এক লুকোনো স্বর্গের কথা, যেথা সাগর পাহাড় বন একসাথে গাঁথা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ০৮/০৪/২০২০ - ২:৫৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৭ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি কোন এক সময় ছিল তখন। একদিন এলেন ফোন দিয়ে বলল, ‘ঘুরতে যাবে?’ আমি সাথে সাথে রাজি আর কিছু জিজ্ঞেস না করেই বললাম চল যাই। তাই পরদিন সকাল সকাল বাসে করে চললাম Cavite নামের এক জায়গায়। ওখানে এলেনের সাথে দেখা করেই রওনা দিয়ে দিলাম গন্তব্যে । যাওয়ার পথে ও বলছিল যেখানে যাচ্ছি সেটা একধরনের Cove.
Cove হচ্ছে একটু আবদ্ধ টাইপ এর সাগর ঘেরা সৈকত। প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হওয়া, ছোট পাহাড় বা পাথর দিয়ে ঘেরা থাকে। ঢোকার জায়গা সীমিত, শুধু সাগর দিয়ে অথবা অন্য কোন সংকীর্ণ পথে। একটু আলাদা, বলা যায় লুকোনো সবার থেকে। প্রাকৃতিক kiosk বলতে পারেন। আমরা যাচ্ছিলাম Anawangin নামের একটা Cove-এ।

প্রথমে Cavite থেকে zambales নামের প্রভিন্স হয়ে সেখান থেকে ছোট গাড়িতে চড়ে যেতে হবে ঘাটে তারপর নৌকোয় বাকিটা। এই ঘাটে পৌছনোর আগ পর্যন্ত রাস্তাটা ছিল খুব সুন্দর। এখানে একটা কথা বলে নেই, আমাকে যদি কেউ কখনও জিজ্ঞেস করে ফিলিপিনের কোন জিনিসটা সবচেয়ে মিস করি তাহলে আমি এক কথায় বলব, এর পথঘাট আর রাস্তা। সুন্দর গোছানো থাকে রাস্তাগুলো। হাইওয়েগুলো অনেক চওড়া আর তার পাশে আরও অনেকখানি থাকে খালি এরপর Green space মানে গাছগাছড়া লাগানোর জায়গা। ম্যানিলাতেও রাস্তাঘাট অনেক প্রশস্ত আর পরিস্কার। কিন্তু আসল Feel পেতে হলে বের হতে হবে শহরের বাইরে।
আমরা প্রথমে Express way হয়ে অন্য একটা রুটে zambales এর দিকে এগুতে লাগলাম। সবচেয়ে ভাল লাগে যখন যেতে যেতে দেখি বাইরের দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছে। কখনও নদী বা সাগরের পাড় ঘেষে যাচ্ছি, কখনও শুধু চাষের জমি, কখনও পাহাড়ি রাস্তা আবার বিস্তীর্ণ মাঠ। এই যে দৃশ্যপটের পরিবর্তন হচ্ছে থেকে থেকে তা এক অন্যরকম ভালোলাগা।
বাস থেকে নেমে যখন ঘাটের দিকে যাচ্ছি তখন আবার আরেক ধরণের রাস্তা। পুরো গ্রামীণ পরিবেশ , কিছু কিছু ঘরবাড়ি, দোকানপাট, দুরের পাহাড়, ক্ষেতখামার, মাঠ, জলাভূমি। আবার হঠাৎ হঠাৎ রাস্তার বাক পেরোতেই উঁকি দিয়ে যাচ্ছে সাগর। পাঠক এই রাস্তায় যদি কখনও যান তবে আপনার মনের অজান্তেই john denver এর Country road গানটা মনে পরবেই পরবে। এই ধরনের রাস্তার জন্যই মনে হয় গানটা লেখা। রাস্তা নিয়ে এত বলছি কেন ভাবতেই পারেন। আসলে আমার দেশের রাস্তাঘাটের দুর্দশা দেখে, ছোটবেলা থেকে শহরের ভাঙাচোরা , চিপাগলি দেখে বড় হয়েছি একারনেও হতে পারে। যাই হোক না কেন ফিলিপিনের রাস্তাগুলোর প্রতি কেমন যেন একটা প্রেমে পরে গেছিলাম। মাঝেমাঝে গভীর রাতে হাটতে বেরিয়ে পড়তাম । ভাল লাগত হাটতে রাতের নির্জন রাস্তায় । চিৎকার করে গান গাইতে গাইতে হাটতে হাটতে চলে যেতাম সমুদ্রের পাড়ে অথবা কোন পার্কের ধারে। রাতের শহর দেখতাম কিন্তু কখনই দ্বিধা বা ভয় হয়নি এত রাতে বের হতে। আমি নিজের দেশে কখনও এত রাতে বের হওয়া সেফ মনে করিনা । কি আজব ! অন্যের দেশে রাস্তায় বেরিয়ে আমার নিজেকে আরও স্বাধীন লাগত, যেটা কখনও দেশে থাকতে ফিল করিনি। একদিন এক বাঙালি ভাই বলছিল, ‘ভাই এই দেশে কেন জানি রাস্তায় হাটলে নিজেরে রাজা রাজা লাগে’।

যাহোক , ফিরে আসি Country road-এ, এই রাস্তা ধরে এসে পৌছলাম ঘাটে। আসলে এটা ঠিক ঘাট না, একটা সৈকত।এখান থেকে বিভিন্ন রুটে নৌকো চলাচল করে। অনেক নৌকো পাড়ে তোলা, কিছু পানিতে। কিন্তু গাদাগাদি করে রাখা নয়, অনেক প্রশস্ত আর গোছানো ভাবে। আসলে ঘাট বলে আমি জায়গাটাকে খানিকটা অপমান করেছি বলা যায়। সৌন্দর্যের দিক থেকে যদি তুলনা করি তাহলে তা আমাদের সেইন্টমারটিন এর সৈকতের তুলনায় কোন অংশেই কম নয় বরং বেশিও হতে পারে।
ওখানে আগেই ফোনে সব বলা ছিল, দুজন গাইড এসে আমাদের নৌকোয় নিয়ে গেল। এখানকার নৌকো গুলি আমাদের দেশের মত না। চিকন লম্বাটে মাঝখানটায় বসার জায়গা আর দুপাশে বাঁশের ফ্রেম দিয়ে Balance করা । যেতে লাগলাম আমরা আর একটু পর পর ঢেউ এর ছিটায় ভিজতে লাগলাম। একেক জায়গার পানির রঙ একেক রকম। কোথাও কাচের মত স্বচ্ছ, কোথাও হালকা নীল আবার গাড় সবুজ, একটু গভীরে গাড় নীল হতে হতে ধুসর কালো হয়ে গেছে। এক বিচিত্র রঙের খেলা যেন। কিছু পাহাড় এসে ঝুলে পড়েছে পানির ওপর। ওখানে আবার রঙ বেরঙের মাছ আর পানি হালকা সবুজাভ।
প্রথমে আমরা নামলাম একটা ছোট দ্বীপে । দূর থেকে মনে হচ্ছিল একটা পাথর পানিতে ভাসছে, কাছে এসে সেটা একটা পাহাড় হয়ে গেল যার একপাশে ছোট বীচ, এই নিয়েই পুরো দ্বীপটা । লম্বায় ৫০০-৬০০ ফিট আর চওড়ায় অর্ধেকেরও কম। কিন্তু অসাধারন সুন্দর, একদম ছবির মত। সাদা মিহি বালি আর আবছা আকাশী রঙা পানি। পাহাড়টা হয়ত ষাট ফিট উঁচু। দূরের মেইনল্যান্ডের বড় সবুজ পাহাড়গুলোর অবয়ব যোগ করেছিল এক অতুলনীয় পটভূমির। প্রবালের রঙ, আকাশের রঙ, পানির রঙ, সৈকতের রঙ আর তার সাথে মাতাল হাওয়া মিলিয়ে যেন এক অপার্থিব পরিবেশ। একদমই যেতে ইচ্ছে করছিল না ওখান থেকে, দারুণ উপভোগ করছিলাম। কিন্তু নৌকোর ছেলেরা ডাকতে লাগল। দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল, যেতে নাকি আরও ঘণ্টাখানেক লাগবে। তাই তাড়াতাড়ি আবার চড়ে বসলাম নৌকোয় ।
বিকেলের মাঝামাঝি এসে পৌঁছলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। তিনদিকে পাহাড়ে ঘেরা তার মাঝখানে অর্ধচন্দ্রাকৃতির সাদা বালির সৈকত। সৈকতের পাড়ে কয়েকটা বাঁশের কটেজ, মানুষ খুবই কম। সৈকতের পরেই একটা লম্বাটে লেক। অল্প কিছু টুরিস্ট আর কয়েকজন গার্ড। পিক সিজনে নাকি অনেক মানুষ আসে। আমি নির্জনতাপ্রিয়, তাই সময়টা একদম Perfect আমার জন্য।
গাইডদের সাথে আগেই সব প্ল্যানিং করা ছিল। তাবু, আইসবক্স, সাথে কিছু হাড়িপাতিল আর জ্বালানি ওরাই নিয়ে এসেছিল। আমাদের জিজ্ঞেস করল কোথায় ক্যাম্প করব? আমি লেকের পাড়ে সৈকতের কাছাকাছি একটা জায়গা বেছে দিলাম। ওরা তাবু গেড়ে, সব গুছিয়ে দিয়ে চলে গেল। বিকেল প্রায় শেষের দিকে তাই আলো থাকতেই পোশাক বদলে বেরিয়ে পরলাম পাহাড়ে চড়তে। বাম পাশের কোনায় পাহাড়ের চুড়োটা শেষ হয়েছে সাগরে গিয়ে। ট্রেইল দেখে চড়তে লাগলাম ওখানটায়। চুড়োয় উঠে পুরো জায়গাটা এবার ভালো করে চোখে পড়ল। ছোটবেলায় আমাদের প্রকৃতির ছবি দেখার সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো (তখনও ইন্টারনেটের যুগ শুরু হয়নি)। খুব সুন্দর সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ থাকত সেগুলোতে। তন্ময় হয়ে আমি দেখতাম আর ভাবতাম ইশ! একরম কোন জায়গায় যেতে পারতাম । চুড়োটায় দাড়িয়ে আমার সেই ছোটবেলার কথা মনে পরে গেল। মনে হচ্ছিল আমার চারপাশ পুরোটাই একটা বিশাল ছবির ফ্রেম। অবাস্তব লাগছিল সবকিছু, এত সুন্দর !

সবকিছু বেশ ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছিল সেখানটায় দাড়িয়ে। মাঝখানের সৈকত ঘিরে তিনদিকে পাহাড়ের সারি আটকে একটা নৈসর্গিক বাগানের মত। যদি সৈকত থেকে সাগরের দিকে মুখ করে দাড়াই তাহলে সামনে সাগর, দুপাশে পাহাড়, পিছনে আড়াআড়িভাবে লেক, লেক পেরিয়ে পাতলা ঝাউবন এর বাগান, তারপর ঘন জঙ্গল শেষে আবার পাহাড় শুরু। বোঝা গেল এখানে ঢোকার দুটো মুখ, এক সাগর হয়ে আর নয়ত আগলে রাখা পাহাড় ডিঙিয়ে। এখানটা আসলে একটা জ্যাকপট, একসাথে সবকিছুই করা যাবে । সাগরে গোসল, লেকে ঝাপাঝাপি, ঝাউবনে ক্যাম্পিং, বনে বাদারে ঘোরাঘুরি আর পাহাড়ে ট্র্যাকিং। যা ইচ্ছে তাই, All in one যাকে বলে আরকি।
শুকনো হলদেটে আর সতেজ সবুজ রঙের ঘাস আর গাছগুলো মিলেমিশে পুরো পাহাড়জুড়ে তুলির আচর দিয়ে রেখেছে যেন। সাথে আছে আকাশের নীল আর গোধূলির ম্লান আলো। অনেক জায়গায় বেড়িয়েছি আমি কিন্তু নিসর্গ কথাটার মানে বুঝতে পারলাম ওখানে দাড়িয়ে। চুড়োর বাঁপাশে দেখলাম এরকম আরও একটা Cove। আমাদেরটা থেকে একটু ছোট। মানুষজন তেমন দেখা গেল না। আসলে এই অংশটাতে মানচিত্রে বিশাল এক পাহাড়ের রেঞ্জ ভৌগলিকভাবে গড়ে উঠেছে শখানেক মাইল জুড়ে, যার মাঝে এরকম অসংখ্য Cove ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমরা এসেছি সবচেয়ে জনপ্রিয়টাতে। এরকম আরও অনেক কোভ নাকি এখনও unexplored রয়ে গেছে।
আলো থাকতে থাকতে আগুন জ্বালতে হবে তাই নেমে আসলাম। প্রচুর খাবার আর পানি নিয়ে এসেছিলাম আমরা। বালিতে একটা গর্ত করে এর উপর লাকড়ি দিয়ে চুলা জ্বালালাম, পাশে আরেকটা ছোট গর্ত করে জুড়ে দিলাম ওটার সাথে যাতে বাতাসের ফ্লো থাকে আর ভালোভাবে জ্বলে ( বেয়ার গ্রেইলস দেখে শেখা)। চারদিকে কিছু প্রবাল দিয়ে হাড়ি রাখার ব্যবস্থা হয়ে গেল। হাড়িপাতিল ধুতে লেকের পাড়ে গিয়ে দেখি গাইডরা দুটো বড়শি পেতে রেখে গেছে। তখনি বড়শিতে টান দিয়ে দেখলাম কিছু পড়েছে কিনা। প্রথমটায় কিছু ছিলনা, দ্বিতীয়টাতে টান দিয়ে চমকে গেলাম বেশ ভারী কিছু বিধেছে। টানাটানি করে পানি থেকে তুলে দেখি বেশ বড় একটা বান মাছ । খুব মজা লাগলো এই অনাকাঙ্ক্ষিত পাওয়ায়। বেশ কসরত করে ধরলাম ওটাকে। এলেন পুরোটা ভিডিও করছিল ফোনে, করতে করতেই ডাক দিল, ‘look, look at the sky’. তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম, রঙের খেলা তখনও শেষ হয়নি। সূর্য মাত্র ডুবেছে, পুরো পশ্চিম আকাশ বিভিন্ন রঙ দিয়ে মেঘের পরতে পরতে রাঙানো। কোথাও গাড় লাল, কোথাও কমলা, ম্যজেন্ডা, হলুদ আরও কত রঙ। এত সুন্দর সূর্যাস্তও দেখিনি কখনও!
এরপর রান্না করতে লেগে গেলাম। এলেন ভাত আর কিছু মাছ কিনে এনেছিলাম সেগুলো রান্না করতে লেগে গেল। আমি বান মাছটাকে ছিলে পরিস্কার করে একটা কাঠিতে গেথে বারবিকিউ করতে লাগলাম। বেশ বেগ পেতে হল কিন্তু খুব অ্যাডভেঞ্চার-অ্যাডভেঞ্চার লাগছিল। রান্না করতে অনেক্ষন লাগল। খিদে পেয়েছিল অনেক তাই তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করে ফেললাম। বান মাছটা ভালোমতো পোড়া হয়নি যদিও কিন্তু খেতে দারুণ লাগল। খাওয়া শেষে মনে হল আরে পানিতেই তো নামা হল না। যেই ভাবা সেই কাজ চলে গেলাম বীচে , আরেকটা চমক অপেক্ষা করছিল সেখানে। তখন রাত হয়ে গেছে পুরোপুরি, বীচ একদম খালি, মানুষ নেই। লাফ দিয়ে পানিতে নেমেই অবাক, জোনাকির মত আলো জ্বলছে চারদিকের অন্ধকার পানিতে। আলোড়ন দিতেই অসংখ্য আলোর কনা যেন জ্বলে উঠছে আশপাশে। কিছুক্ষন জ্বলেই আবার নিভে যায়, ঠিক জোনাকির মত, পানির নিচের জোনাকি। পরে বুঝলাম এগুলো প্ল্যাঙ্কটন বা ফসফরাস জাতীয় কিছু হবে। যেদিকেই সাতার দিলাম আলোর মিছিল চলল আমার সাথে সাথে, এটাও এই প্রথম দেখলাম।
রাতে সৈকতে শুয়ে আকাশ দেখছিলাম আর ভাবছিলাম কাল কোথায় ছিলাম আর আজ কোথায়! চিরচেনা শব্দ আর দৃশ্য পাল্টে পুরো বিপরীতে। শহরের কোলাহল পাল্টে গেছে পাখির ডাক আর বাতাসের শনশনে, দালান আর skyscraper গুলো পাল্টে গেছে পাহাড়ের আদলে। ওখানে ছিলনা কোন ফোনের নেটওয়ার্ক, না ইন্টারনেট, না ইলেক্ট্রিসিটি। পুরোপুরি আধুনিকতা বর্জিত, আদিম আদিম একটা ভাব। ফোনটা হয়ে গেছিল শুধুই ক্যামেরা, ছবি তোলা ছাড়া কোন কাজ নাই। ফোনে তোলা ছবিগুলো ভালোই ছিল কিন্তু বাস্তবের সাথে অনেক ফারাক। চোখে দেখা সৌন্দর্যের দশ ভাগের এক ভাগও বোঝা যাবে না ওই ছবি দেখে।
মেঘমুক্ত পরিস্কার রাতের আকাশ। কোন চাঁদ ছিল না। আকাশ যে এত বড় আর আকাশে যে এত তারা থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না। জানিনা কেন আকাশটা এত বড় লাগছিল। কোন সাগরপাড়েই আমি এরকম আকাশ দেখিনি। তারায় তারায় ছেয়ে আছে পুরোটা আকাশ, হালকা মেঘের মত মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি খালি চোখে প্রথম দেখলাম। জোছনা নাই তবুও কেমন একটা ম্লান অতিপ্রাকৃত আলোয় ভাসছিল চারপাশ। গাছের মাথাগুলো নড়ছিল আবছা ছায়ার মত, পাহাড়সারির অবয়ব যেন আগলে রেখেছে পুরোটা এলাকা।
আমারা তাবু গেরেছিলাম খোলা একটা জায়গায়। পরে বুঝেছি কি ভুলটাই না করেছি । গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল ঝড়ো বাতাসের আওয়াজে। সাগর পাড়ে সবসময়ই অনেক বাতাস থাকে কিন্তু সেরকম না আবার ঠিক ঝড়ও না। একটু পর পর অনেক জোরে ঝটকা বাতাসের মত আসে আর তাবুটা প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যায় এই অবস্থা। প্রথমে কম ছিল আস্তে আস্তে আরও বাড়তে লাগল। সবচে ভয়ঙ্কর এর আওয়াজটা। ওয়েভ গুলো আসছিল প্রায় দেড় থেকে দু মিনিট পরপর, একটা ওয়েভ শেষ হয় আর তার পরেরটা শুরু হতে হতে এগুতে থাকে। অনেক দূর থেকে শুরু হয় আর আস্তে আস্তে কাছে আসতে আসতে জোরালো হতে থাকে শব্দ। মনে হচ্ছিল কোন দানো ফুসতে ফুসতে এগিয়ে আসছে ঝাপিয়ে পরার জন্য। কি বীভৎস যে সে আওয়াজ তা বলে বোঝান যাবে না। বাতাসের ঝাপটাও অনেক ছিল কিন্তু আমাদের তাবু উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেনি আর সেটাতে ভয়ও পাইনি। অসহ্য লাগছিল শব্দটা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়টা দীর্ঘ হওয়ায় ওই অপেক্ষা করার সময়টা সবচেয়ে অসস্তিকর ছিল। বসে বসে শুনতে হবে শব্দটা আস্তে আস্তে ঘাড়ে এসে ভেঙে পরার জন্য। কি ভীষণ অপেক্ষা ! এছাড়া কিছুই করার নেই। যাহোক শেষরাতে অনেক কমে গিয়েছিল এটুকু মনে আছে ঘুমিয়ে পরার আগে।
পরেরদিন সকালে লেকে গোসল করে হাটতে বের হলাম ঝাউবনের দিকে। লেকটা বেশি প্রশস্ত না বড়জোর দুশ ফিট। সৈকত আর ঝাউবন কে আলাদা করেছে লম্বালম্বিভাবে। এর মাঝে দিয়ে কাঠের সাকো পাড় হয়েই ওপারে ঝাউবন। এখানে দেখলাম কয়েকটা তাবু। বেশিরভাগ মানুষ এখানেই ক্যাম্প করে, কেন করে সেটা কাল রাতেই ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি। ঝাউবন চত্বরটাও খুব সুন্দর। কাঠের কিছু বেঞ্চ বানানো গাছের ফাকে ফাকে আর একপাশে একসারি টয়লেট। একটা কুঁড়েঘর দেখলাম বেশ ছিমছাম, সুন্দর। জঙ্গলের মাঝে একটা ট্রেইল ধরে এগুতে লাগলাম। রাতে কিছু শেয়ালের ডাক শুনেছিলাম এই জঞ্জলেরই বোধহয়। বেশ লাগছিল হাটতে, শনশন বাতাস, পাখির ডাক, বিভিন্ন অচেনা গাছ। শহরের বাস্ততা আর কোলাহল ছেড়ে হঠাৎ এমন পরিবেশ শরীরে আর মনে এক ফুরফুরে অনুভূতি জাগাচ্ছিল বেশ ।

কিন্তু বেশিক্ষণ ঘোরা হল না ফিরতে হবে । গাইডরা হয়ত চলে এসেছে এতক্ষনে আমাদের নিয়ে যেতে। হঠাৎ বুঝতে পারলাম কি ভুলটাই না করেছি। আমি ভেবেছিলাম একদিনের জন্য কাজের ফাকে ঘুরে আসব। আসলে এই জায়গাটা একদিনের জন্য নয়, মিনিমাম ৩-৪ দিন থাকা উচিৎ। থাকতামও কিন্তু খুবই জরুরী কাজ থাকায় আমার আজ ম্যানিলায় ফিরতেই হবে। এত সুন্দর জানলে কখনই এত কম সময় নিয়ে আসতাম না।
আমি ফিলিপিনে ম্যানিলার আশেপাশে অনেক দ্বীপ আর বীচে বেড়িয়েছি। কিন্তু এত কাছে এত অসাধারন পরিবেশ আর কোথাও দেখিনি। পুরো দেশটাই অনেক সুন্দর। প্রায় ৭২০০ এরও বেশি দ্বীপ এখানে। এ জায়গাটার চেয়েও হয়ত আরও সুন্দর জায়গা আছে এখানে । কিন্তু আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর এখনও এটাই, Anawangin Cove.
নৌকোয় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম আর একবার আসতেই হবে এখানে। কিন্তু আফসোস থেকেই গেল , ফিলিপিনে থাকতে আর কখনও যাওয়া হয়নি। আদৃস্ট আমাকে আর কখনও ফিরতে দেবে কিনা তাও জানিনা !

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সচলে স্বাগতম! লেখকের নাম খুঁজে পেলাম না! ঘোরাঘুরি না চলুক, অতীত ঘোরঘুরির স্মৃতিচারণ চলুক। পরবর্তীতে ছবির সাথে ক্যাপশন জুড়ে দেবেন, ভাই। আর ইংরেজি শব্দগুলো চোখে লাগে। পরবর্তীতে বদলে দেয়া যায় কি?

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

Fin এর ছবি

ধন্যবাদ, ইংরেজি শব্দগুলো নিয়ে আমারও ইতস্ততা ছিল। পরবর্তীতে চেষ্টা করব কমিয়ে আনতে।

Fin এর ছবি

বি দ্রঃ প্রথম লেখা তাই ছবিগুলো কিভাবে সাজাতে হবে জানতাম না বলে ধারাবাহিকভাবে সাজাতে পারিনি এবং ক্যাপশন দিতে পারিনি, তাই দুঃখিত। আর ছবিগুলো সাধারন ফোনে তোলা তাই জায়গাটার আসল সৌন্দর্য দয়া করে ছবির মান দেখে বিচার করবেন না, শুধুমাত্র ধারনা দেয়ার জন্য দেয়া। ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।