সিক্রেট লাইফ অফ ওয়াল্টার মিটি মুভি দেখার পর থেকে আর ইনস্টাগ্রামে ছবি দেখে দেখে আর আইসল্যান্ড ভ্রমণ বালতিতে জেঁকে বসে আছে। আবার আমেরিকাপ্রবাসী বন্ধু বলে রাখসে অনেকদিন থেকে নেক্সট যেখানেই যাই ওকে যেন বলি, যেভাবেই হোক এসে পরবে। যথাযথ মোটিভেশনের যেন অভাব ছিল; সহকর্মী তার তিন মাস পরের আইসল্যান্ড বুকিং আর কি কি করবে সে নিয়ে কথা বলায় মনে হচ্ছিল, দ্যটস ইট! যাবোগা এবার আমিও। খুব বেশি প্ল্যান করে কোনোসময়েই তেমন কিছু করতে পারিনি; ভরসা তাই এবারো একটু সময় ম্যানেজ করা, অনেক ইচ্ছে আর কিছু বল ব্যাটে আসার ওপর।
অনেক প্ল্যানিং (বন্ধু করছিলো অবশ্যই) এর পর একদিন আশাতীত রৌদ্রজ্জ্বল দিনে আমি আর আমার ভাই চড়ে বসলাম আইসল্যান্ডিক ওয়াও এয়ারে। নরডিক দেশের কোনো একটায় এবারই প্রথম যাত্রা; বলাই বাহুল্য খুবি হাইপড। মানুষ কত কি প্ল্যান করে নতুন কোথাও যাবার আগে, অন্তত কোথায় যাওয়া হবে তার তো লিস্ট থাকে। বন্ধুর আশ্বাস, ফোর হুইল ড্রাইভ গাড়ি আর ক্রেডিট কার্ডের ভরসা ছাড়া আমাদের কিচ্ছুটি নেই পরিকল্পনায়।
সবদিক বিবেচনায় এবারের ট্রিপ টা অন্যরকম। এর আগে যতবার কোথাও গেছি, সাধারণত রাজধানী বা সবচে জনপ্রিয় শহরগুলোতে যাওয়া হতো। কিন্তু এবার সেরকম কোনো সুযোগ ছিল না। সল্প সময়ের যতটা সম্ভব প্রকৃতির কাছে কাটানো যায় আরকি।
উত্তর আটলান্টিকের দেশ আইসল্যান্ড; ইউরোপের সবচে জনবিরল দেশ। সত্যি কিনা পুরোপুরি জানি না ঠিক কিন্তু একটা মজার গল্প শুনেছিলাম দেশটির নামকরন নিয়ে। সেটেলারদের এখানে আসায় নিরুৎসাহিত করতে ভাইকিংরা ওমন নাম দিয়েছিল এবং আরো উত্তরের বরফের রাজ্যের নাম দিয়েছিল গ্রিনল্যান্ড। অনেক কিছুর জন্যেই এই দেশটি অনন্য। দুনিয়ার সবচে বড় সক্রিয় আগ্নেয়গিরি, ইউরোপের সবচে বড় কয়েকটা গ্লেসিয়ার, গেইসার আর ঝর্ণা; অনেক অনেক ঝর্ণা।
বিমানবন্দর থেকে বাসায় পৌঁছে পরদিনের অভিযানের পরিকল্পনা করতে গিয়ে দেখা গেলো যে, আমরা যেথায় যেথায় যেতে চাই, তার সবই এদেশের ন্যাশনাল রোড (রিং রোড নামেই বেশি পরিচিত) এর পাশে। শুধু একটাই সমস্যা; আমাদের হাতে আছে মাত্র দুইদিন! অক্টোবরের সবে শুরু কিন্তু ঠাণ্ডা আর বৃষ্টির কোন বিশ্বাস নেই এখানে। সময় সল্পতা, যাতায়াতের সুবিধা আর আবহাওয়া সবকিছু বিবেচনায় রিং রোডের পাশে থাকাই যৌক্তিক মনে হচ্ছিল। আনন্দের আতিশয্যে জোরে কথা বলে পাশের রুমের লজারের বিরাগভাজন হয়ে, ফোনগুলো চার্জে দিয়ে আর জানালার বাইরের ঝোড়ো বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুম এসে পরেছিল।
সকাল পাঁচটায় উঠে, ৩০০ কিলোমিটার দূরের গ্লেসিয়ার ল্যাগুন Jökulsárlón এ গিয়ে বাসায় ফেরার পথে যা যা পরবে সব দেখে আসার সংকল্প নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আমরা ছিলাম সেলফসে; দক্ষিণ আইসল্যান্ডের ছোট্ট টাউন। ঐ সময়ের নির্জনতায় রিং রোডে উঠতে সময় বেশি লাগেনি। গাড়ি রেন্টাল থেকে বলে দেয়া ছিল গাড়ির দরজা খোলার সময় যাতে অবশ্যই ধরে খোলা হয়। কারণ বোঝা গেল হাতেনাতেই; প্রচন্ড বাতাস, সেই সাতসকালেই। সেদিনের জন্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস ছিল রোদের; দিনের বেশির ভাগ সময়ে তাই থাকলেও বিকেলের মিঠে রোদের বদলে ছিল হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা।
পরদিন সকাল থেকে বৃষ্টি। যেনতেন না; একেবারে মুষলধারে আর সাথে বাতাস আর বিখ্যাত আইসল্যান্ডিক চিল! আগেরদিন যে পথে ছিলাম আজ তার ঠিক বিপরীত দিকে। গন্তব্য সিংহাসনের খেলার অ্যারোহেড মাউন্টেন (আসল নাম Kirkjufell)। গন্তব্যের চেয়ে যাত্রাপথ যেন বেশি সুন্দর! যাবার পথে আইসল্যান্ডিক হাইল্যান্ড হয়ে গেছিলাম; সে এক অতুলনীয় অভিজ্ঞতা। সারাদিন বৃষ্টি ছিল নিত্যসঙ্গী। বৃষ্টি আমার বরাবরই ভালো লাগে। কিন্তু এখানের বৃষ্টি অন্যরকম; দেখিনি ওভাবে যেন আগে। কেমন যেন র পাওয়ার অফ ন্যাচার! বৃষ্টি, রংধনু, সবুজের সমারোহ, শৈবাল আচ্ছাদিত ভলকানিক পাথর, ঝর্না, অনন্যসুন্দর সমুদ্র সৈকত, হিমবাহ, গেইসার (এবার দেখার সুযোগ হয়নি যদিও), সক্রিয়/ নিষ্ক্রিয় আগ্নেয়গিরি। আইসল্যান্ড প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক পরিপূর্ণ প্যাকেজ।
এমন না যে আমি কোন ভ্রমনবিশারদ বা অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তবে আইসল্যান্ড যে কোনো বিচারে আমার দেখা সেরা; অসাধারণ সবকিছুতে। অনেক অনেক কিছু ইচ্ছে ছিল দেখার, অভিজ্ঞতা নেয়ার (জিওথার্মাল পুল, আইসকেভ, অরোরা)। সময় স্বল্পতার জন্যে তার সামান্যই করার সুযোগ ছিল এবার। কিন্তু অনুশোচনার খাতা পুরপুরি খালি। বারবার ফিরে আসবো এই অসাধারণ দেশটিতে।
গেছিলাম ১০ মাস হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেই সময়ের ছবি আর ক্লিপগুলো এখনো মনে করিয়ে দেয় কি অসাধারণ কয়েকটা দিন কাটিয়েছিলাম এই বরফ, আগুনের দেশে! প্রথমে ইচ্ছে ছিল শুধু একটা ছবিব্লগের, তাও কত কথা বলা হলো! ছবিগুলোই না হয় বাকি কথা বলুক।
বিদ্রঃ আইসল্যান্ডিক নাম উচ্চারণ করা অসম্ভবের কাছাকাছি; তাই সে ধৃষ্টতা দেখালাম না।
ল্যান্ডিং এর একটু আগে জানালার ওপাশের আগুনরঙা মেঘের সারি
মস আচ্ছাদিত আগ্নেয় পাথর (Eldhraun Lava Field)
মন্তব্য
ছবিগুলো দারুন! লেখা আরেকটু বড় হতে পারতো, ছবিগুলোর স্থানের বর্ণনা ইত্যাদি দিলে ভালো হতো। আর আপনার নামটা শেষে লিখে দিন। অতিথি লেখকদের ত আলাদাভাবে চেনার উপায় নেই। আরো লিখুন।
___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা
ধন্যবাদ
The secret life of Walter Mitty দেখার পর আমারও আইসল্যান্ড যাবার শখ মাথাচাড়া দিয়েছিল। আরও মনে পড়ে, ছোটকালে কোন একটা তিন গোয়েন্দা পড়ার সময় রিকয়াভিক (Reykjavik) নামটার উচ্চারণ শুনেছিলাম।
ছবিগুলো সুন্দর। সচলে ছবি দেয়ার সময় আকার একটু আধটু নিয়ন্ত্রণ করা যায়, আরেকটু বড় আকারের হলে ভালো লাগতো।
দিন কয়েক আগে এক আইসল্যান্ডের এক ট্যুর অপারেটরের আঁকা কিছু কমিক দেখেছিলাম, যে ট্যুরিস্টরা কতরকম আব বায়না নিয়ে আসে:
দেখতে পারেন, লিংক:
https://www.boredpanda.com/funny-comics-tourists-iceland-thetourbunny/
'ধুসর মেরু'র প্রথম লাইন ছিল; "আইসল্যান্ডে যেতে চাও," জিজ্ঞেস করলেন বিখ্যাত গোয়েন্দা ভিক্টর সাইমন। সেই কোন কৈশোরে 'ধুসর মেরু' পড়ার পর থেকে এই লাইনটা মাথায় রয়ে গেছে। উত্তর ইউরোপে আছি বছর তিনেক, আইসল্যান্ডে যেতে চাওয়াই হচ্ছেনা কেন যে। ভাতের প্লেটে ডিমের কুসুমের মত জমিয়ে রেখেছি সেখানে যাওয়ার স্বপ্ন। লেখাখানা পড়ে মনে হচ্ছে, এবারে কুসুমটা খেয়ে ফেলতে হবে।
জে এফ নুশান
নামটা মনে ছিল না ! "ধূসর মেরু!"
তারপর, ওয়াল্টার মিটি, তারপর আরো আইসল্যান্ড দেখা হয়েছিল নেটফ্লিক্সের "Sense 8" এ।
আমার এক পরিচিতজন আইসল্যান্ডে গিয়ে দেখেন যে, শাহরুখ-কাজলের "দিলওয়ালে" সিনেমার "গেরুয়া" গানের ক্যাসেট বাজিয়ে একজন কালো বালির সৈকতে নাচ করে সেটা ভিডিও করার চেষ্টা করছেন।
ওখানে একটা DC-3 প্লেনের ধ্বংশাবশেষ আছে:
প্লেনের সব যাত্রীরা বেঁচে গিয়েছিল
[ছবির সূত্র:https://guidetoiceland.is/connect-with-locals/jorunnsg/the-abandoned-dc-...]
এখন দেখি ওই বিমানটা যাত্রাপথেই ছিল। অনেক কিছু না দেখে ফেরার লিস্টে এটাও জমা হলো।
আমাদের সামনে পরেছিল এক চাইনিজ দম্পতি। বিয়ের পোষাকে কালো বালির সৈকতে সূর্যাস্তের সময়ে ফটোশুট এ মগ্ন।
অর্ণব
আইসল্যান্ড সত্যিই এক অপরূপ দেশ। প্লেনের এই জায়গাটা মূল বিচ থেকে প্রায় দু কিলোমিটার ভেতরে। কাজেই যেতে আসতে (হেঁটে, কারণ ওখানে গাড়ি যায় না) প্রায় আড়াই ঘণ্টার মত লাগে। কাজেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সময়ের ওভাবে এটা দেখতে পারিনি। যাদের হাতে সময় আর হাঁটার এনার্জি থাকবে, তারা চেষ্টা করে দেখতে পারেন
গুডরিডস
ঘুরেই আসুন এবার। সময় নিয়ে গেলে ভালো হয়। বৈরী আবহওয়ার জন্যে প্রস্তুত থাকলেই হবে, ওমন হাড়কাঁপানো ঠান্ডা অনুভব করিনাই আগে।
অর্ণব
ধন্যবাদ
এতো নয়নাভিরাম একটা দেশ! ছবি/ভিউকার্ড/ সিনেমা, বাস্তবতা সবগুলোকে হার মানায়।
ছবিগুলো আরেকটু বড় করার চেষ্টা করেছিলাম। ফ্লিকারের লিংক এর জন্যে নাকি অন্য কোনো কারণে পারিনি।
উচ্চারণ টা ওরা করে বোধহয় রেইকাভিক; পাইলটের উচ্চারণে ওরকম শুনছিলাম। তাও এটা সহজ; অন্যগুলো তো একেবারে সোয়াসেরি।
আর আপনার দেয়া ওই লিংকটা দেখলাম, হাসতে হাসতে শেষ । কত আকাশকুসুম আবদার যে করে মানুষ!
অসাধারন সব দৃশ্যাবলী!
ধন্যবাদ
নিসর্গের ছবিগুলো সুন্দর। সচলায়তনে আরো লিখুন, অর্ণব।
বাঃ! লেখায়-ছবিতে ভাল লেগেছে। "ছোট্ট একটা ভিডিও"-টা লম্বালম্বি হয়ে আসছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
অনেক ধন্য়বাদ ঃ)
ফ্লিকারে দেয়ার পরে আর খেয়াল করিনি ভিডিওটা।
অসাধারণ কিছু ছবি দেখলাম
নতুন মন্তব্য করুন