মূল নিবন্ধঃ https://elifesciences.org/articles/41926
অনুবাদঃ ড. মোহাম্মদ আসিফ খান, স্বাস্থ্য গবেষক।
এই লেখাটি আমাদের দেশের গবেষণা করতে গিয়ে কতটুকু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় তার কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছেন ঢাকা শিশু হাসপাতালে দীর্ঘদিন কাজ করা একটি গবেষকদল। এই লেখার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে সচলায়তনে একটি সাক্ষাৎকারের আয়োজন করা হয় অন্যতম গবেষক ড. সেঁজুতি সাহার। যার ফলশ্রুতিতে গবেষণায় মাতৃভাষার ভূমিকা কী সেটা নিয়ে আরেকটা প্রব্ন্ধ প্রকাশ করেন একই গবেষকদল যা সম্পূর্ণ বাংলায় বিখ্যাত ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় সম্পূরক অংশ হিসেবে। দেশের বিজ্ঞান গবেষণা সংস্কৃতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ এই কাজগুলিকে বাংলায় অনুবাদের প্রয়োজন বিধায় এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মূল প্রবন্ধের চমৎকার অনুবাদ করেছেন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য গবেষক ড. মোহাম্মদ আসিফ খান। তাকে ধন্যবাদ। এই লেখাটির সম্পূরক আরেকটি লেখা সচলে প্রকাশিত হচ্ছে আমার ব্লগ থেকে। সেটা পড়ারও আমন্ত্রণ রইলো।
(ভূমিকা লিখেছেন সচল সজীব ওসমান)
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে- যেখানে বিশ্বব্যাপী রোগের বোঝা সবচেয়ে বেশী, সেখানকার গবেষণাগারগুলি গবেষণা এবং জনস্বাস্থ্য নজরদারি পরিচালনার ক্ষেত্রে পদ্ধতগিত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এই দেশগুলিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বাধা প্রদানকারী ব্যবস্থাসমূহ যেমন- পে-ওয়াল, শুল্ক বিধিমালা এবং স্থানীয় গবেষণা সরঞ্জাম সরবরাহকারীর অপ্রতুলতা ইত্যাদি কাটিয়ে উঠতে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দু'টি দল অসুস্থ বাচ্চাদের হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেয়া সম্পর্কিত নীতিমালা মূল্যায়ন ও উন্নতি সাধন করতে বাংলাদেশের ঢাকা শিশু হাসপাতালে এসেছিল। গবেষণা নীতিমালা অনুযায়ী “হেমোকিউ” নামক সহজে ব্যবহারযোগ্য একটি যন্ত্র দিয়ে শিশুদের রক্তের নমুনায় হিমোগ্লোবিনের ঘণত্ব পরিমাপ করা্র কথা ছিল। গবেষকদল বাংলাদেশে পৌঁছাবার আগেই “হেমোকিউ” আমদানীর জন্য আদেশ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু এটি শুল্ক ছাড়ের অপেক্ষায় আটকা পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত যন্ত্রটি আমাদের পরীক্ষাগারে পৌঁছাতে এবং গবেষণা প্রকল্পটি শুরু করতে তিনমাস দেরী হয়েছিল।
"হেমোকিউ” আসার মুহূর্তটি উদযাপন করার জন্য আমরা একটি ছবি তুলেছিলাম (চিত্র- ১) এবং ছবিটি এখনও আমাদের পরীক্ষাগারের ফ্রিজে ঝুলছে। আলোকিত মুখগুলি প্রতিফলিত করে কীভাবে একটি সাধারণ মেশিন তিন মাস যাবৎ কর্মীদের কর্মঘন্টা ব্যয় করে আমাদের কাছে অমূল্য এবং অসাধারণ ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছিল!
ঢাকা শিশু হাসপাতালের (ডিএসএইচ) সমীর সাহা (বাম) এবং যুক্তরাষ্ট্রে রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের জুলি শিলিংগার ডিএসএইচ অণুজীববিজ্ঞান পরীক্ষাগারে হেমোকিউ হাতে। শুল্ক বিভাগের মাধ্যমে “হেমোকিউ” পেতে সংঘটিত সমস্যাগুলি্র জন্য জনস্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি শুরু করতে তিন মাস দেরী হয়েছিল; এই ধরনের বিলম্ব সেসব চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে একটি যা বাংলাদেশের গবেষকদের কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে।
(ছবিঃ মাকসুদা আলম, শিশু স্বাস্থ্য গবেষণা ফাউন্ডেশন।)
গবেষণা পরীক্ষাগারগুলি জনস্বাস্থ্য নজরদারি ব্যবস্থার মেরুদণ্ড গঠন করে। গত দুই দশকে ওয়েলকাম ট্রাস্ট, বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন (বিএমজিএফ) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লুএইচও) এর মতো গ্রুপের সহায়তায় নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে (এলএমআইসি) গবেষণা তহবিলের পরিমাণ প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে গবেষণাকর্ম পরিচালনা এবং পরীক্ষাগারে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত এবং দৈনন্দিন প্রতিবন্ধকতা্সমূহ আনুপাতিক হারে কমেনি। ডব্লিউএইচও-র মতে, নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে স্বাস্থ্য প্রযুক্তির ঘাটতি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের দিকে ধীর অগ্রগতির জন্য আংশিকভাবে দায়ী, যার লক্ষ্য ছিল রোগব্যাধি ও মৃত্যুহার হ্রাস করা (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০১৪)। আমরা বিশ্বাস করি এটি গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি এমনকি গবেষণাগারে ব্যবহৃত অতি সাধারণ যন্ত্রপাতি সংরহের ক্ষেত্রে বিরাজমান বাধাগুলির সাথে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ।
বাংলাদেশে আমরা প্রায় প্রতিটি গবেষণা প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনেকগুলি বাধার সম্মুখীন হয়েছি যা উচ্চ-আয়ের দেশগুলিতে প্রায় অস্তিত্বহীন। এই বছরের শুরুর দিকে, আমাদের দলের তিন সদস্য কীভাবে থাইর মার্টিন লালন-মাধ্যম (কালচার মিডিয়া) এবং মেনিনজাইটিস সংঘটনকারী ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পরিপূরক সংগ্রহ করতে পারেন সে সম্পর্কে কৌশল প্রনয়নের জন্য বেশ কয়েক সপ্তাহ ব্যয় করেছিলেন, কারণ স্থানীয় বিক্রেতারা তাদের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন বিক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ করা এবং আসন্ন ডেলিভারির অবাস্তব প্রতিশ্রুতির মুখোমুখি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বিদেশে আমাদের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমরা আশা করছিলাম যে বাংলাদেশ ভ্রমণকারী কোনও সহকর্মী হয়তো লালন-মাধ্যমের কিছু নমুনা আনতে পারেন; যাতে করে যে সময়টা আমরা স্থানীয় উৎস থেকে সরবরাহের সিংহভাগ প্রাপ্তির অপেক্ষায় থাকব, সেসময়ে আমরা অন্তত পরীক্ষাগুলি শুরু করতে পারি। এটি একটি টেকসই সমাধান নয়, তবে আমাদের জরুরীভাবে লালন-মাধ্যমগুলো প্রয়োজন ছিল – কেননা আমরা ইতোমধ্যে বাচ্চাদের কাছ থেকে ১,৬০০ নমুনা সংগ্রহ করেছি কিন্তু সেগুলি প্রক্রিয়াজাত করতে সক্ষম হইনি। দীর্ঘমেয়াদী স্থানীয় সরবরাহ পেতে এবং নমুনাগুলি প্রক্রিয়াজাত করতে আমাদের পাঁচ মাসের বেশি সময় লেগেছিল।
পলিমারেজ চেইন রিয়েকশান (পিসিআর) এর জন্য প্রাইমার প্রাপ্তির মতো রুটিন কাজগুলিও বেশ জটিল হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে যে কারও জন্য প্রাইমারের জন্য চাহিদা দেওয়া সাধারণত একটি সহজ এবং অল্প সময়ের কাজ, সাধারণত প্রাইমার হাতে পেতে তিন দিনের বেশি সময় লাগেনা। এখানে অবশ্য পিসিআর চালানো মানে বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে চিন্তা করা; প্রাইমারগুলি পাওয়ার জন্য ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোন স্থানীয় নির্মাতা নেই এবং শুল্কবাধা পার হয়ে পরীক্ষাগারে পৌঁছাবার প্রক্রিয়াটি এখনও বেশ কঠিন। এই বাধাগুলির কারণে সাধারণত একটি গবেষণার ধারণা তৈরী করা এবং পরীক্ষাগুলি সম্পাদনের মধ্যে সাধারণত দীর্ঘ সময়, প্রায়শঃ কয়েক মাসের ব্যবধান তৈরী করে। এই বিলম্ব শেষ পর্যন্ত গবেষণার উদ্যমকে ভোঁতা করে দেয় এবং অনেকক্ষেত্রে গবেষণার বিষয়বস্তুকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা সম্প্রতি সালমোনেলা টাইফিতে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী জিনগুলির রূপান্তর সনাক্ত করতে অভিনব প্রাইমার নকশা করেছি। প্রাইমারগুলো হাতে পেয়ে আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষাসমূহ শেষ করবার আগেই আরেকটি গবেষকদল এ বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছিল। একটি বিজ্ঞাননির্ভর পৃথিবীতে গবেষণা কর্মের প্রতিলিপি নিঃসন্দেহে অবমূল্যায়িত হয় যা আমাদের দলের জন্য সম্পদ ও মানসিক শ্রমের অর্থে একটি বড়ধরনের ক্ষতির কারণ হয়েছিল। এই জাতীয় ঘটনাগুলি বেশিরভাগ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলির গবেষণা ব্যবস্থায় হরহামেশাই ঘটছে, তবে এ ব্যাপারে খুব কমই আলোচিত হয় বা এ বিষয়ে খুব অল্প ক্ষেত্রেই কার্য্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়।
সমসাময়িক গবেষণা-প্রবন্ধ সম্বন্ধে জানাশোনাও অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়ে। গবেষণাপত্র প্রকাশের বর্তমান কাঠামো নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশসমূহের গবেষকদের প্রকাশিত গবেষণা ফলাফল থেকে দূরে রাখে, পক্ষান্তরে তাদের গবেষণাকর্মসমূহ আন্তর্জাতিক গ্রহনযোগ্যতার জন্য এসব ফোরামে প্রকাশ করতে হয়। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশসমূহের প্রতিষ্ঠানগুলি, বিশেষত আমাদের মতো অলাভজনক গবেষণা সংস্থা, তাদের সদস্যদের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় সীমাহীন প্রবেশ নিশ্চিত করতে পারে না, ফলে এসকল গবেষকদের জন্য অনেকগুলি মানসম্পন্ন গবেষণা বিষয়ক প্রকাশনা অধ্যয়ন অসম্ভব হয়ে যায়। আমাদের সাময়িকী সভাগুলির সমাবেশে সদস্যরা প্রায়ই বলতো- পে-ওয়াল সংক্রান্ত বাধা না থাকলে তারা এমন সব গবেষণা বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতো যেগুলো আরো আকর্ষনীয়।
সবচেয়ে বড় কথা হল এসব বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় প্রবেশাধিকার পেতে হলে এগুলোতে নিজস্ব বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকাশ করতে হয়। সম্প্রতি, আমরা সাধারণ পরিবেশে টাইফয়ডাল সালমোনেলা সনাক্ত করার একটি অভিনব সরঞ্জাম মূল্যায়নের জন্য একটি ছোট প্রকল্প শেষ করেছি। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলির জন্য স্বল্প মূল্যের পিসিআর-ভিত্তিক নজরদারি পদ্ধতি তৈরি করা যারা রক্ত-লালন-ভিত্তিক (ব্লাড কালচার বেইস্ড) নজরদারি প্রতিষ্ঠা করতে বা বজায় রাখতে অসমর্থ। এই প্রকল্পের সর্বমোট ব্যয় ছিল ৩,৮৬৪ মার্কিন ডলার (কর্মীদের সম্মানী বাবদ ব্যয় বাদে) এবং এর জন্য আমরা কোনও বাহ্যিক তহবিল পাইনি। আমরা যে বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় পান্ডুলিপিটি জমা দিয়েছিলাম সেখানে প্রকাশের জন্য ব্যয় হয়েছিল ১,৬২৫ ডলার, প্রকাশনাটিকে সবার কাছে উম্মুক্ত করার জন্য অতিরিক্ত ২,৫০০ ডলার প্রয়োজন হয়েছিল। যদিও গবেষণাপত্রে প্রকাশিত ফলাফলগুলি আমাদের মতো দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলির জন্যই অধিক প্রাসংগিক ছিল, যাদের এ বিষয়ক বেশীরভাগ বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় প্রবেশাধিকার ছিলনা, সুতরাং ব্যয়-প্রতিরোধমূলক প্রকাশনাটি উম্মুক্ত করা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিলনা। আর তা না করলে আমাদের গবেষণার সম্ভাব্য উপকারিতা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করতে হতো। বিজ্ঞান গবেষকদের তথ্যগত ভাবে দরিদ্র রাখার বিজ্ঞান চর্চার ঔপনিবেশিক দুষ্ট চক্র টিকিয়ে রাখতে আমাদেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে।
এটি অগ্রহণযোগ্য যে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানের বিকাশ জ্ঞান এবং গবেষণা-সংক্রান্ত সরবরাহ ব্যবস্থায় নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের গবেষকদের সীমিত প্রবেশাধিকারের জন্য এভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাধাগুলি বহুমুখী, তবে অতিক্রম করা অসম্ভব নয়। বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ অধ্যয়নের বাধা দূর করার ক্ষেত্রে বর্তমান প্রচেষ্টার উদাহরণ হল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা উদ্যোগ সংক্রান্ত প্রকাশনাসমূহে হিনারি’র (HINARI Access to Research Initiative) মাধ্যমে প্রবেশাধিকার। যা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলির অলাভজনক সংস্থাগুলির সাথে সম্পর্কিত গবেষকদের বৈজ্ঞানিক জার্নালে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে (রিসার্চ ফর লাইফ,২০১৮)। তবে, হিনারি’তে প্রবেশাধিকার জিএনপি (বার্ষিক জাতীয় উৎপাদন) ভিত্তিক। সুতরাং এটি ভারত, ব্রাজিল এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলিকে এই সুবিধার বাইরে রাখে এবং অন্যান্য অনেক দেশ তাদের অর্থনীতির বিকাশের সাথে সাথে তাদের প্রবেশাধিকারের যোগ্যতা হারাবে (প্লস মেডিসিন এডিটর, ২০০৬)। তবে জিএনপি (বার্ষিক জাতীয় উৎপাদন)-এর সূচক সামান্য বৃদ্ধি দেশের গবেষণা সংস্থাগু্লোকে রাতারাতি সম্পদশালী করে তোলেনা।
এই সমস্যাটি মোকাবেলায় মূলতঃ সার্বজনীন প্রবেশাধিকারের জন্য আমাদের বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা প্রয়োজন। সম্প্রতি, বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এবং প্রতিষ্ঠান উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ধীর গতির কারণে কিছু বড় প্রকাশক সংস্থায় তাদের সদস্যপদ বাতিল করেছে (স্কিএরমেয়ার, ২০১৮; ইয়েগার, ২০১৮)। অনেক নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশকদের সাথে আলোচনার সামর্থ্য রাখ না; তবে, সম্মিলিতভাবে আমরা পরিবর্তনগুলি ত্বরান্বিত করতে এবং বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় প্রবেশাধিকারের ভবিষ্যৎকে বাস্তবে রূপ দিতে পারি। এছাড়াও, সুইডেন এবং জার্মানির মতো দেশগুলি যদি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ গুলির সাথে একত্রিত হয়, তবে এটি একটি শক্তিশালী ঐক্য হিসাবে প্রমাণিত হতে পারে। এ ধরনের সহযোগিতাসমূহ ক্রমবর্ধমান আন্তঃদেশীয় গবেষণা সহায়তার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
সার্বজনীন প্রবেশাধিকারের নিশ্চয়তার জন্য অপেক্ষাকালীন সময়ে, এ বিষয়ে ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির বিকল্প পথও খোলা রয়েছে। গবেষণা তহবিল প্রদানকারী অনেক সংস্থা এখন অনুদানপ্রাপ্ত গবেষণা প্রকল্পসমূহের ফলাফল উম্মুক্ত প্রবেশাধিকারযুক্ত বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশের বাধ্যবাধ্যকতা প্রনয়ন করেছে এবং উম্মুক্ত প্রবেশাধিকার প্রদানের সাথে সম্পর্কিত খরচ তারা সরাসরি পরিশোধ করছে। যাইহোক, এই সত্যটি ভুলে গেলে চলবে না যে দাতাসংস্থাসমূহের সাধারণত সুনির্দিষ্ট অগ্রাধিকার থাকে এবং ভিন্ন ভিন্ন দাতাসংস্থার সুচিন্তিত প্রচেষ্টায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রভাব পড়তে পারে, যেমন গবেষণার নির্দিষ্ট কিছু বিষয়বস্তু এবং সেসব বিষয়ে প্রকাশনা দেখা গেলেও বিপরীত অনুসন্ধানগুলি প্রকাশ নাও পেতে পারে।
পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদির সহজ সরবরাহের ধারণাটি খুব বেশি অপরিচিত নয়। একটি সমাধানে বিএমজিএফ-এর মতো দাতাদের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে যারা চাহিদাপ্রদানকারী সংস্থাকে সময়মতো যন্ত্রপাতি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় সরবরাহকারী বা অন্যান্য সংস্থার সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে পারে। এটি একটি কল্পিত ধারণা নয়, উদাহরণস্বরুপ উল্লেখ করা যেতে পারে- আমরা রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি; হিবার্ড এবং কাজী, ২০১৬; সাহা এট আল, ২০১৮) এর সহযোগিতায় এএনআইএসএ (দক্ষিণ এশিয়ার নবজাতকদের মধ্যে সংক্রমণের কারণ) গবেষণা পরিচালনা করার সময় এটি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। এএনআইএসএ-এর অধীন ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের গ্রামীণ এলাকাসহ সহ পাঁচটি গবেষণা এলাকায় আধুনিকতর রোগের কারণ নির্ধারণী পরীক্ষা করা হয়েছে। এই দেশগুলিতে স্থানীয় সিডিসি অফিসগুলি যারা ঐ দেশগুলোর সরকারের সাথে দৃঢ় সহায়তামূলক সম্পর্ক তৈরি করেছিল যাতে একই সরঞ্জাম এবং গবেষণা সরবরাহ বিলম্ব বা ঝামেলা ছাড়াই সমস্ত পরীক্ষাগারে সরবরাহ করা হয়েছিল। যাইহোক, সাম্প্রতিক বাজেট ঘাটতির কারণে সিডিসি বর্তমানে যে ৪৯ টি দেশে তার কার্য্যক্রম চালাচ্ছে তার মধ্যে ৩৯ টিতে তার কার্য্যক্রম বন্ধ করে দিতে পারে (ম্যাককে, ২০১৮)।
বৈশ্বিক স্বাস্থ্যে সিডিসি’র ভবিষ্যত পরকল্পনা যাই হোক না কেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হলো সেই সংস্থা যে সংস্থা এখন পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রাখতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। সিডিসির মতো, আমাদের অভিজ্ঞতাও প্রমাণ করে যে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৫৮ টি দেশে আক্রমণাত্মক ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাকসিন প্রিভেন্টেবল ডিজিজ (আইবি-ভিপিডি) নজরদারি সংক্রান্ত গবেষণা পরিচালনা করছে, যেখানে তারা ইতোমধ্যে স্থানীয় অফিস স্থাপন করেছে যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাহায্য প্রাপ্ত পরীক্ষাগারগুলিতে প্রয়োজনীয় সরবরাহ পৌঁছে দিতে সাহায্য করতে পারে (হাসান এট আল, ২০১৮); যাই হোক, বর্তমান প্রক্রিয়া প্রায়শই খুব ধীর গতিতে চলে এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ভারাক্রান্ত। দাতব্য সংস্থাগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা এবং পারস্পরিক সহায়তামূলক সম্পর্কগুলি ব্যবহার করে গবেষণাগারগুলিকে তাদের নিজস্ব প্রকল্পের জন্য সরবরাহ প্রাপ্তিতে সাহায্য করতে পারে।
আরও টেকসই পদ্ধতি প্রনয়নের উদ্দেশ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জৈবিক গবেষণা সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলির ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত শুল্ক বিধিমালা প্রনয়ন করার জন্য নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশসমূহের সরকারের সাথে যৌথভাবে কাজ করতে পারে। এটির জন্য দাতাসংস্থা, সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র কর্মচারী এবং স্থানীয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ সহ সকল অংশীদারদের মধ্যে বিস্তৃত এবং আন্তরিক অংশীদারিত্ব এবং সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করা প্রয়োজন এবং এভাবে আর্থিক সহায়তার বাইরে গবেষণা অনুদান হিসেবে অন্যান্য সহযোগিতাও প্রয়োজন। এর ফলে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশসমূহ বৈজ্ঞানিক গবেষণার উন্নতি সাধনের পথে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।
অবিলম্বে দীর্ঘস্থায়ী হস্তক্ষেপ ব্যতীত উচ্চ এবং নিম্ন সক্ষমতাযুক্ত গবেষণা সংস্থাসমূহের মধ্যে সামর্থ্যের ব্যবধান আরো বাড়বে, যার ফলে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে গবেষণা কার্য্যক্রম আরো কঠিন হয়ে পড়বে। সুতরাং নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে গবেষণা পরিচালনার ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত বাধাগুলি স্বীকার করে নেয়ার সময় এসেছে। বিশ্বব্যাপী একটি বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় হিসাবে ঐক্যবদ্ধ হবার মধ্য দিয়ে আমরা তথ্যগতভাবে পিছিয়ে পড়া গবেষকদের তথ্যগত দারিদ্র দূর করার ক্ষেত্রে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারি এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংক্রান্ত গবেষণাকে সত্যিকার অর্থে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারি।
লেখাতে ব্যবহৃত সূত্রগুলি মূল নিবন্ধে খুঁজে পাবেন এখানে।
মন্তব্য
দীর্ঘ ও সুচিন্তিত এ প্রবন্ধটিকে বাংলায় অনুবাদের জন্যে ড. খানকে ধন্যবাদ জানাই। পাঠকদের কাছে অনুরোধ, লেখাটি গবেষক বন্ধুদের গোচরে আনুন।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
চমৎকার লেখা। উন্নয়্নশীল দেশগুলোতে গবেষণার অন্তরায়গুলো বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে। গবেষণা শব্দটিই তো নেতি্বা্চক অর্থে ব্যবহার করে আমাদের দেশের লোকেরা
নতুন মন্তব্য করুন