হারানো খাম

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৪/০৫/২০১৯ - ১২:২৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নীতুর জন্য গল্প

মুসাররাত জাহান শ্বেতা

ছুটির দিনগুলোতে আমি পড়ে যাই মহা বিপদে। বলছি কেন।

এই যেমন আজ একটা ছুটির দিন। সপ্তাহের নিয়মিত ছুটি নয়, বিজয়া দশমীর ছুটি। স্কুল বন্ধ। ছুটির মধ্যে করার জন্য স্কুল থেকে যেসব বাড়তি হোমওয়ার্ক দেয়া হয়েছিল তা গতরাতেই শেষ করে ফেলেছি। কারন কাজ ফেলে রাখার অভ্যেস আমার নেই, বিশেষ করে স্কুলের হোমওয়ার্ক হলে তো নয়ই। কিন্তু তার অর্থ হল আগামী বাকী দু'দিন আমার আর কিছুই করার নেই।

তবুও ছুটির দিন ভোরবেলাতেই ঘুম ভেংগে গেল রোজকার মত। অনেক্ষন ধরে বিছানায় গড়াগড়ি করলাম। এপাশ থেকে ওপাশ। তারপর শূন্য দৃষ্টিতে ছাদের ঘূর্নয়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন চিন্তা করলাম বিছানা ছেড়ে উঠে সারাদিন কি করা যায়।

এই ঘরে আমরা দুই বোন থাকি। আগে আমরা দুই বোন এক বিছানাতেই ঘুমাতাম। কিছুদিন হল আমার জন্য নতুন বিছানা কেনা হয়েছে। বড়বোন নীলা রাত জাগে অনেক, জেগে জেগে বই পড়ে, আরো কি কি সব করে, তাতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত হয়। আমি প্রতিদিন একই সময়ে ঘড়ির কাটা ধরে ঘুমাই। এখন আলাদা বিছানা পেয়ে নীলা তার বেডসাইড ল্যাম্প জ্বেলে সারারাত জেগে থাকলেও আমি আমার বিছানায় মশারির ভেতর থেকে টের পাইনা। বই রেখে লাইট বন্ধ করার জন্য আর বারবার নীলাকে তাগাদা দিতে হয়না, নীলা ওর মত জেগে থাকে, আমি আমার মত ঘুমিয়ে পড়ি। রাত জেগে গল্পের বই পড়ার শখ আমার নেই।

নীলার বিছানা জানালার পাশে। ঘুম ভেঙ্গে তাকিয়ে দেখি নীলাও তখনো বিছানায় তবে মশারী তুলে রেখে পর্দা সরিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে, সত্যজিৎ রায়ের নতুন বই, গ্যাংটকে গন্ডগোল, ফেলুদার রহস্য গল্প। শুধু রাত জেগে না, রাত দিন সবসময়েই গল্পের বই পড়া তার নেশা। বৃত্তির টাকা জমিয়ে সে সব নতুন বই দোকানে আসা মাত্র কিনে আনে। তার বই রাখার জন্য তিনটে বাঁশের শেলফ কিনে দেয়া হয়েছে, সেগুলো সব ভর্তি হয়ে গেছে। এখন পড়ার টেবিলেও তার গল্পের বই জমা হচ্ছে। ইদানিং সে দুইএকটা ইংরেজী নভেলও পড়া শুরু করেছে মনে হয়। সেদিন দেখি ওর টেবিলে একটা বই ‘the CATCHER in the RYE’। নীলা আজকাল ডায়েরীও লেখে, লেখা শেষ হলেই টেবিলের ড্রয়ারে আবার তালা দিয়ে রাখে। আমার ধারনা সে নিশ্চয়ই কোন সিক্রেট বিষয় নিয়ে লেখে।

আমাকে আরমোরা ভাংতে দেখে নীলা বালিশ থেকে মাথা একটু তুলে আমার দিকে দেখলো তারপর আবার বইতে চোখ ফিরিয়ে নিতে নিতে বলল 'উফ্ কি ভীষন ক্লাইমেক্স, ফেলুদা প্রায় রহস্য সমাধান করে ফেলেছে!’ তারপর আমার দিকে না তাকিয়েই বলল 'রান্না ঘরে যেয়ে দেখতো চা হয়েছে কিনা।’

চা হলেই সে বিছানা থেকে উঠবে, তারপর সরাসরি রান্নাঘরে যেয়ে চুলা থেকে ফুটন্ত চা নিবে, একটুও ঠান্ডা হলে চলবেনা।

বিছানা থেকে নামতে যেয়ে দেখি মেঝেতে নীলার প্রজেক্ট। গতরাতে আমি ঘুমিয়ে যাবার পর রাত জেগে সে এসব করেছে নিশ্চয়ই। সে নিশাচর, সুযোগ পেলেই রাত জেগে থাকে। কাল রাতে দেখছি ব্লেড দিয়ে লাক্স সাবান কেটে মূর্তির মাথা বানিয়েছে। মাথাভর্তি এলোমেলো চুলের একটা মেয়ের মাথা। আমাকে মেঝেতে নামতে দেখে বলল ‘দেখো দেখো, আমার শ্রাবনীকে পাড়িওনা।’ এই সাবানের মূর্তির নাম তাহলে শ্রাবনী? বই পড়ার মত মূর্তি বানানো তার আরেকটা শখ। তার টেবিলের সাথে লাগোয়া তাকে অনেক মূর্তির মাথা বানিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। সব মূর্তির নামও দেওয়া হয়েছে। বম্বের নায়িকা শাবানা আজমী নীলার রোল মডেল, তার মাথাও বানিয়েছে। নাম রেখেছে ‘সাবানের শাবানা’। ইকবাল রোডের কোনায় আমাদের দুই বাসা পরে একতলা নীল বাড়ীটার ছাদে রোজ বিকেলে কয়েকটা ছেলে গিটার বাজিয়ে গান গায়। তাদের একজন নীলাকে কিছুদিন আগে একটা কবিতা লেখা চিঠি দিয়েছিল। তার পর পরই দেখলাম নীলা দুটো নতুন মূর্তি বানিয়েছে, সেগুলো দেখতে ওদের দু’জনের মত, একজনের হাতে গিটার, তার নাম দিয়েছে ‘গান ওয়ালা’। অন্যজনের হাতে চিঠির খাম, তার নাম ‘চিঠি ওয়ালা’। এমনকি আমাদের স্কুলের দাড়ীওয়ালা দারোয়ান ভাইয়ের মাথাও বানিয়েছে, তার নাম ‘মন্টুর মাথা’।

আমি সাবানের শ্রাবনীকে সন্তর্পনে ডিঙিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে রান্না ঘরের দিকে পা দিলাম।

দেয়ালের ওপাশে ছোটবোন নিশা তানপুরায় রেওয়াজ করছে। ঘুমের ঘোরেই তার রেওয়াজ কানে আসছিল। দাদি আর নিশা একঘরে থাকে। দাদি ফজরের আযানের পর পর নামাজ পড়তে ওঠে, নিশাও তখন উঠে পড়ে। স্কুলের দিন কিংবা ছুটির দিন যাই হোক, রোজ ভোরে দিন শুরু করার আগে রেওয়াজ করা তার ছোটবেলার অভ্যেস। আমি গান বাজনা কিছুই বুঝিনা তবে নিশার রিনরিনে মিষ্টি কন্ঠে দরদ দিয়ে গাওয়া গান বোঝার জন্য পন্ডিত হতে হয়না। গান গাওয়ার সময় সে চোখ বন্ধ করে অন্য কোন জগতে যেন হারিয়ে যায়। নিশা সেই সকাল থেকে সাধনা করছে নতুন কোন সুর নির্ভুল ভাবে তোলার জন্য! ধৈর্য আছে বটে। গলা সাধা শেষ হলে সে গরম পানিতে গড়গড়া করবে, তারপর দশমিনিট কোন আওয়াজ না করে চুপ করে থাকবে। ওস্তাদজীর প্রিয় ছাত্রী সে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে শুদ্ধ সঙ্গিত প্রচার সভায় সে নিয়মিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পরিবেশন করে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।

রান্নাঘরের দিকে যাবার পথে দেখি ডাইনিং রুমে রাঁধুনিখালা আলমারীর উঁচু তাক থেকে তুলে রাখা প্লেট গ্লাস নামিয়ে টেবিল সাজাচ্ছে। ছুটির দিনে তার পছন্দের ডিনার সেটে সুন্দর করে সাজিয়ে খাবার পরিবেশন করা তার শখ। আমাকে দেখে পান-জর্দা খাওয়া হাসি মুখে বল্ল 'আম্মু, আইজ ইশপেশাল নাস্তা তাই ইকটু দেরী হচ্ছে, তয় চা রেডী, চা খাবেন?' আমি মাথা নাড়তেই সে আলমারী থেকে নামানো সোনালী বর্ডার দেয়া তস্তুরী আর কাপ ধুয়ে সাদা তোয়ালেতে মুছে তাতে চা দিল আমাকে, সাথে চিনি মাখানো টোস্ট। আমি চা আর টোস্ট নিয়ে ড্রইং রুমে গেলাম।

ড্রইং রুমে মেঝেতে বসে ছোটভাই নিলয় ওর রং-পেন্সিল-কাগজ নিয়ে ছবি আকছে। ছবিতে বড়শির সুতোয় একটা কাছিম, কাছিমের মাথা, গলা আর সামনের দুই পা পানির ওপরে, বাকি পুরো শরীর পানির নিচে ডুবে আছ। পুকুর পাড়ে দাড়িয়ে সাত আট বছরের একটা ছেলে বড়শি টেনে কাছিমটাকে তোলার চেষ্টা করছে, কাছিমের ভারে বড়শির লাঠিটা ধনুকের মত বাঁকা হয়ে আছে। বড়শি হাতে ছেলেটা নিজেও পেছন দিকে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে আছে বড়শির টান সামলাতে যেয়ে।

আমি চা নিয়ে নিলয়ের পাশে মেঝেতে বসলাম। ওকে জিজ্ঞেস করলাম ‘যে ছেলেটা মাছ ধরছে সে কি তুমি?’ নিলয় মাথা নেড়ে বলল ‘ছেলেটা তো মাছ ধরছে না, কাছিম ধরছে। অবশ্য মাছই ধরতে চেয়েছিল কিন্তু তার বদলে একটা কাছিম পেয়েছে।’ তারপর আবার বলল, ‘নাহ, ঐ ছেলেটা আমি না।’ আমি ওঁকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম ‘ঐ ছেলেটা যদি তুমি না-ই হও তাহলে তুমি কিভাবে জানলে যে সে মাছ ধরতে চেয়েছিল, কাছিম ধরতে চায়নি?’ নিলয় দ্রুত জবাব দিল ‘আমিই তো আকছি, সেজন্য আমি সব জানি।’ তারপর আবার কিছুক্ষন চিন্তা করে আমাকে জিজ্ঞেস করলো ‘আপু তুমি কি জানো কাছিমের পেট কিরকম দেখতে? কাছিমটা পানি থেকে উঠালেই তো ওর পেট দেখা যাবে কিন্তু আমি জানিনা কাছিমের পেট কেমন দেখতে।’

‘জানো না? কি মুশকিল, তাহলে তো কাছিমটাকে সারাদিন পানিতেই থাকতে হবে!’ আমি চিন্তিত হওয়ার ভান করে বললাম। তারপর তাকে বললাম ‘আচ্ছা তারচেয়ে তুমি এক কাজ কর, আব্বার সাথে শেরেবাংলানগর লেকে যেয়ে একটা কাছিম ধর তারপর দেখ কাছিমের পেট কেমন দেখতে, তারপর বাসায় এসে আবার এই ছবিটা আঁকা শেষ কর।’

নিলয় বিজ্ঞের মত হাসি হেসে বলল, ‘দূর বোকা! শেরেবাংলানগর লেকে কাছিম থাকে নাকি? তারচেয়ে আমি কল্পনা করেই কাছিমের পেট আকতে পারি..’ তারপর কালো, কমলা আর সবুজ রং নিয়ে নিজেই কাছিমের পেট আকতে শুরু করল। ছবি আঁকার বিষয়ে তার কোন ক্লান্তি নেই। আমাদের চৌদ্দ পুরুষে কোন আকিয়ে ছিল বলে জানিনা তবে নিলয় বড় হয়ে হয় জয়নুল আবেদিন নয় পাবলো পিকাসো কোন একজন হবে বোধ করি।

ভোরবেলা বাসায় থাকলে আব্বা তার পুরনো লং প্লেয়ারে গান বাজায়। প্রায় সময় একই গান শোনে সে। আমার জ্ঞান হওয়া অব্দি আব্বাকে এই গানগুলো শুনতে দেখছি। রেকর্ডের ওপরে গায়িকার সাদাকালো ছবি, চোখে টানা কাজল আর খোপায় সাদা ফুল। ইংরেজীতে তার নাম লেখা ‘ইকবাল বানুর গজল’। আমার আওয়াজ পেয়ে আব্বা খুশী হয়ে বলল ‘আসো, আসো, এই গানটা শোন, চোখ বন্ধ করে শুনতে হবে, এই লাইনটা মনযোগ দিয়ে শোন, .... সুরটা শুনেছো? চমৎকার তাই না?’ আমি দায়সারা ভাবে মাথা নাড়ালাম। এই রেকর্ডগলো আসলে আব্বা-মার বিয়েরও আগের। পনের-কুড়ি বছর ধরে একই গান মানুষ একই রকম ভালোলাগা নিয়ে কিভাবে শোনে তা-ই আমার মাথায় আসেনা।

গান শুনতে শুনতে আব্বা নিজেও গানের সাথে গুনগুন করছে,‘পায়াল মে গীত হ্যায়..’। আর তার সাথে সাথে দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো ঝারমোছ করছে। ছবিগুলো বেশীর ভাগ আব্বার নিজের তোলা। একটা ছবিতে মা টেবিলে বসে একটা খোলা বইয়ের ওপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে, তার পাশে একটা মোমবাতি জ্বলছে। আরেকটা ছবিতে দাদা আর ছোটবোন নিশা মাঠে দাড়িয়ে, দাদার পরনে সাদা পান্জাবী-পাজামা, হাতে লাঠি। নিশা তখন কেবল দাড়াতে শিখেছে, দাদার পান্জাবীর এক কোনা ধরে দাড়িয়ে আছে সে। আরেকটা ছবিতে আমি, আমার হাতে সেতার, আমার আঙ্গুলগুলো সেতারের তারগুলোর ওপর বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে কোন সুর খুঁজছে।

ফটোগ্রাফি আব্বার শখ। ছবি তোলার পর নিজস্ব ‘ডার্ক রুম’ - এ আব্বা তার ছবিগুলো ধোয়। তারপর বাধাই করে ঝুলিয়ে রাখে।

আমি বাড়ান্দার দিকে চলে গেলাম। মনে পড়ল আব্বা ছোটবেলায় নিশার সাথে আমাকেও গান শেখাতে অনেক চেষ্টা করেছে। আব্বার ধারনা গান গাইলে মন শান্ত হয়, প্রান হালকা হয়। কিন্তু আমার ভাঙ্গা কন্ঠে সুর-তালের কোন আভাস না থাকায় সম্ভবত গান শেখানোর প্রয়াস ভেস্তে যায়। তবে আব্বা হাল ছাড়েনি, গান শিখতে আমার অনিহা দেখে অনেক খুঁজে একজন সেতার বাদককে জোগাড় করেছিল আমাকে তালিম দেয়ার জন্য। ঢাকা শহরে সেতার বাদক বিরল, তবে সেতার শেখার শিষ্যও সম্ভবত কম, সেই কারনেই হয়তো যাকে পাওয়া গেল সে বাসায় এসে আমাকে তালিম দিতে রাজি হল। আমাকে তালিম দেয়ার টিউশনিটা সেতার বাদকের জন্য বাড়তী আয় হিসেবে ভালই ছিল ধারনা করি। নিষ্ঠার সাথে সে আমাকে তালিম দিতে শুরু করলো। কিন্তু মাস দুয়েক যাওয়ার পর সংগীতে আমার অজ্ঞতা আর অবনমিত আগ্রহ দেখে অচিরেই তারও উৎসাহে ভাটা পড়ে। শেষাতক একদিন সে আব্বাকে আড়ালে ডেকে তার চোস্ত মুর্শিদাবাদী একসেন্টে বলল ‘জনাব, আপনার মেয়ের সুর তালে তেমন সমস্যা নেই, কন্ঠ একটু ভাঙা বটে তবে সেটাও সমস্যা নয়। সমস্যা হল মেয়েটির প্রানে গান নেই।’ আমার সেতার শেখার সেখানেই সলিল সমাধী ঘটে। আমিও হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। গান বাজনার শখ তো আমার নেই।

বারান্দায় রোদের আলোতে বসে মা তার ঝুলন্ত বাগানের গাছগুলোর পরিচর্যা করছিল। অবশ্য বাগানে কাজ করার জন্য মার ছুটির দিনের প্রয়োজন হয়না, সুযোগ পেলেই গাছের গোঁড়ার মাটি থেকে আগাছা তোলে, মাটি নিড়িয়ে দেয়, সার কিংবা নতুন মাটি দিয়ে পরিচর্যা করে। বাড়ান্দার গ্রিলের সাথে কোন লতা গাছ বেধে দেয়। আমাদের এই ভাড়াবাড়ীর ছোট্ট বাড়ান্দা যেন এক টুকরো চির সবুজ বন।

পাশের ফ্ল্যাটের নিরাও তখন তাদের বাড়ান্দায় বাগানের পরিচর্যা করছে। নিরার বাগানটাও সুন্দর। বাগানে কাজ করতে করতে মা আর নিরা তাদের বাগানের গাছ নিয়ে কথা বলছে। মার সাথে তার গল্প খুব জমে। তারা দুজনে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন রকম নতুন গাছ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে, মাঝেমাঝে সেগুলো নিজেদের ভেতরে লেনদেনও করে। নিরা মাকে একটা চারা দেখিয়ে বল্ল 'আন্টি এই যে আমার সেই হাইড্রেন্জার চারা যেটার কথা আপনাকে বলছিলাম, সেদিন ফার্মগেটের খামারবাড়ী থেকে এনেছি। আপনার জন্য একটা চারা বানিয়েছি, একটু পরে এসে দিয়ে যাব আপনাকে।’

নতুন গাছ দেখে খুশীতে মার চোখ আনন্দ ভরে গেল। মা আমার ঘরের জন্যেও মাঝে মাঝে গাছ বানিয়ে দেয়। এবার একটা অর্কিডের গাছ বানিয়েছে। একফুট দৈর্ঘের এক টুকরো বাঁশের মধ্যে নারকেলের আঁশ দিয়ে তারমধ্যে পাটের সুতো দিয়ে অর্কিডের গাছ পেচানো হয়েছে। আমার হাতে নতুন লাগানো গাছটা দিয়ে মা বল্ল 'এটা তোমাদের ঘরে জানালার পাশে নিয়ে রাখ। আমি কাজ শেষ করে আসছি।' তারপর মা তার টবের গোলাপ গাছ থেকে একটা দুটো গোলাপ কেটে সেগুলো ফুলদানীতে সাজাতে লাগলো। ঘরে সবসময় তাজা গাছ আর ফুল সাজাতে মা পছন্দ করে। নকল ফুল কিংবা প্লাস্টিকের গাছ মার পছন্দ না।

আমি আমার নতুন গাছ নিয়ে আমাদের ঘরে গেলাম। এর আগে মা সেদিনও আমাদের ঘরে কি যেন একটা গাছ ঝুলিয়ে দিয়েছিল, পানির অভাবে গাছটা কবে শুকিয়ে গেছে খেয়ালই করিনি। ছোট একটা ক্যাকটাসের চারাও রেখেছিল কোন একসময় জানালার পাশে, সেটা অবশ্য পানি ছাড়াই বেঁচে আছে দিব্যি। গাছের শখও তো আমার নেই।

সত্যি বলতে, কোন কিছুর শখই আমার নেই। এই ছুটির দিনে অবসরে সবাই যখন যে যার শখের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত, আমি তখন কিছুই করার খুঁজে পাচ্ছিনা। নিজেকে একটা রোবটের মত মনে হল।

এসময় দরজায় কলিং বেলের শব্দ শুনে দৌড়ে গেলাম। পাশের বাসা থেকে নিরা এসেছে, তার হাতে ছোট্ট একটা চারা গাছ। মার জন্য। আমাকে দেখে একগাল হাসি হেসে উৎসাহের সাথে বলল ‘আমার নতুন গাছের চারা, হাইড্রেন্জা, এই গাছ ঢাকায় আর কারো নেই।’ নিরা ঘরে ঢুকেছে, নিরার পেছনে তার ছোটবোন নীতু দাড়িয়ে। নিরা সরাসরি বাড়ান্দায় যেয়ে মার সাথে গল্প করতে শুরু করেছে। নতুন গাছটা কোথায় লাগানো হবে তাই নিয়ে দুজনের জল্পনা চলছে।

নীতুকে আমার ঘরে নিয়ে গেলাম। নীলা তখন বিছানা গুছাচ্ছে। নীতুর চুলে হাত বুলিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলল, ‘কি খবর আপনার?’

নীতু প্রথমে একটু চুপচাপ থাকে তবে প্রাথমিক জড়তা কেটে গেলে অনেক কথা বলে সে। আমার বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে একথা সেকথার পর নীতু বল্ল ‘আপু একটা গল্প বলবে? সেদিনের ক্যাটারপিলারের গল্পটা?'

ক্যাটারপিলারের গল্প তো মনে নেই আমার! এক একদিন নীতুর বায়না মেটাতে যেয়ে বানিয়ে বানিয়ে কত গল্প বলি, পরে কি আর সেসব মনে থাকে? তাছাড়া পরের দিন একই গল্প আবার বানিয়ে বলতে গেলে গল্প এদিক ওদিক হয়ে গেলে নীতু ঠিক ধরে ফেলে! কে জানতো নীতু আমার বানোয়াট গল্পগুলো এত মনযোগ দিয়ে শোনে?

নীতুকে বললাম 'ক্যাটারপিলারটা তো এখন ওর দাদিবাড়ী বেড়াতে গিয়েছে, তারচেয়ে তোমাকে একটা নতুন গল্প বলি, এই গল্প তোমার আগে পৃথিবীর আর কেউ শোনেনি।’

নীতুর চোখ নতুন গল্প শোনার কল্পনায় আনন্দিত হয়ে উঠলো। আমি শুরু করলাম ‘অনেক দূরের কোন এক দেশে ছিল..’ এটুকু বলে আমি থামলাম। চিন্তা করলাম নীতুকে কিসের গল্প বলা যায় যা তাকে আগে বলিনি। আমার ঘরের চারদিকে তাকালাম কোন আইডিয়া পাই কিনা। জানালার পাশে ক্যাকটাস গাছটার দিকে চোখ পড়লো। তারপর আমি আবার শুরু করলাম, ‘অনেক দূরের এক মরুভূমির দেশে ছিল ছোট্ট একটা সবুজ ক্যাকটাসের গাছ, একটু মোটা, একটু গোল। সেই মরুভূমির দেশটা ছিল সোনালী বালুতে ভরা’, আমি আবার থামলাম, তারপর আমার ঘরের চারদিকে আবার দেখলাম, যেন এই ঘরটাই সেই মরুভূমির দেশ। নীতুও আমার দৃষ্টি অনুসরন করে মাথা ঘুরিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে ঘরের চারদিকে দেখলো, তারপর আমরা দু’জন দু’জনের চোখের দিকে তাকিয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম, যার অর্থ হল আমরা দুজনেই একই জিনিষ দেখতে পারছি। আমাদের চোখের সামনে থেকে একে একে ঘরের বিছানা, বালিশ, টেবিল, আয়না সব অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকলো এবং তার জায়গায় একে একে বিভিন্ন রকমের ক্যাকটাসের গাছে ভরে গেল, মোজাইক মেঝে বালুর মরুভূমিতে পরিনত হল। দু'জনে বিস্ময়ভরা চোখে দেখতে থাকলাম। আমি আবার শুরু করলাম ‘সেই ছোট্ট ক্যাকটাসের পাতায় ছিল নরম সোনালী কাটা। মরুভূমির গরম আর শুকনো বালুতে সে তার মা বাবা ভাই বোন আর বন্ধুদের নিয়ে খুব আনন্দেই দিন কাটাচ্ছিল। দিনের বেলা সোনালী সূর্যের আলোয় তার বন্ধুদের সাথে খেলা করে আর নাচ করে। আর রাতের বেলায় খোলা আকাশের তারার নিচে তার বাবা মা ভাই বোন নানু দাদুর সাথে গল্প করে। একদিন এক ভোরে সেই ছোট্ট ক্যাকটাস ঘুম ভেংগে দেখলো ...'

গল্পের মাঝপথে নিরা এসে বল্ল 'চল নীতু, আমাদের এখন যেতে হবে।’ নীতু গল্পের শেষ পর্যন্ত না শুনে যেতে চাচ্ছিল না কিন্তু নিরা তাড়া দেয়াতে অনিচ্ছার সাথে বোনের হাত ধরে চলে গেল।

নীতুকে নিয়ে নিরা চলে যাবার পর আমি নাস্তার জন্য আবার ডাইনিং রুমে গেলাম। ডাইনিং টেবিলে বসে দাদি সবার জন্য অপেক্ষা করছে। দাদির হাতে ফ্রেম-সুতো, টি-টেবিলের জন্য একটা নতুন কভার বানাচ্ছে। সাদা কাপড়ে ভরাট সেলাই, একটা সবুজ কচু পাতায় এক ফোটা পানি জমে আছে, পাতাটা এমন ভাবে ভাজ হয়ে আছে যেন পাতায় জমে থাকা পানিটুকু গড়িয়ে না পড়ে যায়। কচুপাতার এক এক অংশে আলোর তারতম্যের কারনে দুই তিন রকমের সবুজ শেডের সুতো ব্যাবহার করা হয়েছে। চোখের অবস্থা অত ভালো না তবু সেলাই করা দাদির শখ।

দাদিকে সেলাই করতে দেখে হঠাৎ মাথায় কি যেন একটা খেলে গেল। দৌড়ে নিজের ঘরে যেয়ে কাগজ কলম নিয়ে এসে দাদির পাশে আমিও বসে গেলাম, ক্লাসের পড়াশোনার কিছুনা, ছুটির দিনে আমারও অবসরে শখ করে করার মত কিছু খুঁজে পেলাম, শুরু করলাম শিরোনাম দিয়ে - "নীতুর জন্য গল্প"!


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

শ্বেতা, আপনার দুটো লেখা পড়ে ভক্ত হয়ে গেলাম!

করবী মালাকার এর ছবি

আমাদের হারানো যুগের এক টুকরো সকাল। খুব ভাল লাগল।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

সাবলীল লেখা। রিমঝিম রিমঝিম রেশ থেকে যায়। তবে বানান বিষয়ে খানিকটা সতর্কতা প্রয়োজন।শুভকামনা রইল।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

মনি এর ছবি

আপনা্র কোন শখ নেই কিনতু লেখা অসাধারন । আবারও অভিভূত।

অবনীল এর ছবি

ভালো লাগলো। চলুক

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

গগন শিরীষ এর ছবি

ভাল লাগল, যদিও নামটা হারান খাম কেন সেটা বুঝিনি।

কর্ণজয় এর ছবি

নামটা দারুণ লাগলো। একটা স্মৃতি জাগানিয়া রহস্য আছে।।।
গল্পটাও তাই। মনে পড়ে যায়। অনেক কিছু।
আবার মনে পড়তে পড়তে গিয়ে মনে পড়েও না কিছু কিছু।
আবছা স্মৃতির মতো। আছে। নেই। নেই। আছে।

মুসাররাত জাহান শ্বেতা  এর ছবি

কর্নজয়, আমার গল্পের চেয়ে আপনার মন্তব্যটাই বেশি সুন্দর লাগলো! - শ্বেতা

মুসাররাত জাহান শ্বেতা  এর ছবি

সবাইকে ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ে মন্তব্য/ ফিডব্যাক দেয়ার জন্য!- শ্বেতা

কে জুনায়েদ আহসান এর ছবি

যায়যায়দিনের পর অনেকদিন বাজে আপনার লেখা পড়লাম। আপনারা একই মানুষ তো, নাকি?

কে জুনায়েদ আহসান এর ছবি

“অনেকদিন বাদে”

অতিথি লেখক এর ছবি

জুনায়েদ আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আপনার মেমোরির প্ৰশংসা করতে হয়, হ্যা আমি একসময় যায়যায়দিনে নিয়মিত কলাম লিখেছি হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।