একটি গিরগিটি ডিম দেয় এবং জীবন্ত বাচ্চা জন্ম দেয়। আমরা মনে করি এটি একটি গুরুতর বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১০/০৪/২০২০ - ১১:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের প্রথম দিকের মেরুদণ্ডী পূর্বপুরুষেরা ডিমের মাধ্যমে বংশধারা বজায় রাখতো, তবে লক্ষ-লক্ষ বছরের বিবর্তনে কিছু প্রজাতি জীবিত বাচ্চা জন্ম দিতে শুরু করে।
মেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রজনে একটি চিরাচরিত দ্বিবিভাজন প্রক্রিয়া রয়েছেঃ প্রজাতি হয় ডিম দেয় অথবা জীবিত বাচ্চা জন্ম দেয়। যাইহোক, জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায়, আপেক্ষিক দৃষ্টিতে যতটা সহজ মনে হয় বিষয়গুলি ততটা সহজ আসলে নয়, এবং কয়েকটি মুষ্টিমেয় প্রাণী রয়েছে যা উভয়ই করে।

এর মধ্যে একটি হচ্ছে তিন পা বিশিষ্ট স্কিঙ্ক (সাইফস ইকুইলিস/Saiphos equalis)। আমাদের সাম্প্রতিক গবেষণায় সুপারিশ হয়েছে যে, ডিম-পাড়া S equalis বর্তমানে ডিম পাড়া থেকে জীবন্ত জন্মদানের দিকে রুপান্তরের প্রক্রিয়ার মাঝে থাকতে পারে। (গিরগিটি, টিকটিকি বা গিরগিটি জাতীয় প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত. গিরগিটি শব্দের বাংলা না থাকায় এখানে বুঝার সুবিধার্থে গিরগিটি ব্যবহার করা হোল।) তাদের অধ্যয়ন করার মাধ্যমে আমরা বিবর্তনকে চোখের সামনে দেখার একটা অনন্য সুযোগ পাচ্ছি।

ডিম থেকে বাচ্চা, এবং আবার ফিরে আসা?

মেরুদণ্ডী প্রাণীর দুটি প্রধান প্রজনন কৌশল রয়েছে। যে প্রাণীগুলি ডিম দেয় তাদের "অণ্ডজ" বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেক মাছের প্রজাতি ডিম পেড়ে ছড়িয়ে দেয় যা বাইরে নিষিক্ত হয়। বাকি ডিম্বাশয়যুক্ত প্রজাতিতে, পাখি এবং কিছু গিরগিটি এবং সাপে, মায়ের ভিতরে ডিম নিষিক্ত হয়, ডিমের খোসা যুক্ত হয় এবং তারপরে ডিম পাড়ে।

প্রজাতির উপর নির্ভর করে, একটি স্বাস্থ্যকর বাচ্চা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির বেশিরভাগই ডিমের কুসুম সরবরাহ করে।

বিপরীতে, "জরায়ু" ভিত্তিক প্রাণী ভ্রূণ অভ্যন্তরীণভাবে বহন করে সম্পূর্ণভাবে বিকশিত না হওয়া পর্যন্ত। ভ্রূণগুলি পুষ্টির জন্য পুরোপুরি কুসুমের উপর নির্ভর করতে পারে বা মা প্রাণী পরিপূরক পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে, কখনও কখনও নাড়ীর (মানুষের মতো) এর মাধ্যমে।

এর শক্ত প্রমাণ রয়েছে যে ডিমের মাধ্যমে প্রজনন আগে হয়েছে। ডিম পাড়া থেকে জীবিত জন্মের জন্য অনেক শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল। এই পরিবর্তনের সাথে কিছু গঠন প্রণালী হারিয়ে গিয়েছে যেমন শক্ত ডিমের খোসা। সাথে সাথে ভ্রূণের বেঁচে থাকার জন্য অন্যান্য পদ্ধতি মা প্রাণী অর্জন করে যেমন ক্রমবিকাশের সময় পর্যাপ্ত পানি এবং অক্সিজেনের সরবরাহ।
সরাসরি জন্মের বিবর্তন ঘন ঘন ঘটে থাকে, সরীসৃপের গ্রুপগুলিতে অন্তর্ভুক্ত করলে অন্তত ১২১ বার হয়েছে।
ডিম পাড়ার বিবর্তনীয় "প্রতিবর্তন(পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়া)" অনেক বিরল, সম্ভবত কারণ ডিম উৎপাদনের জন্য শারীরিক গঠন পুনরুদ্ধার মারাত্মক কঠিন হবে।

কেন দুটোই নয়!

ডিম পাড়ার এবং সরাসরি জন্মের মধ্যে বিশাল পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কিছু প্রজাতি উভয়ই করতে পারে। "বাইমোডাল প্রজনন"(“bimodal reproduction”) নামে পরিচিত এই ঘটনাটি খুব বিরল। সেখানে বিশ্বজুড়ে গিরগিটির ৬৫০০ টিরও বেশি প্রজাতি রয়েছে, সেখানে কেবল ৩ টি প্রজাতি বিমোডাল প্রজনন প্রদর্শন করে।

অস্ট্রেলিয়ায় এমন দুটি পাওয়ায় আমারা যথেষ্ট ভাগ্যবান। আমাদের সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা গ্রুপ, তিন-পায়ের গিরগিটি নিয়ে অধ্যয়ন করে থাকে যাতে আমরা বুঝতে পারি কিভাবে জীবিত জন্ম বিবর্তিত হয়েছে।
উত্তরাঞ্চলীয় এন.এস.ডাব্লুতে, তিন-পায়ের গিরগিটি জীবিত বাচ্চা জন্ম দেয়, কিন্তু সিডনি কাছাকাছি, তারা ডিম পাড়ে। যদিও তারা আলাদাভাবে পুনরুৎপাদন করে, পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে এই গিরগিটি দুইটি একই প্রজাতি।

এমনকি এই প্রজাতির ডিম পাড়া সদস্যগুলিও অদ্ভুত, কারণ ডিমগুলি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য মায়ের মধ্যে বজায় থাকে। ডিম পাড়ার পরে, সাধারণ গিরগিটি ডিম ফুটতে সাধারণত ৩৫ দিন সময় লাগে কিন্তু তিন-পায়ের গিরগিটি এর ডিম ৫ দিনের মধ্যেও ফুটে যেতে পারে।

একটি মহিলা গিরগিটি একই পাত্রে ডিমও পেরেছে এবং জীবিত বাচ্চাও জন্ম দিয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে।

বিভিন্ন প্রজনন পদ্ধতির পিছনে প্রজননশাস্ত্র

একটি প্রাণীর বিকাশের বেশিরভাগ দিকগুলি তার জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তবে প্রতিটি জিন সবসময় সক্রিয় থাকে না। জিনগুলির প্রকাশ বিভিন্ন রকম হতে পারে এবং প্রয়োজন না থাকলে এটা থেমেও যেতে পারে।
একটি ডিম পাড়া গিরগিটিের জরায়ু খালি থাকা এবং ডিম ধরে রাখার মধ্যে অল্প কিছু জিনগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। অন্যদিকে জীবিত জন্ম দেয়া গিরগিটির বেলায় এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওই প্রাণী তখন হাজারটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। বাচ্চাকে যথেষ্ট পানি এবং অক্সিজেন প্রদান থেকে শুরু করে, মা প্রাণীর শারীরিক প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি নিয়ন্ত্রনে রাখা, যাতে সেটা বাচ্চাকে আক্রমণ না করে।

ডিম পাড়া এবং জীবিত জন্মদানের মধ্যে অপ্রত্যাশিত সাদৃশ্য

আমাদের গবেষণায় তিন-পায়ের গিরগিটির ডিম দেওয়া এবং জীবিত জন্মদানের মধ্যে জিন প্রকাশের পরিবর্তনগুলি পরিমাপ করা হয়। আমরা গিরগিটির জরায়ু পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি যে জরায়ু খালি থাকলে জিন কেমন ভাবে প্রকাশিত হয় আর ডিম বা ভ্রূণ থাকলে কেমন হয়।

যেমনটি প্রত্যাশা করা হয়েছিল, জীবিত জন্মদানকারী এস. ইকুইলিস, একটি স্বাস্থ্যকর বাচ্চা উৎপাদন করতে গর্ভাবস্থায় হাজার হাজার জিনগত পরিবর্তনের মাঝে দিয়ে যায়। যার অনেকটাই জীবিত জন্ম দেয়া প্রাণীগুলির মতোই।

ডিম পাড়া এস. ইকুইলিসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনগত প্রকাশ হচ্ছে, এটি ভ্রূণকে মায়ের ভিতরে অনেক লম্বা সময় বিকাশের সুযোগ দেয়। এই জিনগুলি মনে হচ্ছে জরায়ুর পরিবর্তনে সাহায্য করে যাতে ভ্রূণ বড় হতে পারে। যার অনেকটাই জীবিত বাচ্চা জন্ম দেয়া তিন পাওয়ালা গিরগিটিের মতো।

ডিম পাড়ার \"প্রতিবর্তন\" কি যতোটা কঠিন ভাবা হয় তার থেকে সহজ?

আমাদের গবেষণা লব্ধ আবিষ্কারগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ ডিম পাড়া তিন পাওয়ালা গিরগিটি হচ্ছে সত্যিকারের ডিম পাড়া এবং জীবিত প্রাণী জন্ম দেয়ার মাঝের মাধ্যম। আমরা এখন জানি এস. ইকুইলিসের জরায়ুর জিন প্রকাশ জীবিত জন্ম দানকারী প্রাণীর জরায়ুর সাথে বেশি খাপ খায় অন্য ডিম পাড়া প্রাণীর জরায়ুর তুলনায়। এই ফলাফলগুলি হয়তো ব্যাখ্যা করে কিভাবে মেয়ে তিন পাওয়ালা গিরগিটি একই সাথে, একবার গর্ভাবস্থায় ডিম দেয় এবং জীবিত বাচ্চা জন্ম দেয়।
এই ঘটনা প্রমাণ করে ডিম পাড়া থেকে জীবিত বাচ্চা জন্ম দেয়ায় ফিরে যাওয়া হয়তো আগে যতোটা কঠিন ভাবা হয় তার থেকে সহজ। তবে, এটা হয়তো তিন পাওয়া গিরগিটিের মতো প্রজাতির জন্য সীমাবদ্ধ যাদের জীবিত জন্মদান সাম্প্রতিক ভাবে বিবর্তিত হয়েছে।


মূল লেখা এবং ছবিঃ দ্য কনভার্সন


অনুবাদঃ তারাশংকর


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

অনুবাদের জন্য ধন্যবাদ, তারাশংকর।

Oviparous আর Viviparous এর বাংলা বিকল্প "অণ্ডজ" আর "জরায়ুজ" এর পাশাপাশি "অণ্ডপ্রসূ" ("ডিম পাড়া প্রাণী"র সংক্ষিপ্ত বিকল্প) আর "শাবকপ্রসূ" ("জীবিত জন্ম দানকারী প্রাণী"র সংক্ষিপ্ত বিকল্প) হতে পারে কি? ওভিপ্যারিটি আর ভিভিপ্যারিটিকেও সংক্ষেপে অণ্ডপ্রসব আর শাবকপ্রসব বলা যায়।

বাইমোডাল রিপ্রোডাকশন বা উভসারণিক প্রজননের ব্যাপারটা বেশ আগ্রহোদ্দীপক।

একটা ব্যাপার হয়তো আপনিও অনুবাদ করতে গিয়ে খেয়াল করেছেন, স্কিঙ্কের কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই। একটা পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ এই একটি শব্দের (বা শব্দের অভাবের) কাছে এসে আরেকটি ভাষার মুখাপেক্ষী হয়ে রইলো। অনুবাদক হিসেবে এই পরিস্থিতির অবসান কাউকে না কাউকে ঘটাতে হবে। যেহেতু আর কেউ স্কিঙ্কের বাংলা কোনো লেখায় করেছেন বলে আমরা দেখতে পাচ্ছি না, আপনিই কিন্তু উদ্যোগ নিয়ে বাংলা ভাষার এই শূন্যস্থানটা পূরণ করতে পারেন।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

আপনিও কিছু একটা সাজেষ্ট করতে পারেন।

সোহেল ইমাম এর ছবি

চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

বাহ, আরও লিখুন

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

এক লহমা এর ছবি

হাততালি
"একটি মহিলা গিরগিটি একই পাত্রে ডিমও পেরেছে এবং জীবিত বাচ্চাও জন্ম দিয়েছে এমন ঘটনাও ঘটেছে।" - গত বছরের এই ঘটনাটি খুব-ই সাড়া ফেলেছে। প্রাণীটির ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কোন একটি ধরণে জন্ম দেওয়ার যে ধারা এতাবৎ কাল দেখা গিয়েছে, এই ঘটনাটি সেটিকে নূতন প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। তা হলে কি প্রাণিটি একই সাথে অণ্ডপ্রসূ এবং শাবকপ্রসূ অবস্থান গ্রহণ করতে পারে? দেখা যাচ্ছে, পারে ত বটেই, পরিবেশ থেকে পাওয়া সঙ্কেতের ব্যাপারে নিঃসংশয় না হতে পারলে উভয় প্রক্রিয়াই একসাথে চালিয়ে গিয়ে ডিম আর শাবক একই সাথে জন্ম দিতে পারে।
এই প্রাণীটি ডিমের খোলার কাঠিন্য বা পুরুত্বের তারতম্যও ঘটায় ডিমের মধ্যে বাচ্চাকে কতটা বড় করে দিচ্ছে সেটার তারতম্যের উপর।
প্রজনন গবেষণায় অত্যন্ত কাজের প্রাণী হাসি
এমন গবেষণায় যুক্ত থাকতে পারা দারুণ সৌভাগ্যের।
আপনার কাছ থেকে আরো লেখা পড়তে পারার অপেক্ষায় থাকলাম

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।