করোনার দিনে টিকা আবিষ্কার

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২০/০৩/২০২০ - ১২:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কোভীড-১৯ (COVID-19, Coronavirus disease 2019), একটি মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এই রোগটি প্রথমে চীন এর উহান শহরে ২০১৯ সালে সনাক্ত করা হয়েছিল এবং এর পর থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, ফলে ২০১৯-২০ বৈশ্বিক মহামারীর আকার ধারণ করেছে। কোভীড-১৯ করোনাভাইরাস, এক ধরনের RNA ভাইরাস যার বারবার জেনেটিক পরিবর্তন এর ফলাফল হিসেবে এই নোভেল করোনাভাইরাস এর উৎপত্তি। বলা হয়ে থাকে ২০০২ সালের Severe Acute Respiratory Syndrome (SARS) এবং ২০১২ সালের চীনে Middle East Respiratory Syndrome (MERS) ভাইরাস এর ই পরিবর্তিত আরেক রুপ এই নোভেল করোনাভাইরসা যা এখন কোভিড-১৯ ভাইরাস নামেই পরিচিত। বাংলাদেশ সহ ১৬৬টি দেশে প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ সংক্রামিত হয়েছে যার মধ্যে প্রায় ৯০০০ মৃত্যুবরণ করেছে, ১৯ মার্চ, ২০২০ পর্যন্ত (ডাটা সূত্রঃ https://www.worldometers.info/coronavirus/)। এই রোগের সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, কাশি এবং তীব্র শ্বাসকষ্ট। মাঝে পেশী ব্যথা, এবং গলা ব্যথা ও দেখা যায়।

এই মহামারী মোকাবেলা করা এবং ভবিষ্যৎ সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষে বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা একটি ভ্যাকসিন বা টিকা তৈরির জন্য চব্বিশ ঘন্টা কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে কোভিড -১৯ ভাইরাস এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা দেবে এমন একটি নতুন ভ্যাকসিন, ১৭ই মার্চ ২০২০ এ প্রথম মানব শরীর এ পরীক্ষা করা হয় The US National Institutes of Health এর অধীনে। এছাড়াও অন্যান্য দেশ ও তাদের বিজ্ঞানীরাও একটি সফল ভ্যাকসিন তৈরির লক্ষে তাদের গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কোভীড-১৯ এর ভ্যাকসিন ও কিছু কথা

জেনে রাখা ভাল টিকা আবিষ্কার এর প্রচেষ্টা শুরু করা আর একটি সফল টিকা (ভ্যাকসিন) পাওয়া প্রায় চার থেকে পাঁচ বছর এর গবেষনার ফল।
আপনারা যারা খুব খুশিতে বারবার শেয়ার দিচ্ছেন করোনার টিকা এসে গেছে!!! রোগমুক্তির উপায় খুঁজে পাওয়া গেছে!!!! তাদের জন্য বলছি এত খুশি হবার কোন কারণ নেই। এরকম মহামারীতে টিকা একদম শুরুর ধাক্কা কোনভাবেই সামাল দিতে পারেনা। আমি ইচ্ছে করেই নিরুৎসাহিত করার মত করেই বলছি।

একটি টিকা কাজ করতে হলে অনেকগুলা পরীক্ষার ধাপ পার করতে হয়। সাধারণত ৩/৪ টি ধাপ পার করার পর সেটি বাজারজাত করা হয়। টিকা আবিষ্কার সময় নিয়ে অনেকের অনেক কৌতূহল থেকেই বলছি, জাতীয় পর্যায়ে টিকাদান কর্মসূচী পালন করার মতো একটি টিকা সরবরাহ করা বছরের পর বছর নিরলস গবেষণা এবং আবিষ্কারের শেষ ফলাফল। সারাবছর বিভিন্ন গবেষণাগারে পরীক্ষিত টিকার খুব স্বল্প পরিমানের অংশই লাইসেন্স পেয়ে থাকে এবং বাজারজাত করা হয় সর্বসাধারণের জন্য।

যদি টিকা তৈরির বিভিন্ন পর্যায়কে ধাপে ধাপে ভাগ করা হয় তাহলে

শুরুতেই প্রি-ক্লিনিকাল ধাপ; এই পর্যায়ে ল্যাবে প্রাণীর উপরে গবেষণা চালানো হয়। তার আগে ঠিক করে নেয়া হয় আসলে টিকা টি বানাতে ঠিক কি ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা হবে, অনেক সময় সেটি হতে পারে জীবানুর ই কোন অংশ (বিশেষ করে তাদের কোষ এর বিভিন্ন উপাদান) অথবা কোন রাসায়নিক উপাদান। এরপর প্রাণীদের (গিনিপিগ, ইঁদুর) উপর গবেষণা চালানো হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পরের ধাপ।
ক্লিনিকাল ধাপে, মানুষের মধ্যে টিকাটি প্রথম পরীক্ষা করা হয়। এক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবী অল্পসংখ্যক মানুষ এর উপরই কাজটি করা হয়, এক একজন স্বেচ্ছাসেবী কে সাব্জেক্ট বলা হয়ে থাকে। এটি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে বিভিন্ন ধাপে ধাপে ভ্যাকসিন এর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়।

প্রথম ধাপ; প্রাথমিক পর্যায়ে সরাসরি টিকাটি দেয়া হয় খুব অল্প পরিসরের স্বেচ্ছাসেবীদের উপর। এই পর্যায়ে একজন মানুষকে সেই টিকাটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটুকু দিতে পারছে এবং মানব শরীরে টিকাটি নিরাপদ কিনা তা নির্ধারণ করা হয়। একটি ডোজ দেয়ার পর কিছুওদিন পর পর বিভিন্নভাবে এর কার্যকারিতা খেয়াল করা হয়ে থাকে।

এরপর দ্বিতীয় ধাপে কয়েকশত মানুষের উপর প্রয়োগ এর ফলাফল হিসেবে টিকার ডোজ, রোগপ্রতিরোধ কার্যক্ষমতার সময়, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে কিনা, এবং টিকাদান কর্মসূচীর সঠিক পরিকল্পনা করা হয়। এসব ধাপ শেষ করতে বেশ কয়েকটি বছর চলে যায়।

এরপর তৃতীয় ক্লিনিকাল পরীক্ষাতে সত্যিকারের রোগের অবস্থার বিরুদ্ধে কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য কিছু নির্ধারিত জায়গায় বহু শতাধিক মানুষের উপর পরীক্ষা চালানো হয়। যদি টিকা নির্ধারিত সময়কালে সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা বজায় রাখে তবে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য পণ্য বাজারজাত লাইসেন্সের আবেদন করতে সক্ষম হন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান।

এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে (চতুর্থ ধাপ) টিকাটির নির্দিষ্ট জনসংখ্যার উপর কোন বিরুপ প্রভাব সৃষ্টি করছে কিনা সেটা খোঁজ রাখা হয় এবং কোন অঘটন ঘটলে সেটি সনাক্ত করা এবং পুনরায় পরীক্ষা চালানো হয়। চার থেকে পাঁচ বছর সময় চলে যায় একটি টিকা এর বাজারে আসতে। ২০১৩-২০১৫ সালের ইবোলার কথা মনে আছে? সেই ইবোলার বিরুদ্ধে কার্যকরী টিকা ৫ বছর পর অনুমোদিত হয়ে ২০২০ এ , মাত্র ৫ টি আফ্রিকান দেশে জাতীয় পর্যায়ে দেয়া শুরু করা হয়েছে।

ছবিঃ টীকার ট্রায়ালের ধাপগুলি
(https://blogs.plos.org/absolutely-maybe/2020/03/16/first-in-human-covid-19-vaccines-tales-of-phase-1-clinical-trials-past/)

ছবিঃ ইবোলা ভ্যাকসিন ট্রায়াল
(https://www.who.int/news-room/detail/23-12-2016-final-trial-results-confirm-ebola-vaccine-provides-high-protection-against-disease)

আমরা সবাই জানি বাংলাদেশ এর মত অনুন্নত দেশ এ সবাই জাতীয় পর্যায় এ বিনামুল্যে অনেক টিকা পেয়ে থাকে, কিন্তু কীভাবে পায়?

তাহলে আপনাকে জানতে হবে Gavi (Global Vaccine alliance) এই সংস্থাটির নাম। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর সাথে কাজ করে ফান্ড যোগার করে, সেই টাকা দিয়ে গরীব রাষ্ট্রে টিকা সরবরাহ করতে সাহায্য করে। Gavi, বিনামুল্যে প্রায় ৭৩টি গরীব রাষ্ট্র কে বিভিন্ন রোগের (প্রায় টিকা কিনতে সাহায্য করে থাকে। ম্যালেরিয়া থেকে শুরু করে নিউমোনিয়ার মত প্রায় ৪০টির মত সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টিকাপ্রদান কর্মসূচির জন্য অনুন্নত দেশ গুলোকে Gavi সাহায্য করে থাকে। যেখানে আপাতত ইবোলার টিকা দেয়ার মত ফান্ড যোগার করাই কষ্টকর হচ্ছে, তাহলে ভাবুন এবার করোনার জন্যও কতটা ফান্ড দরকার হবে?

ছবিঃ Pneumococcal vaccine support
(https://www.gavi.org/types-support/vaccine-support/pneumococcal)

সত্যি বলতে করোনার টিকা আসলেই উৎপাদনের সম্ভাবনা কতটুকু হতে পারে?

-- যদিও প্রথম ধাপের কাজ শুরু হয়েছে তবুও এখনো কীভাবে এই ভ্যাকসিনটি আসলেই মানব শরীরে কাজ করবে সেতা নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছে (সূত্রঃ https://www.nature.com/articles/)। হয়ত খুব দ্রুত এর উত্তর আমরা পাব, তবুও প্রথম ধাপের ফলাফল আসতেই US National Institute of Allergy and Infectious Diseases, ধারনা করছে প্রায় তিন মাস সময় লাগবে।

-- সব ধাপের ফলাফল এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করে তবেই এইটি বাজারে আসবে। এরপরও ধারণা করা যাচ্ছে তাতেও এক বছর এর আগে সেটা কেও পাচ্ছেনা। বিভিন্ন মহামারীর ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় বছরখানেক প্রকোপ থাকে এক একটি মহামারীর। এর আগে স্প্যানিশ ফ্লু এর বিস্তার ছিল প্রায় দুই বছর (১৯১৮-১৯২০) পর্যন্ত এবং এতে প্রায় ৫ কোটি জনসংখ্যা মারা যায়।

তাহলে আগামী এক বছর এর মধ্যে এই মহামারীর অবস্থা কি হবে? আমাদের দেশের পক্ষে কি সম্ভব হবে যদি মহামারী না থামে তাহলে সেই টিকা দেশের মানুষ এর জন্য সরবরাহ করা?
নিজের এবং পরিবার এর সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সাধারণ নিয়ম গুলো মেনে চলা ছাড়া আর কোন উপায় আপাতত দেখছিনা।

সূত্রঃ
https://www.ncbi.nlm.nih.gov/books/NBK236428/table/ttt00028/?report=objectonly https://www.historyofvaccines.org/content/articles/vaccine-development-testing-and-regulation
http://www.euvaccine.eu/vaccines-diseases/vaccines/stages-development
https://www.cdc.gov/flu/pandemic-resources/1918-pandemic-h1n1.html


পপি দেবনাথ
অণুজীববিজ্ঞান উপাধ্যায়
নোবিপ্রবি


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটা এরই মাঝে বহু পরিব্যক্তির ভেতর দিয়ে গেছে, এমনটা পড়লাম। প্রয়োগোপযোগী টিকা মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য যে সময় লাগবে, এর মাঝে এই ভাইরাস আরও বহু দফা পরিব্যক্তির ভেতর দিয়ে যেতে পারে (একেক অঞ্চলে এই পরিব্যক্তি একেক রকম হতে পারে)। সেক্ষেত্রে কোনো একক টিকা পুরো পৃথিবীজোড়া মানবসমাজের জন্যে কি কাজে আসবে?

হিমু এর ছবি

প্রাসঙ্গিক খবর

হিমু এর ছবি

প্রাসঙ্গিক আরেকটি খবর

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ পপি। সম্প্রতি ডঃ ফাউচি (Fauci) সম্প্রতি আমেরিকার জন মাধ্যমে বলেছেন ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিন আসতে পারে। তাহলে কি তিনি বাড়িয়ে বলেছেন?

শোনা যাচ্ছে, Favilavir (ফ্লুর ঔষধ), আর Chloroquine (ম্যালেরিয়ার ঔষধ) নাকি বেশ কার্যকরী হচ্ছে। এ ব্যাপারে আলোকপাত করবেন? (সুত্র: https://www.healthline.com/health/coronavirus-treatment#potential-treatments)

উষ্ম আর আর্দ্র জলবায়ুতে করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারেনা বলে শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য সেটা কি সুবিধাজনক হবে? (সুত্র: https://www.accuweather.com/en/health-wellness/new-study-says-high-temperature-and-high-relative-humidity-significantly-reduce-spread-of-covid-19/703418)

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সচলে স্বাগতম! বিজ্ঞান নিয়ে আরো লিখুন!

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।