সপ্তাহ কয়েক আগের কথা, একটা কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছি। ভেবেছিলাম সারাদিন লেগে যাবে, কিন্তু দুপুর বেলাতেই কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় হোটেলে ফিরে এলাম। লাঞ্চ করেই এসেছি, তাই হোটেলে ফিরে একটা ঘুম দিলাম। বিকেলে ঘুম ভাঙার পর উশখুশ করতে লাগলাম। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি, কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। অবশ্য উপায় থাকলেও যে কোথাও যেতাম ব্যাপার সেরকম নয়। এ শহরে আমার পরিচিত কেউ নেই যে দেখা করব। এককালের অতি প্রিয় শহরে আজ আর যাওয়ার মত কোন ঠিকানা নেই ব্যাপারটা মন খারাপ করে দেয়ার মত, কিন্তু কি আর করা? ইদানিং তাই চট্টগ্রাম বেশি আসতে চাইনা, পথ চলতে হঠাৎ করেই হারানো প্রেমের মুখোমুখি হয়ে যাবার মত অনুভুতি হয়। মুখে কথা যোগায় না, আবার পুরোপুরি অগ্রাহ্যও করা যায়না। যাকগে সে কথা।
উপায়ান্তর না দেখে টিভি ছেড়ে চ্যানেল ঘোরানো শুরু করলাম। একটা চ্যানেলে দেখি 'ইনসেপশন' সিনেমাটা দেখাচ্ছে। আগে দেখা সিনেমা, তবুও দেখা শুরু করলাম। প্রথম বার দেখেছিলাম সিনেমাটা বের হওয়ার পরপরই কিন্তু তখন তেমন একটা বুঝি নি। সেবার সাবটাইটেল ছিলনা, অফিস থেকে ফিরে রাত দশটায় এই উচ্চাঙ্গ চলচ্চিত্র মাথায় ঢোকার কারন ছিলনা। এবার ঘুমিয়ে মাথা পরিষ্কার থাকায় এবং সর্বোপরি সাবটাইটেল থাকায় আগের বারের চেয়ে বেশি ঠাহর করতে পেরেছি। সিনেমার মূল যে আইডিয়া- স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্নের অনেক স্তর, ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে হঠাত পুরনো একটা স্মৃতি মনে পড়ল।
এটুকু মনে আছে যে তখন আমরা ফেনি থাকি, সুতরাং এটা অন্তত সাতাশ-আটাশ বছর আগের কথা। স্কুল ছুটি হলে তখন আমরা চট্টগ্রাম যেতাম, সেখানে নানা-নানু থাকতেন। আমি নানুর বিরাট ভক্ত ছিলাম সেকারনে সেখানে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। কয়েকটা দিন পড়তে হতনা, সকাল থেকে রাত শুধু খাওয়া, গল্পের বই পড়া আর খেলা। এরকম স্বপ্নের মত কিছু দিন কাটিয়ে ফেনি ফিরতে একদম মন চাইতনা। রেল স্টেশনে যাবার বেবি ট্যাক্সিটা যখন বাসার সামনে এসে দাঁড়াত, সেটাকে মনে হত জল্লাদ, আর নিজেকে ফাঁসীর আসামি। বেশির ভাগ সময় পুরো পথ কাঁদতে কাঁদতে ফিরতাম।
সেরকমই কোন একবার কাঁদতে কাঁদতে গাল ভিজিয়ে ফেলেছি, পৃথিবী কেন এত নিষ্ঠুর সেটা ভেবে কূল পাচ্ছিনা, ঠিক তখনি ঘুম ভেংগে গেল। দেখি নানুর খাটে শুয়ে আছি, বুঝলাম এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলাম। মনটা নেচে উঠতে না উঠতেই আবার নেতিয়ে গেল। এখন হয়ত যাচ্ছিনা, কিন্তু কাল সকালেই যে যেতে হবে সেটা মনে পড়ল। খানিক আগে দেখা স্বপ্ন অথবা দু:স্বপ্নটা আবারো সত্যি হবে, কয়েক ঘন্টার অপেক্ষা শুধু। এই ভেবে প্রচন্ড মুষড়ে পড়তে না পড়তেই আবার ঘুম ভেংগে গেল। দেখলাম আমি শুয়ে আছি ফেনির মহিপালে, আমাদের টিভি দেখার রুমের খাটে, তার মানে আমি আসলে স্বপ্নের ভেতরে স্বপ্ন দেখছিলাম। টিভি দেখতে দেখতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। চট করে মনে পড়ল আমরা আসলে আগামীকাল চট্টগ্রাম যাব, ফেরার দু:স্বপ্ন নিয়ে পরে মাথা ঘামালেও চলবে, আপাতত আগামী কিছুদিনের আনন্দটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ! মনটা প্রথমে খুশি হয়ে গেলেও আবার ভয় জেঁকে বসল, এটাও আবার স্বপ্ন দেখছি না তো?
এতদিন পর এসে আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে আসলেই এমন ঘটেছিল নাকি পুরোটাই আমার কল্পনা। খারাপ সময়ে মানুষ প্রায়ই ভাবতে চায় যে সেই সময়টা আসলে সত্যি নয়, বরং একটা দু:স্বপ্ন। আমার সমস্যা হচ্ছে আমি এরকম প্রায় সময়ই ভাবি। কফি শপে বসে আরাম করে ঠান্ডা কোন পানীয়তে চুমুক দেয়ার সময় মনে হয় এটা আসলে স্বপ্ন। আমি আসলে এই আমি নই, কে জানে হয়তো কোন রিকশাওয়ালা বা দিনমজুর। সারা জীবন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কফিশপে সুসজ্জিত মানুষদের কফি খাওয়া দেখে দেখে রাতে ছেঁড়া তোষকে শুয়ে এই স্বপ্ন দেখছি। ঘুম ভেঙে দেখব কোন টিনশেড বস্তিতে শুয়ে আছি, গরমে গা ঘেমে নেয়ে গেছে!
কিংবা আমি হয়তো আমিই, শুধু ভবিষ্যতের আমি। এই যেমন এখনো স্বপ্নে দেখি সামনে এইচ এস সি পরীক্ষা, আমি ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের বই কিনেছি মাত্র। একটা ক্লাস ও করিনি কলেজে, কি পড়ব মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিনা। দরদর করে ঘামতে ঘামতে এক সময় ঘুম ভাঙে, বুঝতে পারি আঠারো বছর পার হয়ে গেছে, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র নিয়ে আর মাথা না ঘামালেও চলবে। সেকারনেই যখন আমার সাত বছরের ছেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে, মনে হয় এটা কি স্বপ্ন? ভেঙে গেলে দেখব ত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে? বেঁচে থাকলে আমার বয়স তখন সাতষট্টি আর ওর সাঁইত্রিশ। ঠিক এখন আমার বাবা আর আমার যে বয়স। চাইলেও সে আর তখন বাবার বুকে জেলির মত লেপ্টে শুয়ে থাকতে পারবেনা।
আমি যেমন এখন আর পারি না!
গগন শিরীষ
মন্তব্য
তাও ভালো আপনি স্বপ্নে শুধু ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র দেখেন। আমি ইংরেজি, কেমিস্ট্রি আর ক্যাল্কুলাস দেখি।
- জে এফ নুশান
হুম, ঘুরে ফিরে একদম একই স্ক্রিপ্ট। কেন যা এমন হয় বুঝি না। পড়ার জন্য ধন্যবাদ, নুশান!
তাওতো ভালো পরীক্ষার স্বপ্ন। আমিতো প্রায়ই দেখি খুনটুন করে ফেঁসে গেছি, পালাচ্ছি, নেহাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে যেতে আস্বস্ত হই যাক ব্যাপারটা স্বপ্ন ছিলো।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
তাড়া খাওয়ার স্বপ্নও দেখি মাঝে মাঝে, তখন আসলে আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচি! পড়ার জন্য ধন্যবাদ!
নতুন মন্তব্য করুন