এই খ্যাতিমান জীববিজ্ঞানী এবং বিবর্তনবাদী তাত্ত্বিক ছিলেন একজন মুন্সিয়ান সুলেখক যিনি বিজ্ঞান প্রকাশ এবং প্রচারের মডেল হওয়া উচিত ছিলেন।
একজন বিজ্ঞানীকে তার কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে পরবর্তী কথোপকথন অসাধারণ হয়। হাতে কলমে উদাহারনের মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দেন তার দীর্ঘদিনের অর্জন। কিন্তু একই গবেষকের লিখা একটা পেপার পড়তে আপনার কাছে একঘেয়ে লাগবে। কারণ বৈজ্ঞানিক কাগজগুলির বর্ণনা হতে হয় নিরেপেক্ষ এবং আবেগহীন।
বিজ্ঞানের পেপারগুলি নির্দিষ্ট নিয়মে লিখা হয়ে থাকে। এখানে শুধুই বিজ্ঞানের অগ্রগতি প্রকাশ পায়। বর্তমান গঠনপ্রণালীর মানদণ্ডকে পুনঃ গবেষণা ও ফলাফল স্থানান্তরের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এটা পাঠকের কাছে তথ্য পৌঁছে দেবার জন্য কতটা কার্যকর? বিজ্ঞানীরা যে আগ্রহ ও উত্তেজনা নিয়ে গবেষণা করে থাকেন সেটা পাঠকের কাছে কি পৌঁছে দেয়া যায় না? পেপার লিখার পদ্ধতিটা কি এমন করা যায়না যাতে আরও বেশি মানুষ সেটা পরবে এবং ওই বিষয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী হবে?
এই মাসে "অন দ্যা অরিজিন অফ স্পিসিস" প্রকাশের ১৬০ বছর পূর্তি হবে। বইটি প্রকাশের পর অনেক প্রজাতির বিবর্তন ঘটেছে, অনেক প্রজাতি বিলুপ্তও হয়েছে এবং এই নিয়ে গবেষণা করার জন্য বিজ্ঞানের আলাদা শাখাও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই মৌলিক সৃষ্টি আজও পাঠককে আকর্ষিত করে যেমনটা করেছিল ১৬০ বছর আগে। ডারউইন কিভাবে কবুতরের বিষ্ঠা থেকে বীজ সংগ্রহ করেছেন তার বর্ণনা পড়লে আজও আমার গা গুলিয়ে ওঠে একই সাথে প্রকৃতির যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন বইয়ের পাতায় পাতায় সেটা আমাকে মুগ্ধ করে। যেমন এই লাইনটাই ধরা যাকঃ
মানুষের হাড় আঁকড়ে ধরার জন্য সৃষ্টি হয়েছে, ছুঁচের পা গর্ত করার জন্য,ঘোড়ার পা, শুশুকের পাখা(ফ্লিপার), বাদুড়ের পাখা সবকিছু একই ছাঁচে গঠন করা হয়েছে এবং একই হাড় প্রায় একই জায়গায় অবস্থিত কেন হবে?
ডারউইন তার বইয়ের পাঠককে তার চিন্তা এবং পর্যবেক্ষণের মাঝে একটা ভ্রমণে নিয়ে যান। পাঠককে তার প্রতিটা পদক্ষেপ যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন এবং তার বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন। কিন্তু তার আবিষ্কার যদি আজকের বৈজ্ঞানিক রীতিতে প্রকাশিত হতো?
বৈজ্ঞানিকরা প্রতিনিয়ত তাদের কাজ দ্রুত প্রকাশের চাপে থাকেন। পূর্ব ধার্যকৃত টেমপ্লেট অনুসরণের কারণে এই প্রকাশের প্রক্রিয়া আরো দ্রুততর হয়েছে। এই নিয়ম মানার সুবিধা রয়েছে। একই ক্ষেত্রের বিজ্ঞানীরা খুব অল্প সময়ে প্রয়োজনীয় তথ্য বের করে আনতে পারেন।
কিন্তু আমরা এই পদ্ধতিতে ভ্রমণটাই হারিয়ে ফেলছি। একটা গবেষণা কি এখন কয়েকটা বুলেট পয়েন্টে প্রকাশ করা যায়? গবেষণায় ফলাফল লাভ এতো সহজ না। একটা গবেষণা সরাসরি নির্ধারিত ফল প্রকাশ করে না। একটা পেপারের সুন্দর উপসংহারের পিছনে অনেক হতাশা, রাত জাগা, গালমন্দ রয়েছে।
পেপারের এই অংশগুলি বাদ দেয়ার মাধ্যমে গবেষণার ইউরেকা মুহূর্তের গল্পটাই হারিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান এতোটা একঘেয়ে না। গল্প এবং বর্ণনার মাধ্যমে গবেষণা প্রকাশ করা হলে আরও অনেক বেশি বিশেষজ্ঞরা ওই পেপার পড়তে আগ্রহী হবে এবং একে অপরের গবেষণায় সাহায্য করতে পারবে।
গবেষণা সংক্ষিপ্ত প্রকাশের কারণে অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য হারিয়ে যায় যেটা পরবর্তী গবেষকদের সাহায্য করতে পারতো। রান্নার বইয়ের রেসিপির সাথের ছোট ছোট টিপস/নোট মাঝে মাঝে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে।
বিজ্ঞানের বেলাও কথাটি সত্য। ব্যর্থ গবেষণা খুব একটা প্রকাশ করা হয় না। নির্ধারিত ফলাফল লাভের আগে সেটাকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। অথচ এই না বলা গবেষণা আরেকজনের জন্য সফলতা আনতে পারে।
ডারউইন নিজেই বলেছেন,
আমি আশা করি আমি যেভাবে আমার ব্যক্তিগত বিষয় গুলিকে এখানে অন্তর্গত করেছি এর জন্য আমাকে ক্ষমা করা হবে; আমি এটা করেছি এটা বোঝানোর জন্য যে আমি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে তাড়াহুড়া করিনি।
"অন দ্যা অরিজিন অফ স্পিসিস" এখনো বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনের সীমার অনেক বাইরে। এটা অনেকটা জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইয়ের মত, যেহেতু সাধারণ মানুষেরা এটা পড়তে পারে। এটি ডারউইনের কার্যপ্রণালী সুক্ষ ভাবে বর্ণনা করে এবং একই সাথে এটা আলোচনা করে তার চিন্তা ধারা ও তত্ত্ব সম্পর্কে। তার পর্যবেক্ষণকে তার চিন্তাধারার প্রমাণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা কি ডারউইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারবে? তারা কি তাদের গবেষণার মাঝে বস্তুনিষ্ঠ এবং সূক্ষ্মতা ধরে রেখে সাধারণ মানুষের জন্য পাঠ উপযোগী করতে পারবেন? বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার পদ্ধতির পরিবর্তনের সময় এসেছে। আমি সফল-ব্যর্থ সব গবেষণা সম্পর্কে জানতে চাই। বর্ণনামূলক পেপার আরও বেশি গবেষণা এবং সহযোগিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং পদ্ধতি ক্রমশই পরিবর্তিত হচ্ছে এবং বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনকে তার পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে হবে।
তারাশংকর
মূল লেখা:
https://blogs.scientificamerican.com/observations/why-cant-more-scientists-write-like-darwin/
মন্তব্য
ডারউইন একই সাথে আমার প্রিয়তম ভ্রমণ লেখক। ভ্রমণ নিয়ে লিখেছেন একটাই বই, কিন্তু সেই বিগল যাত্রার ডায়েরীর মত ভ্রমণ লেখা সারা বিশ্বে একটিও নেই! কী অপূর্ব প্রকাশ, কী স্বচ্ছ চিন্তা!
লেখা ভালো লাগল-
facebook
গবেষণা সাময়িকীগুলো গবেষকের বিশদ অভিজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে চলে না। গবেষণাপত্রগুলো কেঠো হলেও তাই সমস্যা নেই। কিন্তু গবেষকরা অনেক ক্ষেত্রেই (যদি কাজের চুক্তিতে বাধা না থাকে) নিজেদের কাজের বিশদ অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রবন্ধ বা বই লিখতে পারেন, এবং লেখেনও।
বাংলাভাষী বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাছে একজন পাঠক এবং বাংলা ভাষার প্রসার-প্রত্যাশী হিসেবে আমার চাওয়া, তারা যেন নিজেদের গবেষণার ক্ষেত্র নিয়ে বাংলায় নিয়মিত লেখেন। সচলায়তনে এ প্রসঙ্গে লেখার সুযোগ বহুলাংশে অবারিত, এবং সচলায়তনের পাঠকগোষ্ঠীও নানা মন্তব্যে তাঁদের পাশে থেকে উৎসাহ যোগাবেন বলে মনে করি। বিজ্ঞানীরা নিজেরা যখন কলম ধরবেন, এবং তাঁদের বাংলায় লেখার হাত যখন গতি পাবে, বাংলা ভাষাও প্রাসঙ্গিক নতুন পরিভাষা আর প্রতিশব্দে সমৃদ্ধ হবে।
আপনার কাছ থেকে আরো বিজ্ঞান-প্রবন্ধের অনুবাদ, সেইসাথে আপনার নিজের বিজ্ঞান-ভাবনাভিত্তিক লেখা সচলায়তনে পড়ার আশায় রইলাম।
শুধু মূল প্রবন্ধের অনুবাদ টুকুতেই না থেমে লেখক আরো একটু বিশদ করতেপারতেন লেখাটা। একটা ভালো অবসর ছিলো বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখিকে বিষয় করে একটা লেখার। এই লেখাটাও ভালো লেগেছে, আপনি আরো লিখবেন আশা করি।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
অনুবাদ/লেখা ভালো হয়েছে তারাশংকর।
লিখে যান, ডারউইনের মতো!
নতুন মন্তব্য করুন