“ভাই কি ঢাকায় যান?”
“হু”
“আমি আগে কখনও ঢাকা যাই নাই। এইবারই ফাস।”
“ও”
“ভাইজান মনে হয় কতা বার্তা কম বলেন।“
“হু”
“বালা, কতা বার্তা কম কউনই বালা।”
“জী”
ট্রেন আসতে এখনো প্রায় দুই ঘণ্টা বাকি। অবশ্য রেলের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। দেখা যাবে এক ঘণ্টা আগেই চলে এসেছে, অথবা তিনঘণ্টা পর। আসে পাশে লোকজন থাকলে গল্পগুজবে সময়টা কেটে যায়। প্লাটফর্মে মানুষজন যে একেবারে নেই তা নয়, ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমুচ্ছে সবাই। এরা সব কামলা শ্রেণির মানুষ, সকাল সকাল ঢাকায় পৌঁছে বেড়িয়ে পড়বে কাজের খোঁজে। তার আগে যতোটা পারা যায় ঘুমিয়ে নেয়া।
হাতের বিড়িটায় একটা সুখটান দিয়ে শামসুল পা বাড়ালো জয়কালি স্টলের দিকে।
হরি নারায়ণ পেছন ফিরে দোকানের ঝাঁপ নামাচ্ছিলো। শীতের নিস্তব্ধ রাতে স্যান্ডেলের চটাস চটাস শব্দে চমকে উঠে ঘুরে তাকিয়ে শামসুলকে দেখেই গালি দিয়ে বললো,
“কিরে নডির পুত, ব্যাকতে গুমায় আর তুই এলকা এলকা আডাআডি করস। তরে কি উড়ানবিবি দরসে?”
গালি খেয়ে শামসুলের কোন বিকার নেই। হরি নারায়ণ এমনই। সে একগাল হেসে বললো,
“জ্যাডার যেমন কতা! হুনলে খাডাইসেও হাসবো। উড়ানবিবির তো খাইয়া দাইয়া আর কুনু কাম নাই। আমার মুহর এই কাডা যেই মাইয়া একবার দেখছে হেই মাইয়া আর দুনুবার বার ফিইর্যা চাইতো না। অহন কও দেহি, দুহান বন্দ কইরা যাও কই তুমি?“
“কই আর যামু? তুই আইছস বালাই অইলো। টিক মাইরা বইয়া থাক, আমি এট্টূ মুইত্তা আই। দেহিস কইলাম, ক্যাশে আত দিস না। টেহা পয়সা সব গুইনা রাখছি। দুইশ তিরিশের এক টেহা কম পাইলে তর মুহর কাডা আমি প্যাডত লামাইয়া দিমু।”
“দূরো যা জ্যাডা। তুমার ক্যাশে আমার কী কাম? ওই যে ওইদিকে, চাইয়া দেহ।”
গলা নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলে শামসুল।
হরি নারায়ণ শামসুলের ইশারা মতো তাকিয়ে একনজর দেখেই জিভ কেটে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। প্লাটফর্মের সীমান্তে একটা সিমেন্টের বেঞ্চিতে পা তুলে বসে রয়েছে আসলাম খাঁ। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে তার হাতের রুপোলী ঘড়ি। পাশেই রাখা সুদৃশ্য একটি সুটকেস।
“হায় হায় হায় হায় হায় হায় রে! বেক্কলের গরের বেক্কল, তর মাতা উতা কি ঠিক আছে শামসুইল্লা?
শামসুলের কানের কাছে মুখ নামিয়ে যতটা পাড়া যায় নিচু গলায় বললো হরি নারায়ণ।
“কেন কী অইসে?”
“অইসে তর বাপের মাতা। তাইনেরে চিনস?”
“অত চিননের কাম কী?”
“এর লাইগ্যাই তর কুনু উন্নতি অইলো না। তাইনের নাম আসলাম খাঁ। কাটাখালির মুন্সি বাড়ির ছুডু জামাই। যাবজ্জীবন ফাটক খাইট্টা গেলো আশ্বিনে খালাস পাইছেন।”
“কও কী জ্যাডা! আমি তো সন্দ করছিলাম খাস্তগির কলেজের মাস্টর উস্টর অইবো! কিন্তুক তাইনে জেলে গেছিলেন কেন?”
“তাইনে নুরু মুন্সির কল্লা লামাইয়া দিছিলেন। ম্যালা প্যাঁচের কাহিনী। পরে এক সুমায় কমুনে। অহন যাই, দিরং করলে আমার তবন ভাইসা যাইবো।”
হরি নারায়ণ বদনা হাতে পা বাড়াতেই শামসুলের মুখ শুকিয়ে গেলো। মুখের বাম পাশে, কান থেকে গলা পর্যন্ত নেমে যাওয়া গভীর কাটা দাগটায় শামসুলকে যতই ভয়ংকর দেখাক, সাহস টাহস তার খুব একটা নেই। সুন্দরপুরের কেউ তাকে গোনায় ধরে না। শুধু সুন্দরপুর কেন, আসে পাশের কোন এলাকায়ই তার কদর নেই। শামসুলের কর্মক্ষেত্র ঢাকা। এতো বড় শহরে কে আর কাকে চেনে! সেখানে খেলা বুদ্ধির, সাহসের নয়।
না বুঝে আগ বাড়িয়ে আসলাম খাঁর সাথে কথা বলে কী বিপদ ডেকে এনেছে কে জানে! সুন্দরপুরে চোর-ডাকাত-গুণ্ডা-বদমাস থাকলেও খুনি নেই। জয়কালি স্টলে চা সিঙ্গারা খেতে আসা মানুষদের কাছে আসলাম খাঁর কথা কখনো শোনেনি সে। কাটাখালি কোথায়, নুরু মুন্সিই বা কে ছিলো এস তার অজানা। সে কেবল জানে অগ্রাহায়নের হিম ঝরানো এই রাতে, নবীনগর স্টেশনের শুনশান প্লাটফর্মে তার আর আসলাম খাঁর মাঝখানে ফারাক খুব বেশি হলে একশ হাত।
******************************
সন্ধ্যে থেকে অবিরাম ঝরে পড়া শিশিরে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে মেঠোপথ। আছাড় খেতে গিয়ে সামলে নিয়ে হরি নারায়ণ একবার ভাবলো পথের ধারেই দাঁড়িয়ে পড়বে কিনা। কিন্তু পেটের ভেতরে যেন বৈশাখের মেঘ ডাকছে গুড়গুড় করে। সব দোষ ওই নবীনগরের স্টেশন মাস্টার মোবারক আলির। প্লাটফর্মের নষ্ট ল্যাট্রিনটা ঠিক করার কোন তাগিদ বা ইচ্ছা তাঁর নেই। থাকবে কী করে? তাঁর তো ব্যাবস্থা অফিসেই।
রেলওয়ের মানচিত্রে সুন্দরপুর আপাত অদৃশ্য একটি স্টেশন। কালেভদ্রে এক দুজন ভদ্রলোক এসে পড়লে মোবারক আলি অফিসের ল্যাট্রিন খুলে দেন। বিপদে পড়েছে হরি নারায়ণের মতো মানুষগুলো। দিনের বেলায় প্লাটফর্মের পেছনের বাঁশঝাড়ে সেরে নিলেও রাত বিরেতে বুক যেন ছমছম করে ওঠে, হাতের টর্চ সে তিন ব্যাটারিরই হোক কি পাঁচ ব্যাটারির।
হরি নারায়ণের দৃঢ় বিশ্বাস আসলাম খাঁ তাকে চিনতে পারেননি। চোদ্দ বছর তো আর মুখের কথা নয়! মাটিতে একটা আমের আঁটি পুঁতে দিলেও চোদ্দ বছরে সেটা আকাশ ছুঁতে চায়। কাৎলাসেনের কিশোরীমাধবই যে আজকের হরি নারায়ণ, বেঁচে থাকলে এ কথা কাটাখালি থানার আলতাফ দারোগাও হেসে উড়িয়ে দিতেন।
শামসুলের কাছে আসলাম খাঁর বৃত্তান্ত বলে ফেলা কি ঠিক হলো! ছেলেটার বয়স কম, পেটে কথা রাখতে পারবে না। আর সেই কথার রেশ ধরে হরি নারায়ণকে খুঁজে বের করা তখন শুধু সময়ের ব্যাপার। এই বয়সে ঘাড়ে-পিঠে কয়েকটা চড়থাপড় খেলে খোলস ছেড়ে সুরসুর করে কিশোরীমাধবের বেড়িয়ে আসতে আর কতক্ষণ!
গালে বসা একটা পিনপিনে মশাকে আঙুল দিয়ে পিষে ফেলে নড়েচড়ে বসলো হরিনারায়ণ।
সুন্দরপুরের মশারা ভারি বজ্জাৎ। এই হিমহিমে রাতেও তাদের উৎসাহের কোন শেষ নেই। কাজ সেরে দ্রুত এখান থেকে চলে যাওয়া দরকার। কিন্তু আসলাম খাঁর কথা ভাবতে গিয়ে কাজে আর মন লাগছে না হরি নারায়ণের।
একে তো আসলাম খাঁর চিন্তা, তার উপর মশার কামড়। এভাবে আর যাই হোক, গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ করা সম্ভব নয়। তাছাড়া পেটের ভেতর জমে থাকা মেঘটাও মনে হচ্ছে কেটে গিয়েছে এখনকার মতো। উঠতে উঠতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো হরি নারায়ণ। সুন্দরপুরে আর এক মুহূর্তও নয়। গোল্লায় যাক জয়কালি স্টল, আর ক্যাশের ভেতরে থাকা দুইশ তিরিশ টাকা। এই ফাঁড়া কেটে গেলে অমন অনেক পাওয়া যাবে।
“কই যাইতাছুইন গো মাধব?”
হরি নারায়ণের কলজে যেন লাফ দিয়ে গলার কাছে চলে এসেছে। হাতের টর্চটা রামদার মতো মাথার উপর ধরে কোনমতে বললো,
“কেলা? কেলায় রাও হরে?”
“আমি গো মাধব। আমারে চিনছুইন না! আমি কাৎলাসেনের আঙ্গুরি বেওয়া।”
আঙ্গুরি বেওয়া! কিন্তু কী করে সম্ভব? চোদ্দ বছর আগে সে নিজের হাতে আঙ্গুরিকে ব্রহ্মপুত্রের পানিতে ডুবিয়ে রেখে এসেছিলো।
বাঁশঝাড়ের ভেতরে অদ্ভুত একটা বাতাস, সে বাতাসে আঁশটে গন্ধ। হরি নারায়ণের দম বন্ধ লাগে। কানে ভেসে আসে একঘেয়ে একটা কণ্ঠস্বর,
“ও মাধব, আমার শইলডার মাইদ্দে বিষের ব্যাদনা গো। গাঙের পানি বড় টেলকা, বরফের লাহান টেলকা। খালি জার হরে। আর হৈল মাছগুলান যেন আজদাহা, ঠাইসা দইরা সমানে ঠূহরায়। ঠুহরাইয়া ঠুহরাইয়া অক্করে আড্ডি বাইর কইরা দিছে গো!”
অন্ধকার ফুঁড়ে একটা হাত বেড়িয়ে এসেছে হরি নারায়ণের সামনে। হাত নয়, ধবধবে সাদা পাঁচটি হাড়ের আঙুল। হাড়ের আঙুলের উপর হাড়ের কব্জি, হাড়ের বাহু। কব্জি পেঁচিয়ে জ্বলজ্বল করছে একটি সোনার বালা।
হরি নারায়ণ জ্ঞান হারালো।
*************************************
আকাশে অনেকগুলো ঘুড়ি উড়ছে, লাল-নীল-সবুজ-সাদা। একটা ঘুড়ির রঙ কালো। দারুণ জাঁদরেল সেই ঘুড়ি। এই নামছে গোঁত্তা খেয়ে, এই আবার সাঁই সাঁই উঠে গিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে মেঘের সীমান্ত। ভোকাট্টা হয়ে ডানে বামে লুটিয়ে পড়ছে লাল-নীল-সবুজ-সাদার দল। শামসুল চিন্তিত মুখে কালো ঘুড়িটার গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করছে। এই মুহূর্তে সব ঘুড়ি ছাড়িয়ে আকাশের একটা জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ওটা। টানের মাঞ্জা থাকলে নিচ থেকে হ্যাঁচকা টানে কেটে দেয়া যেতো। কিন্তু শামসুলের লুটের মাঞ্জা। এই মাঞ্জায় খেলতে হয় উপর থেকে নিচে। হ্যাঁচকা টানে নয়, বরং রয়ে সয়ে, ধীরে ধীরে সুতো ছেড়ে।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর নাটাইটা দু হাঁটুর মাঝখানে চেপে বিড়ি ধরাতে গেলো শামসুল। আর ঠিক তক্ষুনি, দমকা একটা বাতাস এসে এলোমেলো করে দিলো আকাশ। ঘুড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ইচ্ছে মতো উড়ছে, ঘুরছে, পাক খাচ্ছে লাট্টুর মতো। এর মধ্যে যে কোনটা তার, বুঝতে বুঝতেই সে দেখতে পেলো কালো ঘুড়িটা ছোঁ মেরে নেমে আসছে বাজপাখির গতিতে। নামতে নামতে কেটে চলেছে একটার পর একটা ঘুড়ি। শামসুল ঘাবড়ে গেলেও মনে মনে তারিফ না করে পারলো না।
সাত আটটা ঘুড়ি ভোকাট্টা হয়ে যাওয়াতে আকাশটা বেশ ফাঁকা এখন। কালো ঘুড়িটা আবারো উঠে গিয়েছে উপরে। এর সাথে লড়তে যাওয়া বোকামি। কাটা পড়ার চেয়ে কেটে পড়া ভালো। কেটে প্রায় পড়েছিলো সে, কিন্তু কালো ঘুড়িটা তার মতলব টের পেয়ে গিয়েছে।
কোনমতে প্রথম ছোবলটা এড়িয়ে প্রাণপণে নাটাই হাতে পেছন দিকে ছুট লাগালো শামসুল। ছুটতে ছুটতেই সুতো গোটাচ্ছে প্রাণপণে। মুশকিল হচ্ছে কালো ঘুড়ির নাটাই যার হাতে সে দাঁড়িয়ে আরও পেছনে। শামসুল যাবে কোথায়! নাটাই ঘোরাতে ঘোরাতে হাত দুটো যেন ছিঁড়ে আসতে চাইছে। আর মাত্র কয়েকশ ফুট।
মেঘের আড়াল থেকে হঠাৎ বেড়িয়ে আসা সূর্যের তীব্র আলো ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চোখ। ঘুড়িটা আছে, নাকি নেই, ঠাহর করাই মুশকিল। তবে নাটাইয়ের সুতো যেহেতু এখনো টান টান, তার মানে আছে। কিন্তু কালো ঘুড়িটা গেলো কই?
মাথায় একটা খোঁচা লাগলো। খোঁচা নয়, যেন ঠোকর। তালু একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছে। মাঠের পেছনেই একটা বটগাছ আছে, সে গাছে হাজার হাজার পাখি। নিশ্চয়ই তারই কোন একটা। নাটাইটা বাম হাতে ধরে ডান হাত দিয়ে মাথা ঢাকতেই আবার সেই ঠোকর, এবার ডান হাতের কব্জিতে। রাগে অন্ধ হয়ে পেছন ফিরতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো শামসুল।
ধবধবে সাদা একটা পাঞ্জাবী পড়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আসলাম খাঁ। তার হাতে ধরা সেই কালো ঘুড়ি। আসলাম খাঁ ঘুড়িটা দিয়ে শামসুলের মাথায় আরেকটা ঠোকর মেরে জিগ্যেস করলেন,
“কিরম আছো গো শামসুল কবীর? এতবার ডাকলাম, মুহ রাও নাই কেন?”
ভয় পেলেও বুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়ে যায়নি শামসুলের। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। তার নাম শামসুল কবীর নয়। শুধুই শামসুল, কখনো কখনো শামসুইল্লা। কিন্তু শামসুল কবীর কোনকালেই নয়।
শুকিয়ে আসা ঠোট দুটো জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে সে জবাব দিলো,
“ভাইজান সন্দ করি আওলাইয়ালছুইন। আমি শামসুল ঠিহই, মাইনসে আদর কইরা শামসুইল্লাও ডাহে। কিন্তুক আমি কবীর না।”
আসলাম খাঁ আকাশ বাতাস ফাটিয়ে ঠা ঠা করে হেসে দিয়ে বললেন,
“তুমি কইলেই কী আর না কইলেই কী! এইযে দেহো, গুড্ডির মাইদ্দে লেহা আছে শামসুল কবীর।”
আসলাম খাঁ ঘুড়িটা এগিয়ে দিলেন।
শামসুল হাত বাড়াতেই ঘুড়িটা হালকা একটা গোঁত্তা খেয়ে উপরে উঠে গেলো। গেলো তো গেলো, মিলিয়েই গেলো মেঘের ভেতর। যখন ফিরে এলো তখন আর কালো নেই সে ঘুড়ি। ঝকঝক করছে, চকচক করছে, ধারালো টাংগির রুপোলী ফলার মতো।
ঘুড়িটা নেমে আসছে তার ঘাড় তাক করে। শামসুল চোখ বন্ধ করে ফেললো।
ঘাড়টা কি কেটে গিয়েছে, নাকি কাটেনি! মনে তো হয় কাটেনি। তবে না কাটলেও কেমন যেন একটা চাপ রয়েছে ঘাড়ে। শামসুল ভয়ে ভয়ে চোখ মেললো।
মোবারক আলি শামসুলের ঘাড় থেকে হাত নামিয়ে বললেন,
“তুই কি মানুষ, নাকি মহিষ রে? এতক্ষণ ধরে ডাকছি! এভাবে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমায় কেউ?”
বেঁচে যে আছে এতেই খুশি শামসুল। স্টেশন মাস্টার তাকে মহিষ বলুক আর গাধা, কিচ্ছু আসে যায়না। বোকা বোকা একটা হাসি দিয়ে সে বললো,
“হরি জ্যাডার কারবারডা দেখছুইননি মাস্টার সাব? মুইত্তা আই কইয়া হেইলা যে গেছে আওনের আর খবর নাই। বইয়া তাকতে তাকতে গুমে দরছিলো সন্দ হরি।”
“তুই থাক তোর সন্দেহ নিয়ে। এদিকে ট্রেন আসার সময় হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, তুই চা বানাতে পারিস?”
“কুনুদিন বানাই নাই। কিন্তুক বানাইতে আর কী লাগে? পানিত বলক উডলে চাপাত্তি আর দুদ মিশাইয়া গুইট্টা দিলেই অইবো। লগে এট্টু চিনি, কী কইন মাস্টার সাব?”
“তাহলে আর দেরি করছিস কেন উজবুক? চটপট বানিয়ে ফেল এক কাপ।”
“হরি জ্যাডারে তো আফনে চিনুইন। তাইনে কাউরে বিশ্বাস যায় না। বেবাক জিনিস বাসকের মাইদ্দে রাইক্য্যা তালা দিয়া গেছে।”
মোবারক আলি কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
“এ তুই কী শোনালি রে শামসুল! ওই দশ টাকার ঠুনকো তালা তোকে আটকে রাখবে? নে নে জলদি কর, সাথে দুটো নোনতা বিস্কুটও দিস বাপ। হরি নারায়ণকে আমি বলে দেবো।”
ভাবনাটা দশ টাকার তালা নিয়ে নয়। এসব তার বাঁ হাতের মামলা। সমস্যা অন্য জায়গায়। গুপ্ত বিদ্যা মানুষ জনের সামনে প্রকাশ করতে নেই। শামসুল লম্বা একটা হাই তুলে বললো,
“আফনে গরত গিয়া বইন যে, আমি চা-পানি লইয়া আইতাছি।”
“আরে না না, অফিসে গিয়ে কাজ নেই। বরং তোর হাতের কাজটা একটু দেখেই যাই। এতো নাম ডাক তোর!”
অনিচ্ছা সত্যেও লুঙ্গীর ভাঁজ থেকে ছোট্ট একটা শিশি বের করে থেকে গুনে গুনে তিন ফোঁটা তরল তালার ভেতরে ঢাললো শামসুল।
“কী ঢাললি রে তুই? কী এইটা, এসিড নাকি? ভেতরের কলকব্জা সব গলিয়ে ফেলছিস, তাইনা?”
মোবারক আলি শামসুলের ঘাড়ের উপর দিয়ে উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন।
এই জন্যেই লোকজনের সামনে এসব করতে নেই। এসিড দিলেই যদি তালা খুলে যেতো তাহলে কি আর শামসুলের মতো মানুষদের ভাত জুটতো? শিশিতে আছে নিশাগঞ্জের কামেল পীরের ফুঁ দেওয়া পানি।
পানি পড়াটা সাথে থাকলে মনে সাহস জাগে। বাদ বাকি সব হাতের কৌশল। মোবারক আলির চোখের পলক পড়তে না পড়তেই আলতো চাপে তালাটা খুলে ফেললো শামসুল।
বাক্সের ভেতরে সাজিয়ে রাখা চা, বিস্কুট, আর কন্ডেন্সনড মিল্কের কৌটোর পাশে জ্বলজ্বল করে চেয়ে আছে একটা সোনার বালা। যাত্রাপালায় রাজা রাণীরা যেমনটা পড়েন তেমন, তবে তার চেয়ে ঝলমলে। বালাটা যদি সোনার হয়, আর পাথরগুলো যদি হয় দামি, তাহলে মানতেই হবে শামসুলের কপাল ফিরে গিয়েছে।
“কই, জিনিসপত্র সব বের কর বাপ। সেই কখন থেকে চায়ের তেষ্টা নিয়ে বসে রয়েছি!”
খুব সাবধানে মুকুটটাকে আরো খানিকটা ভেতরে, চানাচুরের প্যাকেটগুলোর আড়ালে ঠেলে দিয়ে মোবারক আলির দিকে তাকালো সে। নাহ, দেখেছে বলে মনে হয় না।কাঁপা কাঁপা হাতে চুলোয় আগুন ধরিয়ে কেতলিটা চাপিয়ে দিলো শামসুল।
“দিরং অইবো মাস্টর সাব। আফনে গরত গিয়া বইয়া তাহেন।”
“বলছিস! ঠিক আছে আমি অফিসে গিয়েই বসলাম। বেশি দেরি করিস না আবার।”
মোবারক আলি অফিসে গিয়ে ঢোকা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো শামসুল। তারপর বালাটা চাদরের ভাঁজে লুকিয়েই দিলো ভোঁ দৌড়। সুন্দরপুরে আর এক মুহূর্ত নয়। হরি নারায়ণ ফিরে আসার আগেই চলে যেতে হবে যতদূর যাওয়া যায়। সবচে ভালো হয় ঘাটের দিকে গেলে। খাল পেরিয়ে একবার হোসেনপুর পৌঁছে গেলে তাকে আর পায় কে!
মোবারক আলি টেলিফোনে কথা সেরে রেখে ব্যাজার মুখে বসেছিলেন তাঁর চেয়ারে। মালগাড়ি আটকে গিয়ে লাইন বন্ধ। ভোরের আগে ঠিক হবার কোন সম্ভাবনা নেই। এই ধ্যারধ্যারে স্টেশনে আরও তিনচার ঘণ্টা বসে থাকা যে কী যন্ত্রণার তা তিনি হাড়ে হাড়েই জানেন। সুন্দরপুর যে এখনো টিকে আছে এটাই বিস্ময়। একটাকা আয় নেই সরকারের। যাত্রীরা টিকিট ফিকিটের ধার ধারেনা। তিনিও এই নিয়ে মাথা ঘামান না। তাঁর একার পক্ষে সম্ভবও নয়। আগে তাও একটা গার্ড ছিলো। গেলো বৈশাখে লোকমান ছুটি নিয়ে সেই যে গিয়েছে আর ফেরার নাম নেই।
লম্বা একটা হাই তুলে অফিস থেকে বের হলেন তিনি। শামসুলটা বড় দেরি করছে। কে জানে, আবার ঘুমিয়ে গেলো কিনা!
হরি নারায়ণের দোকানে পৌঁছে দেখেন ঝাঁপ নামানো। বাইরে চুলায় টগবগ করে ফুটছে চায়ের পানি। গাধার বাচ্চাটা পানিতে পাত্তি না দিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে।
হাত দিয়ে টান দিতেই ঝাঁপ খুলে গেলো। ভেতরে কেউ নেই। এদিকে কলজেটা চায়ের জন্য আঁকুপাঁকু করছে। মেঝাজ খারাপ করে কোনদিকে না তাকিয়ে লাথি কষিয়ে দিলেন। লাথিটা গিয়ে পড়লো একটা টুলে, গড়িয়ে গিয়ে উল্টে দিলো কেরোসিনের স্টোভ।
*******************************************
আসলাম খাঁ স্যুটকেসে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে আগুন দেখছেন। অনেকগুলো মানুষ ছুটোছুটি করে নেভানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। খাকি প্যান্টের উপর সাদা শার্ট পড়া ভদ্র গোছের একজন মানুষ গলা ফাটিয়ে তদারকি করছেন, আগুনের আভায় লালচে হয়ে আছে তাঁর মুখ। লোকটা সুন্দরপুরের স্টেশন মাস্টার, সন্ধ্যে বেলায় এঁর কাছ থেকেই ট্রেনের টিকিট কিনেছিলেন তিনি।
আগুন লেগেছে, আবার নিভেও যাবে। এই নিয়ে আসলাম খাঁর কোন মাথাব্যাথা নেই। তিনি চিন্তিত অন্য কারণে। হাতের ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে রাত দুটো বেজে আঠারো। ট্রেন প্রায় দু ঘণ্টা লেট।
গায়ের শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে জয়কালি স্টলের দিকে পা বাড়ালেন আসলাম খাঁ।
দোকানটা এভাবে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়াতে খুব কষ্ট হচ্ছে মোবারক আলির। তবে দোষ যে কেবল তাঁর একার, তাও নয়! শামসুলটা হাওয়া হয়ে না গেলে কি আর মাথায় অমন রক্ত চড়ে যেতো? হরি নারায়ণেরও বুদ্ধি! কেরোসিন স্টোভের কাছে কেউ টুল রাখে? সে যাই হোক, লাথিটা যে তিনিই মেরেছেন সে তো আর মিথ্যে নয়। নাহয় রেলের গুদামঘর থেকে বাঁশ-কাঠ-টিন বের করে নতুন করে আবার বানিয়ে দেবেন দোকান টা। বছর বছর ধরে জমে আছে, এক দুটো খোয়া গেলে কে আর দেখতে আসবে?
পুড়ুক, পুড়ে বরং ছাই হয়ে যাক। তারপর এমন দোকান বানিয়ে দেবেন……
ভাবনাটা শেষ করার আগেই ঘাড়ের পেছনে গলা খাঁকারি শুনে চমকে উঠলেন মোবারক আলি।
“শুধু শুধু অমন একটা লাথি কষালেন মশাই। অবশ্য ট্রেন লেট হলে কারই বা মেজাজ ঠিক থাকে বলুন!”
লোকটাকে চিনেছেন মোবারক আলি। সন্ধ্যে বেলায় টিকিট কিনতে এসেছিলো। বলে কিনা ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট চাই! আরে সুন্দরপুরের সেই দিন কি আর আছে? ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড, সব ক্লাস ঘুচে গিয়ে এখানে এখন চলছে সাম্যবাদ।
পাল্টা একটা গলা খাঁকারি দিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,
“ট্রেন ভোর ছয়টার আগে আর আসছে না।”
“বলেন কী! আমার যে সকাল বেলাতেই ঢাকায় একটা কাজ ছিলো!”
“ভাবনা কী? ট্রেন চলে এলে, দেড় দু’ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবেন।”
“কিন্তু ধরুন যদি আরও লেট হয়!”
মোবারক আলির মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। ট্রেন আরও লেট হতেই পারে। একবার আটকে গেলে কে আর মাথা ঘামায়! অবশ্য উপায় একটা আছে।
রেলের লোক হয়ে যাত্রীকে বাস টার্মিনালের কথা বলতে প্রাণে বাঁধছে তাঁর। কিন্তু তিনি চাইলেই কি আর মানুষকে আটকে রাখতে পারেন! সবাই তো ওইই করছে। আজকাল ট্রেনের অপেক্ষায় থাকে কেবল তারাই যাঁদের ট্যাঁকের জোর নেই।
“আপনি এক কাজ করুন। হোসেনপুর থেকে বাস নিয়ে চলে যান।”
লোকটা কিছুক্ষণ হা করে থাকিয়ে থেকে বললো,
“আপনার মাথা কি ঠিক আছে ভাই সাহেব! নদীর উপর দিয়ে বাস চলবে কেমন করে?”
মোবারক আলি বুক পকেট থেকে চশমা বের করে চোখে দিয়ে ভালো করে আসলাম খাঁর দিকে তাকালেন। এ লোক কি এতবছর ঘুমিয়ে ছিলো? নদীর উপর ব্রিজ হয়েছে সে আজ কম করে হলেও আট বছর। কে জানে, হয়তো উজানের মানুষ, এদিকে নতুন। চশমাটা খুলে মুছতে মুছতে বললেন,
“স্টেশনের পেছন দিকে গেলেই দেখবেন একটা খাল…।”
“উড়ানবিবির খালের কথা বলছেন?”
“আপনি চেনেন দেখছি! জি ওটাই। খাল পেরিয়ে কিছুদূর হাঁটলেই হোসেনপুর। নদীর উপর ব্রিজ হয়েছে, একটানে ঢাকায় চলে যাবেন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাস এখন।”
উড়ানবিবির খালের গভীরতা বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেবার মতো। নড়বড়ে সাঁকোটায় পা রেখে থমকে দাঁড়ালো শামসুল। বরং নৌকাই ভালো। নাহয় নেবেই হারান মাঝি পাঁচ টাকা।টাকা কোন সমস্যা না। হরি নারায়ণের দুইশ তিরিশ তো লুঙ্গির ভাঁজে আছেই। শামসুল জোর গলায় ডাক ছাড়লো,
“ও হারান কাহা, এই পাড়ে আও।”
হারান মাঝি জবাব দিলো,
“কেলা, শামসুইল্লা?”
“হ গো কাহা। হুসেনপুর যাইবাম।”
“মাগনার মাইদ্দে আমি নাই। পুল পাড়াইয়া আয়।”
“মাগনার কতা কও কেন কাহা? পাঁচ টেহার জায়গায় দশই দিমু।”
“নডির পুঁতে কয় কী? কার গরে সিন কাটছস?”
“কাহার কতা হুন যে! আমার টেহাই।”
“আমি খাইতাম বইছি। খাইয়া তামুকে দুইডা টান দিয়া আইতাছি। টিক মাইরা বইয়া তাক।”
উড়ানবিবির খালে হারান মাঝির কথার উপর কথা চলেনা। শামসুল মরা তালগাছটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে চাদরের তলায় লুকানো বালাটার কথা। খুব ইচ্ছে করছে বেড় করে একনজর দেখে নিতে। পেছনে সর সর একটা শব্দ হতে ঘুরে তাকিয়ে শামসুলের জবান বন্ধ হবার জোগাড়।
সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল সুন্দরি একটি মেয়ে।
---চলবে
মন্তব্য
গল্প নিয়ে কথা পরে হবে, মোখলেস-ভাই। এখন, হাচলাভিনন্দন!
এইবার গল্প নিয়ে কথা - বলার ত কিছু নাই, চলতে থাকুক, সঙ্গে আছি। পরের পর্বের গোড়ায় তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে দুই-চার বাক্যে একটা 'এখনও পর্যন্ত' মার্কা সারসংক্ষেপ দিয়া দিয়েন, তাইলেই হবে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
হা হা হা। মিসফায়ার এক লহমা! পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
---মোখলেস হোসেন
যাক্গে, এট্টু আগাম হয়ে গেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
লেখাটি পড়ে মজা পাইলাম।
ধন্যবাদ আলামিন মিয়া।
---মোখলেস হোসেন
ইশশ কেমন জায়গায় এসে গল্প থমকে গেলো। পরের পর্ব না পড়লেই নয়। জলদি দেবেন আশা করি। আচ্ছা এখানে যে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, সেটা কোন অঞ্চলের?
ধন্যবাদ আয়নামতি। দেরি করবো না। ছোটবেলায় দেশের বাড়ির স্বজনদের মুখে শোনা ময়মনসিংহের ভাষা।
---মোখলেস হোসেন
পাইছি একজনকে যিনি ময়মনসিংহের ভাষা জানেন! এই আঞ্চলিক ভাষা জানতে সাহায্য সহযোগিতা চাইলে মুক্তহস্ত হবেন ভাইজান?
দুঃখিত আয়নামতি। আপনার মন্তব্যটি আগে চোখে পড়েনি। ময়মনসিংহের ভাষা জানা একজনকে পেয়ে গিয়েছি। লেখা শেষ হলে সে এডিট করে দেবে পেট চুক্তিতে।
---মোখলেস হোসেন
ব্যাপার না ভাইয়া। আপনি ভাগ্যবান বটেক।
অদ্ভুত সুন্দর গল্প। অনেক দিন সময় করে উঠতে পারিনা, কিন্তু আপনার এরকম একটা গল্প পড়ার লোভেই ঢুঁ মারলাম।ভালো থাকবেন।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ সোহেল ইমাম। অনেকদিন পর আজকে সচলে এলাম। আপনি কিন্তু ভাই লিখছেন না ইদানীং। নতুন কিছু আসা করছি আপনার কাছে।
---মোখলেস হোসেন
নতুন মন্তব্য করুন