জাল সার্টিফিকেট দালাল রমজান মিয়া নীলক্ষেতের বিরাট ব্যবসায়ী। কম্পিউটার নামক যন্ত্রটি আসার পর আর তথ্য প্রযুক্তির অবাধ বিস্তারে তার ব্যবসা আরো ফুলে ফেঁপে উঠেছে। আগে শুধু জাল সার্টিফিকেট বানাতেন; আজকাল মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি থিসিস, রিপোর্ট, এসাইনমেন্ট নিয়ে কারবার আরো জমজমাট। রমজান মিয়ার সার্টিফিকেটে কত মানুষের যে চাকরি হলো তার কোন পরিসংখ্যান নাই। তাই রমজান মিয়া বেশ খানিকটা আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন। তবে সবথেকে বড় আত্মতৃপ্তিটা পেয়েছেন অষ্টম শ্রেণী ফেল মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে। চারদিকে এ-প্লাসের ছড়াছড়িতে মেয়েকে গড়ে দিয়েছেন বেশ ক'খানা এ প্লাসের সার্টিফিকেট; পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইএসসি সব কিছুতে এ-প্লাস। আর এই এ-প্লাস দেখেই অল্পশিক্ষিত অথচ বিত্তশালী মধ্যপ্রাচ্য ফেরত পাত্র সোহরাব হোসেন মেয়েটিকে পছন্দ করে। বিয়েথা করে জামাইবাবা সোহরাব হোসেন আবার মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে যায়। মেয়ের ভাল বিয়ে দিয়েও একমাত্র পুত্রটিকে নিয়ে সামান্য অতৃপ্তি রমজান মিয়ার রয়েই যায়। পুত্রধনটি প্রায় উচ্ছন্নেই চলে গিয়েছিল, কাশির সিরাপ খেয়ে খেয়ে নেশা করে একদম শেষ হয়ে যাচ্ছিল, তা দেখে মফস্বলে মামার কাছে পাঠিয়ে দেন রমজান মিয়া। সেখানে ডাক্তারের কম্পাউন্ডারি করে বেশ কিছু এলেম নিয়ে রাজধানীতে ফিরে এলে, রমজান মিয়া পুত্রধনটিকেও জাল সার্টিফিকেট বানিয়ে চিপা গলিতে একখানা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ডাক্তারি চেম্বার খুলে দেন। তখন রমজান মিয়া নিজেকে বেশ ভাগ্যবান মনে করেন, ডাক্তার সন্তানের পিতা হওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়, হোক সে জাল ডাক্তার তবু ডাক্তার তো!
কিন্তু রমজান মিয়া জানেন না যে প্রবাসী জামাই সোহরাব হোসেন সল্প শিক্ষিত হলেও প্রবাসে ফিরে যাওয়ার দুই দিনের মাথায় ম্যাসেঞ্জারে বানান ভুলের সমাহার দেখে আঁচ করতে পারেন এই এ-প্লাসে বেশ কিছু সমস্যা বিদ্যমান! একদিন বেশ করে ধরলে মেয়েটা স্বীকার করে নেয় এ-প্লাস গুলো মিথ্যে এবং জাল। এরপর থেকেই জামাই সোহরাব হোসেন শ্বশুর রমজান মিয়াকে একদম দেখতে পারেন না। এমনকি দেশে ফেরার পর একবারও শ্বশুরকে দেখতে পর্যন্ত যাননি। এতে রমজান মিয়া সামান্য দুঃখ পেলেও করোনা নামক ভাইরাসের আগমনে ছেলের হঠাৎ পসার বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশ খুশি হন। পুত্রধনের নকল ডাক্তারি ব্যবসা আরো জোরদার হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার ডাক্তারি পসরা বৃদ্ধির সাথেসাথে গলা ব্যাথা, সর্দি-জ্বরটাও বেশ বৃদ্ধি পায়। ততদিনে করোনা উপসর্গগুলোও জেনে যাওয়ায় রমজান মিয়ার পুত্রধনটি চেম্বারে মোটা দস্তুরমত কয়েকটা তালা ঝুলিয়ে, দ্রুত ডাক্তারি থামিয়ে, ঔষধ খেয়ে বিছানায় পরে থাকেন। তাতে হয়তো খুব বেশি লাভ হয় না কারণ ভুয়া ডাক্তার পুত্রধনটি সামাজিক দূরত্ব কিংবা পিপিইর কখনোই খুব একটা ধার ধারেননি।
ঠিক তখন মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে যাওয়ার সুযোগ এলে জামাইবাবা সোহরাব হোসেন অনেক দিনের পর শ্বশুর রমজান মিয়ার সাথে দেখা করতে আসে। জামাইবাবা সোহরাব হোসেন শ্বশুর রমজান মিয়া কে একটা নকল করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেটের আবদার করে। কিন্তু লকডাউনে মার্কেট বন্ধ থাকায় কাজটা দূরুহ হয়ে ওঠে, তাই রমজান মিয়া নিয়ত গড়িমসি করতে থাকে। যদিও জামাইর আগমনে সকালে বিকেলে বাজারে গিয়ে জবরদস্ত বাজার করে জামাইকে জামাই আদর করতে ভোলেন না রমজান মিয়া, কিন্তু জামাই নাছোড়বান্দা সার্টিফিকেট ছাড়া অন্যকিছু সে চায় না। অতঃপর রমজান মিয়া খুব ভোরে অন্য সকলের মতো আইনশৃংখলা বাহিনী কে ফাঁকি দিয়ে সাহসের সাথে মার্কেটে রওয়ানা দেয়। একখানা তরতাজা করোনা সার্টিফিকেট বানিয়েই অতঃপর সে বাসায় ফেরে, ফিরেই জাল করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেটখানা তুলে দেয় জামাইয়ের হাতে। জামাই মুগ্ধ হয়ে সার্টিফিকেট দেখে, কারো পক্ষে বোঝাই সম্ভব নয় ইহা একটি জাল সার্টিফিকেট,এ যেন শিল্পীর নিখুঁত কাজ। শিল্পবোদ্ধা যেভাবে পিকাসোর গুয়ের্নিকো কিংবা ভ্যান গগের সানফ্লাওয়ার দেখে তারিফ করে, তেমনি জামাই বাবাও শ্বশুর রমজান মিয়ার কাজের তারিফ করে যায়। খাবার টেবিলে জামাইবাবা কিভাবে এয়ারপোর্টে কিছু টাকা খরচা করে কোয়ারেন্টাইন এড়িয়ে দেশে প্রবেশ করেছে তা বলে, সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পরে। জামাইবাবা সোহরাব হোসেনের মনে হয় হোক মিথ্যে এ-প্লাস, এই এ-প্লাসই আজ কাজে দিল। সত্য এ-প্লাস পেলে হয়তো এমন শ্বশুর পাওয়া যেত না। রমজান মিয়াও জামাই কে খুশি করতে পেরে বেশ খুশি হয়। শুধু পরিবারের নকল ডাক্তার পুত্রধনটি জ্বর আক্রান্ত হওয়ায় এসব রসিকতায় একাত্ম হতে পারে না। পরদিন সকালেই জামাইবাবা মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে বিশেষ ফ্লাইটে যাত্রা করে।
দুই দিন পরে খবর বেরোয় মধ্যপ্রাচ্যের কোন একটি দেশ ভুয়া করোনা পজিটিভ সার্টিফিকেটধারী বাংলাদেশির জন্যে সকল ফ্লাইট বাতিল করেছে। ওই দেশে সম্পূর্ণ এয়ারপোর্ট আবার লকডাউন করা হয়েছে। ফিরতি ফ্লাইটে সকলকে দেশে প্রেরণ করে দেশটি ঘোষণা দেয়, এ-দেশ থেকে তারা নতুন কিংবা পুরাতন কোন ধরনের শ্রমিক'ই আপাতত নেবে না।
ঠিক তখন করোনা পরীক্ষার জন্যে রমজান মিয়া তার পুত্রধনটিকে নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরতে থাকেন। দুঃখের বিষয় তিনি নিজেও জানেন না, তিনি নিজেও করোনায় আক্রান্ত। জামাইর খবর পাওয়ার পর তিনি বুঝতে পারেন না ভুলটা তার কোথায় হলো!? একসময় পুত্র জামাইয়ের করোনা পজিটিভ ঘটনায় দুঃখে আর শোকে স্ট্রোক করেন, করোনা আক্রান্ত হওয়ায় মারা যেতেও খুব বেশি সময় নেন না। তখন ডাক্তাররা তার'ও পরীক্ষা করলে সকলে বুঝতে পারে রমজান মিয়া নিজেও পজিটিভ ছিলেন!
মুন্সী হোসাইন মোহাম্মদ রাহাত
মন্তব্য
রমজান মিয়ার জামাই করোনা পজিটিভ সারটিফিকেট চায় কেন? তার তো দরকার করোনা নেগেটিভ সারটিফিকেট। নাকি?
আহা লক্ষ্য করিনি! ধন্যবাদ পঠনের জন্য। সচলে পুরনো আইডি উদ্ধার অভিযানে ব্যর্থ হয়ছি অতিথি হয়েই লিখতে হয়েছে। শোধরানোর কোন উপায় বোধহয় নেই...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
ধন্যবাদ এমন একটি পোষ্টের জন্য।
করোনাকাল নিয়ে চমৎকার গল্প। ভালো লেগেছে তবে জামাই বাবা সোহরাব হোসেন এর করোনা নিগেটিভ সার্টিফিকেট দরকার
হবে।
গল্পে সমকালকে ধরা ভালো লেগেছে।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
আপনাকে ধন্যবাদ এই পোষ্টের জন্য।
নতুন মন্তব্য করুন