পশ্চিম ইউরোপের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে দীর্ঘ স্রোতস্বিনী রাইন। রাইনের পূর্ব তীরে ছবির মত ছিমছাম পরিপাটি এক দেশ। প্রায় পনেরশ বছর আগে পাহাড়ের মাঝের এই বিচ্ছিন্ন ভু-খন্ডে থিতু হতে আসা আলেমানি গোষ্ঠীর বংশ ধারা বয়ে এসেছে এদেশের অধিবাসীদের মাঝে। যদি ‘এক দেশে ছিল এক রাজা, রানী, রাজ পুত্র আর তাদের প্রজাকুল’ এভাবে শুরু করতে পারতাম তবে যথার্থ হত। সুবিশাল আল্পস পর্বতমালার একাংশ গভীর আলিঙ্গনে ঘিরে রেখেছে রুপকথার গল্পের মতই ছোট্ট এক দেশ, লিখটেনস্টাইন।
লিখটেনস্টাইন এর দক্ষিন-পশ্চিমে সুইটজারল্যান্ড এবং উত্তর-পূর্বদিকে অস্ট্রিয়া। সাধারনত লোকের গ্রীষ্মছুটি কাটানোর প্রধান গন্তব্য লিখটেনস্টাইন হয়না। কাছে-পিঠের কোনো দেশে না আসলে কেউ সচরাচর লিখটেনস্টাইন দর্শনে যায়না। ছোট দেশ, নিজস্ব বিমানবন্দর নেই। নিকটবর্তী বিমানবন্দর আছে জুরিখ এবং সেইন্ট গ্যালেন (সুইটজারল্যান্ড) এ আর ফ্রিড্রিকস্হাফেন (জার্মানি) এ। দেশটির বড় শহর বলতে কেবল শান, ভাদুজ, ব্যলযারস্ আর ট্রিজেন। আমাদের গন্তব্য ভাদুজ। জুরিখ হপ্টবানহফ (কেন্দ্রীয় রেলস্টেশন) থেকে ভাদুজ এ যেতে ট্রেন-বাস মিলে লাগবে ঘন্টা দেড়েকের থেকে খানিকটা বেশী।
জুন মাসের ঝকঝকে রৌদ্রজ্জ্বল দিন। সকাল সকাল বেরোতে চেয়েও কিছুটা দেরি হলো। এগ্লিস্যাও থেকে জুরিখে আসার পর আরেকটা ছোট্ট দেরি হলো জুরিখ থেকে যার্গান্স এর ট্রেন কানেকশন পেতে। জুরিখ থেকে যার্গান্স এ আসতে ট্রেনে এক ঘন্টার মত লাগল। যার্গান্স রেল স্টেশনের বাইরেই বাসস্ট্যান্ড। দেখলাম মিনিট পনেরো পর আসবে ভাদুজ গামী বাস।
দুপাশের দিগন্তে আল্পস আর আলপাইনের অনাদিকাল অবধি মাথা উঁচু করে থাকা শিহরন জাগানো দৃশ্য। তারমাঝে পরিপাটি রাস্তা ধরে বাস চালক আমাদের নিয়ে যাচ্ছে যেন এক পুরনো পৃথিবীর দিকে। যেখানে আছে সত্যিকারের রাজা, রানী, পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় স্বগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা রাজপ্রাসাদ, আর আছে সাম্রাজ্যের সাধারন প্রজারা। ভাদুজ শহরতলিতে পৌঁছুতে লাগল প্রায় আধা ঘন্টা। সূর্য তখন মাথার ওপরে।
বাস থেকে নেমেই টের পেলাম কোনদিকে যেতে হবে। একটু হাঁটতেই সামনে ভিজিটরস্ সেন্টার। রকমারি স্যুভেনির আর স্থানীয় ওয়াইন কিনছে লোকে। কেউ কেউ তিন ফ্রাংক এর বিনিমিয়ে পাসপোর্টে লিখটেনস্টাইন এর স্ট্যাম্প লাগিয়ে নিচ্ছে। দেশটি ইউরপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত নয় কিন্তু সেঙ্গেন এলাকার অন্তর্ভুক্ত। সুইস ফ্রাংকই এখানকার মুদ্রা। আমি দুখানা চূম্বক খরিদ করে দুটো ম্যাপ নিয়ে আমার দলে ফিরে আসলাম। ভিজিটরস্ সেন্টারকে হাতের ডানে রেখে সোজা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম টাউন হল চত্বরের দিকে। টাউন হল ভবনটা কিছুটা আধুনিক ধাঁচের। পুরো চত্বর গাড়ি বর্জিত এলাকা।
এ শহরের প্রধান আকর্ষন রাজ প্রাসাদ। লোকে বলে, ভাদুজের যেদিক থেকেই দিগন্তের দিকে তাকাওনা কেন ওই উঁচুতে রাজ প্রাসাদ দেখতে পাবে। বারো শতকে নির্মিত এই প্রাসাদে বাস করে দেশটির বর্তমান রাজ পরিবার। ১৪৯৯ এর সোয়েবিয়া যুদ্ধে প্রাসাদটির অনেকাংশই পুরে গেলে বহুকাল এটির গঠনমূলক ও অবকাঠামোর তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। সতের শতকের প্রথম দিকে কাউন্ট ক্যাসপার ভন হোহেনেম প্রাসাদটির মেরামত ও পশ্চিমাংশের সম্প্রসারন করেন। এরপর বিংশ শতকের প্রথম দিকে যুবরাজ জোহান দ্বিতীয় এর শাসনামলে প্রাসাদটির উল্লেখযোগ্য পুনর্নির্মাণের আয়োজন শুরু হয়, এবং ১৯৩৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর যুবরাজ ফ্রাঞ্জ-জোসেফ দ্বিতীয় রাজপ্রাসাদটির বাকি মেরামত ও পুনর্নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করেন। তারপর থেকে রাজ পরিবার আনুষ্ঠানিক ভাবে সেখানে থাকতে শুরু করে। ১৯৮৯ সালে ফ্রাঞ্জ-জোসেফ দ্বিতীয় এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র যুবরাজ হ্যান্স অ্যাডাম দ্বিতীয় সিংহাসনে উপবিষ্ট হন এবং অদ্যাবধি এই প্রাসাদেই রাজপরিবার বসবাস করে আসছে। তাই প্রাসাদটি সর্বসাধারনের জন্য উন্মুক্ত নয়। গাছ-পাতা ছাওয়া ঢালু পথ বেয়ে হেঁটে উপরে উঠে গেলে কাছ থেকে রাজপ্রাসাদ ভালো করে দেখা যাবে সেই ভেবে আমরা টাউন হল চত্বর থেকে আরো সামনে এগিয়ে ডানে উঠে যাওয়া পথ ধরলাম। পিচ ঢালা রাস্তা। আমাদের তিন পরিবারের পাঁচ-পাঁচটি ছানাপোনা, স্ট্রলার নিয়ে ঢাল বেয়ে লাহে লাহে করে উঠব। ভেবেছি ঢাল খুব একটা খাড়া না হয়ে বোধ হয় আস্তে আস্তে উঠে গেছে। কিছুদূর উঠেই প্রমাদ গুনতে হলো। আর তক্ষুনি বিশ্ব পৃথিবীর জনৈক এক পরিব্রাজক পাশ কেটে যাবার সময় বললেন, স্ট্রলার ঠেলে নিয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা না করাই ভাল। নিজেদের কায়িক কষ্টে তৃতীয় পক্ষের সায় পেয়ে অগত্যা পুরো দল ফিরতি পথ ধরলাম।
প্রধান চত্বরে ফিরে এসে আমুদে লোকজন, খাওয়া-দাওয়ার আমেজ আর ট্যুরিস্টদের আনাগোনা দেখতে ভালোই লাগছে। এক পাশে জায়গা খুঁজে বসে দুপুরের খাবার খেতে খেতে স্থানীয় শিল্পীদের কাহিনীময় গান শুনছি। একজন গাচ্ছে আর সহযোগী শিল্পী তুলির আঁচড়ে অনুবাদ করে যাচ্ছে সেই গানের কথা-কাহিনী। এই চমৎকার শিল্পের হয়ত কোনো নাম আছে, আমার জানা নেই।
কিছুক্ষন বসে আবার পথ ধরলাম ভিজিটরস্ সেন্টারের দিকে। ভাদুজ ছোট এলাকা, হেঁটেই দর্শনীয় জায়গা সব দেখে নেয়া যায়। পথে পড়ল পোস্টাল মিউজিয়াম আর ন্যাশনাল মিউজিয়াম। পার্লামেন্ট ভবন এর সামনের চত্বর হয়ে ফিরে এসে বামে একটা ফুট-ওভার ব্রিজ। সেখান থেকে শহর কেন্দ্রের মনোরম এক দৃশ্য নজর কেড়ে নেয়; আধুনিক দালান আর সেইন্ট ফ্লোরিনের নব্য-গথিক ক্যাথেড্রালের অস্তিত্বকে ভ্রূকুটি করে সুনীল মেঘের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে ঘন সবুজ আর কিছুটা তুষারে ছাওয়া অহংকারী আল্পস। এই দৃশ্যপট আমার ক্যামেরা কলুষিত চোখে বন্দি করে নেয়াই শ্রেয়। একটা বড় আফসোস থেকে গেলো, সময়ের সল্পতার কারনে আমার অনেক ইচ্ছের পুরাতন রাইন ব্রিজ বা আল্টহ্রাইনব্রুকহ্য টাই দেখতে যেতে পারলামনা। জুন মাস, সুর্য মধ্য বিন্দু ছেড়ে গেছে কয়েক ঘন্টা হয়, তারপরও কেমন তেঁতে আছে চারপাশটা।
বিকাল প্রায় পাঁচটা, ফিরতি বাস ধরতে হবে। প্রথমে যার্গান্স এ যাব, তারপর যার্গান্স থেকে জুরিখ, এরপর জুরিখ ছেড়ে কিছুটা উত্তরে; যেভাবে এসেছি সেভাবেই। শুনেছি, গ্রীষ্মে ভাদুজের এর আসল সৌন্দর্য নাকি খোলে বেলা পড়ে এলে। যখন দিবা-পর্যটকদের ভীড় কমতে শুরু করে, জীবনের গতি মন্থর হতে থাকে। আর আল্পসের আড়ালে সূর্য গা এলাবে বলে যখন রক্তবর্ণ চূর্ণের মত আভা ছড়াতে থাকে আকাশ, তখন আমুদে শহরবাসী সান্ধ্য পোষাকে সাজে। রাজপ্রাসাদে জ্বলে ওঠে উজ্জ্বল আলো। আর রাইনের বুক থেকে আঙ্গুরের ক্ষেত ছুঁয়ে ভেসে আসে মিষ্টি আর্দ্র বাতাস। আমাদের বাস এসে পড়েছে; মনে মনে ভাবলাম আবারো ফিরে আসব। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে আমরা ফিরতে থাকি আমাদের গন্তব্যে। পেছনে পড়ে থাকলো কালের সাক্ষী পাহাড় চূড়ার রাজপ্রাসাদ। আর গ্রামাঞ্চল জুড়ে বিছিয়ে থাকা আঙ্গুরের আবাদ বুকে করে পড়ে থাকলো অপরূপ রাইনের সবুজ উপত্যকা, আল্পসের লুকানো মণি- লিখটেনস্টাইন।
--জে এফ নুশান
মন্তব্য
ভাল লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্যবাদ।
--জে এফ নুশান
অনেক ধন্যবাদ।
-- জে এফ নুশান
উফ অসাধারন একটা জায়গা। ছবিগুলো দুর্দান্ত লাগলো। আপনার ভ্রমন বিবরনীয় সুন্দর। আরো চাই। এবং যেতে চাই এই নৃস্বর্গে একবার না একবার ।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
অনেক ধন্যবাদ
নতুন মন্তব্য করুন