মণীন্দ্র গুপ্ত, 'অক্ষয় মালবেরি' নামে যে জীবনী গ্রন্থটি লিখেছিলেন তাকে সচরাচর লিখিত জীবনী গ্রন্থের নিয়মিত ছাঁচে ফেলার উপায় তিনি রাখেন নি। এই আকরগ্রন্থটি আক্ষরিকই আকর। ম্যাজিকের তুকতাকের মতো বিশেষ কিছু। এর গাম্ভীর্যে, এর অঙ্গসৌষ্ঠবে কোনো ভারিক্কি ভাব নেই রয়েছে পীতচন্দনের মতো শোভা, যেটি বড়োই মনোহর।
মানুষের সম্ভাবনার কোনো উপসংহার নেই। ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্ব, বিকাশ অসীম। একে সংহার করতে চাইলে ব্যক্তির চাইতে হত্যাকারীকে সুঠাম আর সক্ষম হতে হবে। তবু সম্ভব নয়। তাকে দেহে হত্যা করা যায় তার প্রাণটি ঝুলে থাকে দিগন্তে। দিগন্তে ঝুলে থেকে থেকে সে অভিশাপ দিতে থাকবে তাবৎ প্রাণীকুলকে। তখন তাকে হত্যা করার পাপে ধরণী দ্বিধায় পড়ে যায়।
মণীন্দ্র গুপ্ত কি কৈশোর আর শৈশবে বুঝতে পেরেছিলেন পূর্ববাংলার, বরিশালের ধুলো বালির মধ্যে গড়াগড়ি খাওয়া তাঁর জীবনটা তাঁর শরীরের চাইতে বৃহৎ হয়ে উঠবে? শিশুকালে মাতৃহারা, ঠাকুরমার শীর্ণ স্তন থেকে প্রহেলিকার মতো দুগ্ধ পান করা বালকটি ছিটকে চলে যাবেন মাতুলালয়ে যেখানে ক্ষণে ক্ষণে পালটেছে তাঁর ভাগ্য। উপায়অন্তরহীন অবস্থায় ফের পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তন করেও আবার ছিটকে যাওয়া, একসময় ফৌজি জীবন সবই যেন ম্যাজিকের তুকতাক। তাঁর গদ্যের ভাষার মতোন তুকতাক। কখন কখন জ্বাালিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে অসহায় পাঠকের অন্তর।
কবিদের গদ্যভাষ্যর কারণে তাদের দিকে হেলে পড়া সে অনেকদিনের বিষয়-আশয়। রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপ্ত শক্তিমান কবি মণীন্দ্র গুপ্ত'র বড় সম্পদ তাঁর লেখার ভাষা। 'অক্ষয় মালবেরি' গ্রন্থে তিনি স্মৃতির কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পন করেছেন। স্মৃতিগ্রন্থ লিখতে গিয়ে তিনি চোখের সামনের, বোধের সীমানার সবকিছুকে বর্তমান আর অতীতের ফ্রেমে যুগলবন্দি করেছেন। স্মৃতিগ্রন্থতো এমনই হওয়া উচিত। মণীন্দ্র গুপ্ত যেন উত্তরসূরিদের শেখাতে চেয়েছিলেন লেখালেখির অ-আ-ক-খ। সবকিছুতে ছিল অসম্ভব যত্ন। কি ভাষায়, কি উপস্থাপনে। কোথাও কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো বাহুল্য নেই। সবটাই গড়িয়ে দিয়েছেন উপত্যকায়। সেদিন বেগের কাছে সমর্পন ঘটেছিল শব্দের গতির। যে যার মতো চলে গেছে, চলে গেছে নিজ নিজ পথে। পাঠকের এ বড় আরাম। কত কি জানা হল, কত কি দেখা হল, যা হয়ত পাঠক কোনোদিন বুঝেছিল, জেনেছিল কিন্তু পাঠকের কলমের নেই সেই জোর, তাই লেখা হয় নি। সবার কথাই যেন মণীন্দ্র গুপ্ত বলে দিলেন। যে জীবন আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের মতো করে কাটিয়ে এসেছি, ফিরে সে জীবন নিয়ে লিখতে যে পরিমান দক্ষতা দরকার, তার একটা তরিকা যেন মণীন্দ্র গুপ্ত প্রদর্শন করলেন।
মনে থাকবে মণীন্দ্র গুপ্ত, অক্ষয় মালবেরি পড়ার স্মৃতি মনে থাকবে।
কিছু লাইন শেয়ার করি-
এক.
শরীর কি বস্তু, সেই যৌবনে টের পেয়েছিলাম, আর এখন বার্ধক্যে টের পাই- নদীকে মাঝিরা যেমন টের পায় জোয়ার আর ভাটায়।
মৃত্যুর পরে শ্মশানে বসে হয়তো দেখব শরীর ফিরছে তার অঙ্গারে, জলে, ধাতুতে, লবণে। আর তার সূক্ষ্ম বিদেহ আভা চলে যাচ্ছে আকাশে- অালো মেঘ আর শান্তির দেশে। শরীর তো যা পেয়েছিলাম তাই ছিল, কিন্তু অস্তিত্বের ঐ বিদেহ আভা আমিই দিনে দিনে তৈরি করেছিলাম বই পড়ে, ছবি দেখে, গান শুনে।
দুই.
মানুষী স্মৃতিই মানুষ। স্মৃতিই জটিলতা। মরণের পরে আমাদের যে নির্বাণ হয় না সে কেবল স্মৃতি আছে বলেই না। পুনর্জন্ম সবচেয়ে বড় ম্যাজিক- ধুয়ে মুছে সব পরিষ্কার করে দেয়। জাতিস্মর হলে জন্মক্ষণের দু:খ আর জানার ভার বইতে হত। অল্প লইয়া থাকি, তাই বেঁচে থাকি। কিন্তু অনেকদিন বেঁচে থাকার ফলে আমার মধ্যে জাতিস্মরতা এসে যাচ্ছে। পুরনো রঙ্গমঞ্চে রঙ্গ নিজে-নিজেই আবার গাঢ় হয়ে উঠেছে।
তিন.
সেই বয়সে, এসব আমি স্পষ্ট করে বুঝি না, শুধু বোধের গোধূলিতে দ্বিতীয়বার চাঁদের ধূসর সোনার অবছামতো রেখায় কত লেখা পড়ে। মন সুখ আর বিষাদে দু ভাগ হয়ে চিরে যায়। অনুভূতির চাপে আমি জলের মধ্যে মাছের মতো স্থির হয়ে ডুবতে থাকি, আবার কখনো আঁকুপাঁকু করে উঠি- মহামৎস্যের মতো ঘাই মারতে চাই অনন্তে।
চার.
কালপ্রবাহ এক অদ্ভুত জোড়া শব্দ। কোনোদিন এই নশ্বর তেতলার বারান্দায় বসে দূরের সান্ধ্য লাল মেঘ দেখতে দেখতে সাময়িক বোধিলাভ হয়। ভাবি, কাল বলে কিছু নেই, আছে শুধু প্রবাহ। সর্বপ্রকার অস্তিত্ব নিজধর্মেই রূপান্তর পায়। এই তো চোখের সামনে দেখছি, সবাই, সবাইকে পালটে দেয়-সূর্যডোবা আলো মেঘকে পালটে দিয়েছে, লাল মেঘ বিকেলকে পালটে দিল, বিকেলে ব্রহ্মাণ্ড আমাকে পালটে দিচ্ছে। সবাই সবাইকে পালটে দিচ্ছে-মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার মতো, সবাই মিলে উৎসবে মাতবার মতো।
পাঁচ.
বাতাসের করতালি, মাতলামো, উচ্ছ্বাস এসব ভাসমান সস্তা শব্দে কি করে বোঝানো যাবে সেই অনিবর্চণীয় গভীরকে। এইসব আচম্বিত শব্দ আর পলকদৃশ্য হঠাৎ হঠাৎ জানিয়ে দেয়, এই পৃথিবী কিসের মর্মর।
-লীনা দিলরুবা
মন্তব্য
বইটা পড়ছি এখন। পড়ার অভিজ্ঞতা চমৎকার। অনেক মায়াময় লেখা। কবিদের গদ্য হয়ত এমনই নান্দনিক হয়।
গ্রন্থালোচনা ভাল হয়েছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
গতবছরে পড়া সবচেয়ে প্রিয় বই।
গুডরিডস রিভিউ লিঙ্ক জুড়ে দিলাম।
________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"
একজন সচলের বদান্যতায় বইটি হস্তগত হয়েছে, এখনো পঠিত হয়নি। ছোট্ট আলোচনা কিন্তু চমৎকার টুকরো অংশগুলো পড়ে বইটি জলদি পড়ার তাগিদ অনুভব করলাম।
-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
নতুন মন্তব্য করুন