দ্য অ্যালকেমিস্ট/ পর্ব-১ অণুকাহিনী ২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৭/০৮/২০২০ - ৬:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অণুকাহিনী ২

দিগন্ত জুড়ে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ছিল, সূর্যটা হঠাৎই উঠল। বাবার সাথে ওইদিনের আলাপের কথা ভাবল সান্টিয়াগো, খুশি খুশি লাগল। কত প্রাসাদ প্রতিম দালান দেখলো, কত মেয়ে দেখলো, কিন্তু যে মেয়েটার জন্য গত কয়দিন থেকে ও অধীর হয়ে আছে, তার সাথে কোনোকিছুরই তুলনা চলেনা।

সর্বসাকুল্যে আজ ওর কাছে একটা জ্যাকেট আছে, একটা বইয়ের বদলে আরেকটা বই নেয়ার জন্য বই আছে, আর আছে এক পাল ভেড়া। কিন্তু তাতে কি? সব থেকে বড় কথা হলো স্বপ্নের মত জীবন সান্টিয়াগোর। আন্দালুসিয়ার মাঠ-প্রান্তর চষে বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্তি এলে, ভেড়ার পাল বেচে দিয়ে সাগরও বেছে নেয়া যেত। যদি একদিন সাগরেও অতিষ্ট হয়ে উঠত, ততদিনে হয়তো অন্য কোনো শহর বা অন্য কোনো মেয়েদের সাথে দেখা হত, একটা না একটা সুখের অজুহাত বের করে নেয়াই যেত।

উদিয়মান সূর্যের লাল আভার দিকে তাকিয়ে সান্টিয়াগো ভাবল, ধর্মযাজকদের প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে তো আর আমি ঈশ্বরের খোঁজ পেতামনা।

চলার পথে যখনই পারে নতুন নতুন রাস্তা ধরে ও। অথচ ওই এলাকাগুলো দিয়ে বহুবার আসা যাওয়া করার পরও সেই ভাঙ্গা চার্চটাতে যাওয়াই হয়নি এর আগে। সত্যি, বিপুল এই পৃথিবী, কি বিশাল তার পরিসর। ভেড়াদের একবার রাস্তা ঠিক করে দিলেই হয় আর নতুন নতুন পথে মজার মজার সব জিনিস দেখতে দেখতে যায় ও। সমস্যা হলো; ভেড়াগুলো বুঝতেও পারেনা যে প্রতিদিন ওরা নিত্যনতুন পথ পার হচ্ছে। নতুন ঘাসজমি, ঋতুদের বদল কিছুই ওদের চোখে ধরা পড়েনা। শুধু দানাপানির চিন্তাতেই মশগুল ওরা।

কি জানি, আমরা সবাইই হয়তো অমন, আনমনে ভাবল সান্টিয়াগো। আমি নিজেওতো তাই- যবে থেকে ওই বণিকের মেয়ের সাথে দেখা হয়েছে তবে থেকে আমি ওর চিন্তায় বুঁদ হয়ে আছি, অন্য কারো কথাই ভাবছিনা।

সূর্যের মতিগতি বুঝে হিসেব করে দেখলো, দুপুরের আগেই তারিফায় পৌঁছাতে পারবে। পৌঁছেই বইটা বদলে একটা মোটা বই নেবে, ওয়াইনের বোতলটা ভরিয়ে, দাড়িগোঁফ কামিয়ে, চুলটা ছেঁটে নেবে। মেয়েটার সাথে দেখা হওয়ার আগে একটা তৈরির ব্যাপার আছেতো। এই এক বছরের মধ্যে আবার ভেড়ার বড় পাল ওয়ালা কোনো রাখাল ওর আগেই ওখানে চলে গেল কিনা, মেয়েটার সাথে অন্য কারো দেখা হলো কিনা, বিয়ের প্রস্তাব দিল কিনা, এসব আপাতত ও ভাবতেই চাচ্ছেনা।
সূর্যের অবস্থান দেখে চলার গতি বাড়িয়ে দিল। স্বপ্ন সত্যি হবে, এমন চিন্তা করলেই জীবনটা অর্থপূর্ণ মনে হয়, ভাবল ও। হঠাৎই মনে হলো, তারিফায় না একটা বুড়ি থাকে যে স্বপ্নের মানে বের করতে পারে!

***

বুড়ি সান্টিয়াগোকে বাড়ির পেছন দিককার একটা ঘরে নিয়ে গেলো। রঙ্গিন পুঁতির মালার পর্দা, তাই দিয়ে এই ঘরটা বৈঠকখানা থেকে আলাদা করা। ঘরে আসবাব বলতে একটা টেবিল, দেয়ালে ঝোলানো যিশুর পবিত্র হৃদয়ের একটা ছবি আর দুটো চেয়ার।

বুড়ি বসে ওকেও বসতে বলল। তারপর ওর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে শান্তভাবে প্রার্থনা শুরু করল। শুনে মনে হলো জিপসি প্রার্থনা। রাস্তায় জিপসিদের সাথে একসাথে চলতে হয়েছিল একবার চলার পথে, তখন এরকম প্রার্থনা শুনেছিল সান্টিয়াগো। জিপসিরাও ঘুরে বেড়ায় তবে ভেড়ার পাল ছাড়া। লোকে বলে জিপসিরা জীবনভর অন্যের সাথে ছলচাতুরী করে। এও বলে যে শয়তানের সাথে নাকি জিপসিদের কোনো একটা চুক্তি আছে, বাচ্চাদের চুরি করে গোপন আস্তানায় নিয়ে গিয়ে বন্দী দাস বানিয়ে রাখে। ছোটবেলায়, সবসময়ই মনে হতো একদিন জিপসিরা হয়তো ওকেও ধরে নিয়ে যাবে, কি ভয়টাই না পেত! এখন এই বৃদ্ধ মহিলাটা হাত ধরতেই ছোটবেলার সেই ভয়টা আবার ফিরে এলো।

কিন্তু বুড়ি যিশুর পবিত্র হৃদয়ের ছবি টাঙ্গিয়ে রেখেছে, মনে হয়না অতটা পাজি হবে, নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল ও। চাচ্ছিলনা এই ভীত ত্রস্ত অবস্থায় আবার হাত কাঁপা শুরু হোক আর সেটা বুড়ি টের পাক। হে আমাদের স্বর্গস্থ পিতা- প্রার্থনাটা মনে মনে পড়তে লাগল সান্টিয়াগো।

“আরে, দারুন ব্যাপারতো,” হাত থেকে মুহূর্তের জন্য চোখ না সরিয়ে বলল জিপসি বুড়ি। তারপরই আবার চুপ।
সান্টিয়াগো এবার সত্যিই চিন্তিত হয়ে উঠল। হাত যথারীতি কাঁপতে লাগল, আর জিপসি সেটা টেরও পেল। সাথে সাথে হাত দুটো সরিয়ে নিল সান্টিয়াগো।

“আমিতো এখানে আমার হাত দেখাতে আসিনি” বললো ও। আসার জন্য এবারে আপসোস হচ্ছে। একবার ভাবলো জিপসিকে ওর পাওনা মিটিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে যায়, দরকার নেই অতশত জানার । স্বপ্নটা নাহয় দেখছেই বারবার, এতো বেশী গুরুত্ব দেয়ার কি আছে!

“তুমি তোমার স্বপ্নের মানে জানতে এসেছ,” বলল জিপসি বুড়ি। স্বপ্ন হলো বিধাতার ভাষা। তিনি আমাদের ভাষায় কথা বললে, আমি সেটার মর্ম উদ্ধার করতে পারি। কিন্তু তিনি যদি আত্মার ভাষায় কথা বলেন, সেটার মর্ম কেবল তুমিই উদ্ধার করতে পার। তবে যাইহোক, এই আলাপ পরামর্শের জন্য এখন আমি তোমার কাছে ফী নেবো।

ওহ, আরেকটা ছলচাতুরী, ভাবে সান্টিয়াগো। বেশ, একটা সুযোগ নিয়ে দেখাই যাক। রাখালরা তো সবসময় নেকড়ে, খরা কতকিছুর ঝুঁকিই নেয়, আর এসবই রাখাল জীবনের রোমাঞ্চ।

“একই স্বপ্ন আমি দুইবার দেখেছি,” বলল ও। “দেখলাম, ভেড়াগুলোকে সহ আমি একটা মাঠে। তখন একটা বাচ্চা আসলো, এসে আমার ভেড়াদের সাথে খেলা শুরু করল। কেউ এমন করলে আমার তেমন একটা ভালো লাগেনা, কারন আমার ভেড়ারা অপরিচিত লোক দেখলে ভয় পায়। কিন্তু বাচ্চারা দেখি সবসময়ই ওদের সাথে খেলে, ভেড়াগুলো একটুও ভড়কায় না। কেন কে জানে, কিভাবে যে পশুপাখিরা মানুষের বয়স বোঝে।”

“বলে যাও,” জিপসি বুড়ি বলল। “আমার বাবা রান্না-বান্না বাকি আছে। আর তাছাড়া তোমার তেমন টাকাকড়ি আছে বলে মনেও হয়না, আমি তোমাকে বেশি একটা সময় দিতে পারবনা।“

“বাচ্চাটা আমার ভেড়াগুলোর সাথে অনেকক্ষণ খেলল”, মনক্ষুণ্ণ হয়ে বলল ও। “তারপর হঠাতই বাচ্চাটা করল কি, আমার দুইহাত ধরে আমাকে মিশরের পিরামিডের কাছে নিয়ে গেলো।” ক্ষণিকের জন্য থেমে ও বুড়ির মনোভাব একবার বোঝার চেষ্টা করলো, বোঝার চেষ্টা করল মিশরের পিরামিড সম্পর্কে বুড়ির কোনো ধারনা আছে কিনা। কিন্তু বুড়ি চুপ।

“তারপর, সেই মিশরের পিরামিডে,” ধীরে ধীরে শান্তভাবে শেষের তিনটে শব্দ বলল ও, যাতে বুড়ি বোঝে ও কি বলছে- “বাচ্চাটা বলল, ‘যদি এখানে আসো, তুমি গুপ্তধন পাবে।‘ তারপর যেইনা বাচ্চাটা আমাকে গুপ্তধনের জায়গাটা দেখাতে যাবে, ওমনি আমি ঘুম থেকে জেগে উঠি, দুই বারই একই ঘটনা।”

বুড়ি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর আবার সান্টিয়াগোর হাত দুটো নিয়ে ভালোভাবে পড়ল।

বলল, “আপাতত আমি তোমার কাছে কোনো ফী নিচ্ছিনা। কিন্তু যদি তুমি গুপ্তধনের খোঁজ পাও, তাহলে তার দশ ভাগের এক ভাগ আমার চাই।”
সান্টিয়াগো আনন্দে হেসে উঠল। সীমিত টাকা পয়সা ওর। গুপ্তধনের স্বপ্ন দেখার কারনে এখন জিপসি বুড়ির পারিশ্রমিকের টাকাটাও বেঁচে যাবে!
“আচ্ছা, স্বপ্নের মানেটাতো আগে বলেন” বলল ও।

“আগে কসম কাটো। কসম কেটে বলো যে এখন আমি যা বলব তার বদলে তুমি আমাকে গুপ্তধনের দশ ভাগের এক ভাগ দেবেই দেবে।”
অগত্যা কিরে কাটল ও। তারপরও বুড়ি ওকে যীশুর পবিত্র হৃদয়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে শপথ নেওয়ালো।

“এটা পৃথিবীর ভাষায় দেখা স্বপ্ন, বাছা,” বলল বুড়ি। এর মানে আমি বের করতে পারি, কিন্তু ব্যাপারটা খুবই কঠিন। আর এজন্যেই আমি মনে করি, তুমি যা পাবে তার একটা অংশ আমারও প্রাপ্য।

“শোন তবেঃ তোমাকে অবশ্যই মিশরে যেতে হবে, পিরামিডের ওখানে। আমি কখনো পিরামিড টিরামিডের কথা শুনিনি, তবে স্বপ্নটা যেহেতু একটা বাচ্চা দেখিয়েছে তারমানে ওসব অবশ্যই আছে। পিরামিডের ওখানে ধন-রত্ন খুঁজে পাবে তুমি, অনেক বড়লোক হবে।”

আশ্চর্য কথাবার্তা, বিরক্তিকর। ওকি এইকথা শোনার জন্যেই এখানে এসেছে! তার পরপরই মনে পড়লো, থাক বুড়ি যা বলে বলুক, ওকে তো আর কোনো টাকাপয়সা দিতে হচ্ছেনা।

“একথা শোনার জন্যতো আমার সময় নষ্ট করার কোনো দরকার ছিলনা”, তবু বলল সান্টিয়াগো।

“তোমাকে বললামনা তোমার স্বপ্নের মানে বের করাটা একটু কঠিন। আর তাছাড়া জীবনের সাধারন জিনিসগুলোই দেখা যায় সবচেয়ে অসাধারণ কোনো কিছু; শুধু বিজ্ঞলোকরাই সেটা টের পায়। আমি যেহেতু বিজ্ঞ কেউই না, তাই সেসব বোঝার জন্য আমাকে অন্য কোনো জ্ঞান রপ্ত করতে হয়েছে, এই যেমন~ হাত দেখা।”

“তা ভালোকথা, আমি মিশরে যাব কিভাবে?”

“দ্যাখো বাছা, আমি কেবল স্বপ্নের মানে বের করি। সেটাকে কিভাবে বাস্তব করা যায়, সে উপায় আমার জানা নেই। আর ওইজন্যই আমাকে আমার মেয়েদের উপর চলতে হয়।”

“আর আমি যদি মিশরে কখনোই না যাই?”
“তাহলে আমি আমার ফী পাবোনা। এ আর নতুন কি।”

তারপর বুড়ি সান্টিয়াগোকে চলে যেতে বলল, বলল যথেষ্ট সময় গেছে ওর পেছনে।

সান্টিয়াগো হতাশ। ঠিক করলো আর কখনোই স্বপ্নের উপর বিশ্বাস রাখবেনা।

ওহ, অনেক কাজ বাকি আছে। বাজারে গেলো, একটা কিছু খাওয়া দরকার, বইটা বদলে একটা মোটা বই নিল।
চত্বরের একদিকে একটা বেঞ্চি দেখে সেখানটায় বসলো, নতুন কেনা ওয়াইনটা একটু চেখে দেখবে।

গুমোট গরম একটা দিন, ওয়াইন খেয়ে একটু ঝরঝরে লাগছে।

শহরের দ্বারপ্রান্তে, একটা বন্ধুর আস্তাবলে ভেড়াগুলোকে রেখে এসেছে। অনেকের সাথেই সান্টিয়াগোর জানাশোনা এই শহরে। এইজন্যই ভ্রমণ এতো মজার~ সবসময় নতুন নতুন বন্ধু হয়, আর পুরো সময়টা ওদের পেছনে ব্যয়ও করতে হয়না। একই মানুষদের সান্নিধ্যে রোজ রোজ আসতে থাকলে এমন হয় যে তখন ওই মানুষগুলো জীবনের একটা অংশ হয়ে ওঠে, ধর্মযাজকদের স্কুলে থাকার সময় যেটা হয়েছিলো ওর। আর তখন হয় কি, ওই মানুষগুলো আস্তে আস্তে চাওয়া শুরু করে সে ওদের মনমত হোক। যদি কেউ আশপাশের আর দশজন যেভাবে চায় সেইমত না হয়, তো হয়ে গেল~ তখনই ওদের মেজাজ যায় চড়ে। সব্বাই মনে হয় খুব ভাল বোঝে আরেকজন কি করবে না করবে, আর নিজেদের বেলায় সেটা খাটে কই ~ যত্তসব।

সূর্যটা আর একটু ডুবো ডুবো হোক আগে তারপর ভেড়াদের নিয়ে আবার মাঠে নামবে, ভাবল সান্টিয়াগো। আজ থেকে আর মাত্র তিনদিন, তারপরেই বনিকের মেয়ের সাথে দেখা হবে।

বদলে কেনা বইটা পড়তে শুরু করলো। প্রথম পাতাতে একটা অন্ত্যেষ্টীক্রিয়ার বর্ননা। আর ঘটনার পাত্র-পাত্রীদের নামগুলো এমন কাঠখোট্টা যে উচ্চারণ করাই মুশকিল। ভাবলো, নিজে যদি কখনো বই লেখে, তাহলে একই সময়ে একজনের প্রসঙ্গে বর্ণনা করবে, যাতে পাঠকের এত এত নাম একসাথে মনে রাখতে না হয়।

অবশেষে কাহিনীর মধ্যে যখন একটু মন দিতে পারলো, তখন অবশ্য বইটা ভালো লাগল; কবর দেবার সময় সেদিন তুষার পড়ছিল, আর তুষারের ঠান্ডা শিরশিরে অনুভুতিটা ওই মুহূর্তে যেন ওও টের পেল।

পড়তে পড়তে, পড়ার এক পর্যায়ে দেখে কি, ওমা, কোত্থেকে এক বুড়ো এসে হাজির হয়েছে, বসেছে ওর পাশে, আলাপ জমাবার চেষ্টা করছে বুড়ো।

“কি করছে বলোতো ওরা?” চত্বরের লোকজনের দিকে আঙ্গুল তুলে বুড়ো বলল।

“কাজ করছে,” সান্টিয়াগোর বিরস উত্তর, বোঝালো ও বইয়ে মনোযোগ দিতে চাচ্ছে।

সত্যি বলতে কি, তখন ও ভাবছিল, এবারে যেয়ে বনিকের মেয়ের সামনে ভেড়াদের উল ও নিজেই ছাঁটবে, যাতে সে দেখে ও কত কঠিন সব কাজ করতে পারে। এই দৃশ্য যে কতবার ও মনে মনে ভেবেছে। আর প্রত্যেকবারই ও মেয়েটাকে বুঝিয়ে বলে যে কিভাবে ভেড়াদের উল পেছন থেকে সামনের দিকে ছেঁটে যেতে হয়, প্রত্যেকবারই মেয়েটা মুগ্ধ হয়ে শোনে। সেই প্রসঙ্গে ওর পড়া বইগুলো থেকে ভালো ভালো কিছু কাহিনী মনে করারও চেষ্টা করে, ভাবে, বলার সময় এমনভাবে বলবে যাতে মনে হয় এসব তার নিজেরই অভিজ্ঞতা থেকে বলছে। মেয়েটা বুঝতেও পারবেনা যে ওসব বইয়ের কাহিনী, কারন ওতো লেখাপড়া জানেনা।

আর এর মধ্যে, সেই বুড়ো এসে আলাপ জুড়ে দিয়েছে, থামে কই। বলল ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর, সান্টিয়াগোর বোতল থেকে এক চুমুক ওয়াইন খেতে পারবে কিনা। সান্টিয়াগো বোতল এগিয়ে দিল, আশায় আছে ওয়াইনটা খেয়ে বুড়ো যদি এবার ওকে একটু একা থাকতে দেয়। কিন্তু কই, বুড়ো যায় কই, এ দেখি কথাই বলতে চাচ্ছে।

ও কি বই পড়ছে জিজ্ঞেস করল। সান্টিয়াগো একবার ভাবলো অভদ্র ব্যবহার করে অন্য একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে, কিন্তু বাবা শিখিয়েছে বয়স্কদেরকে শ্রদ্ধা করতে হয়। অগত্যা, বুড়োর দিকে বইটা বাড়িয়ে দিল ~ দুটো কারনঃ প্রথমত, ও নিজেই জানেনা, বইয়ের নামের উচ্চারনটা কি হবে; আর দু-নম্বর কারনটা হলো, বুড়ো হয়তো পড়তেই জানেনা, বইটা দেখালে লজ্জা পাবে, তখন আপনা থেকেই অন্যখানে গিয়ে বসবে।

“হুম...” বুড়ো বইটার আগাপাশতলা এমন ভাবে দেখতে লাগল যেন কি একটা অদ্ভুত জিনিস দেখছে। বলল, “গুরুত্বপূর্ণ একটা বই, কিন্তু খুবই বিরক্তিকর।”

সান্টিয়াগো হতভম্ব। বুড়ো লেখাপড়া জানে, বইটা পড়েও ফেলেছে! এর কথা অনুযায়ী বইটি যদি সত্যিই বিরক্তিকর হয়, তাহলে এখনও সময় আছে এটা বদলে নেয়ার।

“এই বইটা দুনিয়ার আর দশটা বইয়ের মতো সেই একই কথাই বলে,” বুড়ো বলতে লাগল। “মানুষের অপারগতার কথা বলে, বলে মানুষ নিজের জীবনের গল্পটা বেছে নিতে অপারগ। তারপর বইটায় শেষে গিয়ে বলা হয়, প্রতিটা মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা মিথ্যে কথাটা বিশ্বাস করে।”

“পৃথিবীর সব থেকে সেরা মিথ্যে কথা, সেটা আবার কি?” সান্টিয়াগোর জিজ্ঞাসা, অসম্ভব বিস্মিত সে।

“সেটা হলোঃ জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে পরিস্থিতি আমাদের হাতে থাকেনা, আর তখন অদৃষ্টই আমাদের এ জীবন নিয়ন্ত্রন করে। এটাই পৃথিবীর সেরা মিথ্যে।”

“কই, আমারতো তেমনটা হয়নি কখনো” বলে সান্টিয়াগো। সবাই চেয়েছিল আমি যাজক হই, কিন্তু আমার নিজের সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নিয়েছিলাম যে আমি রাখাল হবো।

“সেটাই বরং ভালো,” বলল বৃদ্ধ। “কারন ঘোরাঘুরি তোমার খুবই পছন্দ।”

“কি ভাবছি তাও দেখি এ জানে” নিজ মনে বলল সান্টিয়াগো। ইতোমধ্যে বুড়ো বইটার এপাতা-ওপাতা উল্টে দেখতে শুরু করেছেন, ফেরত দেয়ার কোনো নামগন্ধ নেই। সান্টিয়াগো খেয়াল করলো, কেমন অদ্ভুত একটা বেশভূষা লোকটার। দেখে মনে হচ্ছে আরব, এ এলাকায় সেটা অস্বাভাবিক কিছুনা। তারিফা থেকে আফ্রিকা মাত্র কয়েক ঘন্টা দূরেঃ নৌকায় সরু প্রণালীটা খালি আড়াআড়ি পার হলেই হয়। এই শহরে ওখানকার আরবরা প্রায়ই আসে, বাজার সদাই করে আর দিনের মধ্যে বেশ কয়বার সুললিত সুরে অজানা একটা প্রার্থনা করে।

“তো, আপনি কোত্থেকে এসেছেন?” সান্টিয়াগো জিজ্ঞেস করল।

“অনেক জায়গা থেকে।”

“একজনতো অনেক জায়গা থেকে আসতে পারেনা,” বলল সান্টিয়াগো। এই যেমন ধরেন, আমি রাখাল, বহু এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি, কিন্তু আমি এসেছিতো একটা জায়গা থেকেই- খুব প্রাচীন একটা দুর্গের পাশে সেই শহর, ওখানেই আমি জন্মেছি।”

“বেশ তবে, তাহলে বলা যায় আমি সালেম এ জন্মেছি।”

সালেম কোথায় সান্টিয়াগো জানেনা। কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলনা, বুড়ো ভাব্বে ও দুনিয়াদারির কোনো খবর রাখেনা। তাকিয়ে কিছুক্ষন চত্বরের মানুষজন দেখল ও, লোকেরা আসছে যাচ্ছে, সবাই বেশ ব্যতিব্যস্ত।

“তো, সালেমে কেমন লাগে আপনার?” জিজ্ঞেস করল সান্টিয়াগো, সালেম সম্পর্কে একটা ধারনা পাবার চেষ্টা করছে।

“সবসময় যেমন লাগে তেমনই লাগে।”

কোনো আভাস পাওয়া গেলোনা সালেম সম্পর্কে। কিন্তু এটা বুঝতে পারছে যে সালেম জায়গাটা আন্দালুসিয়াতে না। আন্দালুসিয়াতে হলে ও অন্তত সেটার কথা শুনত।

“কি করেন আপনি সালেমে?” সান্টিয়াগো জিজ্ঞেস করতেই থাকল।

“সালেমে কি করি আমি?” হাসল বুড়ো, “উমম…, আমি সালেমের রাজা!”

(চলবে)

পাওলো কোয়েলো

অনুবাদ- জে এফ নুশান


অণুকাহিনী ১ এখানে


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

চলুক, চলুক হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ। হাসি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।