(দু বছর আগে সচলে কয়েকটা কিস্তি দেয়ার পর গল্পটা নিয়ে আর বসা হয়নি। আজ শেষ করে মনে হচ্ছে ঘাড় থেকে একটা বোঝা নামলো )
এক।।
এরা মাঝে মাঝেই জানতে চায়, আমি কোথা থেকে এলাম। আমি বলি, একটা ভালব টেনে। আর সে ভালবটা ছিলো সুতোয় বাঁধা।
তখন সবাই অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, ভালব সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই এদের, সুতো জিনিসটাও অচেনা। আমি নিজেও বুঝিয়ে বলতে পারিনা, আমার কিছু মনে নেই। এদের কৌতূহল অবশ্য ওই পর্যন্তই, খুব বেশি ঘাটায় না। আমিও নিবিষ্ট মনে কাজ করে যাই।
এখানে সবার একটাই কাজ, ছাঁকনদারি করা। আমি ছাড়া আরও একশ একুশ জন ছাঁকনদার রয়েছে এই তল্লাটে। আমরা সোনালি স্রোত থেকে রুদাই সংগ্রহ করি। ছাঁকনদার শব্দটি শুনে মনে হতে পারে আমরা বুঝি সার বেঁধে ছাঁকনি হাতে দাঁড়িয়ে থাকি আর সোনালি স্রোতটা এলেই ঝাঁপিয়ে পড়ি রুদাইয়ের খোঁজে। আসলে তা নয়।
আমরা থাকি সবুজ তল্লাটে। এখানকার ঘর-বাড়ি-রাস্তা-ঘাট এমনকি আমরা, সব কিছুই সবুজ রঙের। সোনালি স্রোতটা তরল নয়, অনেকটা বাষ্পের মতো, আবার ঠিক বাষ্পও নয়! কেউ জানেনা কী এর উৎস। কখনো দীর্ঘক্ষণ, কখনো অল্পক্ষণ, যখন আসে চতুর্দিক প্লাবিত করে চলে যায়। আমাদের সবুজ তল্লাট ফুলে ফুলে ওঠে রুদাইয়ের ভারে। স্রোত চলে গেলে আটকে পড়া রুদাইগুলোকে জড়ো করে বড় রাস্তাটার মোড়ে নিয়ে যাই আমরা, পৌঁছে দেই আরেকটা দলের কাছে। ওই দলে আছে একুশ জন, ওরা থাকে বাদামি তল্লাটে, যেখানে আমাদের যেতে মানা। এক দুজন যে চেষ্টা করেনি তা নয়, কোন এক বিচিত্র কারণে বড় রাস্তার মোড়টা পেরুনো যায়না।
বাদামিরা আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে, বিনিময়ে আমরা দেই রুদাই, এটাই নিয়ম। রুদাই দিয়ে ওরা কী করে কে জানে! নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। আমরা কতটুকু খাবার পাবো সেটা নির্ভর করে রুদাইয়ের জোগানের উপর। বেশি বেশি রুদাই দিতে পারলে বেশি বেশি খাবার, আমরা খুব চনমনে থাকি তখন। রুদাই অল্প হলে খাবারের পরিমাণ কমে যায়, তখন খুব অবসন্ন লাগে, নেতিয়ে পড়ে আমাদের শরীর। বাদামিদের কাছে শুনেছি আসেপাশে এরকম আরও অসংখ্য সবুজ তল্লাট আছে, রয়েছে অগণিত বাদামি ভুবন।
সোনালি স্রোতটা যখন হারিয়ে যায়, তখন অন্ধকার নামে। অন্ধকারে এদের দারুণ ভয়। প্রথম প্রথম ভাবতাম এ হয়তো না খেয়ে থাকার ভয়। স্রোত নেই তো রুদাই নেই, রুদাই না থাকলে খাবারও নেই। কিন্তু হারিয়ে গেলেও স্রোতটা আবার ফিরে আসে ঠিক ঠিক। কখনো থেমে থেমে, কখনো একটানা অনেকক্ষণ, সোনালি নহর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় আমাদের তল্লাট, তখন আবার পেট ভাসিয়ে খাই আমরা, কম খেয়ে কাটানো সময়গুলো পুষিয়ে যায়। কিসের এতো ভয় তাহলে! ঠিক ভয়ও নয়, ওদের চোখেমুখে কেমন যেন একটা আতংক লক্ষ্য করি, জিগ্যেস করলে শিউরে ওঠে। ভাবছি ফিলকে একবার জিগ্যেস করবো।
ফিল আমাদের সর্দার। খুব গম্ভীর আর চাপা স্বভাবের, কথাবার্তা তেমন একটা বলে না। আমিও ঘাটাইনা, আমার জন্য নিজের ঘরের একটা অংশ ছেড়ে দিয়েছে সে, এতেই আমি কৃতজ্ঞ। ফিল জানিয়েছে এ তল্লাটে, শুধু এতল্লাটেই নয়, সবগুলো সবুজ তল্লাটেই নাকি ঘরের সংখ্যা একশ একুশ।
ছাঁকনদারদের বেশির ভাগই তরুণ, কয়েকজন আছে যারা বয়সে ফিলের কাছাকাছি, এরা এই তল্লাটের আদি বাসিন্দা। আদি বাসিন্দারা খুব চুপচাপ, ফিলের মতোই। তরুণরা আবার ঠিক এর উল্টো, তাদের বকবকানির কোন শেষ নেই। ব্যাতিক্রম কেবল একজন, তার নাম ক্লোরো। সারাক্ষণই কিছু না কিছু একটা ভাবছে। একমাত্র ওরই আমাকে নিয়ে কোন কৌতূহল নেই। একদিন রুদাই তুলতে তুলতে ক্লোরোকে জিগ্যেস করলাম,
“কী এতো ভাবো তুমি?”
উত্তর পাবার আশা না করেই প্রশ্নটা করেছিলাম। আমাকে হকচকিয়ে দিয়ে মুখ খুললো ক্লোরো,
“অনেক কিছু নিয়েই ভাবি, ইদানীং ভাবছি তোমাকে নিয়ে।”
“আমাকে নিয়ে! আমাকে নিয়ে ভাববার কী আছে?”
“অনেক কিছু। এই ধর, তুমি কে? কোত্থেকে এলে? কেমন করে এলে? তুমি দেখতে আমাদের মতো, বাদামিদের মতো নও কেন?”
“দাঁড়াও দাঁড়াও! আমি একজন ছাঁকনদার, কোত্থেকে এসেছি কীভাবে এসেছি বলতে পারবো না। কেবল মনে আছে একটা ভালব টেনেছিলাম, আর সেটা ছিলো সুতোয় বাঁধা। এখন জানতে চেয়ো না ভালব আর সুতো কী জিনিস, আমার মনে নেই। সবাই তো জানে এই কথা, নতুন করে ভাববার দরকার কী? আমি কি কখনো জানতে চেয়েছি তুমি কোত্থেকে এলে?”
“আসতে যাবো কেন! আমি তো এখানেই ছিলাম।”
“বুঝলাম তুমি এখানেই ছিলে, কিন্তু এখানটা এলো কোত্থেকে থেকে শুনি ?”
“ও, তুমি জন্মকথা জানতে চাইছো?”
“তুমি জানো?”
ক্লোরো কোন জবাব না দিয়ে রুদাই তুলতে থাকে, যেন আমার কথা কানেই যায়নি তার।
“কী হলো, কিছু একটা বলবে তো?”
“ভাবছি”
ক্লোরোর ভাবনা আর ফুরোয় না।
সেদিন অন্ধকার নেমে আসার পর ফিলকে বললাম,
“ক্লোরো একটা কথা বলছিলো।”
“হুম”
“কী কথা জানতে চাইলে না?”
“কী কথা?”
এতো নিরাসক্তি নিয়ে ফিল জবাব দেয় যে আমার আর জিগ্যেস করতে ইচ্ছে করে না। ঘুমিয়ে যাচ্ছিলাম, ফিলের কথায় চটকা ভাঙলো,
“ক্লোরোর কাছ থেকে দুরে থাকবে তুমি”
“সেকি! কেন?”
“ওর মাথার ঠিক নেই। প্রিংতা আসার পর থেকেই আবোল তাবোল বকছে।”
“প্রিংতা কে?”
ফিল ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে।
প্রিংতা কে, নাকি কী, সেটা টের পেলাম সোনালি স্রোতটা ফিরে আসার পর।
স্রোতটা সেদিন ছিলো কমজোরি, আর বইছিলও বেশ থেমে থেমে। মোটামুটি অলস একটা সময়। হঠাৎ থরথর করে কেঁপে উঠলো পুরো তল্লাট। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলাম আমি। বাতাসে বিচ্ছিরি একটা গন্ধ, শুধু বিচ্ছিরি নয়, খুব ঝাঁঝালো, শ্বাস নিলে দম আটকে আসে। একটা শব্দ শুনে পেছন ফিরে দেখি জ্ঞান হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে ক্লোরো। একই অবস্থা আরও কয়েকজন তরুণ ছাঁকনদারের। কী হচ্ছে, কী করবো, ভাবতে না ভাবতেই ফিল আর অন্য বুড়োরা দৌড়ে এসে আঠালো একটা তরল ছিটিয়ে দিলো আমার দিকে। এটার গন্ধ আরও উৎকট, রেগেমেগে কিছু একটা বলতে গিয়েই টের পেলাম শ্বাসকস্টটা আর নেই। আমার হাতে একটা বালতি ধরিয়ে দিয়ে খেঁকিয়ে উঠলো ফিল,
“হা করে দেখছ কী? ছিটিয়ে দাও, সবখানে লেপে দাও ভালো করে। দেরি করলে আর রক্ষে নেই!”
কেন ছিটাবো, রক্ষে নেই কেন, এই মুহূর্তে সে প্রশ্ন করার মতো বুদ্ধু আমি নই। ফিলের কথামতো ছিটাতে শুরু করলাম। ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে ক্লোরো এবং অন্যেরা। চারিদিকে গন্ধের যুদ্ধ চলছে যেন, থেকে থেকে কেঁপে উঠছে আমাদের সবুজ তল্লাট, মাঝে মাঝে মাথার উপর দিয়ে সরসর করে সরে যাচ্ছে হিলহিলে একটা ছায়া।, ছায়ার ভেতর থেকেই হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে আসছে গোলাপি হলুদ একটা মাংসপিণ্ড, গায়ে তার অগুন্তি কাঁটা। বুঝে উঠার আগেই তল্লাটের একটা অংশ চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেলো, সেই সাথে সাতজন ছাঁকনদার। একটু আগেই যেখানে ছিলো তিনটি বাড়ি, সাতজন চেনা মুখ, সেখানে এখন অসীম শূন্যতা, অপার্থিব এক অন্ধকার।
“তরলটা ছিটিয়ে দাও, গায়ে মাখো, বাড়িতে মাখো, জমিনে মাখো, ছুড়ে দাও লকলকে ওই জিভটার দিকে।”
চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি আঠার চাঁদরে মোড়া বুড়ো ফিল, যে কিনা সহসা মুখ খোলে না, কথার তুবড়ি ফাটিয়ে নির্দেশ দিয়ে চলেছে। কতক্ষণ চলল এ যুদ্ধ বলতে পারবোনা। কতবার যে শূন্য ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো ঘিনঘিনে সেই মাংসপিণ্ডটা, কে জানে! একটা সময় টের পেলাম, যে এসেছিলো সে আর নেই, যেমন শূন্য থেকে উদয় হয়েছিলো, তেমনি মিলিয়ে গিয়েছে শূন্যে।
আমাদের চারপাশটা ক্ষতবিক্ষত, সবুজ তল্লাটের এখানে ওখানে উঁকি মারছে জমাট অন্ধকার। ওই জায়গা গুলো আর নেই, কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে উনিশ জন ছাঁকনদার। পাশেই স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে ক্লোরো, কী যেন বলছে বিড়বিড় করে। একটা ধাক্কা দিয়ে জিগ্যেস করলাম,
“ওটা কী ছিলো ক্লোরো? কোত্থেকে এলো, আর গেলোই বা কোথায়?”
ক্লোরো নিরুত্তর, অন্যেরা নির্জীব হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে এখানে ওখানে। চিৎকার করে বললাম,
“আমি একটা প্রশ্ন করেছি। কেউ কি জানো, কী হয়ে গেলো এখানে?”
“প্রি - ঙ - তা”
টেনে টেনে এটুকু বলেই আবার থেমে গেলো ক্লোরো।
“প্রিংতা কে? কী?
“প্রিংতা মানে মৃত্যু। আর কিছু জানিনা। শেষবার যখন এসেছিলো তখন সে এতোটা ভয়ংকর ছিলো না, ওই লকলকে জিব্বাটায় এতো কাঁটাও আগে দেখিনি। তখন তাড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম। এবার ফিরে এসেছে আরও অনেক শক্তিশালী হয়ে, হিংস্র হয়ে।”
“কোথা থেকে আসে?”
“কেউ জানেনা।”
“কেউ জানেনা মানে কী? বুড়োরা নিশ্চয়ই জানে।”
“বুড়োদের কথা বাদ দাও। আজগুবি কিছু গালগল্প ছাড়া এঁদের ঝুলিতে আর কিছুই নেই। এরা কী বলে জানো?”
“কী বলে?”
“অনেক অনেকে আগে অতি ক্ষুদ্র, অকল্পনীয় ক্ষুদ্র একটি বিন্দুর ভেতর ঘুমিয়ে ছিলেন আমাদের আদি পিতা, বাড।“
“তারপর?”
“তারপর ঈশ্বর পাঠালেন সোনালি স্রোত, ঘুম ভাঙলো বাডের। তিনি আড়মোড়া ভাঙতে চাইলেন, কিন্তু শরীর তাঁর দারুণ অসাড়। সাহায্যের আশায় চীৎকার করে ডাকলেন কতবার! কোথাও কোন সাড়া নেই। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, অসহায় বাড তখন প্রার্থনায় বসলেন। কেটে গেলো আরও অনেকে অনেক প্রহর। অবশেষে ঈশ্বর তৃপ্ত হলেন, একদিন স্বর্গের দরজা খুলে গেলো। ওই যে বড় রাস্তার মোড়, যা নাকি পেরুনো যায়না, তার পেছনেই সেই স্বর্গদুয়ার। স্বর্গদূতেরা বয়ে এনেছিলেন ঈশ্বরের উপহার, অমৃত। অমৃতের স্পর্শে ক্রমে ক্রমে পুষ্ট হলেন বাড।”
“বাড এখন কোথায়?”
“কোথায় আবার! বাড ছড়িয়ে আছেন সবখানে।”
“হেঁয়ালি কোরোনা ক্লোরো, তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই আমি বুঝতে পারছি না।”
“এই যে সবুজ তল্লাট, এটাই বাড।”
“তাহলে তোমরা, মানে আমরা কারা?”
“আমরা বাডের রক্ষক, তাঁর বংশধর, তাঁরই অংশ। তুমি কি ভেবেছো এই তল্লাটটি জড়? মোটেই নয়। একটা কাজ করো, জমিনে কান পেতে দেখো তো কিছু শুনতে পাও কিনা!”
সব ছাঁকনদারেরা উঠে এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়েছে। সবার চোখেই কেমন যেন একটা শূন্য দৃষ্টি, আমার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বিড়বিড় করে বলছে, কান পাতো, কান পাতো, কান পাতো………………।
আমি হাঁটু গেঁড়ে উবু হয়ে বসে আমার ডান কানটা ছোঁয়ালাম সবুজ জমিনে। প্রথমটায় ঠিক ধরতে পারিনি, তারপর শুনলাম- একটা মৃদু কোলাহল, যেন অনেক গুলো কণ্ঠ সমস্বরে গুনগুণ করে কিছু একটা বলছে আমাকে। আমি মাথা তুলে ক্লোরোর দিকে তাকালাম।
“বাডের আত্মা”
ফিস ফিস করে বললো ক্লোরো। ফিসফিস করে উঠলো সবাই, শত কণ্ঠের মৃদু ফিসফিসানি একটা মন্ত্রের মতো সমস্বরে উচ্চারিত হয়ে যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেলো আমাকে। আমি সংবিৎ ফিরে পেয়ে জিগ্যেস করলাম,
“তারপর?”
ক্লোরো ফিলের দিকে তাকিয়ে কী যেন একটা ভাবলো, ফিল তাঁর মাথাটা একটু নোয়াতেই ক্লোরো আবার বলতে শুরু করলো-
“তখন ঈর্ষায় জর্জরিত হলেন হিমগ্ন, তিনি ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী। বললেন, ধ্বংস করে দেবেন সৃষ্টি। ভয়ার্ত বাড নিরুপায় হয়ে আশ্রয় চাইলেন ঈশ্বরের কাছে। ঈশ্বর দয়ালু, প্রতিশ্রুতি দিলেন বাডকে তিনি রক্ষা করবেন, বিনিময়ে দিতে হবে নৈবেদ্য। এই যে আমরা সোনালি স্রোত থেকে রুদাই ছেঁকে বাদামিদের কাছে পৌঁছে দেই, এটা ঈশ্বরের জন্য বাডের সেই নৈবেদ্য।”
“দাঁড়াও দাঁড়াও! তুমি বলতে চাইছো বড় রাস্তার মোড়ের ওই গোমড়ামুখো বাদামিরা সব স্বর্গের দূত?”
“আমি কিছুই বলছি না। এসব ফিল আর অন্য বুড়োদের কথা। তবে বাদামিরা দেবদূত নয়, ওদের যত দৌড় ওই রাস্তাটাতেই। আমরা যেমন রাস্তাটার এপ্রান্ত পেরুতে পারিনা, ওরাও তেমনি আটকে রয়েছে অন্য প্রান্তের সীমানায়। ওদের কাজ কেবল রুদাই পৌঁছে দিয়ে আমাদের জন্য অমৃত বয়ে আনা।”
“তারপর?”
“সব দেখে, দারুণ রাগে ফেটে পড়লেন হিমগ্ন। সেই রাগ থেকেই জন্ম নিলো প্রিংতা। তখন ঈশ্বর পাঠালেন একশ একুশ ছাঁকনদার, আর ওই আঠালো তরল। প্রিংতা আসে, প্রিংতা চলে যায়। সে ফিরে ফিরে আসে, প্রতিবার আসে আগেরবারের চেয়ে প্রবল হয়ে। ফলাফল তো তুমি জানো, ওই যে দেখো ছোপ ছোপ অন্ধকার, বাডের ওই অংশগুলো হারিয়ে গিয়েছে, হারিয়ে গিয়েছে উনিশ জন ছাঁকনদার। ফিল বলে তারা নাকি স্বর্গে গিয়েছে!”
“কিন্তু তোমরা তো একশ একুশ জন ছিলে, একেকজন একেক বয়সী! তার মানে যারা হারিয়ে যায় তাঁদের জায়গায় নতুন কেউ আসে, তাইনা?”
“তা তো বটেই, নইলে একশ একুশ হয় কী করে? তবে আরও একটা ব্যাপার আছে। আমাদের কাজটা যে দারুণ একঘেয়ে তা নিশ্চয়ই মানো? সবাই তো আর সমান নয়, কেউ কেউ কাজে ফাঁকি দেয়, তখন ভাটা পড়ে নৈবেদ্যে। ঈশ্বর তাঁদের নরকে পাঠিয়ে দেন, তাদের বদলে আসে নতুনেরা। কেউ টিকে থেকে ফিলের মতো বুড়ো হয়, কেউ যায় স্বর্গে, কেউ নরকে। সবুজ তল্লাটে নতুন পুরনো সব মিলিয়ে একশ একুশ জন ছাঁকনদার, এর বেশি কখনোই নয়। এটাই ঈশ্বরের বিধান। একমাত্র তুমিই ব্যাতিক্রম, তোমার নম্বর একশ বাইশ। তুমি আমাদের মতো, কিন্তু আমাদের একজন নও। কে তুমি?”
“আমি কে তা জানিনা। কেমন করে কোথা থেকে, কী ভাবে এখানে এলাম মনে নেই। কেবল মনে আছে একটা ভালব টেনেছিলাম, আর সেটা ছিলো সুতোয় বাঁধা……”
“থামো, থামো! আর বলতে হবেনা।”
“ক্লোরো, এর কি কোন শেষ নেই? জন্মকথায় আর কিছু কি আছে?”
“আছে। একটা ভবিষৎবাণী আছে। প্রিংতা দিনদিন আরও শক্তিশালী হবে। এবার গিয়েছে উনিশ জন, একে একে যাবে আরও অনেকেই। সবুজ তল্লাট ছেয়ে যাবে ছোপ ছোপ অন্ধকারে। আমরা যেমন প্রিংতার বিরুদ্ধে লড়াই করি, ঈশ্বর তেমনি লড়ে চলেছেন হিমগ্নের সাথে। এই লড়াইয়ে ঈশ্বর শেষমেষ হেরে যাবেন। সোনালি স্রোতটা শুকিয়ে আসবে, থেমে যাবে বাডের আত্মার কোলাহল যা তুমি কান পেতে শুনেছো। বিলীন হয়ে যাবে ঈশ্বরের সৃষ্টি………”
ক্লোরো তার কথা শেষ করতে পারলো না। ছুটে এসে একটা ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিলো ফিল। তাঁর কণ্ঠে আবারও সর্দারের কর্তৃত্ব,
“ব্লাসফেমি! ব্লাসফেমি! ছেলেছোকরাদের বাড় বেড়েছে অনেক। কে বলেছে ঈশ্বর হেরে যাবেন? তোমাদের কি ধারণা এটাই তাঁর এক মাত্র সৃষ্টি! আরও অনেক অনেক তল্লাট রয়েছে, আছে অগণিত ছাঁকনদার। ঈশ্বর হেরে যাবেন না। এ জগৎ তাঁর অকল্পনীয় নিরীক্ষার একটা অংশ মাত্র। যা কিছু সৃষ্টি তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে সত্যি, তবে সেটা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই। যারা মন দিয়ে কাজ করবে, যারা টিকে থাকবে শেষের সে দিন পর্যন্ত, তাদের স্থান হবে স্বর্গে। আশ্রয় মিলবে তাদেরও যারা হারিয়ে গিয়েছে প্রিংতার সাথে। অন্যেরা মরুকগে নরকের গভীরে মাথা কুটে কুটে। এখন যাও! ঢের সময় নষ্ট হয়েছে, যেটুকু পারো রুদাই সংগ্রহ করে রেখে আসো বড় রাস্তাটার মোড়ে। ঈশ্বরের নৈবেদ্যে যেন ভাটা না পড়ে।”
আমি হাত বাড়িয়ে জমিন থেকে ক্লোরোকে টেনে তুললাম, তার মুখে একটা হাসি, অবিশ্বাসীর হাসি।
দুই।।
প্রিংতা আসার পর আমার মনেও ভয় ঢুকে গিয়েছে, সেই ভয় যা এখানে আসা অবধি অন্যদের চোখে আমি দেখেছি। সবুজ তল্লাট ছেড়ে পালাতে হবে। কিন্তু যাবো কোথায়, কীভাবে! এই জায়গাটা দারুণ গোলমেলে, যেদিকেই যাই না কেন বারবার ফিরে ফিরে আসি যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই। বাকি কেবল একটা দিক, বড় রাস্তার মোড়। কিন্তু সে চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। মাঝে মাঝে একদুজন পেরুতে চায়, কিন্তু কী এক অলঙ্ঘনীয় বাধা তাদের ছিটকে পাঠিয়ে দেয় এপারে। হয়তো ফিলের কথাই সত্যি, ওপারেই স্বর্গ। চাইলেই কি আর স্বর্গে যাওয়া যায়!
একদিন ফিল ঘুমানোর পর খুব সাবধানে পা টিপে টিপে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এলাম। চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার, সোনালি স্রোত নেমে আসার আগেই যা করার করতে হবে।
বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি আমি। একবার ভাবলাম ফিরে যাই, কিন্তু ফিরতে তো হবেই যদি পেরুতে না পারি। চেষ্টা করতে ক্ষতি কী! ভয়ে ভয়ে ডান পা টা বাড়িয়ে দিলাম, উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার, এই বুঝি ছিটকে পড়ব পেছন দিকে। তারপর বাম পা টা টেনে আনতেই কী একটা যেন জড়িয়ে ধরলো আমাকে। মনে হলো কেউ একজন যেন টেনে টেনে আমার শরীরের সমস্ত ছাল খাবলে নিচ্ছে। আতংকে মূর্ছা গেলাম।
কতক্ষণ পড়ে ছিলাম বলতে পারবো না। জ্ঞান ফিরলো পাঁজরের কাছে তীব্র একটা যন্ত্রণায়। চোখ মেলে দেখি গোমড়া মতো দেখতে একজন আমার দিকে তাকিয়ে। আমি কিছু বলার আগেই আরেকটা লাথি কষিয়ে বললো,
“কাজকর্ম বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে আছো দেখছি! তোমার ভাণ্ড কোথায়? রুদাই আনতে যাবার সময় হয়ে এলো খেয়াল নেই? দেখতে পাচ্ছো না সোনালি স্রোতটা কেমন নেতিয়ে এসেছে?”
“কিসের ভাণ্ড! রুদাই কী?
“রুদাই কী!”
গোমড়া মুখো হতভম্ব হয়ে গেলো। আসেপাশে আরও কয়েকটি কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে মাথা তুলে দেখি আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক, দুই, তিন- সবসুদ্ধ কুড়ি জন গোমড়া মুখো। প্রথমজনকে সহ একুশ। সবার গায়েই বাদামি একটা আভা, যেখানে পড়ে আছি সে জায়গাটাও বাদামি। ডান, বাম, সামনে, পেছনে- যতদূর চোখ যায়, সব কিছুই কেমন যেন বাদামি ধোঁয়ায় মোড়ানো।
প্রথম জন আমার মুখের কাছে একবার এসেই ধাঁ সরে গিয়ে অন্যদের জিগ্যেস করলো,
“এটা কে?”
কুড়িকণ্ঠে একঘেয়ে প্রতিধ্বনি উঠলো,
“এটা কে? এটা কে? এটা………কে?”
প্রথম জন সবাইকে থামিয়ে দিয়ে আমাকে জিগ্যেস করলো,
“অ্যাই, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ?”
আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম, তারপর বললাম,
“আমি কে তা জানিনা। কেমন করে কোথা থেকে, কী ভাবে এখানে এলাম মনে নেই। কেবল মনে আছে একটা ভালব টেনেছিলাম, আর সেটা ছিলো সুতোয় বাঁধা।”
“ভালব জিনিসটা আবার কী? আর সুতোই বা কেমন?”
“সে আমি বলতে পারবো না। আমার আর কিছু মনে নেই।”
চারিদিক জুড়ে একটা গুঞ্জন উঠলো, আবারও হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে প্রথম জন বলল,
“তুমি কে সেটা পরে বোঝা যাবে। এখন নষ্ট করার মতো সময় নেই। অ্যাই, ওকে একটা ভাণ্ড এনে দাও কেউ।”
আমি বুঝে গিয়েছি এ হচ্ছে এখানকার দলপতি।
কতক্ষণ চললাম তা বলতে পারবো না। হঠাৎ দেখি বড় একটা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমরা। রাস্তার ওপারে যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজ আর সবুজ। একটা জায়গায় সবুজ রঙটা কেমন যেন কিলবিল করে নড়ছে। আরেকটু কাছে যেতেই টের পেলাম ওটা একটা মিছিল। মিছিলের সবাই সবুজ, তাদের হাতে সবুজ সবুজ ভাণ্ড।
ভাণ্ডগুলো রাস্তার মোড়ে রেখে একটু পিছিয়ে দাঁড়ালো সবুজেরা। আমাদের দলপতি বিরক্ত হয়ে বলল,
“রুদাই এতো কম কেন হে? তোমরা সব আলসে হয়ে গেলে নাকি?”
সবুজদের ভেতর থেকে বয়স্ক একজন এগিয়ে এসে বললো,
“প্রিংতা আসার পর থেকে আমাদের সংখ্যা কমে গিয়েছে, তাছাড়া তুমিতো জানোই সোনালি স্রোতটা আজকাল আর আগের মতো জোরালো নেই। নতুনদের পেয়ে গেলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আমাদের দলপতি আরও গোমড়া হয়ে বললো,
“নতুনরা কখন আসবে সেটা নির্ভর করছে ঈশ্বরের মর্জির উপর। কিন্তু তাই বলে নৈবেদ্যে ভাটা পড়লে তো চলবে না! এই নাও তোমাদের অমৃত, যত রুদাই তত অমৃত। এটাই ঈশ্বরের বিধান।”
সবুজ দলটা বিমর্ষ হয়ে চলে যেতে যেতে একজন ঘুরে দাঁড়ালো, আমার দিকে আঙুল তুলে বলল,
“তুমি একশ বাইশ।”
দলপতি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কী বলে গেলো ও তোমাকে? তুমি একশ বাইশ! এর মানে কী?”
আমি বিড়বিড় করে বললাম,
“মানে কী আমি জানিনা, আমার কিছু মনে নেই।”
দলপতি একটা ক্রুর হাসি হেসে ফিরে চলল, তার পেছন পেছন রুদাই হাতে আমরা। সবসুদ্ধ বাইশ জন, একজন অতিরিক্ত, সেটা আমি।
মানে যে কী তা আমি জানি। ক্লোরো হাত তুলতেই আমার মনে পড়ে গিয়েছে সব। আমি একশ বাইশ। কোন এক বিচিত্র কারণে বড় রাস্তার সেই অদৃশ্য বাঁধাটা পেড়িয়ে বাদামি তল্লাটে ঢুকে যেতে পেরেছি। নম্বর পাল্টে গিয়ে এখন আমি বাইশ, শুধুই বাইশ। আমার রঙটাও আর সবুজ নেই, এখানকার অন্য একুশ জনের মতো বাদামি।
বাদামিরা অন্যরকম। ভীষণ গোমড়া আর কেমন যেন রাগী রাগী সবাই। সবুজ তল্লাটে কাউকে প্রার্থনা করতে দেখিনি কখনো। ছাঁকনদারদের কাছে ঈশ্বরের কথা শুনেছিলাম একবারই- প্রিংতা আসার পর। বাদামিদের ঈশ্বর ভক্তি প্রবল। রুদাই নিয়ে ফিরে আসার পর থেকেই দেখতে পাচ্ছি গুনগুণ করে একটা গান গাইছে সবাই। গানের কথাগুলো স্পষ্ট নয়, তবে যেটুকু ধরতে পারছি তাতে ঘুরেফিরে কেবল ঈশ্বরের বন্দনা, সম্ভবত প্রার্থনা সংগীত। ভীষণ একঘেয়ে একটা সুরে, পালা করে জোড়ায় জোড়ায় গেয়ে চলেছে,
নিস্প্রানে থাকে প্রাণ
ঈশ্বর আছে তাই
মহাপ্রাণ ঈশ্বর
তোমা বিনে গতি নাই
তুমি প্রভু তোমাকেকেই
…(দুর্বোধ্য)......
……(দুর্বোধ্য)…
ঈশ্বরে ভয় যার
(দুর্বোধ্য) জয় তার
(দুর্বোধ্য) চিন্তার (দুর্বোধ্য)
………………
………………
………………
কতক্ষণ চলল সে গান বলতে পারবো না। হঠাৎ ঘর্ঘর ঘর্ঘর একটা শব্দ শুনে পেছন ফিরে দেখি গোল মতন কী একটা জিনিস ঠেলতে ঠেলতে দলপতি আসছে আমাদের দিকে। কোন ফাঁকে যে দলছাড়া হয়ে গিয়েছিলো সে টের পাইনি। গান থামিয়ে সবাই সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো,
“ঈশ্বরের জয় হোক”
“ঈশ্বরের জয় হোক। জয় হোক দেবদ্যূত কন্ড্রিয়ার। আমি বাইশ নম্বরের কথা তাঁকে বলেছি। ঈশ্বরের সাথে পরামর্শ করে তিনি জানাবেন কী আমাদের করনীয়। আপাতত এ আমাদের সাথেই থাকছে। বাইশ নম্বর, তুমি তোমার ঘরে যাও। কন্ড্রিয়ার স্পষ্ট নির্দেশ রুদাই আনার সময়টুকু ছাড়া ঘর থেকে বেরুবে না তুমি।”
আমি আশেপাশে তাকিয়ে ঘরটর কিছু দেখতে না পেয়ে জিগ্যেস করলাম,
“কোথায় ঘর?”
“কোথায় মানে? এটাই।”
এই গোল জিনিসটাই তাহলে ঘর! কিন্তু ঢুকবো কিভাবে? দরজা জানালা কিছুই চোখে পড়ছে না।
“কী হলো, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?”
“ভেতরে কেমন করে যাবো বুঝতে পারছি না।”
“সবাই যেমন করে যায় তেমন করে।”
“সবাই কেমন করে যায়?”
“ঘরের উপর তোমার একটা হাত রাখো।”
হাত রাখতেই চমকে উঠলাম, গোল জিনিসটা জীবন্ত নাকি! ঝটকা মেরে সরতে গিয়েই টের পেলাম আমি এটার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান জগতটা কোথায় যেন হারিয়ে গেলো, একটা বাদামি গোলকের ভেতরে একলা দাঁড়িয়ে আমি, আশেপাশে কেউ নেই। বের হবার চেষ্টা অর্থহীন জেনেও আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম চারিদিক। দিক বললে অবশ্য ভুল হবে, আবদ্ধ একটা বৃত্তের ভেতরে দিক বলে কিছু নেই।
বাইরে থেকে যতটা ছোটো দেখায় তার চেয়ে বেশ বড় জায়গাটা। বদ্ধ হলেও একেবারে অন্ধকার নয়, সেইসাথে মৃদু একটা উষ্ণতা, ঠিক শুষ্ক নয়, কেমন যেন ভেজা ভেজা একটা উষ্ণতা ছড়িয়ে রয়েছে ঘরময়।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। ঘুম ভেঙে উঠে দেখি ভিজে একেবারে চুপসে গিয়েছি। ঘর জুড়ে থকথকে একটা তরল, জায়গায় জায়গায় ছোটো ছোটো বুদবুদ আর থেকে থেকে ভারি মিষ্টি একটা গন্ধ, গন্ধটা আমার খুব চেনা। কিন্তু তরলটা এলো কোথা থেকে! মাথায় একটা ফোঁটা পড়তেই পরিষ্কার হয়ে গেলো সব। আমার ঘরটাই গলে গলে পড়ছে! কী করব ভাবতে না ভাবতেই চারিদিক থেকে হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়লো সব।
আমার সামনে সেই একুশজন, আমার মতোই ভিজে একসা, গলে গলে পড়া বৃত্তাকার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছে একে একে। সবার হাতে একটি করে ভাণ্ড, উপচে রয়েছে ঘর ভাঙা তরলে।
“হা করে দেখছো কী? খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালাও।”
দলপতির ধমক শুনে আর দেরি না করে লাইনের শেষ মাথায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার বাদামি জীবনের আজ দ্বিতীয় দিন।
ঘর ভাঙার ব্যাপারটা ইদানীং সয়ে গিয়েছে। ঘর ভাঙবেই, এটাই ঈশ্বরের বিধান। ভাঙা ঘর থেকে ঝরে ঝরে পড়া অমৃতের খানিকটা পাই আমি, বাকিটুকু নিয়ে যাই তাদের জন্য যারা পথে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বড় রাস্তাটার মোড়ে। ওদের সাথে আমার কথা হয়না। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কথা হয়না কারও সাথেই, বাদামি তল্লাটে আমার কোন বন্ধু নেই। আমি এখানে বন্দি, একটা বৃত্তের ভেতর আটকে থাকি, প্রতিদিন নতুন বৃত্ত, নতুন ঘর, ঘর না ভাঙলে ঘর থেকে বেরুবার সাধ্য আমার নেই। দেবদ্যূত কন্ড্রিয়া আমার ব্যাপারে এখনও কোন সিদ্ধান্ত জানান নি। ভবিতব্য না জেনেই পথ চলি আমি, একুশজনের পেছন পেছন, বাইশ হয়ে।
পথটাকে দিন দিন আরও দীর্ঘ আর ক্লান্তিকর লাগে। ভীষণ অর্থহীন আর অসহ্য এ যাত্রা! তার চেয়েও অসহ্য বাদামিদের গান। আমি যতটা সম্ভব কান বন্ধ করে ঈশ্বরের কথা ভাবি। ঈশ্বর কি খুব রাগি, নাকি দয়ালু! ক্লোরো নিশ্চয়ই জবাবটা জানে। অবশ্য জানলেই বা কী, আমি তো আর সবুজ তল্লাটে নেই যে রুদাই তোলার অবসরে জিগ্যেস করে জেনে নেবো। সোনালি স্রোতটার জন্য বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করে ওঠে আমার।
একদিন দেখি বড় রাস্তার মোড় জুড়ে বিশাল এক পাহাড়। রুদাই এর পাহাড়! এতো রুদাই আগে কখনো দেখিনি। ছাঁকনদারদের আনন্দও সেদিন ছিলো দেখার মতো। এমনকি বুড়ো ফিলের মুখে পর্যন্ত বেমানান একটা হাসি। অবশ্য সে হাসি থেমে যেতে সময় লাগলো না।
দলপতি ফিলের দিকে তাকিয়ে কাটা কাটা গলায় বলল,
“পাপী তোমরা! ভেবেছো ঈশ্বরকে ফাঁকি দিয়ে বেঁচে যাবে, তাই না? ঈশ্বর সব কিছুর খবর রাখেন।”
ফিল আমতা আমতা করে ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিলো,
“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা! নৈবেদ্যর কি কমতি হয়েছে? আমরা অন্যান্য বারের চেয়ে ঢের বেশি এনেছি এবার।”
“ওই ছোকরাটা একে চেনে। একশ বাইশ বলে ডেকেছিলো। কোথায় সে?”
ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো ক্লোরো, গায়ে গতরে বেশ বেড়েছে এ ক’দিনে, চোখে মুখে দারুণ একটা ঔদ্ধত্য ছিটকে ছিটকে পড়ছে তার।
“এই যে আমি, আমার একটা নাম আছে। এরপর থেকে ক্লোরো বলেই ডাকবে।”
রেগে ফেটে পড়তে পড়তে সামলে নিলো দলপতি। রাগী কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“তুমি এর ব্যাপারে কী জানো? কোথা থেকে এসেছে, কেমন করে?”
“আমাকে জিগ্যেস না করে ঈশ্বরকে জিগ্যেস করলেই পারো! তিনি তো সব কিছুর খবর রাখেন, তুমিই না বললে?”
“ঈশ্বর এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাবিত নন, দেবদ্যূত কন্ড্রিয়া জানতে চেয়েছেন বলেই তোমাকে জিগ্যেস করছি।”
“যাতে তিনি ঈশ্বরের কান ভারি করতে পারেন, তাইতো? আচ্ছা, ঈশ্বরের আবার দ্যূতের প্রয়োজন কী?”
“মুখ সামলে কথা বল ছোকরা, যা জানতে চেয়েছি ঠিক ঠিক জবাব দাও।”
“আমার নাম ক্লোরো, আমি একশ এক। একশ বাইশ এসেছিলো একটা ভালব টেনে, আর সে ভালবটা ছিলো সুতোয় বাঁধা। ভালব আর সুতো কী জিনিস তা তুমি ঈশ্বরকে জিগ্যেস করে জেনে নিও।”
জবাবের অপেক্ষা না করে দলপতির দিকে পিঠ ঘুরিয়ে চলে গেলো ক্লোরো। দলপতি পারলে যে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ঈশ্বরের বিধান সবার জন্যই সমান ভাবে প্রযোজ্য। সবুজ তল্লাটে প্রবেশাধিকার বাদামিদের নেই। তারা আটকে রয়েছে বাদামি তল্লাটে, যেমন আটকে ছাঁকনদারেরা তাদের সবুজে। ব্যাতিক্রম শুধু আমি।
আমি যে ব্যাতিক্রম, আমি যে বাদামি তল্লাট ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারি তা আগে কেন মাথায় আসেনি এটা ভেবে নিজের উপর খুব রাগ লাগছে। কাজটা অবশ্য সহজ হবেনা। সবুজ তল্লাট ছেড়ে আসার আগে আমি ছিলাম স্বাধীন, এখানে বৃত্তবন্দি। পালাতে হলে আগে বৃত্তটাকে ভাঙা প্রয়োজন।
তিন।।
এখানে এখন রুদেলান্তির সময়, ঈশ্বরের অনুগ্রহ হাত ভরে নেবার কাল। সোনালি স্রোতের যেন কোন শেষ নেই, শেষ নেই ছাঁকনদারদের ব্যাস্ততার, তারচেয়েও ব্যাস্ত বাদামিরা। এরই ফাঁকে আমাদের তল্লাটে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। বৃত্ত গুলো এখন আরও বড়, আরও উষ্ণ। আর্দ্রতা কমে এসে অমৃতের স্বাদটাকে পাল্টে দিয়েছে। নিজেকে দারুণ শক্তপোক্ত আর চনমনে লাগে আজকাল, বাকি একুশ জনের দিকে তাকিয়ে টের পাই কলেবরে বেশ বেড়েছি আমি। ভাগ্যিস বেড়েছি, কেননা সবুজ তল্লাটে যাবার পথটাও বেড়ে গিয়েছে দুই গুন! আগের মতো ঢিমে তালে নয়, অমৃত আর রুদাই নিয়ে রীতিমতো ছুটতে হয় এখন।
বাদামিরা আজকাল বেশ গল্প টল্প করে। গল্পগুলো অর্থহীন, মূলত খাওয়া কেন্দ্রিক। কে কতটা অমৃত খেয়েছে সেই নিয়ে এদের বাগাড়ম্বরের কোন শেষ নেই। অমৃতটা যে দুর্দান্ত তা অস্বীকার করছি না, তাই বলে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গল্প ফাঁদার কী আছে?
একদিন বিরক্ত হয়ে পাশের দুজনকে বললাম,
“এমন খাই খাই করো কেন তোমরা? এতো খাবার দরকার কী শুনি? পেট ফেটে মরবে তো!।”
দুজন খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর একজন ফিসফিস করে আমাকে জিগ্যেস করলো,
“তুমি খাওয়া বাড়িয়ে দাও নি!”
খাওয়া বাড়িয়ে দেবো কেন! খাওয়া মানেই তো সময় নষ্ট করা, খাই যতটুকু না হলেই নয়। তারপর ঘরের ছাঁদটা ধ্বসে না যাওয়া পর্যন্ত খুঁজে ফিরি বৃত্ত ভাঙার পথ। এছাড়া সময় কই? বৃত্তে ঢোকার পর শরীরটা অবসন্ন হয়ে আসে, ক্লান্তি অর্থে নয়, কেমন সুখ সুখ একটা অবসন্নতা, না চাইলেও ঘুমিয়ে পড়ি, সে ঘুম ভাঙে অমৃতের ছোঁয়ায়।
হুমহাম ছুটে চলেছে বাদামি মিছিল। দুরে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছাঁকনদারের দল, ঈশ্বরের নৈবেদ্য হাতে প্রতীক্ষায় তারা, ঠায় দাঁড়িয়ে তাদের সীমাহীন ঘন সবুজে।
ফেরার পথে আমাকে টেনে লাইনের পেছনে নিয়ে গেলো দলপতি। অন্যদের দ্রুত পা চালানোর হুকুম দিয়ে আমার দিকে চেয়ে বললো,
“ঈশ্বরের কৃপাকে অবহেলা করোনা ছোকরা। রুদেলান্তির কাল অসীম নয়।”
“অবহেলা করছি ভাবছো কেন?”
“শুনতে পেলাম তুমি নাকি ঠিক মতো খাচ্ছো না?”
“খাচ্ছি না তা নয়। যতটুকু দরকার ততোটুকুই খাচ্ছি।”
“ভুল করছো, খাবে যতটুকু সাধ্যে কুলায়।”
“পেট ফেটে যেতে চাইলেও!”
“পেট ফাটবে না, ঈশ্বরের বিধান।”
“এমন অদ্ভুত বিধান কেন?”
যেন প্রশ্নটা শুনতেই পায়নি- দলপতি বলে চলে,
“বাদামি তল্লাটে প্রিংতার হামলা হয় না, কিন্তু তাই বলে এ জায়গাটাকে বিপদমুক্ত ভাবার কোন কারণ নেই। বিপদ এবং বিপদের ভয় ঈশ্বরের মতোই, সর্বত্র বিরাজমান।”
“কিসের বিপদ? ভয় কাকে?”
“বিপদ অবাধ্যতায়, ভয় নিজেকে। ঈশ্বরের অনুগ্রহ যে অগ্রাহ্য করে সে হিমগ্নের দাস।”
“হিমগ্নের দাস হলে ক্ষতি কী? আমি তো দাস হয়েই আছি এখানে।”
“ঈশ্বরের দাসত্ব সৌভাগ্যের।”
“কী করে বুঝবো বলো! সৌভাগ্য তো সব গোল ঘরের বাইরে।”
“সময় হলে তুমিও বাইরে যেতে পারবে।”
“কখন সময় হবে? কন্ড্রিয়া কি কিছু বলেছেন?”
“রুদেলান্তির পর তাঁর এখানে আসার কথা।”
“আচ্ছা, হিমগ্নের দাস হয়ে যাবার ব্যাপারটা আসলে কী? কী হয় দাসেদের? বলছি না যে তাঁর দাস হবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি আমি…”
“দাসেরা থাকে জীবনমৃত হয়ে, পাপীদের জন্য ঈশ্বরের কোন অনুকম্পা নেই।”
“সে নাহয় বুঝলাম, কিন্তু দাসেরা করেটা কী? কোথায় থাকে তারা, এখানেই? নাকি অন্য কোন তল্লাটে?”
“কন্ড্রিয়া আসলেই সব জানতে পারবে। তোমার ভালোর জন্যেই বলছি হে, যত পারো খাও- কষ্ট হলেও।”
ঈশ্বর এবং হিমগ্নকে নিয়ে এদের ভাবনাগুলো খুব সরলরৈখিক। এই যেমন, ঈশ্বর দারুণ গোছানো, তাঁর সুনির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনা রয়েছে। অপরদিকে হিমগ্ন খেয়ালি, তিনি পরিকল্পনার ধার ধারেন না, তাঁর আনন্দ কেবলই বিরুদ্ধাচরণে। ঈশ্বর নির্মাণ করেন, তিনি জোগান দাতা, প্রতিপালক। উলটোদিকে হিমগ্ন ধ্বংসপরায়ণ, হিংসুটে, আর স্বপ্নহীন। ঈশ্বর ক্ষমতাবান, আর হিমগ্ন ক্ষমতালোভী এবং দুর্বল। শুধু যে দুর্বল তাইই নয়, হিমগ্ন একরোখা এবং নির্বোধ। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও তিনি লড়ে চলেছেন ঈশ্বরের সাথে।
হিমগ্নের প্রতি একটা আকর্ষণ, ঠিক আকর্ষণ নয়, বলা যায় কৌতূহল জেগেছে আমার। ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যার লড়াই তিনি খেয়ালি কিংবা পরিকল্পনাহীন এটা আমি বিশ্বাস করিনা। কেন যেন মনে হচ্ছে ক্লোরোর কথাগুলো ফেলে দেবার মতো নয়।
....................এই লড়াইয়ে ঈশ্বর হেরে যাবেন। সোনালি স্রোতটা শুকিয়ে আসবে, থেমে যাবে বাডের আত্মার কোলাহল যা তুমি কান পেতে শুনেছো। বিলীন হয়ে যাবে সমস্ত ছাঁকনদার………......
রুদেলান্তি কাল শেষ হলো হঠাৎ করেই। একদিন দেখি বড় রাস্তার মোড় পেড়িয়ে যেখানে সবুজ তল্লাটের শুরু, সেইখানে রঙটা কেমন বদলে গিয়েছে। খানিকটা কাছে যেতেই বোঝা গেলো কারণ, ছাঁকনদারদের সবুজ টুপিতে লাল লাল ছোপ।
আমাদের দেখেই সোল্লাসে চিৎকার করে উঠলো ওরা। সবচেয়ে উল্লসিত বুড়ো ফিল। খুব ইচ্ছে করছে ক্লোরোকে ডেকে একবার জিগ্যেস করি, ব্যাপার কী! দলপতির দিকে তাকিয়ে আর সাহস হলো না। কিছু একটা ঘটেছে এখানে, বড় ধরনের কোন ঘটনা, যা গোমড়ামুখো বাদামিদের আরও গোমড়া করে তুলেছে।
রুদাই ভরা ভাণ্ডগুলো নিতে নিতে ফিলের দিকে তাকিয়ে দলপতি বলল,
“শেষ হলো তাহলে?”
ফিলের হাসিটা আরও চওড়া হয়ে এলো, হাসতে হাসতেই বললো,
“কিছুক্ষণ আগে আমরা সেই শব্দ শুনেছি।”
আমি আর থাকতে না পেরে জিগ্যেস করলাম,
“কিসের শব্দ? কী হয় শুনলে?”
দারুণ বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকালো ফিল। সবুজ তল্লাট ছেড়ে আসার পর ওর চোখে এমন কর্তৃত্বের ছাপ দেখিনি আর। বাদামিদের সাথে লেনদেনের সময় ফিল একরকম নতজানু হয়েই থাকে। আজ তাঁর গলায় সেই পুরনো ঝাঁজ।
“সবকটা সবুজ তল্লাট এখন বিপদমুক্ত, আমাদের আর কোন ভয় নেই, কাজ নেই, এখন কেবল প্রতীক্ষা ঈশ্বরের আহবানের। ভুল করেছো একশো বাইশ। এখানে থাকলেই ভালো হতো তোমার।”
ফেরার পথে কেউ কোন শব্দ করেনি। না গল্প, না কোন গান। কী এতো ভাবছে এরা!
অন্যান্য সময় রুদাই নিয়ে ফিরে আসার পরপরই আমাকে ঢুকে যেতে হয় গোল ঘরে। আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন, সাধারণত যে জায়গায় আমি থেমে যাই সে জায়গাটা পেরিয়ে আরও অনেকক্ষণ হাঁটলাম আমরা। হাঁটতে হাঁটতেই টের পেলাম আশেপাশের রঙ ফিকে হয়ে এসেছে, এখন আর বাদামি নয়, ধূসর একটি অঞ্চলে দাঁড়িয়ে সবাই। পথের শেষ প্রান্তে চৌকোনা একটি ঘর, ঘরের মুখে আরেকটি ঘর, দ্বিতীয় ঘরটি তুলনায় ছোটো, দেখতেও কেমন যেন কুৎসিত আর এবড়ো থেবড়ো। ঘরগুলো ক্ষণস্থায়ী নয়, দেখলেই বোঝা যায় বহুকাল টিকে থাকার মতো করে তৈরি এগুলো।
দ্বিতীয় ঘরটি পেছনে ফেলে চৌকো ঘরের সামনে দাঁড়ালাম সবাই। দলপতি গুনগুণ করে গান ধরলো, সেই একঘেয়ে গান।
তাঁর সাথে আরেকজন, আরও একজন, তারপর সবাই। সম্মিলিত গুঞ্জনে কানে তালা লেগে যাবার জোগাড় আমার। কতক্ষণ চললো সে গান কে জানে! হঠাৎ দেখি দেয়াল সরে গিয়ে একটা পথ বেরিয়ে এসেছে। প্রথমে দলপতি, তারপর একে একে সবাই, ভেতরে ঢুকে রুদাই এর ভাণ্ডগুলো নামিয়ে রাখলাম আমরা।
ঘরের মাঝখানে একটি আসন, সেখানে কেউ নেই। দলপতি আসনের পাশে দাঁড়িয়ে গমগমে গলায় বললো,
“রুদেলান্তির অবসান হয়েছে। ছাঁকনদারদের কাজ শেষ, যে শব্দটার কথা বলছিলো ফিল তাঁর অর্থ তোমরা জানো, বাইশ নম্বরের জন্য আবার বলছি। প্রিংতা চলে যাবার শব্দ ওটা। একটা দুটো নয়, সবগুলো সবুজ তল্লাট ছুঁয়ে ঘিরে থাকা প্রিংতারা সব বিদায় নিয়েছে। হিমগ্ন এখন চোখ রাখবেন বাদামি তল্লাটে। তোমরা যারা ঈশ্বরের অবাধ্য হয়েছ তাদের উপর ভর করবেন তিনি, চেষ্টা করবেন এই পবিত্র ঘরে ঢোকার। কিন্তু ঈশ্বর সহায়, আমরা সেটা হতে দেবোনা।”
চার।।
বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো এরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। আমার কাজের ধরনটাও বদলে গিয়েছে পুরোপুরি। এখন আর রুদাই আনতে যেতে হয় না। অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগ পর্যন্ত বুরুশ হাতে সবার সাথে ঘুরে বেড়াই বাদামি তল্লাটের এধার ওধার। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে গুড়ো গুড়ো ধুলো, ভারি রুক্ষ আর কেমন কালচে খয়েরি তাদের রঙ। ঘষে ঘষে সেসব জায়গা পরিষ্কার করে সময় কেটে যায়। কাজটা ভীষণ পরিশ্রমের। কোমর ধরে ওঠে, ক্ষুধায় অবসন্ন হয়ে আসে সমস্ত শরীর। সেই তুলনায় অমৃতের জোগান আজকাল সামান্যই, যেটুকু পাই তাতে পেট ভরেনা। আমরা দিন দিন শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হচ্ছি। ভাগ্যিস দলপতির কথামতো তখন খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছিলাম!
একদিন হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে দেখি যতদূর চোখ যায় কেবল লাল আর লাল। সবুজের ছিটেফোঁটাও নেই সেখানে। খাঁখাঁ করছে চারিদিক, বাদামি আর লালের সীমান্তে আমি একা দাঁড়িয়ে। ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে কোন ফাঁকে যে দল ছেড়ে চলে এসেছি কে জানে! রাস্তাটা পেরিয়ে ওপারে যেতে পারি কিনা ভেবে পা বাড়াতেই কেউ একজন খপ করে চেপে ধরলো আমার কাঁধ। পেছন ফিরে দেখি দলপতি।
“ওখানে কেউ নেই”
“কেউ নেই মানে? কোথায় গিয়েছে সবাই!”
“স্বর্গে। আমরাও যাবো একদিন, হয়তো সবাই নয়। তুমি তো নওই”
“আমার কী হবে?”
“তোমার শরীর দিয়ে স্বর্গের পাঁচিল বানাবো আমরা, দেবদূত কন্ড্রিয়ার নির্দেশ। হা হা হা”
কেউ যে এমন নিষ্ঠুর ভাবে হাসতে পারে দলপতিকে না দেখলে আমি জানতে পারতাম না। ওকে আর কোন প্রশ্ন করা বৃথা। এটুকু যে বলেছে সেই ই অনেক। হঠাৎ একটা শোরগোল ভেসে এলো কানে। পিঠে খোঁচা দিয়ে দলপতি বললো,
“ফিরে চল, কিছু একটা হয়েছে।”
বুরুশ হাতে ছুটলাম আমরা।
যা হয়েছে তা ব্যাখ্যাতীত। বাদামিদের একজন হামাগুড়ি দিয়ে পড়ে রয়েছে। তার সারা গায়ে সাদা সাদা দানার মতো ধুলো। থেকে থেকে মুখ দিয়ে লালা ঝরছে, কুৎসিত সাদা, ঘোলাটে ঘোলাটে লালা। একটু পর পর সে হেসে উঠছে উন্মাদের মতো, গুঙিয়ে গুঙিয়ে বলছে-
“উচ্ছন্নে যাবে সব। সব কিছু সাদা করে দেবো, শীতল করে দেবো, শুষে নেবো সব প্রাণ!”
খানিকটা দূরত্ব রেখে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অন্যেরা।
আমি ফিসফিস করে দলপতিকে জিগ্যেস করলাম,
“ওর কী হয়েছে! এমন করছে কেন?”
“হিমগ্ন ভর করেছে। খবরদার কাছে যাবেনা এখন।”
বাদামিটা ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে আসছে। হঠাৎ করেই, বলা নেই কওয়া নেই, আয়তনে দ্বিগুণ হয়ে গেলো সে। আতংকে লাফ দিয়ে পিছিয়ে গেলো সবাই।
পায়ের তলায় বাদামি ভুবনটা কাঁপতে শুরু করেছে। কিছু একটা আসছে এদিকে, কাঁপুনির যা বহর তাতে মনে হচ্ছে বিশাল আকৃতির কিছু, কিংবা কেউ।
টের পেয়েছে অন্যরাও। হাঁটু গেঁড়ে মাথা নত করে বসে পড়েছে সবাই। হ্যাঁচকা টানে আমার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে চাপা গলায় দলপতি বলল,
“গান গাও।”
শুরু হলো সেই একঘেয়ে গান।
মাথা নিচু বসে থাকার জন্য ভালো করে দেখতে পাচ্ছিনা।মনে হচ্ছে কাদার মতো থকথকে কিছু একটা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে। জিনিসটা অর্ধস্বচ্ছ, নির্দিষ্ট কোন আকৃতি নেই। হঠাৎ সেখান থেকে একটা শুঁড় বেরিয়ে এসে আমাকে আস্টেপৃষ্টে জাপটে ধরলো। আতংকে চীৎকার দিতে গিয়েই শুনতে পেলাম অপূর্ব মিষ্টি একটা কণ্ঠস্বর,
“তুমি বাদামি, কিন্তু বাদামিদের মতো নও। আগে সবুজ ছিলে, কিন্তু সবুজদের সাথে তোমার কতো অমিল! হিমগ্ন তোমাকে পাঠায়নি, তোমার গায়ে কুৎসিত ওই দানা গুলো নেই। কে হে তুমি?”
এই কি তাহলে কন্ড্রিয়া? বিড়বিড় করে বললাম,
“আমি কে তা বলতে পারবো না। কোথা থেকে এসেছি জানিনা, কেবল মনে আছে একটা ভালব টেনেছিলাম, আর সেটা ছিলো সুতোয় বাঁধা।”
“হা হা হা। তুমি খুব মজার। ভেবেছো অর্থহীন কতগুলো শব্দ উচ্চারণ করলেই কন্ড্রিয়া খুশি হয়ে যাবেন?”
“আপনি দেবদ্যূত কন্ড্রিয়া!”
পেছন থেকে ঘষটানো গলায় কে যেন বলে উঠলো,
“ঈশ্বর ক্ষয়িষ্ণু এখন, হিমগ্নের শক্তি বাড়ছে। কন্ড্রিয়ার এখানে আসার সাহস নেই। এটা ওর চাকর মাইটো।”
তাকিয়ে দেখি সেই বাদামিটা, যার উপর নাকি হিমগ্ন ভর করেছেন। আমারই মতো আটকে রয়েছে থকথকে জিনিসটার ভেতর। মাইটো যেন খুব মজা পেয়েছে, দুলে দুলে শরীরে ঢেউ খেলিয়ে বললো,
“খুব যে বড় গলা হয়েছে তোর! হিমগ্ন মাথাটা একেবারে কুরেকুরে খেয়েছেন দেখছি।”
মাইটোর কোন হাত-পা নেই। সে চলছে ঘষটে ঘষটে। আমি আর বাদামিটা চলছি মাইটোর অংশ হয়ে মাইটোর সাথে সাথে, পেছন পেছন বিশজন বাদামি।
আমরা চলে এসেছি সেই ধূসর রাজ্যে। এবড়ো থেবড়ো ঘরটা ছাড়িয়ে চৌকোনো ঘরের দরজায় এসে থামলো মাইটো। ভেতরে সিংহাসন আলো বসে আছেন রূপবতী একজন তরুণী, কেউ বলে না দিলেও আমি বুঝতে পারতাম ইনিই দেবদ্যূত কন্ড্রিয়া। আমাদের দেখে আলগোছে হাত নাড়লেন। বাদামিদের ভেতরে পাঠিয়ে দিয়ে মাইটো আমাদের নিয়ে এলো বিচ্ছিরি দেখতে সেই ছোটো ঘরটায়। আমি বন্দী হলাম, দ্বিতীয়বারের মতো।
পাঁচ।।
বাদামিটাকে এখন আর চেনা যায় না। কুৎসিত একটা মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছে সে। নড়ে না, চড়ে না, ঘরের দেয়ালের এক কোনে সেঁটে থেকে বকবক করে চলে সারাক্ষণ। এখানে কোন আলো নেই, আবার পুরোপুরি অন্ধকারও নয় জায়গাটা, যেন এক অনন্ত গোধূলিলগ্নে আটকে রয়েছি আমি। প্রথম প্রথম খুব চেষ্টা করতাম বাইরে যাবার পথ খুঁজতে। মাংসপিণ্ডটা খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতো কেবল। কেন হাসে জানতে চাইলে একদিন বললো,
“যাবার কোন পথ নেই হে। বরং বলতে পারো, তুমি আর আমি মিলেই একটা পথ এখন। এই পথ দিয়ে একদিন হিমগ্ন যাবেন, ওহ সে এক কাণ্ড হবে তখন!”
এভাবেই দেয়ালের সাথে সেঁটে থাকা একটা মাংস পিণ্ডের সাথে কথা বলে কেটে যায় আমার সময়। নাকি কাটেনা!
একদিন আরেকজন এলো। তারপর আরেকজন, আরও একজন। এই ঘরটার দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে আছে ওরা। কতদিন কেটেছে কে জানে! সবসুদ্ধ সাতজন বাদামি এখন এই ঘরে- সাতটি মাংসপিণ্ড। নতুনদের কাছে শুনেছি তল্লাট জুড়ে নাকি দারুণ দুঃসময় চলছে। সবাই ভয়ে অস্থির, এই বুঝি হিমগ্ন ভর করেন।
এদের মধ্যে কোনটা যে প্রথম এসেছিলো তা আর বুঝতে পারি না। সবগুলোকে একই রকম দেখায়। দেয়ালে সেঁটে থেকে থেকে এরা যেন দেয়ালেরই অংশ হয়ে গিয়েছে। কী যে এক বিষণ্ণ ভুবনে আটকে আছি আমি! এখানে ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, শ্রম নেই, ঘুম নেই। আছে কেবল শূন্যতা - অসীম অকল্পনীয় এক শূন্যতা।
কত পুরনো এই ঘরটা? এই দেয়ালগুলো? কত প্রজন্মের বাদামি প্রাণ মিশে রয়েছে এই সব দেয়াল জুড়ে, দেয়াল হয়ে!
একটা বাদামি এখনো কালেভদ্রে কথা বলে ওঠে। অদ্ভুত একটা কথা বলেছে সে আমাকে। বলেছে ঈশ্বর বলে কিছু নেই। হিমগ্ন নাকি মিথ্যে। স্বর্গ নেই, নরক নেই, এমনকি মাইটো কিংবা কন্ড্রিয়া, যাদেরকে আমি চাক্ষুষ দেখেছি, তারাও নাকি স্রেফ কল্পনা। আমরা আসলে আটকে রয়েছি নিরন্তর বয়ে চলা একটা গল্পের ভেতর- যে গল্পের কোন শেষ নেই।
বাইরের জগতের সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আমার। দেয়ালগুলো ক্রমশ পুরু হয়ে আসছে, ঘিরে ধরছে চারিদিক থেকে। এভাবে চলতে থাকলে পায়চারি করার মতো জায়গাটুকুও আর অবশিষ্ট থাকবেনা আমার। তারপর মৃত্যু, হয় প্রবল চাপে পিষ্ট হয়ে, নয়তো তার আগেই, দমবন্ধ অবস্থায়।
কী আশ্চর্য! এই কথাটা কখনো মাথায় আসেনি কেন! এই বদ্ধ ঘরে শ্বাস যখন নিতে পারছি তখন বাতাস চলাচলের একটা পথ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কোথায় সে পথ? টিম টিম করে টিকে থাকা বাদামিটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“তুমি যে বলছিলে আমি আর তুমি মিলেই একটা পথ, সেই পথটা কোথায় গিয়েছে জানো?”
“কোথায় আবার, স্বর্গে! কিন্তু পথের হদিস দিয়ে দিয়ে তুমি কী করবে?”
“কী করব মানে! এখান থেকে বেরিয়ে যাবো।”
“এখান থেকে কেউ বেরুতে পারেনা।”
“এইরকম একটা কথা এর আগেও একজন বলেছিলো আমাকে। বলেছিলো বড় রাস্তার মোড়টা নাকি পেরুনো যায় না। কিন্তু আমি পেরিয়ে এসেছি ঠিক ঠিক। আমি ওদের মতো নই। আমি তোমাদের মতোও নই। খালি জানা দরকার পথটা কোথায়।”
“তুমি আসলেই আমাদের মতো নও। নইলে কি আর এখনো হাঁটতে পারো, চলতে পারো, ঘাড় ঘুরিয়ে কথা বলতে পারো যখন ইচ্ছে! আচা, গায়ে এখনো জোর আছে তোমার?”
“আছে কিনা বলতে পারবো না, জোর খাটানোর কোন সুযোগ কি আর পেয়েছি এখানে!”
বাদামিটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর হাসলো, কী ভয়াবহ প্রাণহীন সেই হাসি!
“আছে, সুযোগ আছে। কিন্তু মনে রেখো, একটার বেশি সুযোগ তুমি পাবেনা।”
“একটার বেশি দরকারও নেই, কী করতে হবে বলো।”
“আমার মাথাটা টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলতে হবে, পারবে না?”
“তোমার এই সব আবোল তাবোল কথা শোনার ইচ্ছে নেই আমার। পথ যদি না জানো, তবে মুখ বন্ধ করে থাকো। মিশে যাও দেয়ালের সাথে, ঈশ্বরের দোহাই, না না হিমগ্নের দোহাই, উৎকট রসিকতা নেয়ার মতো অবস্থায় আমি নেই।”
“মাথাটা ছিঁড়ে নেয়ার সময় আমার ভীষণ যন্ত্রণা হবে, আমি চিৎকার করবো, পারলে কামড়ে দেবো তোমার হাত, খুবলে নিতে চাইবো তোমার চোখ, আমি ডাক ছেড়ে কাঁদবো, অনুনয় করবো, ভিক্ষা চাইবো, যাতে বেঁচে থাকি আরও একটা প্রহর। তোমার কিন্তু সেসব ভাবলে চলবে না। টানতে টানতে হ্যাঁচকা একটা মোচড় দিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে আমার মাথা। আমার মুণ্ডুহীন ধড় থেকে বেরিয়ে আসবে থকথকে তরল, ভিজে যাবে তুমি, তোমার ওই হাত দুটো দিয়ে তখন দেয়াল থেকে উপড়ে ফেলো আমার শরীর, পথটা পেয়ে যাবে। খুব বেশি সময় নেই, আমি দেয়ালের সাথে দেয়াল হয়ে মিশে গেলেই পথটা আর খুঁজে পাবেনা। তুমি তো আর হিমগ্ন নও! নাকি তুমিই সে? এই, কে তুমি?”
আমি দুহাতের আঙুলগুলো মট মট করে ভেঙে বললাম,
“আমি কে তা জানিনা। কেমন করে কোথা থেকে, কী ভাবে এখানে এলাম মনে নেই। কেবল মনে আছে একটা ভালব টেনেছিলাম, আর সেটা ছিলো সুতোয় বাঁধা।”
তারপর বাদামিটার মাথা শক্ত করে চেপে ধরে দিলাম টান।
ছয়।।
পথটা অন্ধকার, ভেজা ভেজা আর শীতল, ধীরে ধীরে নেমে গিয়েছে নিচের দিকে। আমি অন্ধের মতো সামনের দিকে দিকে এগিয়ে চলেছি, প্রতি মুহূর্তে আতংকে থরথর করে কেঁপে উঠছে আমার শরীর, মনে হচ্ছে এই বুঝি শক্ত দুটো হাত এসে চেপে ধরলো আমার মাথা, টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেললো ধড় থেকে, যেমন করে আমি ছিঁড়ে এনেছিলাম হতভাগ্য ওই বাদামিটাকে।
সামনে একটা আলোর রেখা, ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে ওঠা সেই রেখার দিকে এগিয়ে চলেছি আমি, চারিদিকে অপূর্ব একটা গন্ধ, গন্ধটা আমার খুব চেনা। কোথায় গেলো ভয় ডর! হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ছুটতে শুরু করেছি বলতে পারবো না। স্বর্গের দ্বারপ্রান্তে এসে আমি ঝাঁপ দিলাম।
আমার গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বয়ে চলেছে রুদাইএর নহর।
“স্বর্গে এসে ভালো লাগছে তোমার?”
চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখি কন্ড্রিয়া, মিটি মিটি হাসছেন আমার দিকে তাকিয়ে। তাঁর দৃষ্টিতে স্নেহের ছোঁয়া। কন্ড্রিয়া আমাকে আসতে দিলেন এখানে! কেন?
“ভয় নেই একশ বাইশ। ঈশ্বর না চাইলে এতদূর তুমি আসতে পারতে না।আমার কাজ ছিলো হিমগ্নকে রুখে দেয়া, তিনি যেন স্বর্গের দ্বার অতিক্রম করতে না পারেন।”
আমি খানিকটা ইতস্তত করে বললাম,
“ঈশ্বর কি তাহলে জিতে গিয়েছেন?”
কন্ড্রিয়ার চোখের তারায় রহস্যময় একটা হাসি। এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
“জয় পরাজয় বড় আপেক্ষিক, একশ বাইশ। একটা পর্যায়ে এসে হিমগ্ন জিতবেনই, ঈশ্বরের সাধ্য নেই তাঁকে রোখার। কিন্তু কি জানো, হেরে গিয়েও শেষমেশ জিতে যান ঈশ্বর, প্রতিবার, বারংবার। হিমগ্নের হাতেই তাঁর পতন, কিন্তু সেই পতনেই আবার উত্থান।”
“আমি কি ঈশ্বরের সাথে দেখা করতে পারি?”
কন্ড্রিয়া কোনো জবাব না দিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলেন রুদাইএর আড়ালে। আমার কানে ভেসে আসছে বাদামিদের মুখে শোনা সেই প্রার্থনা সংগীত- নিস্প্রানে থাকে প্রাণ ঈশ্বর আছে তাই…………।
কিন্তু কোথায় তিনি! কোথায় ঈশ্বর?
হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালাম। ধবধবে সাদা রুদাইএর মাঝে, অনেক দুরে, কালো একটা বিন্দু। হাঁটার গতি বাড়িয়ে এখন আমি ছুটছি। পথ যেন আর ফুরায় না।
কতক্ষণ ছুটলাম, অল্পক্ষণ, নাকি অনেকক্ষণ! রাতের আঁধারের মতো কালো, অসম্ভব মসৃণ, নিটোল, নিশ্ছিদ্র, বিশাল একটা স্থাপনার সামনে আমি দাঁড়িয়ে। কোথায় তুমি ঈশ্বর? দয়া করে বেরিয়ে এসো। অনেক পথ ভ্রমণ করে, অনেক চড়াই উৎরাই পাড়ি দিয়ে তোমার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি আমি। আমি কে তা জানিনা। কেবল মনে আছে একটা ভালব টেনেছিলাম, আর সেটা ছিলো সুতোয় বাঁধা।
কোন জবাব এলো না।
একটা ঝাঁকুনি অনুভব করলাম হঠাৎ। একটা দুলুনি, মনে হলো যেন পড়ে যাচ্ছি। পরক্ষনেই টের পেলাম, আমি নই, পড়ে যাচ্ছে স্বর্গটাই।
*****************
একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ মেললাম আমি। কিচির মিচিরের জ্বালায় আরাম করে একটু ঘুমানোর উপায় নেই। হাত দিয়ে ফিঞ্চটাকে তাড়াতে গিয়েই খটকা লাগলো, আমি তো এসেছিলাম ওষুধ ছিটাতে, বেঞ্চে বসে ঘুমিয়ে পড়লাম কখন! যাই হোক, এই নিয়ে পরে ভাববো। আগে কাজটা শেষ করে নেই। দুপুর থেকে বৃষ্টি শুরু হবার কথা, চলবে টানা সাতদিন। এর আগে ওষুধ দিতে না পারলে আর লাভ নেই।
ব্ল্যাক এন্ড ডেকারের মেশিনগুলো ততক্ষণই ভালো যতক্ষণ কাজ করে। একবার বিগড়ে গেলেই শেষ। এটার মনে হচ্ছে সেই দশাই হয়েছে, স্টার্টার কর্ড ধরে এতো টানাটানি করলাম কিন্তু বান্দা নিথর। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো আমার। গাছটার পেছনে অনেক শ্রম দিয়েছি আমি। সবে মাত্র ফুল এসেছে, ফল পেতে পেতে আরও অন্তত তিনমাস। সব এখন যাবে শুঁয়োপোকাদের পেটে।
ভাবতে ভাবতেই চোখ চলে গেলো গাছের দিকে। ফুলগুলো সব উধাও, গাছের নিচে, মাটিতে বিছিয়ে রয়েছে টসটসে পাকা থোকা থোকা ফল! আধ খাওয়া একটা ফলের পাশে পড়ে, রাতের আঁধারের মতো কালো, অসম্ভব মসৃণ, নিটোল, নিশ্ছিদ্র একটি বীজ।
মন্তব্য
নতুন মন্তব্য করুন