হর্সশো ব্যাট বা অশ্বক্ষুর বাদুড়টাকে আপনার হাতের তালুতে নিলে দেখবেন, এটা এতই ছোট যে তালুর কিছুটা জায়গা বেঁচে গেছে! আর ওজনে এটা একটা বলপয়েন্ট কলমের চেয়ে একটু বেশি হবে। জীবটার বসত অন্ধকারে। এদের নাকটাও অদ্ভুত, অনেকটা উল্টো করে রাখা ঘোড়ার ক্ষুরের মতো। এই অদ্ভুত নাকের কারণেই তাদের এই অদ্ভুত নাম, হর্সশো ব্যাট,বাংলায় অশ্বক্ষুর বাদুড় বলা যায়। সাধারণত, আমরা এদের পাত্তা দিই না, এরাও আমাদের তেমন পাত্তা দেয় না!
২০১৩ সালে দক্ষিণ-পশ্চিমে চীনের ইউনান প্রদেশে একটি অশ্বক্ষুর বাদুড় ধরা পড়েছিল। জায়গাটা উহান থেকে প্রায় দু‘হাজার কিলোমিটার দূরে। চীনা বিজ্ঞানীরা এর মুখটি মুছে নিয়ে লালা পরীক্ষা করেছিলেন, ভাইরাসের জিনের অন্বেষণে।
সাধারণত, বাদুড়দের ক্ষুদ্র দেহ ভাইরাসের আধার। কিন্তু এই বাদুড়ে একটা ভাইরাস পাওয়া গেল যা গবেষকরা এর আগে কখনো দেখেননি। এটা একধরণের করোনা ভাইরাস ছিল যা দেখতে অনেকটাই সার্স ভাইরাসের মতো। (বলা বাহুল্য, করোনা ভাইরাস কয়েক ধরণের হতে পারে।) সার্স ভাইরাস এক দশক আগে দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং হারিয়ে গিয়েছিল কোন হদিশ ছাড়াই।
বাদুড়ে পাওয়া সেই করোনা ভাইরাসটা সংক্রামিত করেছিল কেবল বাদুড়কেই, মানুষকে নয়। গবেষকরা এর নাম রেখেছিলেন আরএটিজি১৩। তারপর দ্রুতই ভুলে গিয়েছিলেন ব্যাপারটা।
ঠিক একই সময়ে, আরো কিছু গবেষকদল রিপোর্ট করেছিলেন যে,বাদুড়ের করোনা ভাইরাসগুলি প্রায়শই প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা যায়,এবং তাতে একটা বৈশ্বিক মহামারী ঘটার মতো যথেষ্ট হুমকি রয়েছে।
তারপর?
পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরে গেল। চীনা বাদুরের করোনা ভাইরাসের থেকে বেশি ভাববার মতো আমাদের আরো অসংখ্য বিষয় আছে।
এখন এটা খুব স্পষ্ট, আমরা একটি ভুল করেছিলাম।
গত একশো বছরে যে ভাইরাসটি প্রথম বৈশ্বিক মহামারী ঘটাচ্ছে – সর্বনাশের শেষের আগে এটি হয়ত আরো লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেবে, জীবন হয়তোবা কখনোই আর আগের মতো হবে না, জানেন সেই ভাইরাসের জেনেটিক কোড প্রায় ৯৬ ভাগ মিলে যায় আরএটিজি১৩ ভাইরাসের জেনেটিক কোডের সাথে !
“আমরা এই করোনা ভাইরাসগুলি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। এরা প্রজাতি-সীমা অতিক্রম করছিল” অধ্যাপক এডওয়ার্ড হোমস বলেন।
"এটা যে ঘটবে, আমরা তা আগেই জানতাম ।”
আরএটিজি ১৩, অথবা এর খুবই কাছাকাছি ধরণের কোন একটা ভাইরাস খুব ছোটখাট দুটি জেনেটিক বিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে যা ছিল বাদুড়ের রোগের কারণ, তা অভিযোজিত হয়েছে মানুষকেও অসুস্থ করে ফেলার মতো ক্ষমতা নিয়ে।
খুব দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, এরপর পরই এটা আত্মপ্রকাশ করেছে, এক ভুল সময়ে, ভুল এক জায়গায়।
হোমসের ভাষায়, ‘এই ভাইরাসে বিদ্যমান রয়েছে সুন্দর ভাবে অভিযোজিত কিছু মিউটেশন (পরিব্যাক্তি)’ তাঁর প্রকাশনায় তিনি একে আখ্যা দিয়েছেন,“একটি নিখুঁত মহামারী বিষয়ক ঝড়” হিসেবে।
হোমস হলেন ইউনিভার্সিটি অফ সিডনির একজন গবেষক। তিনি সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের জীনতত্ত্ব ও বিবর্তন বিষয়ে একজন বিশ্বসেরা বিশেষজ্ঞ। প্রসঙ্গত, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসই কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী।
তিনি উহানের প্রথম দিককার রোগীদের একজনের শরীর থেকে সর্বপ্রথম ভাইরাসের জীন সিকুয়েন্স করা গবেষক দলের অন্যতম ছিলেন। এই ভাইরাসের উৎপত্তি সম্পর্কে লেখা তাদের নিবন্ধটি এখন বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের ইতিহাসে সর্বাধিক প্রচারিত নিবন্ধ।
তিনি হুনানের সামুদ্রিক খাবার এবং বন্যপ্রাণী বেচাকেনার বাজার ঘুরে ঘুরে দেখেছেন, যেখানে উহানের এই ভাইরাস রোগের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল।
বাদুড়ের অন্বেষণে তিনি চীনের গুহায় ঘুরেছেন যাতে বাদুড়েরা কীসব ভাইরাস বহন করছে তা খুঁজে বের করতে পারেন।
কোভ-২ একটি সার্স এবং মার্সের এর মতোই এক ধরনের করোনা ভাইরাস। এদের নামটিও দেয়া হয়েছে এদের বিশেষ আকৃতির জন্য। অণুবীক্ষণের নিচে ফেললে এদের দেখা যায়, চর্বির একটা ছোট বুদবুদ (bubble) বা পিন্ডের মতো, যার চারপাশে স্পাইকের মুকুট (মানে করোনা) যেটি এরা ব্যাবহার করে এরা কোষে ঢুকে পড়ার জন্য।
প্রাণীদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ভাইরাস আছে। কিন্তু করোনা ভাইরাসগুলির প্রাণীদের থেকে মানুষের মধ্যে চলে আসার বিশেষ সক্ষমতা রয়েছে।
"তাদের এই ক্ষমতা আছেই।" হোমস বলেন।
আমরা জানি না, ঠিক কেন আছে।
২০০৩ সালে সার্সের উত্থান এবং ৭৪৮ মানুষের মৃত্যু একট সতর্ক-সংকেত হিসেবে দেখা উচিত ছিল। অর্থাৎ ভাইরাসগুলি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছে এবং অসংখ্য মৃত্যুর কারণ হচ্ছ।
আমাদের উচিত ছিল সামগ্রিক ভাবে কার্যকরী ভ্যাকসিন এবং ভাইরাস-প্রতিষেধক তৈরি করা যা সমস্ত করোনা ভাইরাসকে প্রতিহত করবে।
এর পরিবর্তে, শুধুমাত্র স্বাস্থসম্মত জীবন যাপন আর ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সার্স কে প্রতিরোধ করা হয়েছিল। সার্স নিরাময়ের জন্য যদিও বেশ কয়েকটি ওষুধ এবং ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছিল, পরবর্তীতে সেগুলোও মূলত পরিত্যক্ত হয়।
সিএসআইআরও’র শীর্ষস্থানীয় বাদুড়-ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ডঃ মিশেল বেকার বলেছেন, “আমরা সম্পূর্ণ আত্মতুষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম।”
“যখন রোগের প্রাদুর্ভাব না ঘটে, তখন এ বিষয়ে গবেষণার অর্থ পাওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে দাড়ায়। লোকজন একরকম মানষিক স্বস্তিতে থাকে। তারা এটিকে আর প্রাসঙ্গিক বলে মনে করে না। "
২০১৩ সালে বাদুড় থেকে পাওয়া ভাইরাসটি মানুষকে সংক্রামিত করতে পারেনি। সার্স-কোভ-২ পারে। কেন?
এর উত্তর খুঁজলে দেখা যায়, ভাইরাসটির জেনেটিক কোডের দুটি ছোট বিবর্তন একটি বিশাল ব্যাবধান গড়ে দিয়েছে।
কোভ-২ দুটি জিনিস করতে চায়: প্রথমত একটি মানব কোষে সংযুক্ত হতে চায় এবং এরপরে এর ভেতরে প্রবেশ করতে চায়। ভাইরাসটি মানব কোষের এসিই২ নামক রিসেপ্টারের (সংগ্রাহক) সাথে যুক্ত হয়। কিভাবে? ভাইরাসটি অনেকটা ছোট অ্যান্টেনার মতো করে কোষের গায়ে লেগে যায়।
এসিই২ রিসেপ্টরগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা যে এরা একধরনের সংকেত শুনার জন্য প্রস্তুত থাকে। যে সংকেতে আমাদের রক্তচাপ পরিবর্তিত হয়।
রক্তচাপের সমন্বয় হওয়া আমাদের ফুসফুসের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ণ। এজন্য আমাদের ফুসফুসের কোষগুলি এসিই২ রিসেপ্টরে আচ্ছাদিত থাকে।
সার্স ভাইরাসও এসিই২ রিসেপ্টরে যুক্ত হতে পারতো। কিন্তু সামান্য জীনগত পরিবর্তনের কারণে কোভ-২ প্রায় নিখুঁতভাবে, সার্সের চেয়ে অন্তত দশ গুণ শক্তভাবে, এই রিসেপ্টরে যুক্ত হতে পারে।
হোমস বলেন, ‘এই কাজটা করার জন্য এটা খুব সুন্দরভাবে অভিযোজিত হয়েছে।‘
কিন্তু কথা এখানেই শেষ নয়। শুধু কোভ-২ কোষের সাথে যুক্ত হলেই তো চলবেনা, এর ভেতরেও ঢুকতে হবে। এখানেই দ্বিতীয় বিবর্তনের ব্যাপারটা চলে আসে।
কোভ-২ স্পাইক দিয়ে আবৃত থাকে। এই স্পাইকগুলো ছোট হারপূন বা বল্লমের মতো কাজ করে। ভাইরাসটিকে কোষের সাথে প্রথমে যুক্ত হতে হবে এবং এরপর হারপুনটিকে ছুড়ে মারতে হবে। এই ছুড়ে মারা হারপুন কোষের পৃষ্ট এবং ভাইরাসকে টেনে একীভুত হতে সাহায্য করে। আর এভাবেই ভাইরাস ঢুকে পড়ে কোষের ভেতরে।
মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক স্টিফেন টার্নার বলেছেন, " হারপুন এলোমেলোভাবে ছুড়লেই তো কাজ হবেনা।"
ভাইরাসটিকে হারপুন তখনই ছুড়তে হবে যখন সে কোষকে সংক্রামনের জন্য নিজে প্রস্তুত থাকে। যদি এর আগে বা পরে ছোড়া হয় তাহলে ভাইরাস আমাদের সংক্রামিত করতে পারবে না।
সময় মত হারপুনটি ছোড়ার জন্য ভাইরাসগুলি আবার নির্ভর করে মানুষের শরীরে থাকা এনজাইম বা উৎসেচকের (উৎসেচক আমাদের শরীরের কিছু বিশেষ ধরণের প্রোটিন)। কিছু উৎসেচকের ক্রিয়ায় ভাইরাস এই হারপুন খুব তাড়াতাড়ি ছুড়ে, আবার কিছু উৎসেচকের কারণে দেরিতে। এসব উৎসেচকের একটি হচ্ছে ফিউরিন, এই ফিউরিন হারপুনটিকে একেবারে ঠিক সময়ে ছুড়তে নির্দেশ দেয়।
এবং আমাদের শরীর অঢেল পরিমাণে ফিউরিন উৎপাদন করে।
টার্নার বলেন, “ভাইরাসটি রোগের কারণ হবে কিনা আপনি বুঝতে পারবেন মূলত এটি ফিউরিনের দ্বারা সক্রিয় হয় কিনা তার মাধ্যমে।“
বার্ড ফ্লুও ফিউরিনের দ্বারা সক্রিয় হয়। আমরা ভাগ্যবান, কারণ ওই ভাইরাসটা কোষের সাথে ঠিকমত যুক্ত হতে পারতো না। কিন্তু কোভ-২ খুব ভালভাবেই কোষের সাথে লেগে যায় এবং একই সাথে ফিউরিনের দ্বারা সক্রিয় হয়। একটা ভাইরাসের বিস্তারে এরচেয়ে ভালো ট্রিগার বা সক্রিয়ক উৎসেচকের আর হয়না।
“এই সমন্বয়টাই একে এত সংক্রামক করে তুলেছে।“ বলেন টার্নার।
কিভাবে বাদুড় বাহিত ভাইরাসটি এত কৌশল আয়ত্ত করল।
বাদুড়ের সাথে এসব ভাইরাসের সম্পর্ক সহাবস্থানমূলক। ভাইরাসরা বাদুড়কে মেরে ফেলতে চায় না, কারণ এতে তাদের বাঁচার মতো জায়গা থাকবে না।
বিজ্ঞানীরা যখন বাদুড় পরীক্ষা করেন, তাঁরা বিভিন্ন ধরণের অনেক ভাইরাস খুঁজে পান। তবে পরিমাণে খুবই কম।
"প্রায়শই বাদুড়ে একটি ভাইরাস খুঁজে বের করা সত্যিই কঠিন" বেকার বলেন।
বিবর্তনের দিকটা চিন্তা করলে ভাইরাসগুলি অত্যন্ত স্থিতিশীল। তারা খুব বেশি বিবর্তিত হয়না।
“তাই একটি বাদুড়ের দেহের মাঝেই আরএটিজি১৩ ভাইরাসটি সারস-কোভ-২ এ পরিণত হয়েছে সে সম্ভাবনা খুব কম।“ বেকার বলেন।
কিন্তু এসব হিসেব বদলে যাবে যদি বাদুড়ের ভাইরাস অন্য প্রাণীতে উঠে আসে।
একটা সম্ভাবনার চিত্র এরকম।
আরএটিজি১৩ ভাইরাসটির মানুষের এসিই২ রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু ভাইরাসটির মধ্যে ফিউরিনের মাধ্যমে সক্রিয় হওয়ার ব্যাপারটা ছিলনা, যা একে সংক্রামক করে তুলতে পারতো।
একটা সম্ভাবনা হচ্ছে, আরএটিজি১৩ বা এর কাছাকাছি ধরণের কোন ভাইরাস বাদুড় থেকে বনরুই (প্যাঙ্গোলিন)-এর দেহে ছড়িয়ে পড়ে। বনরুই হচ্ছে পিঁপড়া খেয়ে বেঁচে থাকা ছোটখাট একধরনের আঁশযুক্ত প্রাণী। ঐতিহ্য বাহী চৈনিক চিকিৎসা ক্ষেত্রে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী।
বনরুইয়ে শরীরে এসিই২ রিসেপ্টরও রয়েছে। এরকম আরো প্রাণী আছে যেমন ফেরেট (ইউরোপীয়ান পোলক্যাট)।
হতে পারে এই প্রাণী বা অন্যান্য কিছু প্রাণী মানুষ ও বাদুড়ের মধ্যবর্তীস্থানে, যাদের মাধ্যম হয়ে এ ভাইরাস মানুষে ঢুকে পড়েছে। তবে এই বিশেষ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মানুষের সঙ্গে বনরুইও সংক্রামিত হয়েছে বাদুড়বাহিত আরেকটি করোনা ভাইরাস দ্বারা, একই সময়ে । এবং সেই ভাইরাসটিও ফিউরিনের মাধ্যমে সক্রিয় হয়।
যদি এই দুই ধরণের করোনা ভাইরাস একই পোষককে সংক্রামিত করে তাহলে এরা আবার একত্রিত হয়ে তাদের নিজেদের জিন অদল বদল করে নিতে পারে।
হয়ত এভাবেই একটি ভাইরাস তৈরি হয়ে গেছে যা একই সাথে এসিই২ রিসেপ্টরে যুক্ত হতে পারে এবং ফিউরিনকে ব্যাবহার করে মানবকোষেও প্রবেশ করতে পারে। আর এভাবেই জন্ম হল সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের। তারপরই হয়ত এটি লাফিয়ে ঢুকে পড়ল উহানের বন্যপ্রাণী বিক্রির বাজারের কাছাকাছি সীমায় থাকা মানুষের মাঝে।
আর উহান হল কোনও ভাইরাসের মানুষের মাঝে সংক্রামিত হওয়ার জন্য একেবারে উপযুক্ত জায়গা। এই শহরে লক্ষ লোকের বসবাস। তার উপরে এটা আন্তর্জাতিক যোগাযোগের একটা কেন্দ্রস্থল। আর ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব হল বছরের ভ্রমণবহুল সময়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে। এরপরেই চাইনিজ বসন্ত উৎসবের সময়কাল।
জন্মরহস্যের এই গল্পটা পরিষ্কার। কিন্তু পুরোটা যে ঠিক এরকমই ঘটেছে তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ প্রথম স্বীকৃত কোভিড-১৯ রোগীর কিন্তু উহানের সেই বাজারের সাথে সংযোগ - সংস্পর্শ ছিল না।
এমনও তো হতে পারে, ভাইরাসটি আসলে বেশ কয়েক বছর ধরেই মানুষের মাঝে ঘাপটি মেরেছিল, এই বৈশ্বিক মহামারী হয়ে আত্মপ্রকাশ করার আগে। যদিও সে সম্ভাবনা খুবই কম।
এটি নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাতে কেবলমাত্র হালকা ঠান্ডা জাতীয় লক্ষণ দেখা দিত। কিন্তু হঠাৎ করেই এতে জীনগত একটি বা দুটি বিবর্তন ঘটে যায়, তাতে সেটি হয়ে পড়ল আরো বেশি সংক্রামক এবং বিপদজনক।
হোমস বলছেন, "আপনি এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারেন না।"
“সেই বাজারের ভূমিকা তাতে আদৌ ছিল কিনা, এই মুহূর্তে এ্টা আসলেই স্পষ্ট নয়। হয়তো আমরা কখনোই এই প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবো না। ”
হোমস বিস্মিত হয়েছিলেন এটা ভেবে যে কত দ্রুত এই সার্স-কোভ-২ ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তিনি ভেবে একেবারেই অবাক হননি যে বাদুড় বাহিত ভাইরাসই এই বিশ্বব্যাপী মহামারীর কারণ।
পরিবেশদূষণ, অবৈধ বন্যপ্রাণীর ব্যবসা (বিশেষত বনরুইগুলো নিয়ে প্রচুর ব্যাবসা হয়), কাঁচা বাজার এবং জলবায়ু সংকট সব মিলিয়ে মানুষ এবং বাদুড় প্রজাতিকে আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
“চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় যে, মানুষ হিসেবে অন্য প্রাণীদের সাথে আমাদের মিথিস্ক্রিয়ার ধরণ বদলাতে হবে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।“ তিনি বলেন, “এবং এক্ষেত্রে অন্য প্রাণীদের আসলে কোন দোষই নেই।“
“বাদুড় হাজার বছর ধরে এই ভাইরাস বহন করে আসছে।আমরা তাদের সংস্পর্শে কিভাবে যাই, সেটা তারা নয়, আমরা পরিবর্তন করেছি।“
তিনি বলেন।
“পুরো বিশ্ব যেন এখন মহামারীর জন্য প্রতীক্ষা করছে - আমরা বিশাল বড় বড় শহরে থাকি, সেখানে গণপরিবহন ব্যাবস্থা রয়েছে। যেন দুর্ঘটনাটি ঘটার অপেক্ষায় ছিল এবং তা ঘটে গেল।“
“একটা সময় যখন পৃথিবী এই মহামারী থেকে আরোগ্য লাভ করতে শুরু করবে, পদক্ষেপ নিতে হবে যেন মানুষ আর বাদুড়ের মাঝে দূরত্বটা বাড়ে যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটতে পারে।“ হোমস বলেন।
“আমাদের এসবের সংস্পর্শে আসা কমাতে হবে। এ ধরণের বাজারগুলিকে বন্ধ করতে হবে।“ তিনি বলেন, “বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য রোধ করতে হবে। আমাদের এসব সংস্পর্শে আসা কমাতেই হবে। এটা খুবই পরিষ্কার।“
অনুবাদক:
রাজর্ষি রায় রাজু
PhD Candidate, Colloid Chemistry, University of Potsdam, Germany
মন্তব্য
সচলায়তনে আরো লিখুন, রাজু। আক্ষরিক অনুবাদের পাশাপাশি আপনার নিজস্ব গবেষণাক্ষেত্র নিয়ে স্বতন্ত্র প্রবন্ধও লিখতে পারেন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, উৎসাহ দেয়ার জন্য। অবশ্যই চেষ্টা করবো।
রাজর্ষি
ভাল লাগলো। মানুষের দিক থেকেতো বটেই,
ভাইরাস হয়েও বিষয়টা দেখা গেল।
তথ্য, উপস্থাপনা এবং
স্বচ্ছন্দ অনুবাদ
সহজে একটা জটিল বিষয়ের ছবি দেখিয়ে দিয়ে গেল।
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য।
আসলে সচলের তানজীদ ভাইয়ের প্রেরণায় কলম ধরা। অনেক ধন্যবাদ উনার প্রাপ্য।
রাজর্ষি
রাজর্ষিদা, আপনার করা অনুবাদ পইড়া ভাল লাগছে। অনলাইনে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখার বাংলা অনুবাদ পড়তে গেলে দুইটা জিনিস খুব চোক্ষে বাজে। প্রথমটা হইতাছে বাংলা বানানে ইংরাজি শব্দের ছড়াছড়ি। আপনার এই লেখা সেই দোষ থিকা পুরাপুরি মুক্ত না, কিন্তু তুলনা করলে বলতে হবে মুক্ত হওয়ার পথে আছে। দ্বিতীয় চোক্ষা-বাজা সমস্যা বানানে। আমি নিজেও যেহেতু বানানে কাঁচা, পরের দোষ ধরা আমারে সাজে না। তারপরও কমু যে বানান ভুল থাকলে পাঠক লেখকের উপর শ্রদ্ধা আর আস্থা হারায়। আপনার লেখায় বানান ভুল তুলনায় কম। কাজেই আপনার উপর আমি ভরসা করতে চাই। বলি, আরও লিখেন। বিজ্ঞান বিষয়ে মসৃণ ঝরঝরা কালিজিরা চাউলের পোলাওয়ের মত লেখা দরকার, বেশি বেশি। ফেসবুকে ঢুকলেই দেখি ধাড়ি ধাড়ি বিজ্ঞান-শিক্ষিত মুরুব্বি লোকজন গেন্দা ফুল নিয়া বাতচিত কইরা লাইক টোকায়। এই বুদ্ধির খরার সময়ে আপনাদের দুই চারজনরে দেখলে আমার মত নাদানও ভরসা পায়। যাওয়ার আগে কইয়া যাই, ভেক্সিনের বাংলা টিকা আর রিসেপ্টরের বাংলা গ্রাহী।
অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার পরামর্শের জন্য।
রাজর্ষি
সচলে স্বাগতম! আবার বিজ্ঞান লেখায় ভরে যাক জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার!
পুনশ্চঃ ছবিগুলো দেখা যাচ্ছে না, মডুরা একটু দেখবেন?
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
বিজ্ঞান লক্ষ্মীর পশ্চিম মন্দির থেকে ধন্যবাদ আপনাকে।
রাজর্ষি
চমৎকার একটি সময়োপযোগী লেখা, আন্তরিক ধন্যবাদ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হরেক রকম প্রাণী হত্যা করে তা ভক্ষন করা মানুষের এক প্রাচীন অভ্যাস। এই বাংলাদেশেই বাদুড় খাওয়ার প্রচলন রয়েছে, এখনও। প্রাণীজ আমিষ গ্রহন থেকে সরে আসার সময় বোধ হয় হয়ে গেছে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
নতুন মন্তব্য করুন