মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুই প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছে। এতদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রপুঞ্জগুলোর এই গতি অন্য গ্যালাক্সিগুলোর সাথে সম্পর্কিত নয়। তবে অতি সম্প্রতি তাঁরা কিছুটা অবাক হয়ে লক্ষ্ করছেন, গ্যালাক্সিগুলো ছুটে চলেছে অন্য কোন গ্যালাক্সির সাথে অদৃশ্য কোন যোগাযোগ রেখে, এবং এই যোগাযোগটা তারা রাখছে বহুদূর থেকেই। এমন অদৃশ্য এই সম্পর্কের ব্যাপারে প্রচলিত মহাজাগতিক মডেলগুলোও কোন ধারণা দিতে পারেনি। কেন এমনটা হচ্ছে? এর পেছনের কারণটা মহাবিশ্বকে নিয়ে আমাদের প্রচলিত ধারণাকেই বদলে দিতে পারে।
আমাদের পৃথিবী যে গ্যালাক্সি বা নক্ষত্রপুঞ্জে অবস্থান করছে, তার নাম মিল্কি ওয়ে (Milky Way) বা আকাশগঙ্গা। মহাবিশ্বে এমন গ্যালাক্সির সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। এই গ্যালাক্সিগুলোর আকৃতিও বিচিত্র- কোনটির আছে সাপের মত অসংখ্য বাহু, কোনটি গোলাকার, আবার কোনটির নির্দিষ্ট কোন আকার নেই।
নিজেদের মধ্যে এত বৈচিত্র্য আর অকল্পনীয় দূরত্ব থাকার পরেও, বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি লক্ষ করেছেন, কয়েকটি গ্যালাক্সি ছুটে চলেছে নিজেদের মধ্যে অদ্ভুত যোগাযোগ রেখে, যেন কোন দানব অদৃশ্য কোন সুতোয় বেঁধে রেখেছে তাদের। দুটো বলকে সুতোয় বেঁধে ছুঁড়ে দিলে যেমনটা দেখা যায়, অনেকটা সেরকম। প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞান এমন কোন যোগাযোগের ব্যাপারে কোন ধারণা দিতে পারে নি।
মাত্র কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত গ্যালাক্সিগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের মহাকর্ষীয় বল দিয়ে একে অন্যকে প্রভাবিত করে। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি লক্ষ্ করেছেন, বহু দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোও ছুটছে নিজেদের মধ্যে অদ্ভুত সামঞ্জস্য রেখে।
এই রহস্যময় সামঞ্জস্যের পেছনের কারণ কোন অতিকায় বস্তু, যা কিনা এই গ্যালাক্সিগুলোকে এক সুতোয় গেঁথে রেখেছে, এমনটাই ধারণা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। অস্তিত্ব প্রমাণিত হলে এটাই হবে মহাবিশ্বে মানুষের জ্ঞাত সবচেয়ে বড় বস্তু। কিন্তু আপাত অদৃশ্য এই বস্তু আসলে কি? এটা কি দিয়ে তৈরি? বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই বস্তু হাইড্রোজেন গ্যাস আর কৃষ্ণবস্তু (Dark Matter) দিয়ে তৈরি। সুতা, চাদর আর গিঁটের আকৃতি নিয়ে এটা জালের মত ছড়িয়ে আছে পুরো মহাবিশ্ব জুড়ে। এখন পর্যন্ত আমরা জানি যে গ্যালাক্সিগুলোর গতি আর জীবনচক্রের বিবর্তনে এই বস্তু বিরাট ভূমিকা রাখে। তবে এর মৌলিক গঠন সম্পর্কে প্রায় পুরোটাই আমাদের অজানা।
গ্যালাক্সিগুলোর এমন অদ্ভুত আচরণ মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের মৌলিক ধারণাগুলোকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। ফলে বিজ্ঞানীরা এই বস্তু সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে ক্রমেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
এ সম্পর্কে জার্মানির লাইবনিজ ইন্সটিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (AIP) এর জ্যোতির্বিদ নোয়াম লিবেস্কিন্ড বলেছেন, “মহাকর্ষ বল, পদার্থ, কৃষ্ণবস্তু (Dark Matter), কৃষ্ণবল (Dark Energy) আর মহাবিশ্বের মৌলিক নীতিগুলো জানার জন্যই বিজ্ঞানীরা এই রহস্যময় অতিকায় বস্তু সম্পর্কে নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন।”
মহাকর্ষ বলের কারণে কয়েকটি গ্যালাক্সি একসাথে মিলে ছোট ছোট গুচ্ছ তৈরি করে, এই ছোট গুচ্ছগুলো মিলে আবার বড় গুচ্ছ তৈরি হয়। আমাদের মহাজাগতিক ঠিকানা, মিল্কি ওয়ে বা আকাশগঙ্গা, এমনই এক গুচ্ছের অংশ। এই গুচ্ছটি আবার বড় আরেকটি গুচ্ছের অংশ, যাকে বলা হয় ভার্গো সুপারক্লাস্টার (Virgo Supercluster)। ভার্গো সুপারক্লাস্টারে এক হাজারেরও বেশি গ্যালাক্সি আছে।
এইসব ছোট গুচ্ছের গ্যালাক্সিগুলো সব সময়ই একে অন্যের ঘূর্ণন, আকৃতি আর কৌণিক গতিবেগকে প্রভাবিত করে, মহাকর্ষ বল দিয়ে। মাঝে মাঝে কিছু গ্যালাক্সি আবার অন্য গ্যালাক্সিকে স্রেফ গিলে ফেলে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, কিছু গ্যালাক্সির আচরণে ঠিক এমনই মিল পাওয়া যায়, যারা কিনা একে অন্যের থেকে বহুদূরে। এতই দূরে যে নিজস্ব মহাকর্ষ বল দিয়ে এদের নিজেদেরকে প্রভাবিত করতে পারার কথা নয়। অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে গত বছর অক্টোবর মাসে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধে দেখা যায়, মহাবিশ্বে এমন শত শত গ্যালাক্সি আছে যাদের ঘূর্ণাবর্তের ধরণ একই, অথচ এরা কিনা একে অন্যের থেকে লক্ষ-কোটি আলোকবর্ষ দূরে, মহাজাগতিক পাল্লাতেও যে দূরত্ব যথেষ্টই বেশি। প্রবন্ধটির প্রধান গবেষক এবং কোরিয়া অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড স্পেস সাইন্স ইন্সটিটিউটের জ্যোতির্বিদ জুন হায়োপ লি বলেন, “এমন ঘটনা সম্পূর্ণ নতুন আর অপ্রত্যাশিত। আমি এর আগে কোন গাণিতিক মডেল বা গবেষণায় এই ঘটনা সম্পর্কিত কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনি।”
লি আর তার গবেষকদল পৃথিবী থেকে ৪০ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে প্রায় ৪৪৫টি গ্যালাক্সির উপর গবেষণা চালান। তাঁরা লক্ষ করেন, যে গ্যালাক্সিগুলোর ঘূর্ণনের দিক পৃথিবীর দিকে সেগুলোর প্রতিবেশী গ্যালাক্সিগুলো পৃথিবীর দিকে ছুটে আসছে। অথচ যে গ্যালাক্সিগুলোর ঘূর্ণনের দিক বিপরীতমুখী, সেগুলোর প্রতিবেশী গ্যালাক্সিগুলো পৃথিবী থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। লি বলেন, “এই অদ্ভুত অন্ত্যমিলের পেছনের কারণটা অবশ্যই কোন অতিকায় বস্তু যার দ্বারা এরা পরষ্পরের সাথে সংযুক্ত। কারণ ছয় মেগাপারসেক (প্রায় দুই কোটি আলোকবর্ষ) দূরে অবস্থিত গ্যালাক্সিগুলোর পক্ষে শুধু মহাকর্ষ বল দিয়ে একে অপরকে প্রভাবিত করা প্রায় অসম্ভব।”
লি আর তার সহকর্মীদের ধারণা, একই ধরণের আচরণ করছে এমন সবগুলো গ্যালাক্সিই কোন আপাতঃ অদৃশ্য অতিকায় বস্তুর অংশ, যে বস্তুটি খুব ধীরে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরছে। তাঁদের মতে এমন কোন বস্তুর পক্ষেই গ্যালাক্সিগুলোর আচরণে এমন সামঞ্জস্য আনা সম্ভব, যদিও তাঁরা মনে করেন এই তত্ত্ব নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে এখনো আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে।
লি এর গবেষকদলের এমন পর্যবেক্ষণ বিজ্ঞানীদের কাছে নতুন, কিন্তু এটাই এমন ঘটনার একমাত্র উদাহরণ নয়। বিজ্ঞানীরা আরো অনেক বেশি দূরত্বের গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যেও এমন নজির খুঁজে পেয়েছেন। ২০১৪ সালে একটি গবেষকদল কোয়াসারের (Quasar) মধ্যে অবস্থিত কৃষ্ণগহ্বর (Black Hole) গুলোর আচরণে অদ্ভুত মিল খুঁজে পান। কোয়াসার হচ্ছে এক ধরণের অতি উজ্জ্বল নক্ষত্রপুঞ্জ। কোয়াসারের পরিধি কয়েকশ কোটি আলোকবর্ষ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বেলজিয়ামের লিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড্যামিয়েন হাটসেমেকারের নেতৃত্বে একদল গবেষক চিলিতে অবস্থিত একটি টেলিস্কোপের সাহায্যে এই ঘটনা লক্ষ করেন। তাঁরা প্রায় ১০০ কোয়াসার থেকে আসা আলোর সমবর্তন (Polarization) বিশ্লেষণ করে এদের কেন্দ্রে অবস্থিত কৃষ্ণগহ্বরগুলোর গঠন ও সজ্জার একটি মডেল দাঁড়া করান। ফলাফল বিশ্লেষণ করে তাঁরা দেখতে পান, ১০০টির মধ্যে ১৯টি কোয়াসারের ঘূর্ণন অক্ষ পরষ্পরের সমান্তরাল, অথচ এরা একে অন্যের থেকে কয়েকশ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। এটাও কোন অতিকায় বস্তুর অস্তিত্বের ইঙ্গিত দেয়। গবেষণা প্রবন্ধটি অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স জার্নালে প্রকাশিত হয়।
হাটসেমেকার বলেন, “গ্যালাক্সিগুলোর ঘূর্ণন অক্ষের সামঞ্জস্যতা অন্য কিছু ক্ষেত্রেও দেখা যায় (যেমনঃ কসমিক ফিলামেন্টের সাথে সামঞ্জস্য), তবে তা ঘটে আরো অনেক ছোট পরিসরে।” তিনি জানান, তাত্ত্বিক গবেষণাগুলোও এই ঘটনার পেছনের কারণ হিসাবে কোন অতিকায় বস্তুর অস্তিত্বেরই ইঙ্গিত দেয়। তবে তিনি এও বলেন যে, “কেন গ্যালাক্সিগুলোর ঘূর্ণন অক্ষ ওই অতিকায় বস্তুর ঘূর্ণন অক্ষের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলেছে, তার কোন ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি।”
এই বস্তুগুলোর রহস্য উন্মোচিত হলে তা মহাবিশ্বের মৌলিক নীতিগুলোর অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। প্রচলিত এইসব তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের উপাদানগুলো বৃহৎ পরিসরে মূলত একই ধরণের আচরণ করে। তবে হাটসেমেকার আর তাঁর গবেষকদলের ধারণা, এমন অকল্পনীয় দূরত্বেও কোয়াসারগুলোর ঘূর্ণন অক্ষের এমন সামঞ্জস্য এই তত্ত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। তবে তাঁরা আরো বলেন, তাঁদের পর্যবেক্ষণ প্রচলিত মৌলিক তত্ত্বগুলোর উপর সত্যিকার হুমকি কিনা, সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এমন আরো বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
এই মূহুর্তে কোয়াসারগুলোর ঘূর্ণন অক্ষের সামঞ্জস্যের পেছনের কারণ সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না কারণ এই ব্যাপারে যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ কৌশলের অভাব রয়েছে। হাটসেমেকার বলেন, “আমাদের পর্যবেক্ষণগুলো মূলত পরিসংখ্যান নির্ভর। এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে আরো অনেক তথ্যের প্রয়োজন।” ভবিষ্যতের রেডিও টেলিস্কোপগুলো (যেমনঃ স্কয়ার কিলোমিটার অ্যারে-Square Kilometer Array) এই ব্যাপারে আরো তথ্য প্রদান করতে সক্ষম হবে বলে তাঁদের ধারণা।
মহাবিশ্বের প্রচলিত মৌলিক তত্ত্বগুলোকে হুমকির মুখে ফেলছে এমন উদাহরণ শুধু কোয়াসারের ঘূর্ণন অক্ষ নয়। বামন গ্যালাক্সিগুলোর আচরণ মিল্কি ওয়ে বা আকাশগঙ্গার মত বড় গ্যালাক্সিগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই ঘটনাকেও প্রচলিত তত্ত্বগুলোর উপর আরেক হুমকি হিসেবে দেখছেন বিজ্ঞানীরা। বামন গ্যালাক্সিগুলোর এমন আচরণকে বর্তমান ল্যাম্বডা-সিডিএম মডেলের (ΛCDM model) গলার কাঁটা হিসেবে দেখা হয়। ল্যাম্বডা-সিডিএম মডেল হচ্ছে বিগ ব্যাং থেকে এখন পর্যন্ত সময়কালের ঘটনাবলির একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। এই মডেল অনুযায়ী বামন গ্যালাক্সিগুলো তাদের জীবনকালের এক পর্যায়ে বড় গ্যালাক্সিগুলোকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করবে, তবে তাদের কক্ষপথ হবে বিক্ষিপ্ত। তবে গত দশকের বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণনরত বহু বামন গ্যালাক্সির কক্ষপথ বিক্ষিপ্ত নয়, বরং সুসজ্জিত এবং একে অন্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শুরুতে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল এমনটা শুধু মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, তবে পরবর্তীতে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা বামন গ্যালাক্সিগুলোর ক্ষেত্রেও একই ধরণের সুবিন্যস্ত কক্ষপথের দেখা মিলেছে। এমনকি ২০১৫ সালে সেন্টরাস-এ (Centaurus-A) গ্যালাক্সির ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। সেন্টরাস-এ গ্যালাক্সিটি মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সি থেকে এক কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।
ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী অলিভার মুলারের মতে, “এই আবিষ্কারগুলো এটাই প্রমাণ করে যে মহাবিশ্বের প্রচলিত মৌলিক নীতিগুলোতে ত্রুটি রয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা তিনটি গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করেছি, তিনটিতেই এমন প্রমাণ মিলেছে। পরিসংখ্যানগত দিক থেকে তিনটি পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট নয়। তবে যেহেতু এখন পর্যন্ত করা তিনটি পর্যবেক্ষণেই এমন প্রমাণ মিলেছে, সুতরাং ঘটনাটি বৈশ্বিক হওয়ার ভাল সম্ভাবনা আছে।”
২০১৫ সালের আরেকটি গবেষণায় লিবেস্কিন্ডের গবেষকদল ইঙ্গিত দেন যে, মহাজাগতিক জালের সুতাগুলো গ্যালাক্সিগুলোর বিন্যাসের কারণ হতে পারে। এই ব্যাখ্যাটি ল্যাম্বডা-সিডিএম মডেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে এখন পর্যন্ত এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। লিবেস্কিন্ড আরো বলেন, “আপনার বৈজ্ঞানিক মডেল হতে হবে নিশ্ছিদ্র। এতে সব ঘটনার যথাযথ ব্যাখ্যা থাকতে হবে। আপনার মডেল যদি শুধু একটি ঘটনার ব্যাখ্যা দিতেও ব্যর্থ হয়, তবে আপনার মডেল সংশোধন করতে হবে অথবা বাতিল করতে হবে। এখানেই বিজ্ঞানের সৌন্দর্য।”
এমন চাঞ্চল্যকর পর্যবেক্ষণগুলো লাইবনিজ ইন্সটিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (AIP) এর শোয়ার্জশিল্ড ফেলো মার্সেল পাওলোস্কির মত অনেক গবেষককেই তাদের গবেষণার মূল বিষয় হিসেবে নির্বাচন করতে উদ্ধুদ্ধ করেছে। পাওলোস্কি বর্তমানে অতিকায় ৩০ মিটার ব্যাসার্ধের টেলিস্কোপগুলোর পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যের জন্য অপেক্ষা করছেন। এই টেলিস্কোপগুলো অন্য বৃহৎ গ্যালাক্সিগুলোকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা বামন গ্যালাক্সিগুলোর আচরণে সামঞ্জস্য খুঁজবে। পাওলোস্কি বলেন, “আমাদের এখন উচিত হবে বড় আকারের গ্যালাক্সিগুলোর উপর আরো বেশি গবেষণা চালানো। বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কের কারণেই জ্যোতির্বিদ্যার এই শাখাটি এতটা বিস্তৃত হয়েছে। পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্য উপাত্তও কতটা শক্তিশালী হতে পারে তা উপলব্ধি করতে পেরে আশ্চর্য হচ্ছি।”
আমাদের গ্যালাক্সিকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকা বামন গ্যালাক্সিগুলোর সুবিন্যস্ত কক্ষপথ হোক কিংবা শতকোটি আলোকবর্ষ দূরে থাকা কোয়াসারগুলোর ঘূর্ণন অক্ষের রহস্যময় অন্ত্যমিল হোক, বিজ্ঞানীরা এখন নিশ্চিত যে গ্যালাক্সিগুলোর আচরণ পর্যবেক্ষণ করেই মহাবিশ্বের এই আপাতঃ অদৃশ্য অতিকায় বস্তর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। টেলিস্কোপে ধারণ করা মহাবিশ্বের দূর প্রান্তের ছবিগুলোতে আমরা যে গ্যালাক্সিগুলো দেখি, তাদের আচরণের পেছনে দায়ী যেসব শক্তি, সেসব সম্পর্কে এখনো আমাদের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। বিজ্ঞানী মুলার বলেন, “আমার কাছে সবচেয়ে উৎসাহব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে আমরা এখনো এই গবেষণার একদম প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। তাই আমি এই ব্যাপারে জানতে অত্যন্ত উৎসাহী।”
মূল প্রবন্ধঃ www.vice.com
মন্তব্য
লেখাটা এ প্রসঙ্গে আরো জানতে আগ্রহ উসকে দিলো। সচলায়তনে আরো লিখুন, ইহাম। আপনার করা অনুবাদ সুপাঠ্য। আগ্রহ আর সময় যদি পান, অনুবাদের বাইরে মৌলিক লেখাও লিখুন।
গ্যালাক্সির বাংলা ছায়াপথ; নক্ষত্রপুঞ্জ বলতে কনস্টেলেশন বোঝায়।
ধন্যবাদ। নিজেকে মৌলিক লেখা লিখার যোগ্য মনে করি না এখনো। তবে অনুবাদটা চালায় যাওয়ার চেষ্টা করবো। গ্যালাক্সি আর কনস্টেলেশনের ব্যাপারটা উল্লেখ করার জন্য ধন্যবাদ।
সচলায়তনে শিক্ষানবিশ নামে একজন আগে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে গুছিয়ে লিখালিখি করতেন। অনেক দিন উনার কোন লিখা পড়ি না। উনি কোয়েসারের একটা মজার বাংলা করেছিলেন "বেতারকা"। এরকম শব্দগুলি ব্যবহার হলে বিজ্ঞানের শুকনা লিখাতেও একটু রসের সঞ্চার হয়।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। জ্যোতির্বিজ্ঞানের টার্মগুলোর বাংলা পরিভাষার ব্যাপারটা আসলেই একটু জটিল। কোন প্রমিত রীতি না থাকায় প্রায়ই ঝামেলায় পড়তে হয় এটা নিয়ে। তবে নিজস্ব পরিভাষা যেহেতু কিছুটা ব্যবহার করতেই হয়, তাতে একটু রস মিশিয়ে দিলে মন্দ হয় না আসলে। মাথায় থাকবে ব্যাপারটা।
Dark energy কে কৃষ্ণ শক্তি বললে ভাল হয় কারণ "কৃষ্ণবল" বললে ব্যাপারটার অর্থ কিছুটা ভিন্ন হয়ে যায়, মানে বল=ত্বরণ×ভর চলে আসে আর এনার্জি আর ফোর্সের এককটাও তো ভিন্ন। তবে লেখা চমৎকার। জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয় আমার বড্ড পছন্দের, ওখানে গ্রিন মেশিন নামে একটা অরকেস্ট্রা গ্রুপের Rage Against the Machine এর Killing in the name of কাভার শুনেছিলাম সেই থেকে আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি মাথায় ঢুকে গেছে কাকতালীয়ভাবে কিছুদিন পর এক বাল্যবন্ধু সেখানে কম্পিউটার সাইন্সে পিএইচডি করতে চলে যায়! কেউ কাভারটা শুনতে চাইলে: https://youtu.be/gqG4oSfQYIY
কমেন্টটা বড্ড ব্যক্তিগত হয়ে গেল। ভাল লেখা গুলো আসতে দিন!
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। যেমনটা বললাম আসলে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের টার্মগুলোর পরিভাষা নিয়ে প্রায়ই ঝামেলায় পড়ে যাই, একটা প্রমিত রীতি দরকার ছিল। বল আর শক্তির ব্যাপারটা মাথায় থাকবে।
মেসন নিয়ে চমৎকার তথ্য দিলেন। আমি নিজেই জানতাম না। জর্জ মেসন খুব পরিচিত কোন বিশ্ববিদ্যালয় না, কেউ এমনিতেই এটাকে চেনে দেখে আরো ভাল লাগলো। আবারো ধন্যবাদ।
রহস্যময় গা-ছমছমে কথাবার্তা সব। পড়তে ভালো লাগে, কিন্তু বেশীটাই ঐ উপর দিয়ে চলে যায়। তবু যে টুকু আভাষ পেলাম তাই আপ্লুত করে রাখে। আরো আসুক এমন লেখা।
--------------------------------------------------------
এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।
এক লহমার... টুকিটাকি
ধন্যবাদ। আমি নিজেও পুরো লেখাটা বুঝে লিখেছি বললে মিথ্যা বলা হবে। তবে যতই কম বুঝি ততই আগ্রহ বাড়ে, সেই আগ্রহ থেকেই লেখা।
বিজ্ঞানের টারমগুলির প্রমিত বাংলা আগে আসবে পরে আমরা লিখব এরকম চিন্তা করলে সারা জীবন ইংরাজিতে লিখালিখি করতে হবে, কারন করতৃপক্ষের ছেলেমেয়েরা এখন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালিখা করে। বাংলা নিয়া কারওই কোন মাথাব্যাথা নাই। লেখকদেরই চিন্তা ভাবনা করে বাংলা বানাতে হবে। এক লেখক আরেক লেখকরে শব্দ যোগাইতে যোগাইতে আগাইতে থাকেন।
ধন্যবাদ। এভাবেই আগানোর চেষ্টা করছি। আমার ব্যবহার করা পরিভাষাগুলোও কেউ না কেউ প্রথম ব্যবহার করেছিলেন।
আপনার অনুবাদ করা প্রবন্ধটি পড়ে ভাল লাগল।
আমরা যে ভাষায় কথা বলি, সব সময় সে ভাষায় লিখি না। বিজ্ঞান রচনার ক্ষেত্রে এ কথা স্পষ্ট। এটি বাংলা ছাড়াও ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার লেখকদের ক্ষেত্রেও খাটে। পুস্তকী বা লেখ্য ভাষার কাজ পাঠকের চোখ দিয়ে ঢুকে মন জয় করা, আর কথ্য ভাষার কাজ পাঠকের কান দিয়ে ঢুকে মন জয় করা। লিখতে বসে দুটিকে পৃথক রাখতে মন অনেক সময় সায় দেয় না, তাই মুখের কথা কলমে চলে আসে। আপনার এ প্রবন্ধে আপনি তিপ্পান্নবার গ্যালাক্সি লিখেছেন, আর তিনবার লিখেছেন নক্ষত্রপুঞ্জ (যদিও উপরে একজন সঠিক বলেছেন, এটা ছায়াপথ হবে)। প্রতিদিনের জীবনে আমরা ছায়াপথ বলার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছি, ফলে সুন্দর লিখিত বাংলা থেকে আমাদের লেখাও বঞ্চিত হচ্ছে। আপনি যদি নিজেকে একবার এই বিশ্বাসে স্থির করতে পারেন যে গ্যালাক্সি শব্দটা নিজের লেখায় আর ব্যবহার করবেন না বরং ছায়াপথই লিখবেন, তাহলে শব্দটা পাঠককেও আত্মবিশ্বাস যুগাবে।
শুধু সমালোচনার স্বার্থে সমালোচনা না করে দরকারি কথাটা কি চমৎকারভাবে বললেন! অবশ্যই মাথায় থাকবে আপনার পরামর্শ!
চমৎকার লেখা এবং যথেষ্টই আগ্রহ উদ্দীপক। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজবোধ্য করে তোলার জন্যই এরকম অনুবাদ দরকার। আবার যখন বাংলা প্রতিশব্দ ব্যবহার করার ব্যাপারটা আসে তখন আবার দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিশব্দগুলো এতোটাই নতুন যে পড়ে গেলে ভেতরে কোন ছবি তৈরী হয়না, লেখার বক্তব্যও বোধে আসতে চায়না। বাংলায় বিজ্ঞানের নতুন প্রতিশব্দ প্রচলন আর বিজ্ঞানকে সহজবোধ্য করে বাংলা ভাষাভাষীদের উপস্থাপনটা কেন যেন একসাথে যায়না। মনে হয় বাংলায় লিখলাম সহজ করে বলবার জন্য আবার কম প্রচলিত বা নতুন প্রতিশব্দ দিয়ে সেই সহজবোধ্যতার একটা অন্তরায়ও তৈরী করে দিলাম। ফল হলো বিজ্ঞান নিয়ে যারা কিছুটা আগ্রহী তারা এ পথ মাড়াতেই আর আগ্রহী হননা। আসলে বিজ্ঞান নিয়ে লেখা এতো কম হয় আর এক একজন লেখক কালেভদ্রে যে কয়টা নতুন প্রতিশব্দ আবিস্কার বা রচনা করেন তা সবার দৃষ্টিতে আসেনা। ফলে এই শব্দগুলো আমাদের অচেনাই থেকে যায়। আবার এটা না করলে ইংরেজি শব্দের ওপরই নির্ভরশীল থেকে যেতে হয়, নিজেদের ভাষাটা যে এগোবে সে মুহূর্তটা পিছিয়েই যেতে থাকে। আসলে আমার মনে হয় কোন সহজ পথ নেই। লিখতে লিখতেই বিজ্ঞানের পরিভাষাটা সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। তবে অনেকেই আছেন যারা একটু কাজটা এগিয়ে নিতে পারেন। যেমন সচলায়তনেই অনেক বিজ্ঞান বিষয়ক রচনায় বাংলা শব্দ ব্যবহারের উদাহরণ আছে এবং এই ব্লগের অনেক বিজ্ঞান বিষয়ক লেখার লেখকই একটা বিজ্ঞান পরিভাষা কোষ রচনার কাজে এগিয়ে আসতে পারেন। এতে করে লেখক পাঠক উভয়েই এই আপাত কঠিন বাংলা প্রতিশব্দ গুলোর সাথে পরিচিত হয়ে ওঠার সুযোগ থাকবে।
---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।
যে পাঠক নিজের ভাষায় একটা নতুন বা কম প্রচলিত শব্দ দেইখা পিছায় যায়, সে বিজ্ঞান নিয়ে লিখা পড়লেই কি আর না পড়লেই কি? আর বাংলার জায়গায় ইংরাজি রাইখা দিলেই যে ঐ পাঠক সব বুঝে যাবে, তারই বা কি নিশ্চয়তা? এত বড় বিজ্ঞান আর ইংরাজি দিগগজ ঘরে ঘরে থাকলে তো আমরা ফাটাইয়া ফেলতাম। যে পাঠকের বিজ্ঞান নিয়া আগ্রহ আছে, বাংলা বা ইংরাজি তার জন্য অন্তরায় না।
আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। বিজ্ঞান পরিভাষা কোষ রচনার প্রস্তাবটি আগ্রহোদ্দীপক।
১। অন্তর্জালের যে পাতাটি থেকে অনুবাদ করেছেন, সেটি কারা পরিচালনা করেন?
২। পরিভাষার জন্য বাংলা একাডেমি প্রকাশিত জোতির্বিদ্যা বইগুলো এবং আব্দুল্লাহ-আল-মূতীর বইগুলো একটু দেখে নিতে পারেন। জোতির্বিদ্যার প্রচুর পরিভাষা অগ্রজেরা তৈরি করে রেখেছেন, কেবল ব্যবহারের অপেক্ষা।
৩। বিজ্ঞান লেখা দেখলেই ভাল লাগে। আরো লিখুন।
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
১। কারা পরিচালনা করেন সঠিক জানা নেই, কিন্তু এতটুকু জানি যে এরা মূলত একটি মিডিয়া গ্রুপ। সাধারণ সাংবাদিকতা থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, ভিডিও কনটেন্ট সবই বানান এরা।
২। এবং ৩। অসংখ্য ধন্যবাদ পরামর্শ ও উৎসাহের জন্য।
নতুন মন্তব্য করুন