব্য গ্লুটেনবার্গ মিউজিয়াম। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করলাম কেমন করে যেন সৈকতে চলে এসেছি। ভাগ্যিস এসেছিলাম!
কালকের সেই দলটা চাদর পেতে বসে রয়েছে পাথরগুলোর কাছে। ওডে আমাকে দেখেই হাত নাড়লো। একবার ভাবলাম আমিও হাত নেড়ে চলে যাই। কালকের অপমানটা দগদগে ঘায়ের মতো জ্বালাচ্ছে খুব। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওডে নিজেই উঠলো।
পেছনে সমুদ্র।
সমুদ্রের সীমান্ত ছুঁয়ে ঘন নীল আকাশ।
ভেজা বালুতে ছিপছিপে তীরের মতো দাঁড়িয়ে ওডে।
আর আমি যেন সেই নির্বোধ কিশোর, কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি যাতে বিদ্ধ হই। মাত্র একশ গজ, হেঁটে আসতে যেন অনন্ত কাল পেরিয়ে যাচ্ছে। আমারও কি পা বাড়ানো উচিৎ!
“ডাকলাম, অথচ এলেনা যে নওফেল!”
“কী করে বুঝবো যে আমাকেই হাত দেখিয়েছো? কতো আজে বাজে লোকই তো বেড়াতে আসে এখানে!”
খোঁচাটা হজম করে নিয়ে ওডে বলল,
“আমার ভাইদের ব্যবহারে কিছু মনে কোরোনা। বেশিক্ষণ রোদে থাকতে মানা আমার। ওরা তাই খুব অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো।”
“তোমার অসুখটা কী?”
“সে আছে একটা। তুমি তো ওই হোটেলটাতেই উঠেছো, তাইনা?”
“হু, কেমন করে জানলে?”
“জানতাম না, এখন জানলাম।”
খুচরো কথা বার্তা সব। পাশাপাশি হাঁটছি আমরা। তিন ভাই কিছুটা দূরত্ব রেখে আমাদের পেছন পেছন। আমি চারপাশে একবার তাকাই। নাহ, একটা কাঁকড়াও নেই এই চরাচরে।
“তোমার বাড়ি কোথায় ওডে? কোথায় থাকো?”
“লাভাল, কুইবেক সিটির পাশেই। তুমি?”
“তোমার থেকে খুব বেশি দুরে নয়, টরন্টোতে।”
“হা হা হা, আটশো কিলোমিটার কিন্তু খুব একটা কাছেও নয়। কী করো তুমি?”
“যদি বলি আমি একজন আর্কিটেক্ট, বিশ্বাস করবে? লোকে তো বানিয়ে বানিয়ে কতো কথাই বলে, নাম পর্যন্ত বদলে ফেলে মানুষ!”
“তাই নাকি! তোমার নাম তাহলে নওফেল নয়?”
“বিশ্বাস না করলে আমার কিচ্ছু করার নেই। তবে কিনা, হোটেলের খাতায় ওটাই লেখা আছে। গিয়ে দেখে আসতে পারো।”
“দাওয়াত দিতে চাইছো? আমরা কিন্তু অনেকগুলো মানুষ।”
“তাই তো দেখছি। আচ্ছা তোমার ভাইগুলো কি যমজ? দেখতে কিন্তু বেশ কাছাকাছি তিনজন।”
“আরে নাহ, যমজ হবে কেন? তোমাদের চোখে আসলে সব কালোদের একই রকম লাগে।”
“তোমার সাথে কিন্তু তোমার মা-খালার কোন মিল নেই।”
শুধু যে চেহারায় অমিল তা নয়। এই দলটায় ওডে যেন বড্ড বেমানান। ওর চলা ফেরা, কথাবার্তায় কিছু একটা আছে যা বাকি পাঁচ জনের নেই। পাশাপাশি দাঁড়ালে মনে হয় অন্যেরা বুঝি ওর কর্মচারী।
ওডে জবাব না দিয়ে মিষ্টি করে হাসলো কেবল। তিন ভাই এগিয়ে আসছে দ্রুত। মেঘ কেটে গিয়ে রোদ উঠেছে, চড়চড় করে বাড়ছে সেই রোদ।
কি মনে করে ওডের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললাম,
“তোমার পাহারাদারেরা তো চলে এলো। শহরে একটা ওয়ার মিউজিয়াম আছে, আমি এখন ওদিকেই যাচ্ছি। তুমি যাবে?”
ওডের হাসি হাসি মুখটা হঠাৎ করে শ্রাবণের মেঘের মতো মলিন হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস নওফেল। আমার ভালো লাগেনা।”
মিউজিয়ামে যাবার পথে হোটেলে ঢু মেরে স্যামকে জিগ্যেস করলাম আমার কোনো চিঠি এসেছে কিনা। আসেনি। আজকে আর ডাক আসবেনা।
মিরেলা এতো দেরি করছে কেন! প্রজেক্টের প্ল্যান তো যত দূর জানি তৈরি হয়েই আছে। অবশ্য সে সব আমার ভাবনা নয়। আমি হলাম জুনিয়র এক্সিকিউটিভ। আমার কাজ কেবল প্রজেক্ট এক্সিকিউট করা।
মিউজিয়ামটা সত্যিই সুন্দর। বড় একটা তিনতলা দালান। মাঝখানটা একেবারে ফাঁকা, চারিদিকে বৃত্তাকারে সাজানো গ্যালারি, গ্যালারিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আস্ত্রসস্ত্র, যুদ্ধের পোশাক, দলিল-দস্তাবেজ। ফাঁকা অংশটায় বিশাল একটা গাছের গুঁড়ি, ওঠে গিয়েছে সোজা ছাঁদ বরাবর। কাছে গিয়ে দেখি গুঁড়ি জুড়ে নানান ধরনের ছবি আঁকা।
পাশেই দাঁড়িয়েছিলো কলেজের অধ্যাপক টাইপের মাঝ বয়সী একজন মানুষ। আমি জিগ্যেস করলাম, এটাই কি টোটেম পোল? লোকটা গম্ভীর গলায় জবাব দিলো,
"এ এলাকায় এই একটাই আছে।”
কী অপূর্ব একটা শিল্প কর্ম! না জানি কোন ক্ষণজন্মা শিল্পীর কীর্তি। আমি লোকটাকে আবার জিগ্যেস করলাম,
“শুনেছি টোটেম পোলটা নিয়ে কি নাকি সব গল্প রয়েছে।”
লোকটা হেসে উঠলো। এখন আর অধ্যাপকের মতো কাঠখোট্টা লাগছে না তাকে।
“রাম রানার ইনে উঠেছো, তাই না?”
“হ্যাঁ, তাই! কিন্তু তুমি কী করে জানলে?”
“কোন গল্প টল্প নেই, বুঝলে। ও সব স্যামের বানানো কথা। ওর কাজ হচ্ছে সারাদিন পড়ে পড়ে মদ গেলা আর আজগুবি সব কেচ্ছা ফাঁদা। স্যামের ধারণা ওর গায়ে মিকম্যাকদের রক্ত আছে, হা হা হা।”
“কিন্তু গল্পটা কী?”
“মিকম্যাকরা আর দশটা যাযাবর ট্রাইবের তুলনায় বেশ সভ্য ছিলো, মানে লিখতে পড়তে পারাকে যদি সভ্যতার মাপকাঠি ধরো। এই যে ছবি গুলো দেখছো, এগুলো কিন্তু শুধুই ছবি নয়। এগুলো ওদের লেখা। হায়ারোগ্লিফিক্সের নাম শুনেছো?”
“হ্যাঁ শুনেছি। মিশরীয়দের চিত্রলিপি।”
“বাহ, তুমি তো বেশ জানাশোনা লোক দেখছি হে! চিত্রলিপিই বটে। টোটেম পোলটার পাশেই দেখ পুরনো আমলের একটা ঢাউস খাতা পড়ে আছে। মিকম্যাকদের চিত্র লিপি নিয়ে এতো ভালো কাজ আমার মিউজিয়াম ছাড়া আর কোথাও পাবেনা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এই লেখাগুলো আমরা পড়তে পারছি না। সংকেতে লেখা সব। ভাবো একবার, একেতো হায়ারোগ্লিফিক্স, তার উপর সংকেতর প্যাঁচ। পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আমার মতো কতো কিউরেটর চুল পাকিয়ে ফেললো!”
আমি বেশ হতাশ হলাম।
“এইই গল্প!”
“এটা ভূমিকা। জেনারেল কর্নওয়ালিস শহরটা দখল করার পর রক্তের বন্যা বসিয়ে দিয়েছিলেন। এমনিতেই ফরাসি, পর্তুগীজ, আর ডাচদের হাতে মার খেয়ে মিকম্যাকদের তখন নেই নেই অবস্থা। বনে জঙ্গলে লুকিয়ে লুকিয়ে কোনমতে টিকে আছে। ইংরেজরা সেখান থেকে খুঁজে খুঁজে ওদের ধরে এনে মারতো। সে এক ভয়ংকর ব্যাপার। ছেলে-বুড়ো-নারী-পুরুষ কেউই রেহাই পায়নি। কর্নওয়ালিসের ছিলো সংগ্রহের বাতিক। একটা কিছু মনে ধরেলেই হলো, জাহাজে করে সোজা পাঠিয়ে দিতেন ইংল্যান্ডে নিজের এস্টেটে। এই টোটেম পোলটা না পাঠিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন সংকেতের মানে বোঝার জন্য। অনেককে দিয়েই চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু লাভ হয়নি। একদিন রাতে ঘুম ভেঙে চিৎকার করতে করতে প্রাসাদ ছেড়ে সমুদ্রের দিকে ঘোরা ছোটালেন। পেছন পেছন ছুটে গেলো তাঁর দেহরক্ষীর দল। কর্নওয়ালিসকে যখন পেলো তারা, তখন তিনি কোমর সমান জলে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছেন। তাঁর মাথার চুল উস্কুখুস্কু, চোখে তাঁর শূন্য একটা দৃষ্টি। সংকেতের অর্থ বুঝতে পেরেছেন তিনি।”
“তারপর? কী ছিলো সেই মানে?”
“সেটা আর জানা যায়নি। পরদিন সকালেই লন্ডন থেকে যুদ্ধের বার্তা নিয়ে দূত এসেছিলো। কোন যুদ্ধ, জানো তো?”
ইতিহাসে আমার খুব একটা আগ্রহ কখনোই ছিলো না। দুনিয়া জুড়ে তো কতোই যুদ্ধ হয়েছে! কতো যুদ্ধ চলছে এখনো। আমি আমতা আমতা করে জবাব দিলাম,
“আমেরিকান সিভিল ওয়ার?”
“আরে ধুর! সে তো অনেক পরের কথা। এটা ছিলো অ্যামেরিকার স্বাধীনতার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে গো হারা হারলেন কর্নওয়ালিস। এটা ১৭৮১ সালের ঘটনা। আত্মসমর্পণ করে কিছুদিন বন্দি থাকার পর চলে গেলেন ইংল্যান্ডে। কিন্তু যুদ্ধ তাঁকে তাড়া করেছে সারা জীবন। শেষটায় মারা গেলেন সামান্য জ্বর বাঁধিয়ে। ইংল্যান্ড থেকে অনেক দুরে, ভারতবর্ষে। স্যামের মতে, এই টোটেম পোলে একটা অভিশাপ বাণী লেখা রয়েছে। জীবনে ভয়ংকর কোন দুর্বিপাক নেমে আসার আগেই কেবল পড়া যায় সেই বাণী। চেষ্টা করে দেখবে নাকি একবার? বই টই কিচ্ছু লাগবে না। তোমার জন্য যদি হয়, তাহলে তোমার ভাষাতেই ধরা দেবে সেই অভিশাপ।”
আমি হেসে মাথা নাড়িয়ে ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলাম।
হোটেলে ফিরতেই স্যামের সাথে দেখা। আমার চিঠি এসেছে।
ছোট্ট একটা খাম, প্রেরকের নাম নেই। খামটা ছেঁড়া। আমি স্যামের দিকে তাকাতে সে আমতা আমতা করে বললো,
“ডাক বিভাগের যে কী অবস্থা! একটা চিঠি পর্যন্ত ঠিক মতো পৌঁছে দিতে পারেনা।”
রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ঢুকে চিঠিটা বের করলাম। একটা সাদা পাতা। পাতার নিচে লেখা- টিনিটাস সারে না।
স্পর্শকাতর সব বিষয় নিয়ে আমাদের প্রজেক্ট। আর স্যামের মতো উৎসাহী লোকের তো অভাব নেই। যোগাযোগের ব্যাপারে কড়া গোপনীয়তা বজায় রাখা আমাদের অফিসের নিয়ম।
পকেট থেকে লাইটার বের করে ভেতরের পেট্রলটা চিঠির উপর ঢেলে দিতেই একটা বাক্য ফুটে উঠলো।
GEBONAR DINGABA AKA AKA GORA GORA
নীচে একটা ইনিশিয়াল, M. T
তার পাশে তারিখ দেওয়া, 18/03/2016.
**********************************
সারা রাত ঘুমুতে পারি নি। কাগজটা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ওই একটি বাক্য, ইনিশিয়াল এবং তারিখ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়েনি আমার। প্রজেক্ট যেহেতু শুরু হয়ে গিয়েছে, এখন শেষ না করা পর্যন্ত, কিংবা নতুন কোন নির্দেশ না আসা পর্যন্ত যোগাযোগ করতে পারবো না আমি। অক্ষর গুলো বিভিন্ন ভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখেও মেলাতে পারছি না। সকাল বেলা টলতে টলতে যখন নাস্তার জন্য যখন গেলাম তখন আমার চোখ রক্ত জবার মতো লাল।
টেবিলে গিয়ে বসার কিছুক্ষণ পর একটা গ্লাস হাতে দৌড়ে এলো স্যাম।
“নাক চোখ বন্ধ করে ঢকঢক গিলে ফেলো।”
গ্লাসের ভেতরে কী আছে কে জানে! গন্ধে আমার নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসার জোগাড়। হাত দিয়ে গ্লাসটা সরিয়ে দিয়ে বললাম,
“কী এটা?”
“এটা ম্যাজিক। কোনমতে খেয়ে ফেলো, দশ মিনিটে যদি হ্যাংওভার না কাটে তাহলে আমার নাম পাল্টে ফেলবো।”
“আরে নাহ। হ্যাংওভার হতে যাবে কোন কারণে? তোমার যন্ত্রণায় শহরে মদ টদ কিছু থাকে নাকি?”
স্যাম খুব খুশি হয়ে গেলো। সম্ভবত এই প্রথম কেউ তার সামর্থ্যের প্রশংসা করেছে। মাথা নাড়তে নাড়তে বললো,
“শুধু শুধু তিনটা পচা ডিম নষ্ট করলাম।”
“নষ্ট করলে মানে! পচা ডিম নষ্টই, নতুন করে আবার কীভাবে নষ্ট করবে তুমি?”
“হে হে হে। তাতো বটেই তাতো বটেই। তোমার বুদ্ধি আছে নওফেল।”
বুদ্ধির গুষ্টি কিলাই। বুদ্ধি থাকলে সামান্য একটা চিঠির মানে বুঝিনা! হাত দিয়ে নাক চেপে বললাম,
“দয়া করে এই জিনিসটা সরিয়ে নাও স্যাম। নইলে কী যে হবে সে আমি বলতে পারি না।”
আমার গলায় কিছু একটা ছিলো। স্যাম সভয়ে দু পা পিছিয়ে গেলো। গ্লাসটা নিয়ে ওর ডেস্কে পৌঁছে চশমার নিচ দিয়ে কুতকুত করে আমার দিকে চাইলো একবার। চোখে চোখ পড়তেই অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো মুখ।
মেজাজটা এমনিতেই তিরিক্ষে হয়ে আছে। এমন সময় হই হই করতে করতে ডাইনিং হলে ঢুকলো বুড়ো বুড়ির দল। এরা চেঁচাতেও পারে!
আমি প্রাণ পণে চেষ্টা করছি ওদেরকে উপেক্ষা করতে। যেকোনো সময় পোকাগুলো জেগে উঠবে, এরা আবার শব্দভুক। কোন মতে ডিম আর টোস্ট মুখে গুঁজে বেড়িয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ সামনে পড়ে গেলো একজন বুড়ো। তার হাতে ছিলো একটা চায়ের কাপ। কাপটা ছিটকে পড়লো মেঝেতে। উফফ, স্টেইনলেস স্টিলের সে কি ঝন ঝন শব্দ! রাগে দুঃখে পাগল হয়ে খেঁকিয়ে উঠলাম,
“চোখের মাথা খেয়েছো নাকি বুড়ো গাধা? দেখে চলতে পারো না?”
বুড়ো লোকটা ঠাণ্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বাম হাতের মধ্যমা তুলে বললো,
“আপ ইউওরস!”
নিজের কান কে বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। শালা তুমি বুড়োই হও আর যেই হও, পিটিয়ে সিধে করে ফেলবো আজকে। আস্তিন গুটিয়ে সামনে এগুতেই বুড়ো তার দলের পেছনে চলে গেলো। মুখে তার খিস্তি চলছে মেশিন গানের মতো।
পেছনে গিয়ে লুকিয়েছে! আরে মুরোদ থাকলে সামনে আয় হারামজাদা।
কথাটা ভেবেছি কি ভাবিনি, অমনি মাথায় যেন একশ ওয়াটের একটা বাতি জ্বলে উঠলো। পেয়েছি! উল্টো দিকে ঘুরেই দিলাম দৌড়। পেছনে একদল বুড়োবুড়ির জয়োল্লাস। কিন্তু আমার সেদিকে ফিরে তাকানোর সময় নেই। এক্ষুনি ঘরে যাওয়া দরকার। ল্যাপটপটা খুলতে হবে।
গোপনে ছদ্মনামে ফেসবুকে একটা একাউন্ট করেছিলাম, সেটা কীভাবে যেন অফিস জেনে গিয়েছে। শুধু যে জেনে গিয়েছে তাই নয়, রীতিমতো খুঁজে বের করেছে আমি কোথায় কোথায় যাই, কোন কোন গ্রুপের পেজে গিয়ে ঢুঁ মারি।
M. T. মানে মুরাদ টাকলা। বাংলাদেশের ফেসবুক জগতে বেশ পরিচিত একটি নাম। কবে, কে একজন, কী একটা গ্রুপে ইংরেজি হরফে পোস্ট দিয়েছিলো, ‘MURAD TAKLA SAMNA AY’ অর্থাৎ ‘ মুরাদ থাকলে সামনে আয়’। সেই থেকে মুরাদ টাকলা। কয়েক লক্ষ সদস্য এই পেজের। এদের কাজ ইন্টারনেট ঘুরে ঘুরে ইংরেজি হরফে লেখা উদ্ভট সব জিনিস সংগ্রহ করে স্ক্রিনশট পোস্ট করা।
আমাকে যেতে হবে মুরাদ টাকলার ২০১৬ সালের একটি পোস্টে। মার্চ মাসের আঠারো তারিখের একটি পোস্ট।
আঠারো তারিখে গিয়ে দেখি প্রায় ‘শ খানেক পোস্ট, খুঁজতে খুঁজতে একেবারে নিচের দিকে গিয়ে চোখে পড়লো সেই স্ক্রিন শটটি।
কাজল ল্যাপটানো চোখে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে একটি তরুণী। তাঁর গাল বেয়ে নেমেছে জলের ধারা। পাশে লেখা,
“GEBONAR DINGABA AKA AKA GORA GORA”
যিনি স্ক্রিন শটটি দিয়েছেন তিনি সম্ভাব্য একটি তরজমাও জুড়ে দিয়েছেন সাথে-
“জীবনের দিন যাবে একে একে ঝরে ঝরে।”
আসুরিক! রীতিমতো অমানুষিক পোস্ট। হাসতে হাসতে আমার পেটে খিল ধরে গিয়েছে। কোনমতে হাসি থামিয়ে চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম। হাসির সময় এটা নয়। আমার জানতে হবে এই পোস্টের সাথে প্রজেক্টের কী সম্পর্ক ! স্ক্রল করে একটু নামতেই প্রথম মন্তব্যটি চোখে পড়লো। দুঃখের জ্যাঠা নামের একজন ড্যাবড্যাবে চোখের মেয়েটিকে ঠাট্টা করে লিখেছে,
“She Pom Gana”
Pom মানে ফ্রম, আর গানা হচ্ছে ঘানা। অনন্ত জলিল বলে একজন অভিনেতা রয়েছেন বাংলাদেশে, Pom Gana কথাটি তাঁরই অবদান।
মিরেলার সংকেত আমি ধরতে পেরেছি। ঘানা থেকে কেউ একজন এখানে এসেছে। একটি মেয়ে।
দু হাজার লোকের এই শহরে ঘানা থেকে আসা একটি মেয়েকে খুঁজে বের করা খুব একটা কঠিন হবেনা। সহজ প্রজেক্ট, অবশ্য না হলেই বা কী? সাত বছর ধরে জুনিয়র এক্সিকিউটিভের কাজ করছি আমি, ফিল্ড ওয়ার্কে আমার সাথে পাল্লা দেয় এমন মানুষ অফিসে হাতে গোনা। প্রাথমিক কিছু তথ্য জোগাড় করেই কাজ শুরু করে দেবো।
গুগলে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম- কী ঘটছে ঘানায়?
ছাগলের মড়ক, ইবোলার সংক্রমণ, নতুন এয়ারপোর্ট বানানো নিয়ে দুর্নীতি, এই জাতীয় খবরে বোঝাই প্রথম পাতা। দ্বিতীয় তৃতীয়, চতুর্থ পাতা জুড়েও একই ধরনের সব সংবাদ। কোন কিছুই ঠিক নজর কাড়ার মতো নয়। ল্যাপটপ বল্ধ করে উঠে যাবো, এমন সময় চোখে পড়লো একটা লিংক, বছর দুয়েকের পুরনো।
“নাইজেরিয়ার সামরিক অভ্যুত্থানে সমর্থন নেই ঘানার”
………………অসমর্থিত সূত্রে জানা গিয়েছে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে নিহত রাষ্ট্রপতি চিয়েমেকার এগারো পুত্র এবং তিন স্ত্রীর সবাই সেদিন প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাসাদে বন্দি অবস্থায় ছিলেন। অভ্যুত্থানের নেতা জেনারেল ইবাতু অবশ্য এই সংবাদ অস্বীকার করে জানিয়েছেন যে বিপ্লব সংগঠিত হবার আগের রাতেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন তাঁরা। ইবাতু আরও জানিয়েছেন যে এই দুর্নীতিবাজ (ইবাতুর ভাষায়) পরিবারকে খুঁজে এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোই হচ্ছে বিপ্লবী সরকারের প্রথম কাজ। এ ব্যাপারে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন আশা করছেন তিনি।
রাষ্ট্রপতির পরিবারের সদস্যদের আসলে যে কী হয়েছে তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ধারণা করছি তাঁদের কেউই আর বেঁচে নেই, কেবল ইবায়েন মাকুয়াচুকু ছাড়া। নিহত রাষ্ট্রপতি চিয়েমেকার এক মাত্র কন্যা ইবায়েন মাকুয়াচুকু (ছবিতে দেখা যাচ্ছে) ঘানা দূতাবাসে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। শোনা গিয়েছে অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী একজন অফিসার তাঁকে এই ব্যাপারে সহায়তা করেন। গত কাল সেই অফিসারকে জনসমক্ষে হত্যা করেছে জেনারেল ইবাতুর সৈন্যরা…………………………
শি ইজ ফ্রম ঘানা।
মিরেলা আমাকে একমাস সময় দিয়েছে। আমি নিশ্চিত তার আগেই প্রজেক্ট নেমে যাবে। কপাল ভালো থাকলে হয়তো আজকেই। ছবির মাকুয়াচুকুর সাথে ওডের চোখের মিলটা ধরতে পারার কথা ছিলো না আমার। কিন্তু এতো নাম থাকতে নাইজেরিয়ার সেই রাজকন্যার নামটাই নিতে গেলে মেয়ে! কতো বড় বোকা তুমি! একেবারে বেকুব, ওডে।
সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছি। আমার .32, বিশ্বস্ত রেশমি সুতো, একটা সিরিঞ্জ……….। তবে সৈকতটা খুব খোলামেলা জায়গা। ভালো হয় ওর বাসাটা চিনতে পারলে, অথবা গ্লুটেনবার্গের কোন একটা গলি………।
তার আগে কেবল একটা কাজ বাকি। ভাবছি মিউজিয়ামে যাবো একবার। কেন যেন মনে হচ্ছে টোটেম পোলের লেখাটা আমি পড়তে পারবো।
সমাপ্ত।
মন্তব্য
গল্পটা ভাল। তবে বয়ানটা বেশী ভাল।
ধন্যবাদ করবী মালাকার
---মোখলেস হোসেন
আপনার গল্পগুলো আগ্রহ নিয়ে পড়ি। সুন্দর গল্প। শেষে এসে খুনই করে ফেললেন??!!
ধন্যবাদ হাতুড়ি। আমার ধারণা নওফেলের পেশাদারিত্ব ছাপিয়ে একটা দ্বিধা উঁকি দিলেও দিতে পারে।
---মোখলেস হোসেন
আপনার গল্পের হাত, দারুণ। পড়তে পড়তে কখনো কখনো মনে হয়, মুক্তো ঝরে পড়ছে। স্পেশাল এজেন্টের রহস্যময় গল্পগুলোতে, শুরু থেকেই সাসপেন্স সৃষ্টি করা হয়। পাঠক শেষ পর্যন্ত পৌঁছে রহস্যটুকু জানার জন্য। এই গল্পটির ক্ষেত্রে, শেষের কিছু আগ পর্যন্ত আমি ধারণাও করতে পারি নি। গল্পটি এমন ধাঁচের হবে। বড় গল্প । আমি শেষ পর্যন্ত পড়েছি, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো আপনি দারুণ ডিটেইলে উপস্থাপন করেছেন। এবং তা করেছেন, দারুণ সফল ভাবে। যদিও আমার ব্যক্তিগত মতামত, তবু কেন যেন মনে হলো, মানুষের যাপিত জীবন ও সম্পর্ক নিয়ে আপনি দারুণ কিছু লিখতে পারবেন। ভাবলাম, আমার ভাবনাটি আপনাকে জানাই। অনধিকার চর্চা মনে হলে, মার্জনা করবেন।
স্নেহাশিস্ রায়।
ধন্যবাদ স্নেহাশিস রায়। বানিয়ে বানিয়ে গল্প লেখা খুব একটা কঠিন নয়। কিন্তু মানুষের যাপিত জীবন এবং সম্পর্ক নিয়ে লেখা বেশ পরিশ্রমের কাজ। এখানে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ কম। তবে ইচ্ছে তো আছেই।
---মোখলেস হোসেন
গল্পের শেষটা! লেখা চমৎকার বরাবরের মতোই। অনেকদিন পরে সচলে এসে প্রথম লেখা পড়ে ভাল্লাগলো।
...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”
ধন্যবাদ দেবদ্যুতি।
---মোখলেস হোসেন
দুই আয়োজনে পড়ে শেষ করলাম। শেষে এসে ব্যাপক চিত্ত চঞ্চল।
নওফেল টোটেম পোলের মর্ম উদ্ধার করুক, দৈব দূর্বিপাকে পরুক, রাজকন্যা (!) বাচুক...
আপনার গল্পগুলো নতুন শব্দ, বাক্য, প্রেক্ষাপটের বুননে সুগঠিত। যৌক্তিক বিষয় থেকে শুরু করে সূক্ষ্ম উপাদানগুলো আবেগ অনুভুতির ব্যাপারগুলো সবখানেই অভ্যস্ত হাতের শব্দ কারুকাজ।
--জে এফ নুশান
ধন্যবাদ নুশান।
---মোখলেস হোসেন
মোখলেস ভাই আপনার লেখা হচ্ছে চলন্ত সিঁড়ি, একবার পা রাখলেই হলো আর কোন পরিশ্রম নাই।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ ভাই। তবে স্টপেজ থেকে সিঁড়িটা কিঞ্চিৎ দূরে থেকে যাচ্ছে।
---মোখলেস হোসেন
টিনিটাস-এর বর্ণনা মনে হয় খুব সঠিক হয়েছে। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এই যন্ত্রণার শিকার। তার কাছ থেকে যা শুনেছি, তার ভিত্তিতে বললাম।
এবারের গল্প - বলাটা যতটা অসাধারণ হয়েছে সেটা গল্পটার আরও বিস্তার-এর দাবী রাখে। আসলেই আপনি বড় লেখার লোক। এই সব লেখালেখি - প্রস্তুতিপর্ব।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
লীলেন একবার বলেছিলো, 'চান্দিতে বেল পড়লে শরবত বানাইয়া খাও'। আমার টিনিটাস হবার পর এই শরবতটা বানালাম। পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ এক লহমা।
কতকটা আলসেমি করেই গল্পটা আর বাড়াইনি।
---মোখলেস হোসেন
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
নতুন মন্তব্য করুন