সিক্রেট
মুসাররাত জাহান শ্বেতা
জুলাইয়ের লম্বা দিনের উষ্ণতার পর খানিকটা ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে। পেছনের লনের পিকেট ফেন্সের সাথে বেয়ে ওঠা হানিসাকল ফুলের মিষ্টি মাদক গন্ধ ছড়িয়েছে সেই বাতাসে। একটা মা কাঠবিড়ালি তার বাচ্চাদের নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পিকান গাছের একডাল থেকে অন্যডালে হুটোপুটি করে কি যেন খেলা করছে। মাঝেমাঝে মাটিতে পড়ে থাকা পিকান বাদাম কুড়িয়ে দুইহাতে ধরে নিয়ে ঝটপট কোন গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে আবার ফিরে আসছে, শীতের সঞ্চয় হবে হয়তো। কিংবা তাদের মা-ছেলেমেয়ের ভেতরকার কোন সিক্রেট খেলা।
আমি ম্যাগনোলিয়া গাছ থেকে ঝোলানো দোলনায় বসে দুলছি আর আমার বাচ্চাদের খেলা দেখছি। বড় বড় সাদা ফুলে ভর্তি হয়ে আছে ম্যাগনোলিয়া গাছ, তাতে দিনভর মৌমাছিদের গুন্জন। আমার দোলার সাথে কিছুটা ছন্দ মিলিয়ে ঝিঝি পোকার মত ক্রিকেট নামের পোকা ডেকে চলেছে। শেষ বিকেলের আলো মলিন হয়ে আসার সাথে একটা দু’টো করে জোনাকি পোকা বের হয়ে আলো জ্বেলে জ্বেলে উড়তে শুরু করেছে।
সন্ধার মায়াভরা বাতাসে অলসভাবে দোলনায় বসে থাকতে আমার কোন একঘেয়েমি নেই তবু বাচ্চাদের হালকা তাগাদা দেই, ‘সন্ধা হয়েছে, ঘরে চলো এবার।’ বাচ্চাদের খেলা শেষ করার কোন লক্ষন নেই। তাদের সারা শরীরে, মাথায় ধুলো বালি, পায়ে কাদা। তার ওপর বাগানে পানি দেয়ার পাইপ ছেড়ে একজন অন্যজনের গায়ে পানি ছিটাচ্ছে। ঘরে যাবার কোনই তাড়া নেই।
ছেলের বয়েস তখন এক হল কেবল, পুরোপুরি হাটতে শেখেনি, তবু আড়াই বছর বয়েসি বোনের পেছনে ছুটে খেলা করার চেষ্টা করে, অসমতল ঘাসের মধ্যে মাঝেমাঝেই ধপাস পড়ে যায়, আবার নিজেই সামলে নিয়ে স্লো মোশনে উঠে দাড়ায়। ওঠার সময় হাতের মুঠিতে দু’একটা ঘাস তুলে নেয়, তারপর সেই ঘাস সন্তর্পনে মুখে দিয়ে বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকায় আমার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। আমি ছুটে যেয়ে তার মুখ থেকে ঘাস বের করে নেই কিনা সেই আশংকায় দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। আমি তাকে সহজেই পাকড়াও করে কোলে তুলে নিলে সে বিনা বাক্যে আত্মসমর্পন করে মুখ হা করে ঘাস বের করে দেয়। শাস্তিস্বরূপ আমি তার পেটে আমার মুখ ঘষে সুরসুরি দেই, তবে পুরোটা সময় সে তার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য বজায় রাখার চেষ্টা করে।
দিনের শেষ বেগুনী আলোটুকু যখন মিলিয়ে যায়, বড় বড় গাছগুলোর ছায়ায় কিছুই যখন আর তেমন দেখা যায়না, তখন দুজনকে একসাথে কোলে তুলে কোন আপত্তি করার সুযোগ না দিয়ে ঘরে নিয়ে বাথটাবে নামিয়ে দেই। চুলে শ্যাম্পু মেখে, ধুয়ে মুছে পরিপাটি করে রাতের পোশাক পরিয়ে দেই। মেয়ের চুল আচড়ে দিতে দিতে তার মাথায় চুমু দিয়ে গভীর নিশ্বাষ নিয়ে যখন বলি ‘উম কি সুন্দর গন্ধ..’ তখুনি ছেলেও কাছে এসে তার মাথা বাড়িয়ে দেয়, তাকেও একই জিনিষ বলতে হবে। দুজনকে বিছানায় শুইয়ে লোশন মেখে দিতে দিতে একটা একটা করে পায়ের আঙ্গুল গুনে দেয়ার সময় কামড়ে খেয়ে ফেলার ভয় দেখাই, তারা মজা পেয়ে হাসে। তবে পাছে মা সত্যি আঙ্গুল খেয়ে ফেলেছে কিনা তা পরখ করার জন্য আবার আড়চোখে তাকিয়ে পায়ের আঙ্গুলগুলো নেড়েচেড়ে দেখে নেয় সব ঠি’ক আছে কিনা। আমি আমার দুই হাতের মধ্যে তাদের ভেজা, ছোট্ট পা দু’টোকে মুঠি করে নিয়ে তিনবার চাপ দেই, একবার-দু’বার-তিনবার। ওরাও তিনবার করে পা নেড়ে উত্তর দেয়। এটা আমাদের তিনজনের ভেতরকার একটা সিক্রেট সাংকেতিক ভাষায় পরিনত হল, যার অর্থ ‘আই-লাভ-ইউ’।
আমাদের তিনজনের আরো কিছু সিক্রেট আছে।
ঘরের অনেক কাজই আমরা তিনজন একসাথে করি। আমি যখন ঘর ঝাড়ু দেই, তারাও তখন তাদের ছোট ঝাড়ু নিয়ে এসে এলোমেলোভাবে ঝাড়ু দেয়ার চেষ্টা করে। আমি ঘর মুছতে গেলে কে আগে আমার পিঠে চড়ে বসবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আমি বাগানের মাটি নিড়াতে বসলে তারাও কালো মাটির মধ্যে তাদের ছোট্ট, নরম হাতগুলো ডুবিয়ে দেয়, আমি যখন কাপড় ভাজ করি তারাও আমার সাথে কাপড় ভাজ করার নামে কিছু একটা করে। কখনো কোন বিরল অবসরে আমি হারমোনিয়াম বের করে গান গাইতে বসলে তারা এসে আমার গা ঘেষে বসে গুনগুন করে। আমি সিডি প্লেয়ারে গান বাজালে তারা মাথার ওপর ওড়নার ঘূর্নি উড়িয়ে ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা দৌড়ে নেচে নেচে আমার জন্য বাড়তি বিনোদনের আয়োজন করে, আমাকেও তাদের নাচের সঙ্গী বানিয়ে নেয়। আমি বই খাতা নিয়ে কিংবা কম্পিউটারে বসলে তারাও ব্যাস্ত হয়ে তাদের কাগজপত্র নিয়ে আমার পাশে বসে আকিঝুকি শুরু করে। রান্না করার সময় তারা রান্নাঘরের তাকের ওপর বসে তদারকি করে।
তবে রান্না করার সময় আমাদের তিনজনের একটা সিক্রেট আছে।
আমরা টক ঝাল মিষ্টি যা-ই রান্না করি না কেন, সবকিছুতেই একটা সিক্রেট উপাদান দেই। রান্নাঘরের সবচেয়ে ওপরের তাকে একটা রঙ্গিন কাচের জারে আমাদের সেই সিক্রেট উপাদান তুলে রাখা থাকে, তাতে কাগজের লেবেলে হাতে লেখা রয়েছে ‘সিক্রেট ইনগ্রিডিয়েন্ট’। রান্নার সময় সেই জার নামিয়ে তার ঢাকনা খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে আমরা তিনজন রহস্যময় ভঙ্গিতে একে একে তিন চিমটি কাল্পনিক সেই উপাদান খাবারে মিশিয়ে দেই। শুধু আমরা তিনজনই জানি আমাদের যৌথ প্রয়াসে রান্না করা খাবারগুলো কেন এতো সুস্বাদু হয়, কারন হচ্ছে এই রহস্যময় উপাদান।
ডিনার বানানো শেষ হলে আমরা তিনজন মিলে টেবিল সাজাই। টেবিলের মাঝখানে কাচের ফুলদানিতে বাগান থেকে তোলা পাতাসহ গোলাপি পিওনী আর সাদা ম্যাগনোলিয়া ফুল।
বাবার কলিং বেলের শব্দ শুনে দু’জনে একসাথে দৌড়ে যায়, বাবা তাদের দু’জনকে একসাথে কোলে তুলে নেয়। তারপর ডিনার খেতে বসে বাবা যখন তার চোখ কপালে তুলে বলে ‘হুম..খাবার তো খুব মজা হয়েছে..!’ তখন আমরা তিনজন চোখের ইশারায় হাসি, বাবা যে তাদের সিক্রেট উপাদানের বিষয়ে কিছুই জানেনা তাতে তাদের সে কি আনন্দ!
রান্নাঘরের জারটা ছাড়াও আমাদের আরো একটা কাচের জার আছে। বুকশেল্ফে সাজানো এই জারটাতে জমানো রয়েছে রঙ্গিন বালু। একেক আস্তরে একেক রঙ্গের বালু। সবচেয়ে নীচে বেগুনী, তারপর নীল, তারপর সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল তারপর আবার বেগুনী, নীল, সবুজ..। এই বালুগুলো কোথায় পেয়েছি সেটাও আমাদের তিনজনের একটা সিক্রেট।
আমরা চারজন মিলে মাঝেমাঝে সমুদ্রে বেড়াতে যাই। কখনো প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে, কখনো আটলান্টিকের পারে। কখনো আর্কটিকের কিনারায়, কখনো ক্যারিবিয়ানের দ্বীপের ধারে, আবার কখনো বঙ্গপোসাগরের সৈকতে। সমুদ্র সৈকতে বেড়ানো শেষে ফেরার সময় সুভেনির হিসেবে সেখান থেকে ঝিনুক, শামুক, রঙ্গিন পাথর কুড়িয়ে আনি। আর আনি আমাদের তিনজনের হাতের মুঠি ভর্তি করে তিন মুঠি বালু। বাসায় ফিরে একেক সমুদ্র সৈকত থেকে আনা বালুগুলোকে একেক রং করি, তারপর আমাদের জারে ঢেলে সাজিয়ে রাখি। তার সাথে দু'একটা পাথর আর ঝিনুকও রাখি। এই ঝিনুক আর পাথরগুলোর প্রতিটির সাথে আমাদের তিনজনের অনেক গল্প জড়ানো, কোথায় পেয়েছিলাম, কখন, কিভাবে পেয়েছিলাম, কিভাবে এনেছিলাম এসব গল্প।
একবার এক বীচ থেকে সি-ডলার নামের সাদা গোল কিছু সামুদ্রিক প্রানীর খোলস কুড়িয়ে এনে হোটেলের বাথটাবের কিনারায় রেখেছিলাম পানি ঝরানোর জন্য। পরদিন সকালে আমাদের ফ্লাইটের আগে ব্যাগ গোছাতে যেয়ে দিখি সেগুলো আর বাথরুমে নেই, নিজেরা ধীর গতিতে হেটে হেটে রুমের সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে! তারমানে আমরা যেগুলোকে নিষ্প্রান খোলস ভেবেছিলাম, তার ভেতরে আসলে জীবন্ত প্রানী ছিল!
গল্পে গল্পে সময় যেন বাষ্পের মত উড়ে যায়। আমার ছোট্ট ছেলে হাটতে হাটতে দৌড়াতে শেখে, মেয়ে ট্রেনিং চাকা ছাড়া সাইকেল চালাতে শেখে। আমিও নিজের ক্যারিয়ার গড়তে শুরু করি। আর সময়ের সাথে আমাদের তিনজনের মধ্যে আরো অনেক সিক্রেটও তৈরী হতে থাকে।
একবার এক পাহাড়ে বেড়াতে যেয়ে পাহাড়ী ঝর্না থেকে কিছু পাথর কুড়িয়েছিলাম, ছোট, মাঝারি, বড় পাথর। কি বাহারি তাদের রং! মেঘের মত ধোয়াটে সাদা, ক্রিস্টালের মত স্বচ্ছ কমলা, ঘোলাটে সবুজ, জমাট নীল, মসৃন কালো, মলিন গোলাপি, গাঢ় লাল। কত ঝুঁকি নিয়ে বাবার অগোচরে আমরা তিনজন ঐ পাথরগুলো সংগ্রহ করেছি, ওগুলোর প্রতিটি আলাদা আলাদা সংরক্ষনের মর্যাদার দাবি রাখে, কোনটাই ফেলে আসা যাবেনা। তবে আমরা যে প্রতিবার ব্যাগভর্তি করে এসব ঝিনুক, বালু আর পাথর বয়ে নিয়ে আসি অবশ্যই সেটা বাচ্চাদের বাবা জানেনা। কিন্তু সেবার পাহাড়ী পাথরের ভারে আমাদের তিনজনের ব্যাকপ্যাক অনেকটাই ওভারওয়েট হয়ে গেল। বিরাট জরিমানা হবার উপক্রম হলে এয়ারপোর্টে বাচ্চাদের বাবা চিন্তায় পড়ে গেল। সেবার আমরা তিনজন ধরা পড়ে গেলাম। জরিমানা এড়ানোর জন্য বাধ্য হয়ে বালু, পাথরগুলো এয়ারপোর্টেই ফেলে আসতে হল। খালি হাতে বাড়ী ফিরছি বলে আমাদের খুব মন খারাপ। তারপর বাসায় ফিরে দেখি আমার পাঁচ বছর বয়েসী ছেলে তার সবগুলো পাথর ফেলে না দিয়ে পকেটে ভরে চুপি চুপি কিছু ট্রান্সলুসেন্ট কমলা আর সবুজ পাথর নিয়ে এসেছে। সেটা ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় স্মাগলিং চালান।
আরেকবার এক সমুদ্র সৈকত থেকে বোতলে ভরে ভেজা বালু আনতে যেয়ে সে কি কান্ড! কাস্টমস অফিসারদের ফাঁকি দেয়া আমাদের মতলব ছিলনা, আমরা শুধু বাচ্চাদের বাবার কাছে গোপন রেখেই সমুদ্রের পানি আর বালু পাচার করা কথা ভাবছিলাম। তবে আমাদের হুঁশে ছিলনা যে প্লেনে হ্যান্ডব্যাগ বা ক্যারিঅন লাগেজে নির্দিষ্ট পরিমানের বেশী তরল পদার্থ নেয়া নিষেধ। বোতলভর্তি সমুদ্রের পানি তো নয়ই। সেবার আমাদের ব্যাগ তল্লাশি হল, কাস্টমস অফিসাররা আমাদের সেই ঘন-ঘোলা রহস্যময় পানীয়র দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে রইলো। তারপর একবার আমার দিকে আরেকবার বাচ্চাদের দিকে। আমার ছেলে কিছুটা বিব্রত কারন বোতলে পানিসহ বালু নেয়ার আইডিয়াটা তারই ছিল। তবে মেয়ে ভাবলেশহীন। আমি লজ্জায় লাল। আর ওদের বাবা রেগে নীল। বলা বাহুল্য সেবার বালুর বোতল ফেলে আসতে হল। কিন্তু সেবারও বাসায় ফিরে দেখি মেয়ে তার পুতুলের মেকাপ বক্সে ভরে এক মুঠি বালু ঠিক নিয়ে এসেছে!
এভাবে বছর বছর আমাদের বালুর জারে রংধনুর পর রংধনু তৈরী হল। আর রংধনুর প্রতিটি রঙে জমা হল বাচ্চাদের বিভিন্ন বয়েসের অনেক মাইলফলক পার হবার স্মৃতি। অনেকগুলো ‘প্রথম’ আর অনেকগুলো ‘শেষ’ স্মৃতি।
প্রথম পুরো একটা লাইন বলতে শেখা, প্রথম দিন স্কুলের বাসে চড়ে স্কুলে যাওয়া, প্রথম স্টেজে দাড়িয়ে গান গাওয়া, প্রথম দাঁত পড়া, প্রথম একা একা পুরো একটা বই পড়া, প্রথম মাকে ছেড়ে স্কুলের বন্ধুদের সাথে শহরের বাইরে যেয়ে ক্যাম্পে রাত কাটানো।
তারপর হঠাৎই কখন কৈশোর পেরিয়ে প্রথম যৌবনে পা দেয়া।
মনে করার চেষ্টা করি শেষ কবে আমি তাদের কোলে নিয়ে গল্প পড়ে শুনিয়েছি, শেষ কবে কাজ থেকে টেনে নিয়ে তারা আমার সাথে খেলা করতে চেয়েছে, শেষ কবে তাদের কোলে নিয়ে হেটে হেটে গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়েছি, শেষ কবে আমার গলা জড়িয়ে বায়না করেছে ‘মা, আর একটা গল্প বল, প্লিজ!’, শেষ কবে খেলতে যেয়ে হাঁটুতে ব্যাথা পেয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছে, চুমু দিয়ে ব্যাথা সারিয়ে দেয়ার জন্য, ‘make-it-better kiss’? শেষ কবে ওদের জুতো পড়িয়ে দিয়েছি, চুলে পনিটেল বেধে দিয়েছি? শেষ কবে নিজের ঘরে ভয় পেয়ে মাঝ রাতে বালিশ নিয়ে আমাদের বিছানায় ঘুমাতে এসেছে?
তারপর, প্রথম যেদিন গাড়ীর স্টিয়ারিং এ বসে একা একা গাড়ী চালিয়ে বের হয়ে গেল, মনে হল যেন আমার প্রানও উড়ে গেল। তারা উড়তে শিখেছে! তারপর একদিন ঘর ছেড়ে চলে গেল যার যার ইনুভার্সিটিতে। আমরা দু’জন একা শূন্য নীড়ে আবার সেই আগের মত। শুধু প্রতিক্ষায় থাকা কখন লেখাপড়ার ব্যাস্ততার ফাকে ছুটিতে বাচ্চারা বাসায় বেড়াতে আসবে একদিন কিংবা এক সপ্তার জন্য। তাদের পড়াশুনার ব্যাস্ততার মাঝে তাদের সাথে সময় মিলিয়ে চারজন একসাথে বেড়াতে যাওয়া কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ে। তারপর একসময় আমরা দু’জন আবার নিজেরা বেড়ানো শুরু করি।
সেদিন বেড়াতে গিয়েছিলাম দূরের এক শহরে, সমুদ্রের কাছে। সৈকতে হেটে বেড়িয়েছি সারাদিন, কম্বল বিছিয়ে সূর্যের আলোতে শুয়ে গল্প করেছি দু’জনে। সূর্য অস্ত গিয়েছে, তবু হোটেলে ফেরার তাড়া নেই। উষ্ণ নোনা বাতাসে কেমন আলস্য ধরে যায়। চাঁদের আলোয় আবার হেটেছি বালুতে পা ভিজিয়ে। ঢেউয়ের সাথে ঝিনুক এসে পায়ের কাছে আছড়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে আনমনে দুই একটা ঝিনুক কুড়িয়ে নিয়েছি। আমার ছোট্ট ‘পার্টনার অফ ক্রাইম’ দের মনে পড়লো। তবে ঝিনুক কুড়ালেও বালু তুলিনি। বাচ্চাদের ছোটবেলায় ওদের অযুহাতে অনেক ছেলেমানুষি করে পার পাওয়া গেছে, এখন একা একা এসব করতে যেয়ে ধরা পড়লে কেলেংকারি হবে ভেবে নিজেকে সংযত করে রাখি।
কয়েক দিন সমুদ্রে বেড়ানোর পর বাড়ী ফিরে আসি। ফ্লাইট পৌছতে মধ্যরাত। বাড়ী ফিরে এসে সমুদ্র থেকে আনা নতুন ঝিনুকগুলো আমাদের কাচের জারটাতে সাজিয়ে রাখি। খেয়াল করিনি কখন বাচ্চাদের বাবা আমার পেছনে এসে দাড়িয়েছে। আমি তার দিকে ঘুরে তাকাতে বলল ‘চোখ বন্ধ কর’। তাকে অত বিশ্বাষ নেই, তাছাড়া আমার শরীরে অন্যের কথা অক্ষরে পালন করার মত কোন একটা হাড়ও নেই বলে জানি, তাই তার কথা মত চোখ বুজলেও চোখের কোনা দিয়ে চুপি চুপি দেখার চেষ্টা করছি তার মতলব কি। সে বলল ‘হাত পাতো’, এবার হাত বাড়িয়ে দিলাম। সে আমার হাতে তিনবার আলতো করে চাপ দিল। আমার হার্ট বিট বেড়ে গেল, এতো আমাদের তিনজনের সিক্রেট, সে কি করে জানলো? তারপর নিজের হাতের মধ্যে বালু অনুভব করে পুরো চোখ মেলে তাকালাম। সে আমার হাতে একমুঠি বালু দিয়ে বলল, ‘এগুলো তোমাদের বালুর জারের জন্য এনেছি। এগুলো রং ক’রোনা, সাদাই থাকুক।’
মন্তব্য
অসাধারন, চমৎকার স্মৃতিময়তা। খুব ভালো লাগল। বাচ্চাদের জন্য শুভকামনা।
জে এফ নুশান
অসাধারণ! ৫-এ ৫ তারা!
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
মুক্ত সুন্দর
আসাধারন ! চমৎকার !
অস্থির এই পৃথিবীতে ভীষণ শান্তির এক গল্প।
এত সুন্দর করে কিভাবে লেখেন জানিনা কিন্তু আমার বাড়ন্ত বাচ্চাদের কথা আর সামনের আসন্ন দিনগুলোতে ওদের ডানা মেলে উড়ে যাবার কথা ভেবে চোখের কোনায় কখন যেন বাস্প জমে উঠলো।
ওদের কানে ফিসফিস করে, বুকের ভিতর চিৎকার করে কতোবার যে বলি চাইনা তোরা বড় হ, থেমে থাক ২ বা ৩ বা ৫ বছরের স্বপ্নিল মায়াময় বয়সগুলোতে, তারপরও প্রতিদিন চোখের পলকে কিভাবে যেন বড় হয়ে যায় ওরা। আফশোষ করি আর চেয়ে দেখি আর ভাবি কি আশ্চর্য মিল ওদের মুঠো করে ধরতে চাওয়া মিহিদানা বালির সাথে! প্রানপনে ধরে রাখতে চাই মুঠোর ভিতর, কিন্তু ঠিকই আংগুলের ফাক গলে ঝিরঝির করে বের হয়ে যায়!! একদিন আমরা বসে থাকি শূণ্য মুঠির ভিতর অন্তহীন ভালবাসা নিয়ে, অপেক্ষায়।
জারের ভিতর রঙিন বালু, পাথর আর ঝিনুক জমানোর আইডিয়া চমৎকার লেগেছে। কত সৈকত ঘুরে ফেললাম, আগে জানলে আমরাও শুরু করে দিতাম!
ভাল থাকুন, আরো লিখুন প্রত্যাশায়।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
দারুন লিখেছেন
দারুন
নতুন মন্তব্য করুন