মানুষের যে 'বৈশিষ্ট্য'টাকে আমি সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করি সেটা হচ্ছে গড়পড়তা হওয়া। Mediocrity এর বাংলা করলাম গড়পড়তা হওয়া। জানিনা অনুবাদটা ঠিক হল কিনা(সম্ভবত সেটাও গড়পড়তাই হয়েছে)। খেয়াল করলে দেখবেন যে প্রথম লাইনে বৈশিষ্ট্য শব্দটাকে আমি ইনভার্টেড কমার মধ্যে রেখেছি। কারন আমি এখানে মানুষের দোষ নিয়ে কথা বলছিনা, তাহলে হয়তো অসততা বা ভণ্ডামির কথা তুলতাম।
সমস্যা হচ্ছে গড়পড়তা হওয়াটা আসলে দোষের কিছু না। কারন গড়পড়তা মানুষেরা জগতের খুব একটা কাজে না আসলেও সচরাচর অন্যের ক্ষতিও করেনা, তাহলে এদের অপছন্দ করার কারন কি? সত্যি কথা বলতে কি উত্তরটা আসলে আমার নিজেরো জানা নেই। সম্ভবত প্রতিভা জিনিসটার প্রতি আমার একটা আকর্ষণ আছে। সেকারনেই সাধাসিধে নির্বিরোধী সাদামাটা লোকের চেয়ে বদমাশ প্রতিভাবান লোকদের আমার বেশি পছন্দ। আমি জানি এমনটা ভাবা মোটেও উচিত না কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এটাই সত্যি। বইয়ে যতই লেখা থাক "দূর্জন বিদ্বান হলেও পরিতাজ্য"- আমি সেটা অনুসরণ করিনা। আর কেন যেন পৃথিবীর বেশিরভাগ ট্যালেন্টেড লোকগুলার মধ্যে কোন না কোন 'ডিস্টাপ' থাকেই, সেটাও একটা আশ্চর্যের ব্যাপার।
একটা সম্ভাব্য কারন হতে পারে যে আমি নিজে একজন পারফেক্ট মিডিওকার এবং কে না জানে যে, 'অপোজিট এট্রাক্টস'? ছাত্র হিসেবে অবশ্য আমি মন্দ ছিলাম না, বরং এককালে নিজেকে ভাল ছাত্রই ভাবতাম। সমস্যা হচ্ছে আমি যেই বিশ্ববিদ্যালয় এর যেই বিভাগে পড়েছি সেখানে গন্ডায় গন্ডায় স্ট্যান্ড করা ছেলেপিলে ছিল। সেইসব রুই কাতলার ভিড়ে আমার মত মলা ঢেলা মাছেদের তো গড়পরতাই মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। নিজেকে মিডিওকার ভাবার সেই বোধহয় শুরু।
পড়াশোনা বাদই দিলাম- আশেপাশের লোকজন কেউ ভাল প্রোগ্রামিং জানত, কেউ বিতর্ক করত, কেউ ভাল ক্রিকেট খেলত, কেউ ছবি আঁকত, কেউ গান গাইত বা গিটার বাজাত। অবশ্যই সবাই সেরকম ছিলনা কিন্তু তারা হয়ত আর কিছু না পারলেও প্রেমটেম করত, কিংবা হলে বসে থ্রি কার্ড খেলত, সেটাও না পারলে নিদেনপক্ষে টিউশনি করাত। আমি এসবের কিছুই করিনি, কি করে যে পাঁচ বছরের সেই সময়টা পার করলাম আজো বুঝতে পারলাম না। টেবিল টেনিস বা টুয়েন্টি নাইন খেলে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছি সত্যি, কিন্তু শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর পাল্লার পড়লে সেখানেও হারতাম। স্কুলে, কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অজস্র মিডিওকার মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়াতেই বোধহয় প্রতিভাবান হবার এই আজন্ম সলজ্জ সাধ দিনে দিনে বেড়েই গেছে!
যেহেতু ভাল পারি না, সুতরাং কিছুদিন চেষ্টা করে ক্রিকেট, ছবি আঁকা, দাবা খেলা বা এই জাতীয় সব সুকুমারবৃত্তির চেষ্টাই ছেড়ে দিয়েছি। যখনই বুঝেছি যে শচীনের মত কভার ড্রাইভ, ম্যারাডোনার ড্রিবলিং, দা ভিঞ্চির মোনালিসা আমার দ্বারা হবেনা, তখনই ক্রিকেট, ফুটবল, ছবি আঁকা সবই নিরর্থক মনে হয়েছে। সেই নিয়ম অনুযায়ী আমার লেখালেখিও ছেড়ে দেয়া উচিত, কিন্তু কাজের বাইরে একমাত্র এই টুকটাক লেখার অভ্যাসটাই এখনো টিকে আছে। তার মানে এই না যে লেখার বেলায় আমি নিজেকে টলস্টয় বা রবীন্দ্রনাথ মনে করি। টলস্টয় বা রবীন্দ্রনাথের মত মহীরুহদের নাম নেয়াটাও একটা ধৃষ্টতা, এমনকি ফেসবুকের সেলিব্রিটি সাহিত্যিকদের তুলনায়ও যে আমি বনসাই, সেটা ভালই জানি, তাহলে লিখি কেন? আমি আশা করি না যে আমার লেখা পড়ে হাজার মানুষ হাসবে বা কাঁদবে বা বিস্ময়ে অভিভূত হবে, তাহলে কিসের আশায় লিখি? অনেক ভেবে সেটার একটা কারন দাঁড়া করাবার চেষ্টা করেছি, সেজন্যেই এই লেখা।
বেঁচে থাকাটাই একটা আশ্চর্য সুন্দর একটা ব্যাপার এটা অনেকেই বলেন। আমি জানি পৃথিবীতে এই মুহূর্তে অনেক মানুষ জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে আছে, ভাবছে এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়। কারও কারও জন্য সেই কষ্টের তীব্রতা এত বেশি যে তারা আত্মহত্যাও করে ফেলে। কিন্তু সেরকম ঘোর সংকটকাল বাদ দিলে আমরা সবাই বেঁচে থাকতেই চাই। জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন- গলে যাওয়া নিশ্চল ব্যাঙও নাকি আরো এক মুহূর্ত বেশি বাঁচতে চায়। জীবন যদি সুন্দর নাই হত- তবে কি চাইত?
কিন্তু এই সৌন্দর্যটাকে কেন যেন ঠিক ধরা যায়না, খালি টের পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন কিছু সুন্দর মনে হলে ঠিক কি কারনে সেটা সুন্দর, সেটা আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু এত্ত দু:খ কষ্ট, হতাশা বা অপূর্ণতা থাকার পরও জীবন কেন সুন্দর সেটার পরিষ্কার উত্তর আমরা দিতে পারিনা। সেই সৌন্দর্য ধরতে না পারার হাহাকার থেকেই বোধহয় লেখকেরা লেখেন। হাতে না হোক, শব্দ বা ছন্দে যদি ধরা যায়। আমিও কি সেই একই কারনে লিখি? চেখভ কিংবা জীবনানন্দের প্রতিভাটুকু আমার না থাকতে পারে, কিন্তু সেই সৌন্দর্যকে ধরার আকুতিটা তো আমারো আছে। ট্রেনে যেতে যেতে পথের ধারের ফুলগুলোকে একনজর দেখতে না দেখতেই হারিয়ে ফেলে রবার্ট ফ্রস্ট যে দু:খ পান সেই একই দু:খতো আমাকেও আচ্ছন্ন করে! এবং আমার ধারনা সম্ভবত সেকারনেই যুতের কিছু লিখতে না পারলেও আমি মাঝেসাঝে দুকলম লিখি। পাথর কুঁদে গোলাপ বানাতে চেয়ে আঁচড়ের বেশি কিছু কাটতে হয়ত পারিনা, কিন্তু ভেতরের অতৃপ্তিটুকু তো তাতে কিছুটা হলেও কমে!
"Heaven gives its glimpses only to those
Not in position to look too close."
- 'A Passing Glimpse' by Robert Frost
গগন শিরীষ
মন্তব্য
বেশিরভাগ মানুষ নিজে আসলে কী পারেন সেটা বুঝতে বুঝতে, নিজে কী ভালোবাসেন সেটা জানতে জানতে, নিজে কী চান সেটা উপলদ্ধি করতে করতে জীবন পার করে ফেলেন। মানুষ কেবল অন্যের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজের দিকে আরেকটু বেশি তাকালে, নিজের ওপর আস্থা রাখলে, নিজেকে ভালোবাসলে শেষ জীবনে এসে হাহুতাশ করতে হয় না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
ভাল বলেছেন ষষ্ঠ পান্ডব। জীবনে যে কি চাই সেটাই পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারলাম না আজ অবধি। পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
মিডিওকারের একটু ভারি বাংলা মধ্যবিধ। মিডিওক্রিটির বাংলা সম্প্রতি চোখে পড়লো: মধ্যবিধা।
যা ভেবেছিলাম, আমার অনুবাদ মধ্যবিধাই হয়েছে। নতুন শব্দ শিখলা, ধন্যবাদ হিমু ভাই!
মধ্যবিধা হওয়াটাও কিন্তু খুব একটা খারাপ না। অনেকে এই পর্যায়টাও ছুঁতে পারেন না। আপনি হয়ত আপনার অর্জনকে 'অল্প ভাবছেন, কিন্তু অনেকের কাছেই আপনি ঈর্ষণীয় অবস্থানে আছেন, কেউ হয়ত আপনার অবস্থান দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলছেন।
আর, লেখালেখি কিছুর আশায় করেন কেউ কেউ, আর কেউ কেউ করেন তার নিজের ভালো লাগে বলে। কারণ যেটাই হোক, লেখা তো লেখাই, তাই না?
শুভেচ্ছা
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
মেঘলা মানুষ-এর মন্তব্যের সাথে পূর্ণ সহমত।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মাঝখানে দেশের বাইরে থাকায় সচলে ঢোকা হয়নি, তাই ধন্যবাদ জানাতে একটু দেরি হয়ে গেল। চমৎকার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ মেঘলা মানুষ। আপনার মন্তব্যের অপেক্ষায় থাকি যখন কোন লেখা ছাপা হয়।
পড়ার এবং মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ অবনীল এবং এক লহমাকেও!
নতুন মন্তব্য করুন